চিররঞ্জন সরকার
সরকার পরিবর্তনের পরপরই নতুন দখলদারেরা মাঠে নেমে পড়ে। রাতারাতি শুরু হয়ে যায় পদত্যাগ করানো, পছন্দের ব্যক্তিদের মূল পদে বসানো, পছন্দের জায়গায় ও পদে বদলি করিয়ে নেওয়া, মারধর, হুমকি, অফিসে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে। অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিচারালয়সহ সবখানে রীতিমতো ‘মব জাস্টিস’ কায়েম করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এই স্বেচ্ছাচারিতা ঠেকানোর জন্য কোনো উদ্যোগ ও কৌশল নেওয়া হয়নি। এমনকি কোনো আদেশ-নির্দেশ বা উপদেশবাণী পর্যন্ত উচ্চারণ করা হয়নি।
এই সুযোগে নিজেদের ‘বঞ্চিত’ দাবি করে একশ্রেণির শ্রমিক-কর্মচারী নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের সর্বতোভাবে সহায়তা করেছেন বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা। ‘বিগত সরকারের দোসর’ এই ট্যাগ দিয়ে একটা বড় অংশকে অফিসত্যাগ, এমনকি বাসাবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। পেশাজীবী গ্রুপগুলো বেশির ভাগই প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। সেই পুরোনো ঐতিহ্য মেনেই সবকিছু করা হয়েছে। কেবল প্রতিশোধ আর প্রতিশোধ। আচার-আচরণে কোনো পরিবর্তন নেই। সবাই চেয়েছে দলীয়করণমুক্ত একটা ভালো প্রশাসনিক সংস্কার। একটা উন্নত বাংলাদেশ। কিন্তু উদ্যোগ-আয়োজন দেখে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।
শুধু প্রতিশোধ ও ব্যক্তির পরিবর্তনের জন্য তরুণ-যুবারা প্রাণ দেয়নি। চলমান অরাজকতা মোকাবিলা করে পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এবারের এই রক্তভেজা আগস্ট-বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এখান থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দুই সপ্তাহ ধরে নানা ধরনের মামলা দেখা যাচ্ছে। এর বেশির ভাগই হত্যা মামলা। কোনো কোনো মালায় ৩০, ৪০ ও ৫০ জনের বেশি করে আসামি। ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে গার্মেন্টস কর্মচারীকে হত্যার অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়েছে। এমনকি চিত্রনায়ক জায়েদ খান, উপস্থাপক শাহরিয়ার নাজিম জয় ও অভিনেতা সাজু খাদেমের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়াকে হত্যা চেষ্টা মামলায় আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলো দেখেই বোঝা যায়, এগুলো রাগ বা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের রিমান্ডে নিয়ে কী হচ্ছে, কে কী বলছেন—সেসব বিষয়ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে। অথচ রিমান্ডে কী বলা হয়েছে বা না হয়েছে, তা কেউ জানার কথা নয়। কিন্তু গণমাধ্যমে তা প্রকাশ হচ্ছে। এর জন্য কাউকে জবাবদিহি করা হয়নি। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আদালতে হাজিরের সময় তাঁদের নিরাপত্তা ও যথাযথ আইনি অধিকার পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
একজন সাবেক বিচারপতি পুলিশের গাড়ি থেকে নামার পরই তাঁর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যেই তাঁর মাথায় আঘাত করা এবং তাঁর দিকে জুতা ছুড়ে মারছেন অনেকে। তাঁর যৌনাঙ্গেও প্রবল আঘাত করা হয়। ব্যাপক ধাক্কাধাক্কির মধ্যে টেনেহিঁচড়ে তাঁকে আদালত ভবনে প্রবেশ করানো হয়। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া প্রায় সবাই আদালত চত্বরে কিল-ঘুষি-লাথির মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁদের দিকে ইটের টুকরা, ডিম ও জুতা ছুড়ে মারা হয়েছে। এই চিত্র মোটেও ভালো কিছুর লক্ষণ বহন করে না। বিগত সরকারের আমলে একই পরিস্থিতির শিকার হওয়ার কারণে ক্ষোভের বশে প্রতিশোধমূলকভাবে যদি এখনো একই কায়দায় আদালত পরিচালনা করা হয়, তাহলে এই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার অবশিষ্ট রইল কী?
অবিলম্বে বিচারব্যবস্থা সংস্কার করা দরকার। আদালত এলাকায় এমন একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রত্যেকে তাদের মামলার মুখোমুখি হতে নিরাপদ বোধ করে। সবাই যেন ন্যায়বিচার পায়। ‘ক্যাঙারু কোর্ট’—এই অপবাদ থেকে বিচার বিভাগকে মুক্তি দিতে হবে।
শিক্ষাঙ্গনগুলোয়ও চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে। একশ্রেণির শিক্ষার্থী বিভিন্ন কুচক্রী মহলের দ্বারা পরিচালিত হয়ে শিক্ষকদের ওপর চড়াও হচ্ছে। তাদের হেনস্তা ও লাঞ্ছিত করছে। জোর করে পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নিচ্ছে। কখনো জুতার মালা গলায় পরাচ্ছে। কখনো আবার গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখছে। অনেক জায়গায় শিক্ষকদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘দুর্নীতি’ কিংবা ‘দলপ্রীতি’র অভিযোগ আনা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের দ্বারা পাইকারি হারে শিক্ষকদের এমন অপমান ও লাঞ্ছনা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও দুঃখজনক।
কোনো শিক্ষক যদি অতিরিক্ত দলবাজি করে থাকেন, কিংবা কারও বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ থাকে, তবে তাঁর বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়তো দরকারিও।
কিন্তু সেটা না করে ঢালাওভাবে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক ও বেআইনিভাবে পদত্যাগ করানো চরম অবক্ষয়েরই বহিঃপ্রকাশ।যত শিগগির সম্ভব এই হঠকারী ও অবস্থান থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনা দরকার। শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সচল করা দরকার। শিক্ষার্থীদের বই ও ক্লাসরুমমুখী করা দরকার। তা না হলে গণ-অভ্যুত্থানের যাবতীয় অর্জন হারিয়ে যাবে।
মনে রাখতে হবে, রাজপথে আন্দোলন করে স্বৈরাচার হটানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, বন্যার্তদের সাহায্য করা শিক্ষার্থীদের ‘সময়ের দাবি’ মেনে দায়িত্বশীলতার পরিচয় প্রদান করা। কিন্তু তাদের আসল কাজ লেখাপড়া করা। যোগ্য মানুষ হিসেবে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা। এই কর্তব্যকর্মে অবহেলা করলে বাকি সব গুণই সস্তা অলংকারে পরিণত হবে।
ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেও দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সব জায়গা থেকেই অতিমাত্রায় দলবাজ, অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো কারণে বঞ্চিতদের অবশ্যই টেনে তুলতে হবে। কিন্তু দক্ষ ও যোগ্যদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করে নয়। কোনো রকম বাছবিচারহীন ঢালাওভাবে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে প্রতিষ্ঠান স্থবির হয়ে পড়বে। আবার কেবল ‘বঞ্চিত’ বলে দুর্নীতিবাজ কিংবা অদক্ষদের সামনে টেনে আনা যাবে না। সবকিছু করতে হবে রয়েসয়ে, বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে এক দলের পরিবর্তে আরেক দলের সমর্থকদের পুনর্বাসন যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বাক্স্বাধীনতার বিষয়টিও নিশ্চিত করা দরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাক্স্বাধীনতা অত্যন্ত সচেতনভাবে অস্বীকৃত হয়েছে। শাসকদের সমালোচনা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সমালোচনা করলে অনেক সময় সরকারি রোষানলের মুখে পড়তে হতো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়্গে অনেক গণমাধ্যমকর্মী ও নাগরিককে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে শাস্তি ভোগ করেছেন। একটা ভয় ও নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি পুরো দেশে কায়েম হয়েছিল।
ছাত্রসমাজ-সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমালোচনাকে এখনো কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে। সরকার কিংবা আন্দোলনকারীদের কাজের সমালোচনা করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে তাদের শারীরিক ও সামাজিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। পুরো গণমাধ্যমের ওপর একধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ছাড়া অন্য কোনো সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে না।
হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে যারা প্রত্যক্ষ সমর্থন দেয়নি বা অংশগ্রহণ করেনি, তাদের সরাসরি ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসেবে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। তাদের বয়কটের আহ্বান জানানো হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের নিয়ে ট্রল করা হচ্ছে। অনেক উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, মিডিয়াকর্মী, খেলোয়াড়, সংস্কৃতিকর্মী, কবি, লেখক, অভিনয়শিল্পী, সামাজিকভাবে খ্যাতিমান ব্যক্তিরা শিক্ষার্থীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই ধারাও সর্বনাশা। সমাজের একটা বড় অংশকে অকারণেই শত্রুপক্ষে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। একটি সমৃদ্ধ ও অংশগ্রহণমূলক সমাজ গড়ার জন্য এই মানসিকতা মোটেও সহায়ক নয়।
ক্ষমতা গ্রহণের ১৭ দিন পরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দীর্ঘ ১৫ বছরের ‘গণতন্ত্রহীনতায়’ দেশের যে পরিস্থিতি হয়েছিল তা থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে তাঁর সরকার প্রস্তুত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফল ধরে রাখতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকার দেশত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটাই—উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে, সে জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
মুহাম্মদ ইউনূস সবাইকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেছেন। উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছেন। দেশবাসী তাঁর কথায় আস্থা রাখতে চায়। দেশের সবাই একটা রূপান্তরিত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। কেবল আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপি বা জামায়াতের শাসন নয়। কেবল শাসকের পরিবর্তন নয়, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন। যেখানে কেউ যেন আর স্বৈরাচার হতে না পারে। নতুন করে ফ্যাসিবাদী শাসন চাপিয়ে দিতে না পারে।
ইতিমধ্যে যে ত্রুটিগুলো হয়েছে, সেগুলো দ্রুতই সংশোধন করতে হবে। দখলদার-চাঁদাবাজদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে।একটি রূপান্তরিত নতুন বৈষম্যহীন মুক্ত সমাজের স্বপ্ন থেকে সরে আসা যাবে না। বাংলাদেশ ক্রান্তিকাল পার করছে। বলতে গেলে সুতার ওপর হাঁটছে। এই সরকার ব্যর্থ হলে গণ-আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু হবে; যা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
সরকার পরিবর্তনের পরপরই নতুন দখলদারেরা মাঠে নেমে পড়ে। রাতারাতি শুরু হয়ে যায় পদত্যাগ করানো, পছন্দের ব্যক্তিদের মূল পদে বসানো, পছন্দের জায়গায় ও পদে বদলি করিয়ে নেওয়া, মারধর, হুমকি, অফিসে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে। অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিচারালয়সহ সবখানে রীতিমতো ‘মব জাস্টিস’ কায়েম করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এই স্বেচ্ছাচারিতা ঠেকানোর জন্য কোনো উদ্যোগ ও কৌশল নেওয়া হয়নি। এমনকি কোনো আদেশ-নির্দেশ বা উপদেশবাণী পর্যন্ত উচ্চারণ করা হয়নি।
এই সুযোগে নিজেদের ‘বঞ্চিত’ দাবি করে একশ্রেণির শ্রমিক-কর্মচারী নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের সর্বতোভাবে সহায়তা করেছেন বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা। ‘বিগত সরকারের দোসর’ এই ট্যাগ দিয়ে একটা বড় অংশকে অফিসত্যাগ, এমনকি বাসাবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। পেশাজীবী গ্রুপগুলো বেশির ভাগই প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। সেই পুরোনো ঐতিহ্য মেনেই সবকিছু করা হয়েছে। কেবল প্রতিশোধ আর প্রতিশোধ। আচার-আচরণে কোনো পরিবর্তন নেই। সবাই চেয়েছে দলীয়করণমুক্ত একটা ভালো প্রশাসনিক সংস্কার। একটা উন্নত বাংলাদেশ। কিন্তু উদ্যোগ-আয়োজন দেখে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।
শুধু প্রতিশোধ ও ব্যক্তির পরিবর্তনের জন্য তরুণ-যুবারা প্রাণ দেয়নি। চলমান অরাজকতা মোকাবিলা করে পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এবারের এই রক্তভেজা আগস্ট-বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এখান থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দুই সপ্তাহ ধরে নানা ধরনের মামলা দেখা যাচ্ছে। এর বেশির ভাগই হত্যা মামলা। কোনো কোনো মালায় ৩০, ৪০ ও ৫০ জনের বেশি করে আসামি। ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে গার্মেন্টস কর্মচারীকে হত্যার অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়েছে। এমনকি চিত্রনায়ক জায়েদ খান, উপস্থাপক শাহরিয়ার নাজিম জয় ও অভিনেতা সাজু খাদেমের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়াকে হত্যা চেষ্টা মামলায় আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলো দেখেই বোঝা যায়, এগুলো রাগ বা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের রিমান্ডে নিয়ে কী হচ্ছে, কে কী বলছেন—সেসব বিষয়ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে। অথচ রিমান্ডে কী বলা হয়েছে বা না হয়েছে, তা কেউ জানার কথা নয়। কিন্তু গণমাধ্যমে তা প্রকাশ হচ্ছে। এর জন্য কাউকে জবাবদিহি করা হয়নি। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আদালতে হাজিরের সময় তাঁদের নিরাপত্তা ও যথাযথ আইনি অধিকার পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
একজন সাবেক বিচারপতি পুলিশের গাড়ি থেকে নামার পরই তাঁর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যেই তাঁর মাথায় আঘাত করা এবং তাঁর দিকে জুতা ছুড়ে মারছেন অনেকে। তাঁর যৌনাঙ্গেও প্রবল আঘাত করা হয়। ব্যাপক ধাক্কাধাক্কির মধ্যে টেনেহিঁচড়ে তাঁকে আদালত ভবনে প্রবেশ করানো হয়। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া প্রায় সবাই আদালত চত্বরে কিল-ঘুষি-লাথির মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁদের দিকে ইটের টুকরা, ডিম ও জুতা ছুড়ে মারা হয়েছে। এই চিত্র মোটেও ভালো কিছুর লক্ষণ বহন করে না। বিগত সরকারের আমলে একই পরিস্থিতির শিকার হওয়ার কারণে ক্ষোভের বশে প্রতিশোধমূলকভাবে যদি এখনো একই কায়দায় আদালত পরিচালনা করা হয়, তাহলে এই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনার অবশিষ্ট রইল কী?
অবিলম্বে বিচারব্যবস্থা সংস্কার করা দরকার। আদালত এলাকায় এমন একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রত্যেকে তাদের মামলার মুখোমুখি হতে নিরাপদ বোধ করে। সবাই যেন ন্যায়বিচার পায়। ‘ক্যাঙারু কোর্ট’—এই অপবাদ থেকে বিচার বিভাগকে মুক্তি দিতে হবে।
শিক্ষাঙ্গনগুলোয়ও চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে। একশ্রেণির শিক্ষার্থী বিভিন্ন কুচক্রী মহলের দ্বারা পরিচালিত হয়ে শিক্ষকদের ওপর চড়াও হচ্ছে। তাদের হেনস্তা ও লাঞ্ছিত করছে। জোর করে পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নিচ্ছে। কখনো জুতার মালা গলায় পরাচ্ছে। কখনো আবার গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখছে। অনেক জায়গায় শিক্ষকদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘দুর্নীতি’ কিংবা ‘দলপ্রীতি’র অভিযোগ আনা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের দ্বারা পাইকারি হারে শিক্ষকদের এমন অপমান ও লাঞ্ছনা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেছে বলে মনে হয় না। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও দুঃখজনক।
কোনো শিক্ষক যদি অতিরিক্ত দলবাজি করে থাকেন, কিংবা কারও বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ থাকে, তবে তাঁর বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়তো দরকারিও।
কিন্তু সেটা না করে ঢালাওভাবে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক ও বেআইনিভাবে পদত্যাগ করানো চরম অবক্ষয়েরই বহিঃপ্রকাশ।যত শিগগির সম্ভব এই হঠকারী ও অবস্থান থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে আনা দরকার। শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সচল করা দরকার। শিক্ষার্থীদের বই ও ক্লাসরুমমুখী করা দরকার। তা না হলে গণ-অভ্যুত্থানের যাবতীয় অর্জন হারিয়ে যাবে।
মনে রাখতে হবে, রাজপথে আন্দোলন করে স্বৈরাচার হটানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, বন্যার্তদের সাহায্য করা শিক্ষার্থীদের ‘সময়ের দাবি’ মেনে দায়িত্বশীলতার পরিচয় প্রদান করা। কিন্তু তাদের আসল কাজ লেখাপড়া করা। যোগ্য মানুষ হিসেবে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা। এই কর্তব্যকর্মে অবহেলা করলে বাকি সব গুণই সস্তা অলংকারে পরিণত হবে।
ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেও দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সব জায়গা থেকেই অতিমাত্রায় দলবাজ, অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো কারণে বঞ্চিতদের অবশ্যই টেনে তুলতে হবে। কিন্তু দক্ষ ও যোগ্যদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করে নয়। কোনো রকম বাছবিচারহীন ঢালাওভাবে সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে প্রতিষ্ঠান স্থবির হয়ে পড়বে। আবার কেবল ‘বঞ্চিত’ বলে দুর্নীতিবাজ কিংবা অদক্ষদের সামনে টেনে আনা যাবে না। সবকিছু করতে হবে রয়েসয়ে, বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে এক দলের পরিবর্তে আরেক দলের সমর্থকদের পুনর্বাসন যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বাক্স্বাধীনতার বিষয়টিও নিশ্চিত করা দরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাক্স্বাধীনতা অত্যন্ত সচেতনভাবে অস্বীকৃত হয়েছে। শাসকদের সমালোচনা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সমালোচনা করলে অনেক সময় সরকারি রোষানলের মুখে পড়তে হতো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়্গে অনেক গণমাধ্যমকর্মী ও নাগরিককে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে শাস্তি ভোগ করেছেন। একটা ভয় ও নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি পুরো দেশে কায়েম হয়েছিল।
ছাত্রসমাজ-সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমালোচনাকে এখনো কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে। সরকার কিংবা আন্দোলনকারীদের কাজের সমালোচনা করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে তাদের শারীরিক ও সামাজিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। পুরো গণমাধ্যমের ওপর একধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ছাড়া অন্য কোনো সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে না।
হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে যারা প্রত্যক্ষ সমর্থন দেয়নি বা অংশগ্রহণ করেনি, তাদের সরাসরি ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসেবে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। তাদের বয়কটের আহ্বান জানানো হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের নিয়ে ট্রল করা হচ্ছে। অনেক উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, মিডিয়াকর্মী, খেলোয়াড়, সংস্কৃতিকর্মী, কবি, লেখক, অভিনয়শিল্পী, সামাজিকভাবে খ্যাতিমান ব্যক্তিরা শিক্ষার্থীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই ধারাও সর্বনাশা। সমাজের একটা বড় অংশকে অকারণেই শত্রুপক্ষে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। একটি সমৃদ্ধ ও অংশগ্রহণমূলক সমাজ গড়ার জন্য এই মানসিকতা মোটেও সহায়ক নয়।
ক্ষমতা গ্রহণের ১৭ দিন পরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দীর্ঘ ১৫ বছরের ‘গণতন্ত্রহীনতায়’ দেশের যে পরিস্থিতি হয়েছিল তা থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে তাঁর সরকার প্রস্তুত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফল ধরে রাখতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকার দেশত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটাই—উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে, সে জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
মুহাম্মদ ইউনূস সবাইকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেছেন। উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছেন। দেশবাসী তাঁর কথায় আস্থা রাখতে চায়। দেশের সবাই একটা রূপান্তরিত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। কেবল আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপি বা জামায়াতের শাসন নয়। কেবল শাসকের পরিবর্তন নয়, শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন। যেখানে কেউ যেন আর স্বৈরাচার হতে না পারে। নতুন করে ফ্যাসিবাদী শাসন চাপিয়ে দিতে না পারে।
ইতিমধ্যে যে ত্রুটিগুলো হয়েছে, সেগুলো দ্রুতই সংশোধন করতে হবে। দখলদার-চাঁদাবাজদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে।একটি রূপান্তরিত নতুন বৈষম্যহীন মুক্ত সমাজের স্বপ্ন থেকে সরে আসা যাবে না। বাংলাদেশ ক্রান্তিকাল পার করছে। বলতে গেলে সুতার ওপর হাঁটছে। এই সরকার ব্যর্থ হলে গণ-আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু হবে; যা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে