আজাদুর রহমান চন্দন
ডান-বামনির্বিশেষে বিভিন্ন দলের নেতারা বেশ কয়েক বছর ধরেই শেখ হাসিনার সরকারকে কর্তৃত্ববাদী সরকার আখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। এত বেশিসংখ্যক বার এটি উচ্চারিত হয়েছে যে কে কবে প্রথম এটি বলেছিলেন, সেটি আপাতত মনে পড়ছে না। তবে শুরু থেকেই দু-একজন বামপন্থী রাজনীতিক ছাড়া অন্য নেতারা যখন সরকারকে এ গালিটি দেন, তখন আমার হাসি পায়। এর কারণ একটাই, ওই নেতারা যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার কোনোটাই গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয় না।
সবচেয়ে বড় কথা, সরকারবিরোধী সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালেও জনগণের সামনে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চার এমন কোনো নজির রাখেনি, যাতে করে তারা অন্যকে কর্তৃত্ববাদী বলে সমালোচনা করার নৈতিক অধিকার রাখে। যদিও এর অজুহাতে অন্য পক্ষের অগণতান্ত্রিক আচরণ ন্যায্যতা পায় না।
আভিধানিকভাবে ‘অথরিটারিয়ানিজম’ বা কর্তৃত্ববাদ হলো এমন একধরনের রাজনৈতিক ও সরকারব্যবস্থা, যেখানে কর্তৃপক্ষের প্রতি অন্ধ আনুগত্য থাকে এবং ব্যক্তির চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতাকে দমিয়ে রাখা হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন বলতে এমন সরকারব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো মেকানিজম থাকে না এবং নাগরিক বা রাজনৈতিক অধিকার বলতেও কিছু নেই। সব ক্ষমতাই থাকে এক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র একটি এলিট গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত। এ ক্ষেত্রে সবার আগে সামরিক সরকারের কথাই মাথায় আসে।
তবে নির্বাচিত সরকারের গায়েও অনেক সময় এ তকমাটি লাগতে দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনকালটিকেও অনেকে কর্তৃত্ববাদী শাসন বলতে ছাড়েননি। ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় আসেন, সে সময় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টেফান ওয়াল্ট কর্তৃত্ববাদের ১০টি লক্ষণের কথা বলেছিলেন। লক্ষণগুলো মোটামুটি এ রকম—ভীতি অথবা উৎকোচের মাধ্যমে তথ্যব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ; একটি তাঁবেদার তথ্যব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা; প্রশাসন ও নিরাপত্তাব্যবস্থার দলীয়করণ; বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নজরদারির জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানো; অনুগত ব্যবসায়ীদের পুরস্কার, অবাধ্য ব্যবসায়ীদের শাস্তি দান; বিচারব্যবস্থা নিজ মুঠোয় নিয়ে আসা; শুধু এক পক্ষের ওপর আইনের প্রয়োগ; নিজ স্বার্থে ভোটব্যবস্থায় অনিয়ম; ভীতি ছড়ানো এবং বিরোধী রাজনীতিকদের ব্যাপারে অপপ্রচার। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাশ্চাত্যে ওয়াল্টের এই ‘চেকলিস্ট’ ব্যবহার করে কোন দেশ কতটা কর্তৃত্ববাদী, তা মেপে দেখার একটি প্রবণতা লক্ষণীয়।
কাজেই বর্তমান সরকারকে কর্তৃত্ববাদী বলা হলেও খুব একটা অতিরঞ্জন হয় না। তবে এ দেশের বড় দলগুলো তো বটেই, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই যেখানে একক নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে পরিচালিত, তাতে তারা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলেও তাদের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক আচরণ আশা করাটা বাতুলতা মাত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. রওনক জাহান ২০১৫ সালে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর একটি অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করেন। এতে প্রধান দুটি দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার প্রকট অভাব থাকার কথা তুলে ধরা হয়।
দেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের বিষয়েও তিনি বেশ কিছু সুপারিশ করেন। গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের মধ্যে আছে—রাজনৈতিক দলগুলোর অগণতান্ত্রিক রীতিনীতি বর্জন করতে হবে; দলগুলোকে গঠনতন্ত্র ও নিবন্ধনের আইনগত শর্ত অবশ্যই প্রতিপালন করতে হবে ইত্যাদি। এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দলগুলোকে গঠনতন্ত্র মেনে চলার পরামর্শ দিলেও বাস্তবে গঠনতন্ত্রেই গলদ রয়ে গেছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ‘দ্য স্টেট অব গভর্ন্যান্স বাংলাদেশ ২০১৩: ডেমোক্রেসি, পার্টি, পলিটিকস’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, দেশের বড় দুটি দলে গণতন্ত্রচর্চার ‘একান্ত অভাব’। আওয়ামী লীগে গঠনতন্ত্র রক্ষার জন্য সামান্য আলোচনা হলেও বিএনপির গঠনতন্ত্রেই এসব বিষয় তেমন সুবিন্যস্ত নয়।
অন্যান্য দল নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। তবে বাস্তবে দু-একটি ছোট দলে কিছুটা গণতান্ত্রিক মনোভাব ও চর্চা থাকলেও তা এখনো জনমনে রেখাপাত করার মতো অবস্থায় নেই। দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষ দিক হলো, ৪০ বছর ধরে বড় দুই দলের প্রধান একই ব্যক্তি। সব দলেই উত্তরাধিকারের নেতৃত্ব প্রাধান্য পাচ্ছে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত একই অবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক দলের উপযোগী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারেনি।
দেশে রাজনৈতিক দলে কর্তৃত্ববাদের বড় নজির দেখা গেল অতিসম্প্রতি। গত মাসেই বিএনপির ঢাকাসহ চারটি মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়ার পরপর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে বড় রদবদল আনা হয়েছে দলের কোনো পর্যায়ে কোনো আলোচনা ছাড়াই। দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ যদিও অনেক আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু কাউন্সিল করার কোনো উদ্যোগ তো নেই-ই, এই কমিটির ৩৯টি পদে রদবদলের কথা জানানো হয়েছে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।
দলের নেতা-কর্মীরা যখন ঈদুল আজহা উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে ৩৯ পদে কাউকে কাউকে নতুন যুক্ত করা হয়েছে, আবার কারও কারও পদ পরিবর্তন করা হয়েছে।
এই রদবদলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে ১০ জনকে যুক্ত করা হয়েছে। তাঁরা এত দিন এ কমিটিতেই বিভিন্ন পদে ছিলেন। তিনজনকে যুগ্ম মহাসচিব করা হয়েছে। তাঁরা সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। একজন সম্পাদককে করা হয়েছে ভাইস চেয়ারম্যান। এ ছাড়া কয়েকজনের দায়িত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিএনপিসহ দলের যুব ও ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল এবং যুবদলেও রদবদল করা হয়। সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একক ক্ষমতাবলে এই রদবদল করেন। মধ্যরাতের এই রদবদলে দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা নিজেদের অসন্তোষ গোপনও রাখেননি। যদিও তাঁদের চাওয়াটাও মূলত আগে থেকে একটু অবহিত হওয়ার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে সভাপতি বা চেয়ারপারসন বা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের বিধান আছে। কিন্তু বাস্তবে বংশানুক্রমিকভাবে মনোনীত নেতারাই দলগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্য পদেও নির্বাচন হয় না।
শীর্ষ নেতারাই তাঁদের ইচ্ছামতো এসব পদে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা অবারিত। চেয়ারম্যান যে কাউকে পদ দেওয়া, বহিষ্কার এমনকি নিজের পদও আরেকজনকে দিতে পারেন। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চেয়ারপারসনের ক্ষমতাও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অনেকটাই একচ্ছত্র।
দলের কমিটিতে যেকোনো পরিবর্তন আনার ক্ষমতা দেওয়া আছে তাঁকে। চেয়ারপারসন চাইলেই যে কাউকে যেকোনো সময় দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারেন কিংবা কাউকে যুক্তও করতে পারেন। চেয়ারপারসন সেই ক্ষমতা লিখিতভাবে দিয়েছেন নিজের ছেলেকে, যার প্রয়োগ করা হয়েছে সম্প্রতি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বলা আছে, ‘সভাপতি, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যবৃন্দ, সাধারণ সম্পাদক, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও কোষাধ্যক্ষ নিজ নিজ পদে ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিল কর্তৃক কাউন্সিলরদের মধ্য হইতে নির্বাচিত হইবেন।’ কিন্তু বাস্তবে কাউন্সিলে হাত তুলে সভাপতি নির্বাচন করা ছাড়া আর কোনো পদে নির্বাচনেরই নজির নেই। কাউন্সিলররা হাত তুলেই সভাপতির ওপর সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করে আসছেন। সেই ক্ষমতাবলে সভাপতিই দলের অন্যান্য পদে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে নেতৃত্ব নির্বাচনের যে পদ্ধতির উল্লেখ আছে, সেটিও দেশের শাসন পদ্ধতির সঙ্গে মানানসই নয়। সংবিধান অনুযায়ী দেশে সরকার গঠিত ও পরিচালিত হয় সংসদীয় পদ্ধতিতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ চলে অনেকটা প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেমে।
দেশে গণতন্ত্রের যে-সংকট চলছে, তার প্রধান কারণই হলো কোনো রাজনৈতিক দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চা না থাকা। দলগুলোর তৃণমূল পর্যায়েও একক ব্যক্তি বা একক পরিবারের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে। ফলে কোনো পর্যায়েই গণতন্ত্রচর্চা হয় না। রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্রের অন্যতম একটি উপাদান হলো জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের পদ্ধতি। প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই প্রাথমিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করা হয়। বাংলাদেশে এ ব্যবস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
ডান-বামনির্বিশেষে বিভিন্ন দলের নেতারা বেশ কয়েক বছর ধরেই শেখ হাসিনার সরকারকে কর্তৃত্ববাদী সরকার আখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। এত বেশিসংখ্যক বার এটি উচ্চারিত হয়েছে যে কে কবে প্রথম এটি বলেছিলেন, সেটি আপাতত মনে পড়ছে না। তবে শুরু থেকেই দু-একজন বামপন্থী রাজনীতিক ছাড়া অন্য নেতারা যখন সরকারকে এ গালিটি দেন, তখন আমার হাসি পায়। এর কারণ একটাই, ওই নেতারা যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার কোনোটাই গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয় না।
সবচেয়ে বড় কথা, সরকারবিরোধী সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালেও জনগণের সামনে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চার এমন কোনো নজির রাখেনি, যাতে করে তারা অন্যকে কর্তৃত্ববাদী বলে সমালোচনা করার নৈতিক অধিকার রাখে। যদিও এর অজুহাতে অন্য পক্ষের অগণতান্ত্রিক আচরণ ন্যায্যতা পায় না।
আভিধানিকভাবে ‘অথরিটারিয়ানিজম’ বা কর্তৃত্ববাদ হলো এমন একধরনের রাজনৈতিক ও সরকারব্যবস্থা, যেখানে কর্তৃপক্ষের প্রতি অন্ধ আনুগত্য থাকে এবং ব্যক্তির চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতাকে দমিয়ে রাখা হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন বলতে এমন সরকারব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো মেকানিজম থাকে না এবং নাগরিক বা রাজনৈতিক অধিকার বলতেও কিছু নেই। সব ক্ষমতাই থাকে এক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র একটি এলিট গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত। এ ক্ষেত্রে সবার আগে সামরিক সরকারের কথাই মাথায় আসে।
তবে নির্বাচিত সরকারের গায়েও অনেক সময় এ তকমাটি লাগতে দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনকালটিকেও অনেকে কর্তৃত্ববাদী শাসন বলতে ছাড়েননি। ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় আসেন, সে সময় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টেফান ওয়াল্ট কর্তৃত্ববাদের ১০টি লক্ষণের কথা বলেছিলেন। লক্ষণগুলো মোটামুটি এ রকম—ভীতি অথবা উৎকোচের মাধ্যমে তথ্যব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ; একটি তাঁবেদার তথ্যব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা; প্রশাসন ও নিরাপত্তাব্যবস্থার দলীয়করণ; বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নজরদারির জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগানো; অনুগত ব্যবসায়ীদের পুরস্কার, অবাধ্য ব্যবসায়ীদের শাস্তি দান; বিচারব্যবস্থা নিজ মুঠোয় নিয়ে আসা; শুধু এক পক্ষের ওপর আইনের প্রয়োগ; নিজ স্বার্থে ভোটব্যবস্থায় অনিয়ম; ভীতি ছড়ানো এবং বিরোধী রাজনীতিকদের ব্যাপারে অপপ্রচার। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পাশ্চাত্যে ওয়াল্টের এই ‘চেকলিস্ট’ ব্যবহার করে কোন দেশ কতটা কর্তৃত্ববাদী, তা মেপে দেখার একটি প্রবণতা লক্ষণীয়।
কাজেই বর্তমান সরকারকে কর্তৃত্ববাদী বলা হলেও খুব একটা অতিরঞ্জন হয় না। তবে এ দেশের বড় দলগুলো তো বটেই, বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই যেখানে একক নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে পরিচালিত, তাতে তারা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলেও তাদের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক আচরণ আশা করাটা বাতুলতা মাত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. রওনক জাহান ২০১৫ সালে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর একটি অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করেন। এতে প্রধান দুটি দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার প্রকট অভাব থাকার কথা তুলে ধরা হয়।
দেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের বিষয়েও তিনি বেশ কিছু সুপারিশ করেন। গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের মধ্যে আছে—রাজনৈতিক দলগুলোর অগণতান্ত্রিক রীতিনীতি বর্জন করতে হবে; দলগুলোকে গঠনতন্ত্র ও নিবন্ধনের আইনগত শর্ত অবশ্যই প্রতিপালন করতে হবে ইত্যাদি। এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দলগুলোকে গঠনতন্ত্র মেনে চলার পরামর্শ দিলেও বাস্তবে গঠনতন্ত্রেই গলদ রয়ে গেছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ‘দ্য স্টেট অব গভর্ন্যান্স বাংলাদেশ ২০১৩: ডেমোক্রেসি, পার্টি, পলিটিকস’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, দেশের বড় দুটি দলে গণতন্ত্রচর্চার ‘একান্ত অভাব’। আওয়ামী লীগে গঠনতন্ত্র রক্ষার জন্য সামান্য আলোচনা হলেও বিএনপির গঠনতন্ত্রেই এসব বিষয় তেমন সুবিন্যস্ত নয়।
অন্যান্য দল নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। তবে বাস্তবে দু-একটি ছোট দলে কিছুটা গণতান্ত্রিক মনোভাব ও চর্চা থাকলেও তা এখনো জনমনে রেখাপাত করার মতো অবস্থায় নেই। দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশেষ দিক হলো, ৪০ বছর ধরে বড় দুই দলের প্রধান একই ব্যক্তি। সব দলেই উত্তরাধিকারের নেতৃত্ব প্রাধান্য পাচ্ছে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত একই অবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক দলের উপযোগী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারেনি।
দেশে রাজনৈতিক দলে কর্তৃত্ববাদের বড় নজির দেখা গেল অতিসম্প্রতি। গত মাসেই বিএনপির ঢাকাসহ চারটি মহানগর কমিটি ভেঙে দেওয়ার পরপর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে বড় রদবদল আনা হয়েছে দলের কোনো পর্যায়ে কোনো আলোচনা ছাড়াই। দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ যদিও অনেক আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু কাউন্সিল করার কোনো উদ্যোগ তো নেই-ই, এই কমিটির ৩৯টি পদে রদবদলের কথা জানানো হয়েছে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।
দলের নেতা-কর্মীরা যখন ঈদুল আজহা উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে ৩৯ পদে কাউকে কাউকে নতুন যুক্ত করা হয়েছে, আবার কারও কারও পদ পরিবর্তন করা হয়েছে।
এই রদবদলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে ১০ জনকে যুক্ত করা হয়েছে। তাঁরা এত দিন এ কমিটিতেই বিভিন্ন পদে ছিলেন। তিনজনকে যুগ্ম মহাসচিব করা হয়েছে। তাঁরা সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। একজন সম্পাদককে করা হয়েছে ভাইস চেয়ারম্যান। এ ছাড়া কয়েকজনের দায়িত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিএনপিসহ দলের যুব ও ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল এবং যুবদলেও রদবদল করা হয়। সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একক ক্ষমতাবলে এই রদবদল করেন। মধ্যরাতের এই রদবদলে দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা নিজেদের অসন্তোষ গোপনও রাখেননি। যদিও তাঁদের চাওয়াটাও মূলত আগে থেকে একটু অবহিত হওয়ার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে সভাপতি বা চেয়ারপারসন বা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের বিধান আছে। কিন্তু বাস্তবে বংশানুক্রমিকভাবে মনোনীত নেতারাই দলগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যান্য পদেও নির্বাচন হয় না।
শীর্ষ নেতারাই তাঁদের ইচ্ছামতো এসব পদে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যানের ক্ষমতা অবারিত। চেয়ারম্যান যে কাউকে পদ দেওয়া, বহিষ্কার এমনকি নিজের পদও আরেকজনকে দিতে পারেন। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি চেয়ারপারসনের ক্ষমতাও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অনেকটাই একচ্ছত্র।
দলের কমিটিতে যেকোনো পরিবর্তন আনার ক্ষমতা দেওয়া আছে তাঁকে। চেয়ারপারসন চাইলেই যে কাউকে যেকোনো সময় দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারেন কিংবা কাউকে যুক্তও করতে পারেন। চেয়ারপারসন সেই ক্ষমতা লিখিতভাবে দিয়েছেন নিজের ছেলেকে, যার প্রয়োগ করা হয়েছে সম্প্রতি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বলা আছে, ‘সভাপতি, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যবৃন্দ, সাধারণ সম্পাদক, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও কোষাধ্যক্ষ নিজ নিজ পদে ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিল কর্তৃক কাউন্সিলরদের মধ্য হইতে নির্বাচিত হইবেন।’ কিন্তু বাস্তবে কাউন্সিলে হাত তুলে সভাপতি নির্বাচন করা ছাড়া আর কোনো পদে নির্বাচনেরই নজির নেই। কাউন্সিলররা হাত তুলেই সভাপতির ওপর সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করে আসছেন। সেই ক্ষমতাবলে সভাপতিই দলের অন্যান্য পদে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে নেতৃত্ব নির্বাচনের যে পদ্ধতির উল্লেখ আছে, সেটিও দেশের শাসন পদ্ধতির সঙ্গে মানানসই নয়। সংবিধান অনুযায়ী দেশে সরকার গঠিত ও পরিচালিত হয় সংসদীয় পদ্ধতিতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ চলে অনেকটা প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেমে।
দেশে গণতন্ত্রের যে-সংকট চলছে, তার প্রধান কারণই হলো কোনো রাজনৈতিক দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চা না থাকা। দলগুলোর তৃণমূল পর্যায়েও একক ব্যক্তি বা একক পরিবারের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে। ফলে কোনো পর্যায়েই গণতন্ত্রচর্চা হয় না। রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্রের অন্যতম একটি উপাদান হলো জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের পদ্ধতি। প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই প্রাথমিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করা হয়। বাংলাদেশে এ ব্যবস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে