চিররঞ্জন সরকার
গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তাসহ সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থাই হলো সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী। এটা এমন একটা নিরাপত্তা বেড়াজাল, যার মাধ্যমে সমাজের আয়-উপার্জনহীন ও পিছিয়ে পড়া মানুষকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।
আমাদের জাতীয় সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা হয়েছে। কাগজে-কলমে এই খাতে প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দ বাড়লেও প্রকৃতপক্ষে বরাদ্দ আরও কমে যায়। এ বছরের বাজেটেও তা ঘটেছে। বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা করছে সরকার, যা মোট বাজেট বরাদ্দের ১৭ দশমিক ০৬ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এই হিসাবে সামান্যই বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ।
সত্যিকার অর্থে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নয়, আগামী অর্থবছরে এমন কিছু বিষয়কে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের তালিকায় দেখানো হচ্ছে। যেমন—ধনী-গরিব সবাই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। আগামী অর্থবছরেও সরকার দেখাতে যাচ্ছে, ব্যাংকে টাকা রাখলে যে হারে সুদ পাওয়া যায়, তার চেয়ে বেশি হারে যতটুকু সুদ সঞ্চয়পত্রে দেওয়া হয়, ততটুকু হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা।
আবার অবসরভোগী সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বৃত্তিকেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির তালিকায় রাখা হচ্ছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দের তিন ভাগের এক ভাগ সরকারি চাকুরের পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদের জন্য রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বহুমুখী কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রাখা হয়েছে বড় অঙ্কের টাকা। এমনকি বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের খরচও সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দের মধ্যেই দেখানো হয়েছে। কৃষি খাতে ভর্তুকির পুরো অঙ্ককেই সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বলে বিবেচনা করছে।
সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য কলোনি নির্মাণ, উপকূল অঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তহবিল গঠন, চাকরিরত অবস্থায় মারা যাওয়া সরকারি কর্মচারীদের জন্য অনুদান ইত্যাদি খাতের বরাদ্দকেও সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের ৩৩ শতাংশ যাচ্ছে পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে। এর ২৭ শতাংশই খরচ হবে সরকারি চাকরিজীবী ও তাদের পরিবারের পেনশন বাবদ। এতে ৩৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। সঞ্চয়পত্রের সুদহারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম বাবদ যাবে আরও ৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা, যা এই খাতে বরাদ্দের ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। দুই খাত মিলিয়ে চলে যাবে ৩৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এ দুই খাতে ৩০ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ যা দেখানো হচ্ছে, তা আসলে একধরনের গোঁজামিল।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ৩ শতাংশের মতো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গড় বরাদ্দ ৪ শতাংশ, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর গড় বরাদ্দ ৮ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর গড় ২০ শতাংশ। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ সবচেয়ে কম।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতার পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু আগামী অর্থবছরে এই প্রস্তাবসহ কোনো ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাবই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। নগদ সহায়তার মধ্যে শুধু প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আর কারও ভাতা বাড়ছে না। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি ১০০ টাকা বাড়ছে। উপবৃত্তি ৯৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৫০ টাকা হচ্ছে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় বেতনকাঠামোর প্রজ্ঞাপন জারি করে যখন সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এক লাফে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছিল, গরিব বয়স্ক নারী-পুরুষদের ভাতা ছিল তখন মাসিক ৪০০ টাকা। বর্তমানে তাঁরা পাচ্ছেন ৬০০ টাকা করে। বয়স্ক ভাতা এক টাকাও বাড়ছে না।
বর্তমানে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয় ৫৮ লাখ ১ হাজার নারী-পুরুষকে। আগামী বাজেটে ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে ২৫ লাখ ৭৫ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাকে মাসিক ৫৫০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। ২৯ লাখ প্রতিবন্ধীকে মাসে ৮৫০ টাকা ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে বয়স্ক কিংবা বিধবা ভাতা রাজ্যভেদে ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা। গবেষকদের মতে, ন্যূনতম জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন বর্তমানে ১ হাজার ৮৬২ টাকা। অর্থনীতিবিদেরা প্রশ্ন করছেন: মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে বেশি হলে ভাতার হার কম কেন? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সরকার কাগজে-কলমে যা-ই দেখাক, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আনুপাতিক হারে বরাদ্দ বরং কমছে। এই বরাদ্দ কমার বিষয়টা কল্যাণমূলক অবস্থান থেকে সরকারের সরে আসার শামিল। প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির খাদ্যের ৫০ শতাংশই চাল। ব্যয়ের বড় অংশই খাদ্যে যায়। মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে মানুষ খাদ্যে কাটছাঁট করে। ফলে পুষ্টি গ্রহণ কমে যাবে এই শ্রেণির। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো বর্তমান পরিস্থিতির চাহিদার আলোকে হয়নি। মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সামাজিক সুরক্ষা ব্যয় যেখানে দ্বিগুণ করা দরকার, সেখানে বরাদ্দ অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
এই টাকায় সামাজিক সুরক্ষা কতটা দেওয়া সম্ভব, সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে। বয়স্ক ভাতার কথাই ধরা যাক। এই ভাতাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে পুরুষের বয়স সর্বনিম্ন ৬৫ বছর ও নারীর ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৬২ বছর হতে হবে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠী সব মিলিয়ে ৭ শতাংশ। দেশে মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি ধরলেও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখের মতো। আর ভাতার পরিমাণ নিয়ে সমালোচনা তো আছেই। তাঁদের জন্য বরাদ্দ ৬০০ টাকা দিয়ে একজন বয়স্ক দরিদ্র ব্যক্তি আগের বছর যতটুকু খাবার এবং ওষুধ কিনতে পারতেন, পরের বছর সেটা পারেন না। কেননা, মূল্যস্ফীতির কারণে ওষুধের দামও বাড়ছে প্রতিবছর। তার মানে, প্রকৃত অর্থে ভাতার পরিমাণ কমে গেছে।
মানুষের বয়স হয়ে গেলে প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়ে যায়। অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকতে হয়। সরকার দয়ার পরিমাণটাও ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে! কয়েক দিন আগে এক দৈনিকে এ রকম ভাতাভোগী এক হতদরিদ্র বৃদ্ধের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বাড়ি রাজশাহী। তিন বছর আগেও তিনি ৫০০ টাকা দিয়ে দুটি ইনহেলার কিনতে পারতেন, এখন আর পারেন না। তা ছাড়া, শরীরে এখন আরও নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। তিনি বলেছেন, জীবন এখন তাঁর কাছে বোঝা হয়ে গেছে। একমাত্র মৃত্যুই তাঁর মুক্তি এনে দিতে পারে! এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের সমাজে ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু সরকার এমন মানুষের প্রতি সহায়তার হাত ক্রমেই গুটিয়ে নিচ্ছে। এটা দুঃখজনক।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম চর্চা এই খাতে অনুপস্থিত। ঠিক ব্যক্তির কাছে অর্থ পৌঁছাচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে কোনো যথাযথ তদারকি নেই। দেশে এখনো অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলোর একটির সুবিধাও পান না।
সরকার নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে প্রতিবছর নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে চায়। পুঁজিপতি-ব্যবসায়ী-লুটেরাদের স্বার্থ রক্ষা করে প্রাণপণে, কিন্তু প্রমাণ করার চেষ্টা করে গরিববান্ধব হিসেবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে সব সময় নিজেদের মহানুভবতার হাতিয়ার হিসেবে দেখানো হয়। দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই গ্রামে থাকে। দারিদ্র্যও তাই প্রবলভাবে গ্রামীণ। সমস্যার শিকড়ও সেই কৃষি ও গ্রামীণ ক্ষেত্রের গভীরেই রয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি দিনে দিনে কমছে। কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কোনো ম্যাকানিজম নেই।
কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত শ্রমিকেরা শিল্প ও সেবা খাতে যথেষ্ট সংখ্যায় যেতে পারেন—তেমন সুযোগ তৈরি হয়নি। ফলে কৃষিতে গড়পড়তা আয় কমছে। ক্রমেই অলাভজনক হচ্ছে চাষবাস। এখন বেশির ভাগ কৃষিজীবী অন্য কোনো জুতসই কাজ পেলে তৎক্ষণাৎ কৃষিক্ষেত্র ছাড়তে চাইবেন। নেহাত যাওয়ার জায়গা নেই, তাই তাঁরা জোয়ালে জুড়ে আছেন। বাজেট-বক্তৃতায় স্বভাবতই এসব কথা থাকে না। থাকে কেবল আত্মপ্রচার, অথচ থাকা দরকার আত্মসমীক্ষা বা আত্মসমালোচনা।
আমাদের দেশে করোনা মহামারির অভিঘাত এখনো কাটেনি। ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেশের অর্থনীতিকে এখনো পর্যুদস্ত করে রেখেছে। বৈষম্য, লুটপাট, টাকা পাচার, ডলার-সংকটের কারণে অতিদরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জীবন ও জীবিকা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তাই সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সুসংহত করে তার দ্বারা অতিদরিদ্র মানুষের জীবন সুরক্ষিত করা এই মুহূর্তে জরুরি কাজ।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তাসহ সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থাই হলো সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী। এটা এমন একটা নিরাপত্তা বেড়াজাল, যার মাধ্যমে সমাজের আয়-উপার্জনহীন ও পিছিয়ে পড়া মানুষকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়।
আমাদের জাতীয় সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা হয়েছে। কাগজে-কলমে এই খাতে প্রতিবছর বাজেট বরাদ্দ বাড়লেও প্রকৃতপক্ষে বরাদ্দ আরও কমে যায়। এ বছরের বাজেটেও তা ঘটেছে। বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা করছে সরকার, যা মোট বাজেট বরাদ্দের ১৭ দশমিক ০৬ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এই হিসাবে সামান্যই বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ।
সত্যিকার অর্থে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নয়, আগামী অর্থবছরে এমন কিছু বিষয়কে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের তালিকায় দেখানো হচ্ছে। যেমন—ধনী-গরিব সবাই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। আগামী অর্থবছরেও সরকার দেখাতে যাচ্ছে, ব্যাংকে টাকা রাখলে যে হারে সুদ পাওয়া যায়, তার চেয়ে বেশি হারে যতটুকু সুদ সঞ্চয়পত্রে দেওয়া হয়, ততটুকু হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা।
আবার অবসরভোগী সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বৃত্তিকেও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির তালিকায় রাখা হচ্ছে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দের তিন ভাগের এক ভাগ সরকারি চাকুরের পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদের জন্য রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বহুমুখী কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রাখা হয়েছে বড় অঙ্কের টাকা। এমনকি বিনা মূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের খরচও সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দের মধ্যেই দেখানো হয়েছে। কৃষি খাতে ভর্তুকির পুরো অঙ্ককেই সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বলে বিবেচনা করছে।
সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য কলোনি নির্মাণ, উপকূল অঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তহবিল গঠন, চাকরিরত অবস্থায় মারা যাওয়া সরকারি কর্মচারীদের জন্য অনুদান ইত্যাদি খাতের বরাদ্দকেও সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দের ৩৩ শতাংশ যাচ্ছে পেনশন ও সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে। এর ২৭ শতাংশই খরচ হবে সরকারি চাকরিজীবী ও তাদের পরিবারের পেনশন বাবদ। এতে ৩৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। সঞ্চয়পত্রের সুদহারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রিমিয়াম বাবদ যাবে আরও ৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা, যা এই খাতে বরাদ্দের ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। দুই খাত মিলিয়ে চলে যাবে ৩৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এ দুই খাতে ৩০ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ যা দেখানো হচ্ছে, তা আসলে একধরনের গোঁজামিল।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ৩ শতাংশের মতো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গড় বরাদ্দ ৪ শতাংশ, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর গড় বরাদ্দ ৮ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর গড় ২০ শতাংশ। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ সবচেয়ে কম।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতার পরিমাণ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু আগামী অর্থবছরে এই প্রস্তাবসহ কোনো ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাবই আমলে নেওয়া হচ্ছে না। নগদ সহায়তার মধ্যে শুধু প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। আর কারও ভাতা বাড়ছে না। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি ১০০ টাকা বাড়ছে। উপবৃত্তি ৯৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৫০ টাকা হচ্ছে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় বেতনকাঠামোর প্রজ্ঞাপন জারি করে যখন সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এক লাফে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছিল, গরিব বয়স্ক নারী-পুরুষদের ভাতা ছিল তখন মাসিক ৪০০ টাকা। বর্তমানে তাঁরা পাচ্ছেন ৬০০ টাকা করে। বয়স্ক ভাতা এক টাকাও বাড়ছে না।
বর্তমানে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয় ৫৮ লাখ ১ হাজার নারী-পুরুষকে। আগামী বাজেটে ভাতাভোগীর সংখ্যা ১ লাখ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে ২৫ লাখ ৭৫ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাকে মাসিক ৫৫০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। ২৯ লাখ প্রতিবন্ধীকে মাসে ৮৫০ টাকা ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে বয়স্ক কিংবা বিধবা ভাতা রাজ্যভেদে ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা। গবেষকদের মতে, ন্যূনতম জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন বর্তমানে ১ হাজার ৮৬২ টাকা। অর্থনীতিবিদেরা প্রশ্ন করছেন: মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে বেশি হলে ভাতার হার কম কেন? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সরকার কাগজে-কলমে যা-ই দেখাক, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আনুপাতিক হারে বরাদ্দ বরং কমছে। এই বরাদ্দ কমার বিষয়টা কল্যাণমূলক অবস্থান থেকে সরকারের সরে আসার শামিল। প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির খাদ্যের ৫০ শতাংশই চাল। ব্যয়ের বড় অংশই খাদ্যে যায়। মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে মানুষ খাদ্যে কাটছাঁট করে। ফলে পুষ্টি গ্রহণ কমে যাবে এই শ্রেণির। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো বর্তমান পরিস্থিতির চাহিদার আলোকে হয়নি। মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সামাজিক সুরক্ষা ব্যয় যেখানে দ্বিগুণ করা দরকার, সেখানে বরাদ্দ অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
এই টাকায় সামাজিক সুরক্ষা কতটা দেওয়া সম্ভব, সেই প্রশ্ন রয়ে গেছে। বয়স্ক ভাতার কথাই ধরা যাক। এই ভাতাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে পুরুষের বয়স সর্বনিম্ন ৬৫ বছর ও নারীর ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৬২ বছর হতে হবে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠী সব মিলিয়ে ৭ শতাংশ। দেশে মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি ধরলেও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখের মতো। আর ভাতার পরিমাণ নিয়ে সমালোচনা তো আছেই। তাঁদের জন্য বরাদ্দ ৬০০ টাকা দিয়ে একজন বয়স্ক দরিদ্র ব্যক্তি আগের বছর যতটুকু খাবার এবং ওষুধ কিনতে পারতেন, পরের বছর সেটা পারেন না। কেননা, মূল্যস্ফীতির কারণে ওষুধের দামও বাড়ছে প্রতিবছর। তার মানে, প্রকৃত অর্থে ভাতার পরিমাণ কমে গেছে।
মানুষের বয়স হয়ে গেলে প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়ে যায়। অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকতে হয়। সরকার দয়ার পরিমাণটাও ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে! কয়েক দিন আগে এক দৈনিকে এ রকম ভাতাভোগী এক হতদরিদ্র বৃদ্ধের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বাড়ি রাজশাহী। তিন বছর আগেও তিনি ৫০০ টাকা দিয়ে দুটি ইনহেলার কিনতে পারতেন, এখন আর পারেন না। তা ছাড়া, শরীরে এখন আরও নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। তিনি বলেছেন, জীবন এখন তাঁর কাছে বোঝা হয়ে গেছে। একমাত্র মৃত্যুই তাঁর মুক্তি এনে দিতে পারে! এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের সমাজে ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু সরকার এমন মানুষের প্রতি সহায়তার হাত ক্রমেই গুটিয়ে নিচ্ছে। এটা দুঃখজনক।
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। আন্তর্জাতিক সর্বোত্তম চর্চা এই খাতে অনুপস্থিত। ঠিক ব্যক্তির কাছে অর্থ পৌঁছাচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে কোনো যথাযথ তদারকি নেই। দেশে এখনো অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলোর একটির সুবিধাও পান না।
সরকার নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে প্রতিবছর নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে চায়। পুঁজিপতি-ব্যবসায়ী-লুটেরাদের স্বার্থ রক্ষা করে প্রাণপণে, কিন্তু প্রমাণ করার চেষ্টা করে গরিববান্ধব হিসেবে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে সব সময় নিজেদের মহানুভবতার হাতিয়ার হিসেবে দেখানো হয়। দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই গ্রামে থাকে। দারিদ্র্যও তাই প্রবলভাবে গ্রামীণ। সমস্যার শিকড়ও সেই কৃষি ও গ্রামীণ ক্ষেত্রের গভীরেই রয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি দিনে দিনে কমছে। কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কোনো ম্যাকানিজম নেই।
কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত শ্রমিকেরা শিল্প ও সেবা খাতে যথেষ্ট সংখ্যায় যেতে পারেন—তেমন সুযোগ তৈরি হয়নি। ফলে কৃষিতে গড়পড়তা আয় কমছে। ক্রমেই অলাভজনক হচ্ছে চাষবাস। এখন বেশির ভাগ কৃষিজীবী অন্য কোনো জুতসই কাজ পেলে তৎক্ষণাৎ কৃষিক্ষেত্র ছাড়তে চাইবেন। নেহাত যাওয়ার জায়গা নেই, তাই তাঁরা জোয়ালে জুড়ে আছেন। বাজেট-বক্তৃতায় স্বভাবতই এসব কথা থাকে না। থাকে কেবল আত্মপ্রচার, অথচ থাকা দরকার আত্মসমীক্ষা বা আত্মসমালোচনা।
আমাদের দেশে করোনা মহামারির অভিঘাত এখনো কাটেনি। ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেশের অর্থনীতিকে এখনো পর্যুদস্ত করে রেখেছে। বৈষম্য, লুটপাট, টাকা পাচার, ডলার-সংকটের কারণে অতিদরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জীবন ও জীবিকা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তাই সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সুসংহত করে তার দ্বারা অতিদরিদ্র মানুষের জীবন সুরক্ষিত করা এই মুহূর্তে জরুরি কাজ।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে