এ কে এম শামসুদ্দিন
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থান রূপ নেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের ৯ দফা যখন ১ দফায় চলে আসে, তখনই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রবল পরাক্রমশালী শাসক শেখ হাসিনার বিদায়ঘণ্টা বেজে ওঠে। ৫ আগস্ট সকালে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ঢাকায় জড়ো হতে থাকলে, শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিক দেশ ছেড়ে চলে যান। এত দিন যাদের ওপর ভর করে তিনি ক্ষমতায় টিকে ছিলেন, সেই পুলিশ ও নিজ দলের আর্মড ক্যাডারের সদস্যরাও জনরোষ থেকে তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি।
শেষ ভরসা, সশস্ত্র বাহিনীও তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ওই মুহূর্তে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া তাঁর অবশ্য আর কোনো গত্যন্তরও ছিল না। নিজ দেশের তিন শতাধিক নাগরিকের খুনের রক্তে যাঁর হাত রাঙা, তেমন একজন পতিত শাসককে আশ্রয় দেওয়া, প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের জন্যও অস্বস্তিকর ছিল। তবু ভারত তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়।
জানা গেছে, খুব অল্প সময়ের নোটিশে ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিতে সম্মত হয়েছে। ৬ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এ বিষয়ে সবাইকে অবগত করেন। তিনি জানান, যত দিন তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রে শেখ হাসিনার আশ্রয়ের ব্যবস্থা না হবে, তত দিন তিনি ভারতেই থাকবেন।
শেখ হাসিনা কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্রে আশ্রয়ের চেষ্টা করলেও কোনো দেশই তাঁকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। তবে শেখ হাসিনার ভারত ছেড়ে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অনেকেরই প্রশ্ন, শেখ হাসিনা সত্যিই কি ভারত ছেড়ে অন্যত্র যেতে ইচ্ছুক? নাকি তিনি ভারতেই থেকে যেতে চান? ভারতে থাকতে পারলে শেখ হাসিনার সুবিধাই হবে। ভারতে বসে বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতি পরিচালনা করতে পারবেন। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও তাই মনে করেন। ১৪ আগস্ট ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জয় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা দেখার জন্য তিনি (শেখ হাসিনা) অপেক্ষা করছেন।
সম্ভবত মা আপাতত ভারতেই থাকবেন।’ শেখ হাসিনা বর্তমানে দিল্লির সন্নিকটে ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবেষ্টনীতে অবস্থান করছেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, নিরাপত্তাজনিত কারণে শেখ হাসিনার সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার কন্যা পুতুলও নাকি তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাননি। সত্যিই কি তাই?
হাসিনাকে যদি কড়া নিরাপত্তাবেষ্টনীতেই রাখা হতো, তাহলে ভারতীয় বিমানঘাঁটির মতো একটি সংবেদনশীল জায়গায় বসে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনা তাঁর নেতা-কর্মীদের, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হতে পারে—এমন রাজনৈতিক নির্দেশনা দেন কী করে? এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার।
১৪ আগস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত ভূখণ্ডে বসে শেখ হাসিনা যেসব বিবৃতি দিচ্ছেন, তা দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অন্তরায়। এটা দুই দেশের সুসম্পর্কের জন্য সহায়কও নয়।
ভারতের বাংলাদেশনীতি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ কখনোই সন্তুষ্ট ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা গেছে, ভারত বরাবরই বাংলাদেশের জনগণের মনোভাবকে অবজ্ঞা করে এককভাবে একটি দলের প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখিয়ে এসেছে। তারা জনগণের চেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এ নিয়ে ভারত বিষয়ে এ দেশের জনগণের ভেতর মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ কোনোকালেই আধিপত্যবাদকে মেনে নেয়নি। আর মেনে নিতে পারেনি বলেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। এ কথা এ দেশের মানুষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকারও করে। কিন্তু ভারত একেবারে নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশকে যে সহায়তা করেছে, সে কথা সঠিক নয়।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই ‘পাকিস্তান ভেঙে দুই ভাগ করা’ ভারত রাজনীতির অন্যতম অ্যাজেন্ডা ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ভারতকে সেই সুযোগ করে দেয়। ভারতও সুযোগ কাজে লাগায়। অতঃপর তারা যথারীতি বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয় এবং মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেখা গেছে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বড় ভাইসুলভ আচরণ শুরু করে দিল।
অথচ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের জনগণ ভারতের কাছ থেকে সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ আশা করেছিল। প্রতিবেশী ছোট রাষ্ট্রের প্রতি বড় রাষ্ট্রের যেমন অহংবোধ ও অবজ্ঞা থাকে, বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যাপারে ভারতেরও সে ধরনের অবজ্ঞা ও অজ্ঞতা পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশের মানুষ তা কোনো দিনও মেনে নিতে পারেনি। সে কারণে দিন দিন ভারতের প্রতি এ দেশের জনগণের হতাশা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের দুর্বলতা প্রকাশ্যে চলে আসে। ভারতে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, আওয়ামী লীগের প্রতিই তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
এ কারণেই জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে কারচুপির নির্বাচন ও ক্ষমতা একচেটিয়া কুক্ষিগতকরণে আওয়ামী লীগের হয়ে ভারতকে বারবার আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক সহযোগিতা দিতে দেখা গেছে; যা বাংলাদেশিদের আরও বেশি ভারতবিদ্বেষী করে তুলেছে।
এবারের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম দিকে ভারত সরকার কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও তাদের অনেক সাংবাদিক, কিছু রাজনৈতিক দল, টেলিভিশন চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্রিকা, সচেতন নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের ছাত্র-আন্দোলন ও হতাহতের প্রতি সহানুভূতি ছিল যথেষ্ট। কিন্তু আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা গদিচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর সে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার যে অবস্থান নিয়েছে, তা বাংলাদেশের মানুষকে হতাশ করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পেছনে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’র তত্ত্ব হাজির করে ভারত এ আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। ভারতীয় গণমাধ্যম এ আন্দোলনে জামায়াত ও পাকিস্তানের হাত আছে দাবি করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের রক্তক্ষয়ী এই আন্দোলনে কালিমা লেপন করতে চেয়েছে। শেখ হাসিনার এমন অপ্রত্যাশিত পতন ভারত যে মেনে নিতে পারছে না, তা তাদের আচরণেই বোঝা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে তাদের কাছে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের গুরুত্ব যে বেশি, আবারও তারা প্রমাণ করেছে। ৬ আগস্ট ভারতের পার্লামেন্টে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের দেওয়া বিবৃতি লক্ষ করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। জয়শঙ্কর তাঁর বিবৃতিতে সেদিন, বাংলাদেশের যানবাহন, রেল, সরকারি ভবন ও অবকাঠামো, পুলিশ, থানা এবং পোশাক কারখানায় আক্রমণের কথা বলেছেন।
আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও তাঁদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের কথা বলেছেন। বাংলাদেশে আটকে পড়া ১৯ হাজার ভারতীয় নাগরিকের কথা বলেছেন। সারা দেশে বেশ কিছু জায়গায় সংখ্যালঘু, তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং মন্দিরে হামলার কথা উল্লেখ করে বিশেষ উদ্বেগের কথা জানালেও আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করেছি, আওয়ামী লীগের দলীয় সশস্ত্র ক্যাডার ও পুলিশের হাতে তিন শতাধিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, সে কথা তিনি একবারও উচ্চারণ করেননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেন, ভারতের একচেটিয়া স্বার্থরক্ষা ও আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ভারত বরাবরই জনগণকে বাদ দিয়ে বন্ধুরাষ্ট্রের পছন্দের রাজনৈতিক নেতা ও দলের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে তোলে। এটা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। নেপাল, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানেও হয়েছে। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বন্ধুরাষ্ট্র হারাচ্ছে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। সুসম্পর্ক গড়তে হলে শুধু পছন্দের দল ও ব্যক্তি নয়, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলেই দুই দেশের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
তাতে সম্পর্ক পাকাপোক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। কারণ যেকোনো রাষ্ট্রে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, সে দেশের জনগণই তা নির্ধারণ করে। মনে রাখতে হবে, নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্য নিয়ে অনৈতিকভাবে একটি স্বৈরশাসকের প্রতি সমর্থন দেখালে আর যা-ই হোক সৎ প্রতিবেশী হওয়া যায় না। বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে সে দেশের জনগণ ও তাদের স্বার্থের কথাও ভাবতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত এ কাজটি করেনি।
এক যুগের বেশি সময় ধরে একজন কর্তৃত্ববাদী নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা ও তাঁর দলকে সমর্থন জুগিয়ে কেবল নিজেদের স্বার্থই উদ্ধার করেছে। শেখ হাসিনাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে ভারত যে একচেটিয়া সুবিধা নিয়েছে, এর বর্ণনা এত অল্প পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়। এ দেশের জনগণের তা জানা আছে। এখন এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত যতই বলুক, বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে, এ দেশের মানুষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে প্রকৃত বন্ধুত্বের সম্পর্ক যে গড়ে তুলতে চায়, তা শুধু কূটনৈতিক ভাষায় মুখে বললেই চলবে না, বাস্তবেও তার প্রতিফলন দেখাতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতাকে বুঝে সেভাবেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এত দিন তারা যাকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, সেই শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের নিন্দা করে এবং তাঁকে গদিচ্যুত করতে গিয়ে বাংলাদেশের যেসব শিক্ষার্থী, অধিকারকর্মী ও সাধারণ মানুষ জীবন দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি ভারত যদি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে পারে, তাহলেই সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার পরিচয় ফুটে উঠবে।
আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকালে যাঁরা এখন দেশের হাল ধরেছেন, তাঁদের প্রতি তারা আন্তরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকবে। ভারত বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধুরাষ্ট্র হলে, অন্তত এ কাজটি করে দেখাবে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থান রূপ নেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের ৯ দফা যখন ১ দফায় চলে আসে, তখনই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রবল পরাক্রমশালী শাসক শেখ হাসিনার বিদায়ঘণ্টা বেজে ওঠে। ৫ আগস্ট সকালে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ঢাকায় জড়ো হতে থাকলে, শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিক দেশ ছেড়ে চলে যান। এত দিন যাদের ওপর ভর করে তিনি ক্ষমতায় টিকে ছিলেন, সেই পুলিশ ও নিজ দলের আর্মড ক্যাডারের সদস্যরাও জনরোষ থেকে তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি।
শেষ ভরসা, সশস্ত্র বাহিনীও তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ওই মুহূর্তে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া তাঁর অবশ্য আর কোনো গত্যন্তরও ছিল না। নিজ দেশের তিন শতাধিক নাগরিকের খুনের রক্তে যাঁর হাত রাঙা, তেমন একজন পতিত শাসককে আশ্রয় দেওয়া, প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের জন্যও অস্বস্তিকর ছিল। তবু ভারত তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়।
জানা গেছে, খুব অল্প সময়ের নোটিশে ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিতে সম্মত হয়েছে। ৬ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এ বিষয়ে সবাইকে অবগত করেন। তিনি জানান, যত দিন তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রে শেখ হাসিনার আশ্রয়ের ব্যবস্থা না হবে, তত দিন তিনি ভারতেই থাকবেন।
শেখ হাসিনা কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্রে আশ্রয়ের চেষ্টা করলেও কোনো দেশই তাঁকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। তবে শেখ হাসিনার ভারত ছেড়ে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অনেকেরই প্রশ্ন, শেখ হাসিনা সত্যিই কি ভারত ছেড়ে অন্যত্র যেতে ইচ্ছুক? নাকি তিনি ভারতেই থেকে যেতে চান? ভারতে থাকতে পারলে শেখ হাসিনার সুবিধাই হবে। ভারতে বসে বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতি পরিচালনা করতে পারবেন। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও তাই মনে করেন। ১৪ আগস্ট ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জয় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা দেখার জন্য তিনি (শেখ হাসিনা) অপেক্ষা করছেন।
সম্ভবত মা আপাতত ভারতেই থাকবেন।’ শেখ হাসিনা বর্তমানে দিল্লির সন্নিকটে ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবেষ্টনীতে অবস্থান করছেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, নিরাপত্তাজনিত কারণে শেখ হাসিনার সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার কন্যা পুতুলও নাকি তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাননি। সত্যিই কি তাই?
হাসিনাকে যদি কড়া নিরাপত্তাবেষ্টনীতেই রাখা হতো, তাহলে ভারতীয় বিমানঘাঁটির মতো একটি সংবেদনশীল জায়গায় বসে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনা তাঁর নেতা-কর্মীদের, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হতে পারে—এমন রাজনৈতিক নির্দেশনা দেন কী করে? এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার।
১৪ আগস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত ভূখণ্ডে বসে শেখ হাসিনা যেসব বিবৃতি দিচ্ছেন, তা দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অন্তরায়। এটা দুই দেশের সুসম্পর্কের জন্য সহায়কও নয়।
ভারতের বাংলাদেশনীতি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ কখনোই সন্তুষ্ট ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা গেছে, ভারত বরাবরই বাংলাদেশের জনগণের মনোভাবকে অবজ্ঞা করে এককভাবে একটি দলের প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখিয়ে এসেছে। তারা জনগণের চেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এ নিয়ে ভারত বিষয়ে এ দেশের জনগণের ভেতর মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ কোনোকালেই আধিপত্যবাদকে মেনে নেয়নি। আর মেনে নিতে পারেনি বলেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। এ কথা এ দেশের মানুষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকারও করে। কিন্তু ভারত একেবারে নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশকে যে সহায়তা করেছে, সে কথা সঠিক নয়।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই ‘পাকিস্তান ভেঙে দুই ভাগ করা’ ভারত রাজনীতির অন্যতম অ্যাজেন্ডা ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ভারতকে সেই সুযোগ করে দেয়। ভারতও সুযোগ কাজে লাগায়। অতঃপর তারা যথারীতি বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয় এবং মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেখা গেছে, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বড় ভাইসুলভ আচরণ শুরু করে দিল।
অথচ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের জনগণ ভারতের কাছ থেকে সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ আশা করেছিল। প্রতিবেশী ছোট রাষ্ট্রের প্রতি বড় রাষ্ট্রের যেমন অহংবোধ ও অবজ্ঞা থাকে, বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যাপারে ভারতেরও সে ধরনের অবজ্ঞা ও অজ্ঞতা পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশের মানুষ তা কোনো দিনও মেনে নিতে পারেনি। সে কারণে দিন দিন ভারতের প্রতি এ দেশের জনগণের হতাশা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের দুর্বলতা প্রকাশ্যে চলে আসে। ভারতে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, আওয়ামী লীগের প্রতিই তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
এ কারণেই জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে কারচুপির নির্বাচন ও ক্ষমতা একচেটিয়া কুক্ষিগতকরণে আওয়ামী লীগের হয়ে ভারতকে বারবার আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক সহযোগিতা দিতে দেখা গেছে; যা বাংলাদেশিদের আরও বেশি ভারতবিদ্বেষী করে তুলেছে।
এবারের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম দিকে ভারত সরকার কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও তাদের অনেক সাংবাদিক, কিছু রাজনৈতিক দল, টেলিভিশন চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্রিকা, সচেতন নাগরিক ও শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের ছাত্র-আন্দোলন ও হতাহতের প্রতি সহানুভূতি ছিল যথেষ্ট। কিন্তু আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা গদিচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর সে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার যে অবস্থান নিয়েছে, তা বাংলাদেশের মানুষকে হতাশ করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পেছনে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’র তত্ত্ব হাজির করে ভারত এ আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। ভারতীয় গণমাধ্যম এ আন্দোলনে জামায়াত ও পাকিস্তানের হাত আছে দাবি করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের রক্তক্ষয়ী এই আন্দোলনে কালিমা লেপন করতে চেয়েছে। শেখ হাসিনার এমন অপ্রত্যাশিত পতন ভারত যে মেনে নিতে পারছে না, তা তাদের আচরণেই বোঝা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে তাদের কাছে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের গুরুত্ব যে বেশি, আবারও তারা প্রমাণ করেছে। ৬ আগস্ট ভারতের পার্লামেন্টে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের দেওয়া বিবৃতি লক্ষ করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। জয়শঙ্কর তাঁর বিবৃতিতে সেদিন, বাংলাদেশের যানবাহন, রেল, সরকারি ভবন ও অবকাঠামো, পুলিশ, থানা এবং পোশাক কারখানায় আক্রমণের কথা বলেছেন।
আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও তাঁদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের কথা বলেছেন। বাংলাদেশে আটকে পড়া ১৯ হাজার ভারতীয় নাগরিকের কথা বলেছেন। সারা দেশে বেশ কিছু জায়গায় সংখ্যালঘু, তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং মন্দিরে হামলার কথা উল্লেখ করে বিশেষ উদ্বেগের কথা জানালেও আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করেছি, আওয়ামী লীগের দলীয় সশস্ত্র ক্যাডার ও পুলিশের হাতে তিন শতাধিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, সে কথা তিনি একবারও উচ্চারণ করেননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেন, ভারতের একচেটিয়া স্বার্থরক্ষা ও আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ভারত বরাবরই জনগণকে বাদ দিয়ে বন্ধুরাষ্ট্রের পছন্দের রাজনৈতিক নেতা ও দলের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে তোলে। এটা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। নেপাল, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানেও হয়েছে। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত বন্ধুরাষ্ট্র হারাচ্ছে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। সুসম্পর্ক গড়তে হলে শুধু পছন্দের দল ও ব্যক্তি নয়, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলেই দুই দেশের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
তাতে সম্পর্ক পাকাপোক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। কারণ যেকোনো রাষ্ট্রে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, সে দেশের জনগণই তা নির্ধারণ করে। মনে রাখতে হবে, নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্য নিয়ে অনৈতিকভাবে একটি স্বৈরশাসকের প্রতি সমর্থন দেখালে আর যা-ই হোক সৎ প্রতিবেশী হওয়া যায় না। বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে সে দেশের জনগণ ও তাদের স্বার্থের কথাও ভাবতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারত এ কাজটি করেনি।
এক যুগের বেশি সময় ধরে একজন কর্তৃত্ববাদী নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা ও তাঁর দলকে সমর্থন জুগিয়ে কেবল নিজেদের স্বার্থই উদ্ধার করেছে। শেখ হাসিনাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে ভারত যে একচেটিয়া সুবিধা নিয়েছে, এর বর্ণনা এত অল্প পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়। এ দেশের জনগণের তা জানা আছে। এখন এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত যতই বলুক, বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে, এ দেশের মানুষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে প্রকৃত বন্ধুত্বের সম্পর্ক যে গড়ে তুলতে চায়, তা শুধু কূটনৈতিক ভাষায় মুখে বললেই চলবে না, বাস্তবেও তার প্রতিফলন দেখাতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতাকে বুঝে সেভাবেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এত দিন তারা যাকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, সেই শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের নিন্দা করে এবং তাঁকে গদিচ্যুত করতে গিয়ে বাংলাদেশের যেসব শিক্ষার্থী, অধিকারকর্মী ও সাধারণ মানুষ জীবন দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি ভারত যদি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে পারে, তাহলেই সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতার পরিচয় ফুটে উঠবে।
আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকালে যাঁরা এখন দেশের হাল ধরেছেন, তাঁদের প্রতি তারা আন্তরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকবে। ভারত বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধুরাষ্ট্র হলে, অন্তত এ কাজটি করে দেখাবে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে