এ কে এম শামসুদ্দিন
২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ৭ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে ভেঙে দিয়ে, চোরের মতো পালিয়ে যান সামরিক জান্তা জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান।
২৫ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টকে দেওয়া সংবিধানের খসড়ার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা এবং অনুমোদনের জন্য সময় নির্ধারণের কথা ছিল এদিন। ১৬ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত আলোচনায় তেমন কোনো অগ্রগতি না হলেও ২০ মার্চের বৈঠকে আওয়ামী লীগের দেওয়া তিনটি মৌলিক বিষয় প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।
এগুলো হলো—(১) সামরিক আইন প্রত্যাহার, (২) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং (৩) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন। পরবর্তী দুদিন তাঁরা নানা টালবাহানা করে সময় কাটিয়ে দেন। ২৩ মার্চ ঘোষণার খসড়া সংশোধন করতেই দিন পার হয়ে যায়। ২৪ মার্চ দুপুরের দিকে জানানো হয়, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার জেনারেল এস জি এম এম পীরজাদা ২৫ মার্চ কোনো একসময় ড. কামাল হোসেনকে প্রেসিডেন্টের ঘোষণাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের কথা টেলিফোনে জানিয়ে দেবেন। ২৫ মার্চ সারা দিন ধরেই আওয়ামী লীগের নেতারা টেলিফোনের অপেক্ষায় থাকেন, কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি। অথচ ড. কামালকে টেলিফোনে জানিয়ে দেওয়ার কথা যখন বলা হয়েছিল ঠিক তার কয়েক ঘণ্টা আগেই ২৪ মার্চ বেলা ১১টায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করা হয়। অতঃপর খুব দ্রুত বাংলাদেশের দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে।
২৫ মার্চ মধ্যরাতের আগেই ঢাকাসহ দেশের সব সেনানিবাস থেকে হালকা ও ভারী অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিনা নোটিশে, এমনভাবে যে হিংস্র হায়েনার শিকারে পরিণত হবে তার জন্য বাঙালি জাতি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। অথচ এর আয়োজন চলছিল অনেক আগে থেকেই। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকেই এ দেশে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাদের শক্তি বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। হাজার হাজার সৈনিক পাকিস্তান থেকে ঢাকায় উড়িয়ে আনা হয়।
অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদবোঝাই জাহাজ ‘এমভি সোয়াত’ তত দিনে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে গিয়েছিল। দুষ্কৃতকারী মোকাবিলায় দেশের বিভিন্ন জেলায় সেনাবাহিনী পাঠানোর কাজটিও সম্পন্ন করা হয়। বাঙালি সংখ্যাধিক্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ড স্ট্রাকচার ভেঙে দিয়ে ব্যাটালিয়নগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। এতসব ব্যাটেল ইন্ডিকেশনের পরও আমাদের পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেই প্রশ্ন আজও মানুষের মনে তাড়া করে ফেরে। অনেকেই মনে করেন, দূরদর্শিতা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে প্রায় অপ্রস্তুতভাবেই বাঙালি সেদিন এক অসম লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছিল।
একাত্তরের মার্চের প্রথমভাগেই আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। এমনকি রংপুর সেনানিবাসে অবস্থিত ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্ট থেকে ট্যাংকবহর ঢাকায় এনে রাজপথে সহজেই যাতে অপারেট করা যায়, সে জন্য ট্যাংকের চাকার চেইনে রাবার বেল্ট লাগিয়ে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল।
এসব তৎপরতা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্স এবং চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারসহ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা তৎপর হয়ে ওঠেন। স্বাধীনতার অনেক পরে এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিত্বদের লেখা বিভিন্ন বই, নিবন্ধ ও বক্তব্য থেকে এ-সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। তাঁরা সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের কেউ সম্মুখ সমরযোদ্ধা ছিলেন, আবার কেউ প্রবাসী সরকারের স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন।
সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার। তিনি তখন একই সঙ্গে চট্টগ্রামের সামরিক আইন প্রশাসকও ছিলেন। ফলে বেসামরিক প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগসহ স্থানীয় অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের সুযোগ ছিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও হেডকোয়ার্টার্সের সঙ্গেও তাঁর সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
এ কারণে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগাম তথ্য পাওয়ার সুবিধাও ছিল তাঁর। এ ছাড়া একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে অভিজ্ঞতার আলোকে, সামরিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও ছিল। ২ মার্চ বিপুল পরিমাণ ভারী অস্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জামসহ পাকিস্তানি জাহাজ এমভি সোয়াত নোঙর করার পর, ২৪ মার্চ পর্যন্ত তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সব চাপ উপেক্ষা করে টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস বন্ধ রেখেছিলেন। ওদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করে অস্ত্র খালাসে বাধা দিয়েছিলেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার মনে করেছিলেন, পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতা সামরিকভাবেই মোকাবিলা করা সমীচীন হবে এবং সময় নষ্ট না করে তা যত দ্রুত করা যায় ততই মঙ্গল।
তবে, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার প্রয়োজন আছে। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন থেকে সরকারের সব বিভাগ তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেই চলছিল। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার এ বিষয়েও বঙ্গবন্ধুর অনুমতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেছিলেন। এমন চিন্তা থেকেই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলায় তাঁর পরিকল্পনার কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় অনুমতির জন্য ১৪ মার্চ ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীকে (পরে মেজর জেনারেল) ঢাকায় কর্নেল ওসমানীর (পরে জেনারেল) কাছে পাঠান। সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকাও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
ক্যাপ্টেন আমিন সেদিনই কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সামরিক পরিকল্পনা সবিস্তার খুলে বলেন। কর্নেল ওসমানী সব শোনার পর উচ্চতর রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে ক্যাপ্টেন আমিনকে বলেন, ‘তিনি বাঙালি সেনাদের দুশ্চিন্তার কারণগুলো চিহ্নিত করতে পারছেন, তাঁদের পরিকল্পনার সারবত্তাও উপলব্ধি করতে পারছেন। তবে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে দ্বিধামুক্ত নন। সংগত কারণেই তাঁরা আলোচনায় বসে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে বিশ্বাসী।
তাঁরা মনে করেন, বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে রাখার জন্য আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।’ এমতাবস্থায়, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ২১ মার্চ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীকে বলেন, ‘আমাদের হাতে সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই। শিগগিরই কিছু ঘটবে...কাজেই তিনি যেন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অনুমতি এনে দেন।’ ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের অনুরোধে এম আর সিদ্দিকী ঢাকায় গিয়ে ফিরে এসে বলেন, ‘রাজনৈতিক আলোচনা চলছে। আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে।’
এর দুদিন পর ২৪ মার্চ পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ ছলচাতুরীর মাধ্যমে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ঢাকায় আসার এক দিন পরেই ব্রিগেডিয়ার মজুমদার কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করে বলেন, ঢাকা সেনানিবাসের গোপন সূত্র থেকে তিনি খবর পেয়েছেন, ইয়াহিয়া খান কিছুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেবেন না। অসহযোগ আন্দোলন ঠেকাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শিগগিরই অভিযানে নামবে। ইতিপূর্বে যখন তিনি সেনা বিদ্রোহের পরিকল্পনা নিয়ে খবর পাঠিয়েছিলেন, তখন যদি অনুমতি দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ভালো কিছু করা যেত। জবাবে কর্নেল ওসমানী ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে বলেছিলেন, ‘তাঁকে ধৈর্য ধরতে হবে। কারণ শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সঙ্গে একটি সমঝোতায় এসেছেন।’ কর্নেল ওসমানী নাকি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে টেলিফোনে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে এ কথা বলেছিলেন।
কথিত আছে, মার্চের গোড়াতেই বেসামরিক ব্যক্তিদের মাধ্যমেও অনুরূপ তথ্যবার্তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।মার্চের ৩ বা ৪ তারিখ, ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সের ইন্টেলিজেন্স শাখার জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড-২, সংক্ষেপে জি-২ (আই), বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা মেজর মসিউদ দৌলা তাঁর সহকর্মী ক্যাপ্টেন সালামকে নিয়ে পাকিস্তানি ও বাঙালি সৈনিকদের তুলনামূলক সৈন্যসংখ্যা ও শক্তির পরিসংখ্যান তৈরি করেন।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছিলেন, তখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তানিদের তুলনায় বাঙালি যে সেনাসদস্য আছেন, তাতে সহজেই তাদের নিরস্ত্র করা সম্ভব। ছয়টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার, এয়ার ফোর্স, নেভি, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে কর্মরত সব বাঙালি সদস্যসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে তিনি এ বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাঁর সেই বার্তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অসহযোগ আন্দোলন দমনে শিগগিরই যে আক্রমণ শুরু করবে, সেই রণকৌশল সম্পর্কে নির্দিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ বিবরণও ছিল।
তিনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসংবলিত একটি মিলিটারি অপারেশনাল ম্যাপসহ তথ্যবার্তাটি তাঁর বোন প্রখ্যাত নজরুলসংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগমের মাধ্যমে উচ্চতর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ‘মূলধারা’ ৭১-এর লেখক মঈদুল হাসান তাঁর ‘উপধারা একাত্তর মার্চ-এপ্রিল’ বইয়ে দাবি করেছেন, ৫ মার্চ তিনি নিজে ওই একই তথ্য রাজনীতির উচ্চমহলে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি সেনাসদস্যদের যে সশস্ত্র বিদ্রোহের কথা বলা হয়েছে তা কতটুকু কার্যকর করা সম্ভব ছিল? নাকি রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আলোচনার পথে চলাই সেদিন সঠিক ছিল? ২৫ মার্চ কালরাত এবং তারও পরে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় যে লাখ লাখ বাঙালি জেনোসাইডের শিকার হয়েছিলেন, সে কথা বিবেচনা করে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রস্তুতির আগাম তথ্য পাওয়া সত্ত্বেও প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না কেন? আমাদের সশস্ত্র বাঙালি সদস্যরা তো প্রস্তুতই ছিলেন।
বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা যদি প্রথমেই নির্দেশ পেয়ে যেতেন যে স্বাধীনতার জন্য তাঁদের লড়তে হবে, তাহলে বেসামরিক প্রশাসনের সবাই যেমন পাকিস্তানিদের অসহযোগিতা করার নির্দেশ মেনে নিয়েছিলেন, তেমনি সশস্ত্র বাঙালি সদস্যরাও অস্ত্র হাতে তুলে নিতেন। এভাবে প্রথমেই যদি সব বাহিনীর সশস্ত্র বাঙালি সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হতো, তাহলে পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালির মৃত্যুর হার হয়তো আরও কম হতে পারত।
আবার অনেকেই মনে করেন, তখন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তাতে হঠাৎ করে একটি সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া কতটা সঠিক হতো। সেদিন রাজনৈতিক মহল থেকে বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এমন প্রশ্নও করা হয়েছিল, ‘আপনারা যে বিদ্রোহ করতে চান, আপনাদের কাছে কত অস্ত্র আছে?’ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভেবেছিলেন, রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধানে পৌঁছানো যাবে। এভাবে হঠাৎ করে আঘাত করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগের শুধু অজুহাতই পেত না, নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে সবকিছুর ওপরই আঘাত করত। নিরস্ত্র জাতি কি সেই আঘাত সহ্য করতে পারত? বহির্বিশ্বেই বা কী প্রতিক্রিয়া হতো?
এমন চিন্তাভাবনা সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আগেই করা হয়েছিল। সশস্ত্র পথে পা না বাড়িয়ে, আন্দোলনের গতি বজায় রেখে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখার কথাই তখন ভাবা হয়েছিল। তখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নেতারা হয়তো ভেবেছিলেন, আন্দোলনের গতি বজায় রাখলে এবং জনগণের একতা সংহত করা গেলে ইয়াহিয়া খানের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে সামরিক বলপ্রয়োগ করে তিনি যে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছেন, তা অর্জন করতে পারবেন না। সুতরাং তিনি হয়তো সে পথে আর পা বাড়াবেন না। কিন্তু বাস্তবে ২৫ মার্চ কালরাতে তাঁদের সেদিনের সেই চিন্তাভাবনার কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল
২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ৭ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে ভেঙে দিয়ে, চোরের মতো পালিয়ে যান সামরিক জান্তা জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান।
২৫ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টকে দেওয়া সংবিধানের খসড়ার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা এবং অনুমোদনের জন্য সময় নির্ধারণের কথা ছিল এদিন। ১৬ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত আলোচনায় তেমন কোনো অগ্রগতি না হলেও ২০ মার্চের বৈঠকে আওয়ামী লীগের দেওয়া তিনটি মৌলিক বিষয় প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।
এগুলো হলো—(১) সামরিক আইন প্রত্যাহার, (২) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং (৩) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন। পরবর্তী দুদিন তাঁরা নানা টালবাহানা করে সময় কাটিয়ে দেন। ২৩ মার্চ ঘোষণার খসড়া সংশোধন করতেই দিন পার হয়ে যায়। ২৪ মার্চ দুপুরের দিকে জানানো হয়, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার জেনারেল এস জি এম এম পীরজাদা ২৫ মার্চ কোনো একসময় ড. কামাল হোসেনকে প্রেসিডেন্টের ঘোষণাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের কথা টেলিফোনে জানিয়ে দেবেন। ২৫ মার্চ সারা দিন ধরেই আওয়ামী লীগের নেতারা টেলিফোনের অপেক্ষায় থাকেন, কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি। অথচ ড. কামালকে টেলিফোনে জানিয়ে দেওয়ার কথা যখন বলা হয়েছিল ঠিক তার কয়েক ঘণ্টা আগেই ২৪ মার্চ বেলা ১১টায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করা হয়। অতঃপর খুব দ্রুত বাংলাদেশের দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে।
২৫ মার্চ মধ্যরাতের আগেই ঢাকাসহ দেশের সব সেনানিবাস থেকে হালকা ও ভারী অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিনা নোটিশে, এমনভাবে যে হিংস্র হায়েনার শিকারে পরিণত হবে তার জন্য বাঙালি জাতি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। অথচ এর আয়োজন চলছিল অনেক আগে থেকেই। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকেই এ দেশে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাদের শক্তি বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। হাজার হাজার সৈনিক পাকিস্তান থেকে ঢাকায় উড়িয়ে আনা হয়।
অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদবোঝাই জাহাজ ‘এমভি সোয়াত’ তত দিনে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে গিয়েছিল। দুষ্কৃতকারী মোকাবিলায় দেশের বিভিন্ন জেলায় সেনাবাহিনী পাঠানোর কাজটিও সম্পন্ন করা হয়। বাঙালি সংখ্যাধিক্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ড স্ট্রাকচার ভেঙে দিয়ে ব্যাটালিয়নগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। এতসব ব্যাটেল ইন্ডিকেশনের পরও আমাদের পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেই প্রশ্ন আজও মানুষের মনে তাড়া করে ফেরে। অনেকেই মনে করেন, দূরদর্শিতা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে প্রায় অপ্রস্তুতভাবেই বাঙালি সেদিন এক অসম লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছিল।
একাত্তরের মার্চের প্রথমভাগেই আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। এমনকি রংপুর সেনানিবাসে অবস্থিত ২৯ ক্যাভালরি রেজিমেন্ট থেকে ট্যাংকবহর ঢাকায় এনে রাজপথে সহজেই যাতে অপারেট করা যায়, সে জন্য ট্যাংকের চাকার চেইনে রাবার বেল্ট লাগিয়ে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল।
এসব তৎপরতা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্স এবং চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারসহ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা তৎপর হয়ে ওঠেন। স্বাধীনতার অনেক পরে এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিত্বদের লেখা বিভিন্ন বই, নিবন্ধ ও বক্তব্য থেকে এ-সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। তাঁরা সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের কেউ সম্মুখ সমরযোদ্ধা ছিলেন, আবার কেউ প্রবাসী সরকারের স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন।
সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার। তিনি তখন একই সঙ্গে চট্টগ্রামের সামরিক আইন প্রশাসকও ছিলেন। ফলে বেসামরিক প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগসহ স্থানীয় অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের সুযোগ ছিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও হেডকোয়ার্টার্সের সঙ্গেও তাঁর সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
এ কারণে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগাম তথ্য পাওয়ার সুবিধাও ছিল তাঁর। এ ছাড়া একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে অভিজ্ঞতার আলোকে, সামরিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও ছিল। ২ মার্চ বিপুল পরিমাণ ভারী অস্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জামসহ পাকিস্তানি জাহাজ এমভি সোয়াত নোঙর করার পর, ২৪ মার্চ পর্যন্ত তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সব চাপ উপেক্ষা করে টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস বন্ধ রেখেছিলেন। ওদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারাও শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করে অস্ত্র খালাসে বাধা দিয়েছিলেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার মনে করেছিলেন, পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতা সামরিকভাবেই মোকাবিলা করা সমীচীন হবে এবং সময় নষ্ট না করে তা যত দ্রুত করা যায় ততই মঙ্গল।
তবে, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার প্রয়োজন আছে। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন থেকে সরকারের সব বিভাগ তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেই চলছিল। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার এ বিষয়েও বঙ্গবন্ধুর অনুমতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেছিলেন। এমন চিন্তা থেকেই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলায় তাঁর পরিকল্পনার কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় অনুমতির জন্য ১৪ মার্চ ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীকে (পরে মেজর জেনারেল) ঢাকায় কর্নেল ওসমানীর (পরে জেনারেল) কাছে পাঠান। সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকাও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
ক্যাপ্টেন আমিন সেদিনই কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সামরিক পরিকল্পনা সবিস্তার খুলে বলেন। কর্নেল ওসমানী সব শোনার পর উচ্চতর রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে ক্যাপ্টেন আমিনকে বলেন, ‘তিনি বাঙালি সেনাদের দুশ্চিন্তার কারণগুলো চিহ্নিত করতে পারছেন, তাঁদের পরিকল্পনার সারবত্তাও উপলব্ধি করতে পারছেন। তবে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে দ্বিধামুক্ত নন। সংগত কারণেই তাঁরা আলোচনায় বসে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে বিশ্বাসী।
তাঁরা মনে করেন, বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে রাখার জন্য আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।’ এমতাবস্থায়, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ২১ মার্চ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীকে বলেন, ‘আমাদের হাতে সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই। শিগগিরই কিছু ঘটবে...কাজেই তিনি যেন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অনুমতি এনে দেন।’ ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের অনুরোধে এম আর সিদ্দিকী ঢাকায় গিয়ে ফিরে এসে বলেন, ‘রাজনৈতিক আলোচনা চলছে। আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে।’
এর দুদিন পর ২৪ মার্চ পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ ছলচাতুরীর মাধ্যমে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ঢাকায় আসার এক দিন পরেই ব্রিগেডিয়ার মজুমদার কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করে বলেন, ঢাকা সেনানিবাসের গোপন সূত্র থেকে তিনি খবর পেয়েছেন, ইয়াহিয়া খান কিছুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেবেন না। অসহযোগ আন্দোলন ঠেকাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শিগগিরই অভিযানে নামবে। ইতিপূর্বে যখন তিনি সেনা বিদ্রোহের পরিকল্পনা নিয়ে খবর পাঠিয়েছিলেন, তখন যদি অনুমতি দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ভালো কিছু করা যেত। জবাবে কর্নেল ওসমানী ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে বলেছিলেন, ‘তাঁকে ধৈর্য ধরতে হবে। কারণ শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সঙ্গে একটি সমঝোতায় এসেছেন।’ কর্নেল ওসমানী নাকি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে টেলিফোনে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে এ কথা বলেছিলেন।
কথিত আছে, মার্চের গোড়াতেই বেসামরিক ব্যক্তিদের মাধ্যমেও অনুরূপ তথ্যবার্তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।মার্চের ৩ বা ৪ তারিখ, ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার্সের ইন্টেলিজেন্স শাখার জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড-২, সংক্ষেপে জি-২ (আই), বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা মেজর মসিউদ দৌলা তাঁর সহকর্মী ক্যাপ্টেন সালামকে নিয়ে পাকিস্তানি ও বাঙালি সৈনিকদের তুলনামূলক সৈন্যসংখ্যা ও শক্তির পরিসংখ্যান তৈরি করেন।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছিলেন, তখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তানিদের তুলনায় বাঙালি যে সেনাসদস্য আছেন, তাতে সহজেই তাদের নিরস্ত্র করা সম্ভব। ছয়টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার, এয়ার ফোর্স, নেভি, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে কর্মরত সব বাঙালি সদস্যসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে তিনি এ বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাঁর সেই বার্তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অসহযোগ আন্দোলন দমনে শিগগিরই যে আক্রমণ শুরু করবে, সেই রণকৌশল সম্পর্কে নির্দিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ বিবরণও ছিল।
তিনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসংবলিত একটি মিলিটারি অপারেশনাল ম্যাপসহ তথ্যবার্তাটি তাঁর বোন প্রখ্যাত নজরুলসংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগমের মাধ্যমে উচ্চতর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ‘মূলধারা’ ৭১-এর লেখক মঈদুল হাসান তাঁর ‘উপধারা একাত্তর মার্চ-এপ্রিল’ বইয়ে দাবি করেছেন, ৫ মার্চ তিনি নিজে ওই একই তথ্য রাজনীতির উচ্চমহলে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি সেনাসদস্যদের যে সশস্ত্র বিদ্রোহের কথা বলা হয়েছে তা কতটুকু কার্যকর করা সম্ভব ছিল? নাকি রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আলোচনার পথে চলাই সেদিন সঠিক ছিল? ২৫ মার্চ কালরাত এবং তারও পরে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় যে লাখ লাখ বাঙালি জেনোসাইডের শিকার হয়েছিলেন, সে কথা বিবেচনা করে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রস্তুতির আগাম তথ্য পাওয়া সত্ত্বেও প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না কেন? আমাদের সশস্ত্র বাঙালি সদস্যরা তো প্রস্তুতই ছিলেন।
বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা যদি প্রথমেই নির্দেশ পেয়ে যেতেন যে স্বাধীনতার জন্য তাঁদের লড়তে হবে, তাহলে বেসামরিক প্রশাসনের সবাই যেমন পাকিস্তানিদের অসহযোগিতা করার নির্দেশ মেনে নিয়েছিলেন, তেমনি সশস্ত্র বাঙালি সদস্যরাও অস্ত্র হাতে তুলে নিতেন। এভাবে প্রথমেই যদি সব বাহিনীর সশস্ত্র বাঙালি সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হতো, তাহলে পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালির মৃত্যুর হার হয়তো আরও কম হতে পারত।
আবার অনেকেই মনে করেন, তখন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তাতে হঠাৎ করে একটি সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া কতটা সঠিক হতো। সেদিন রাজনৈতিক মহল থেকে বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এমন প্রশ্নও করা হয়েছিল, ‘আপনারা যে বিদ্রোহ করতে চান, আপনাদের কাছে কত অস্ত্র আছে?’ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভেবেছিলেন, রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধানে পৌঁছানো যাবে। এভাবে হঠাৎ করে আঘাত করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগের শুধু অজুহাতই পেত না, নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে সবকিছুর ওপরই আঘাত করত। নিরস্ত্র জাতি কি সেই আঘাত সহ্য করতে পারত? বহির্বিশ্বেই বা কী প্রতিক্রিয়া হতো?
এমন চিন্তাভাবনা সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আগেই করা হয়েছিল। সশস্ত্র পথে পা না বাড়িয়ে, আন্দোলনের গতি বজায় রেখে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখার কথাই তখন ভাবা হয়েছিল। তখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নেতারা হয়তো ভেবেছিলেন, আন্দোলনের গতি বজায় রাখলে এবং জনগণের একতা সংহত করা গেলে ইয়াহিয়া খানের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে সামরিক বলপ্রয়োগ করে তিনি যে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছেন, তা অর্জন করতে পারবেন না। সুতরাং তিনি হয়তো সে পথে আর পা বাড়াবেন না। কিন্তু বাস্তবে ২৫ মার্চ কালরাতে তাঁদের সেদিনের সেই চিন্তাভাবনার কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
৬ ঘণ্টা আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
৮ ঘণ্টা আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে