আজকের পত্রিকা: দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল সংকট কী?
শহিদুল ইসলাম: প্রত্যেক মানুষের ভেতর সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে থাকে, তাকে জাগিয়ে তোলার কাজটা করে থাকে শিক্ষা। কিন্তু একটু গভীরে গেলে বোঝা যায়, শুধু আমাদের দেশে নয়, সমগ্র বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আমাদের দেশে আমরা যত বেশি শিক্ষিত হচ্ছি, তত বেশি দৈহিক পরিশ্রম থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। দৈহিক পরিশ্রমের প্রতি আমাদের একটা অনীহা। শিক্ষা-সংকটের কথা বলতে গেলে, ডারউইনের কথা বলতে হবে। তাঁর মানুষের ক্রমবিকাশ তত্ত্বের কথা আমরা জানি। তাঁর কিন্তু একটা শিক্ষাভাবনাও আছে। সেই শিক্ষাভাবনাটাও কিন্তু ক্রমবিকাশ তাত্ত্বিক। তিনি বলেছেন, জন্মের পর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত, অর্থাৎ স্কুলে যাওয়ার আগপর্যন্ত শিশুরা শিক্ষাটা প্রকৃতি ও পরিবারের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। সেই পর্যায়ের শিক্ষাটা তারা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পায় না। এই পাঁচ বছরে তারা কত কিছু যে শেখে। সেভাবে রিকশাওয়ালা, কৃষক বা নৌকার মাঝির সন্তানেরাও পরিবারের কাছ থেকে শিক্ষা পায়। পৃথিবীর এমন দেশও আছে, যেখানে মাটি নেই। পুরো ছোট্ট দেশটা পানির ওপরে ভাসমান। সেখানে দেখা যায়, দুই বছরের শিশুও সাঁতার জানে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুদের ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। এরপর তাদের পুতুল হিসেবে তৈরি করে। কেউ হয়তো বিরাট একটা পুতুল হিসেবে নাম করে আর কেউ হয়তো সেভাবে নাম করতে পারে না। এভাবে আমরা প্রকৃতি তত্ত্ব থেকে জানা বা কার্যকর করার ক্ষমতা থেকে দূরে সরে যাই। এটা হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাধারণ সংকট। এই সংকটটা তৈরি হয়েছে স্বাধীনতাহীনতা থেকে। আমরা মনে করি, একটা স্বাধীন দেশে বাস করছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে গঠিত শরীফ কমিশনের বক্তব্য ছিল, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ছাত্রদের জন্য পজিটিভ কাজ ছিল। এখন তো পাকিস্তান হয়েছে। আমরা তো স্বাধীন। তাহলে এখন কেন ছাত্ররা আন্দোলন করবে? বাংলাদেশের শাসকশ্রেণিও এখন তা-ই বলছে। আমাদের দেশটা এখন স্বাধীন। তাহলে ছাত্ররা কেন আন্দোলন করবে? এখন তো তারা শুধু পড়াশোনা করবে—মানে স্বাধীনতা আমাদের একটা ক্ষুদ্র গণ্ডিবদ্ধতার মধ্যে বেঁধে ফেলেছে।
শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম সংকট হলো, আমাদের জীবন থেকে স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের বোধ শেষ করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন এলেই শুধু গণতন্ত্রের একটা ঝোঁক আসে আর নির্বাচনের পর নেতারা গণতন্ত্রকে একটা ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখেন। এটা শুধু স্বাধীনতার সংকট নয়, শিক্ষা থেকে শুরু করে আমাদের জীবনের সবকিছুরই সংকট।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষা মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র সবার জন্য সেটা করছে না; বরং এটাকে সুযোগ ভাবতে শেখাচ্ছে। আপনি কী বলেন?
শহিদুল ইসলাম: ১৯৪৮ সালে ইউনেসকো সিদ্ধান্ত নেয়, শিক্ষা হলো মানুষের মৌলিক অধিকার। প্রতিটি শিশুর শিক্ষা অর্জনের অধিকার আছে। সেটা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। এতে স্বাক্ষর করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ হওয়ার পর এই সর্বজনীন সিদ্ধান্তকে কোনো সরকারই মানেনি।
আর বলা হয়েছিল, শিক্ষা খাতে মূল জাতীয় বাজেটের ৭ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই বরাদ্দ ২ শতাংশের আশপাশে ঘুরছে। গতবারের বাজেটে কিন্তু শিক্ষা খাত থেকে কর্তন করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এর মানে আমাদের মৌলিক অধিকারের কথা শাসকশ্রেণি শুধু মুখে বলে, কিন্তু তারা সেটা চায় না। তা চায় না কেন, সেটা তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলেছেন। আর সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমায় আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। মানুষকে যত অন্ধকারে রাখা যায়, তত শাসকশ্রেণির শাসন করতে সুবিধা হয়। এ জন্য সক্রেটিস গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যে জনগণ নিজেকেই চেনে না, তার ভোটে আমি কীভাবে নির্বাচিত হব? সে জন্য আমি এটা মানি না।
আজকের পত্রিকা: ২০১০ সালে একটা শিক্ষানীতি হয়েছিল। আবার নতুন পাঠ্যক্রম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এ রকম হওয়ার কারণ কী?
শহিদুল ইসলাম: কুদরাত-এ-খুদা কমিশন ছিল সত্যিকার অর্থে একটা শিক্ষা কমিশন। অনেক দিন ধরে নানা পেশার লোকের মতামত নিয়ে এটা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা সেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। এরপর যত কমিশন হয়েছে, তার কোনোটাই বাস্তবায়ন করা হয়নি। আমি কোনো বিশেষ দলের কথা বলছি না, শাসকশ্রেণির যে দলই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে এবং তারা যখন ক্ষমতায় যায়, আসলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা একটা বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে—এটা পরিষ্কার করে তলস্তয় তাঁর একটা বইয়ে বলেছেন। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর ছেলেমেয়েদের প্রচলিত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াননি। তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে একটি স্কুল করে বন্ধুবান্ধবসহ তাদের সন্তানদের পড়িয়েছেন।
আজকের পত্রিকা: মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশে থাকছে না। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
শহিদুল ইসলাম: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত যত সরকার এসেছে, এ ব্যর্থতা তাদের সবার। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে আইন করে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২১ দফার মধ্যে এ বিষয়ে একটা দাবি ছিল। ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যে এ বিষয়ে একটা দফা ছিল। স্বাধীনতার পরে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বঙ্গবন্ধুকে চাপ দিতে থাকে এবং দুই-তিন বছর পর তিনি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন। এটা আমাদের প্রাণের দাবি ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, উপাচার্য থেকে সবকিছু দলীয়করণ হয়ে গেল। স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন ভিসি নিয়োগের প্রক্রিয়া চালু করা গেল না?সেখানে দীর্ঘদিন ধরে সিনেটের অধিবেশন হয় না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচজন ছাত্র সিনেটে নির্বাচিত হয়। ১৯৮০, ৮৯ ও ৯০ সালে সিনেটের নির্বাচন হয়েছে। সিনেট নির্বাচন এখন আর হয় না। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার আইন অকার্যকর করা হয়েছে। এটা রাজনৈতিকভাবে করা হয়েছে।
সরকারের পরিচালনায় এখন যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে, তার আইনে চাকরির শর্ত হিসেবে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, তাঁরা কোনো রাজনৈতিক মতবাদ ধারণ করতে পারবেন, কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে উপাচার্য মনে করলে যে কারও চাকরি খেয়ে নিতে পারেন। কিন্তু তিয়াত্তর সালের আইনে সেটা নেই। সেটা অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ছিল। এখন দলীয় বিবেচনা ছাড়া কোথাও উপাচার্য নিয়োগ হয় না। মেধাবী শিক্ষার্থীরা এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাচ্ছে না। আমি একটা উদাহরণ দিতে পারি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ছেলে তাঁর বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। দ্বিতীয় স্থান অধিকারীর সঙ্গে তাঁর নম্বরের পার্থক্য ছিল ৯২। এত ভালো রেজাল্ট করার পরেও বিএনপির আমলে তাঁকে কিন্তু চাকরি দেওয়া হয়নি। শেষে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তিনি নিয়োগ পান। এটা আমার নিজের দেখা। তিনি সম্প্রতি ইউজিসি থেকে শ্রেষ্ঠ গবেষকের পুরস্কার পেয়েছেন। এমনিভাবে এখনো বর্তমান সরকারদলীয় সমর্থক না হওয়ার কারণে অনেকে নিয়োগ পাচ্ছে না।
আজকের পত্রিকা: প্রথম প্রশ্নের সূত্র ধরে বলতে চাই, প্রকৃতিগত শিক্ষা আবার আমরা কীভাবে শুরু করতে পারি?
শহিদুল ইসলাম: ১৮৩৫ সালে যে কাঠামোটা ইংরেজরা মেকলের মাধ্যমে চালু করল, এখন আমরা সে অবস্থায় ইচ্ছে করলেও ফিরে যেতে পারব না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন ‘শান্তিনিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করলেন? তিনি নিজেও কেন স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করলেন না? রবীন্দ্রনাথও চেয়েছিলেন প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা নিতে। ছোটবেলায় আমি নিজেও পুকুর-নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরেছি, লাঙল দিয়ে জমি চাষ করেছি। এটা আমি আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। যেহেতু তিনি কৃষক ছিলেন। এখনকার ছেলেরা নিশ্চয় সেটা পারবে না।
আদিম বা শিকারি যুগে যারা বাস করছিল, তাদের সন্তানেরা কিন্তু বড়দের অনুকরণ করেছে। অনুকরণ করা শিশুদের মস্ত বড় একটা চরিত্র। তারা কিন্তু অনুকরণ করা থেকে শেখে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি আমার ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রে না বুঝলেও আমার নাতির কাছ থেকে বুঝি, সে কীভাবে জিনিসগুলো শিখে ফেলছে। এখনকার শিশুরা মোবাইল ও ইউটিউব থেকে অনেক কিছু শিখছে।
৬ কোটি বছর পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে ডাইনোসর। এরপর ৩০০ থেকে ৪০০ বছর পর তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কিন্তু মনুষ্য সভ্যতার বয়স এখনো দেড় লাখ বছরও হয়নি। আমি এখানে আধুনিক বা হোমো সেপিয়েন্সের কথা বলছি। তার মধ্যে ১২ হাজার বছর আগে আমরা সভ্যতা শুরু করলাম। তার আগে আমরা ছিলাম বন্য। আদিম সমাজের লেখক মর্গানের বই পড়লে জানা যায় মানুষের সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসের কালপর্ব। কীভাবে মানুষ লড়াই করে এ অবস্থায় পৌঁছাল। সেখানে তো প্রকৃতির পাঠই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
শহিদুল ইসলাম: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল সংকট কী?
শহিদুল ইসলাম: প্রত্যেক মানুষের ভেতর সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে থাকে, তাকে জাগিয়ে তোলার কাজটা করে থাকে শিক্ষা। কিন্তু একটু গভীরে গেলে বোঝা যায়, শুধু আমাদের দেশে নয়, সমগ্র বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আমাদের দেশে আমরা যত বেশি শিক্ষিত হচ্ছি, তত বেশি দৈহিক পরিশ্রম থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। দৈহিক পরিশ্রমের প্রতি আমাদের একটা অনীহা। শিক্ষা-সংকটের কথা বলতে গেলে, ডারউইনের কথা বলতে হবে। তাঁর মানুষের ক্রমবিকাশ তত্ত্বের কথা আমরা জানি। তাঁর কিন্তু একটা শিক্ষাভাবনাও আছে। সেই শিক্ষাভাবনাটাও কিন্তু ক্রমবিকাশ তাত্ত্বিক। তিনি বলেছেন, জন্মের পর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত, অর্থাৎ স্কুলে যাওয়ার আগপর্যন্ত শিশুরা শিক্ষাটা প্রকৃতি ও পরিবারের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। সেই পর্যায়ের শিক্ষাটা তারা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পায় না। এই পাঁচ বছরে তারা কত কিছু যে শেখে। সেভাবে রিকশাওয়ালা, কৃষক বা নৌকার মাঝির সন্তানেরাও পরিবারের কাছ থেকে শিক্ষা পায়। পৃথিবীর এমন দেশও আছে, যেখানে মাটি নেই। পুরো ছোট্ট দেশটা পানির ওপরে ভাসমান। সেখানে দেখা যায়, দুই বছরের শিশুও সাঁতার জানে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুদের ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। এরপর তাদের পুতুল হিসেবে তৈরি করে। কেউ হয়তো বিরাট একটা পুতুল হিসেবে নাম করে আর কেউ হয়তো সেভাবে নাম করতে পারে না। এভাবে আমরা প্রকৃতি তত্ত্ব থেকে জানা বা কার্যকর করার ক্ষমতা থেকে দূরে সরে যাই। এটা হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাধারণ সংকট। এই সংকটটা তৈরি হয়েছে স্বাধীনতাহীনতা থেকে। আমরা মনে করি, একটা স্বাধীন দেশে বাস করছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে গঠিত শরীফ কমিশনের বক্তব্য ছিল, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ছাত্রদের জন্য পজিটিভ কাজ ছিল। এখন তো পাকিস্তান হয়েছে। আমরা তো স্বাধীন। তাহলে এখন কেন ছাত্ররা আন্দোলন করবে? বাংলাদেশের শাসকশ্রেণিও এখন তা-ই বলছে। আমাদের দেশটা এখন স্বাধীন। তাহলে ছাত্ররা কেন আন্দোলন করবে? এখন তো তারা শুধু পড়াশোনা করবে—মানে স্বাধীনতা আমাদের একটা ক্ষুদ্র গণ্ডিবদ্ধতার মধ্যে বেঁধে ফেলেছে।
শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম সংকট হলো, আমাদের জীবন থেকে স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের বোধ শেষ করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন এলেই শুধু গণতন্ত্রের একটা ঝোঁক আসে আর নির্বাচনের পর নেতারা গণতন্ত্রকে একটা ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখেন। এটা শুধু স্বাধীনতার সংকট নয়, শিক্ষা থেকে শুরু করে আমাদের জীবনের সবকিছুরই সংকট।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষা মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র সবার জন্য সেটা করছে না; বরং এটাকে সুযোগ ভাবতে শেখাচ্ছে। আপনি কী বলেন?
শহিদুল ইসলাম: ১৯৪৮ সালে ইউনেসকো সিদ্ধান্ত নেয়, শিক্ষা হলো মানুষের মৌলিক অধিকার। প্রতিটি শিশুর শিক্ষা অর্জনের অধিকার আছে। সেটা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। এতে স্বাক্ষর করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ হওয়ার পর এই সর্বজনীন সিদ্ধান্তকে কোনো সরকারই মানেনি।
আর বলা হয়েছিল, শিক্ষা খাতে মূল জাতীয় বাজেটের ৭ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই বরাদ্দ ২ শতাংশের আশপাশে ঘুরছে। গতবারের বাজেটে কিন্তু শিক্ষা খাত থেকে কর্তন করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এর মানে আমাদের মৌলিক অধিকারের কথা শাসকশ্রেণি শুধু মুখে বলে, কিন্তু তারা সেটা চায় না। তা চায় না কেন, সেটা তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলেছেন। আর সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমায় আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। মানুষকে যত অন্ধকারে রাখা যায়, তত শাসকশ্রেণির শাসন করতে সুবিধা হয়। এ জন্য সক্রেটিস গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যে জনগণ নিজেকেই চেনে না, তার ভোটে আমি কীভাবে নির্বাচিত হব? সে জন্য আমি এটা মানি না।
আজকের পত্রিকা: ২০১০ সালে একটা শিক্ষানীতি হয়েছিল। আবার নতুন পাঠ্যক্রম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এ রকম হওয়ার কারণ কী?
শহিদুল ইসলাম: কুদরাত-এ-খুদা কমিশন ছিল সত্যিকার অর্থে একটা শিক্ষা কমিশন। অনেক দিন ধরে নানা পেশার লোকের মতামত নিয়ে এটা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা সেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। এরপর যত কমিশন হয়েছে, তার কোনোটাই বাস্তবায়ন করা হয়নি। আমি কোনো বিশেষ দলের কথা বলছি না, শাসকশ্রেণির যে দলই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করে এবং তারা যখন ক্ষমতায় যায়, আসলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা একটা বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে—এটা পরিষ্কার করে তলস্তয় তাঁর একটা বইয়ে বলেছেন। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর ছেলেমেয়েদের প্রচলিত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াননি। তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে একটি স্কুল করে বন্ধুবান্ধবসহ তাদের সন্তানদের পড়িয়েছেন।
আজকের পত্রিকা: মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশে থাকছে না। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
শহিদুল ইসলাম: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত যত সরকার এসেছে, এ ব্যর্থতা তাদের সবার। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে আইন করে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের ২১ দফার মধ্যে এ বিষয়ে একটা দাবি ছিল। ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যে এ বিষয়ে একটা দফা ছিল। স্বাধীনতার পরে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বঙ্গবন্ধুকে চাপ দিতে থাকে এবং দুই-তিন বছর পর তিনি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন। এটা আমাদের প্রাণের দাবি ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, উপাচার্য থেকে সবকিছু দলীয়করণ হয়ে গেল। স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন ভিসি নিয়োগের প্রক্রিয়া চালু করা গেল না?সেখানে দীর্ঘদিন ধরে সিনেটের অধিবেশন হয় না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচজন ছাত্র সিনেটে নির্বাচিত হয়। ১৯৮০, ৮৯ ও ৯০ সালে সিনেটের নির্বাচন হয়েছে। সিনেট নির্বাচন এখন আর হয় না। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার আইন অকার্যকর করা হয়েছে। এটা রাজনৈতিকভাবে করা হয়েছে।
সরকারের পরিচালনায় এখন যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে, তার আইনে চাকরির শর্ত হিসেবে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, তাঁরা কোনো রাজনৈতিক মতবাদ ধারণ করতে পারবেন, কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে উপাচার্য মনে করলে যে কারও চাকরি খেয়ে নিতে পারেন। কিন্তু তিয়াত্তর সালের আইনে সেটা নেই। সেটা অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ছিল। এখন দলীয় বিবেচনা ছাড়া কোথাও উপাচার্য নিয়োগ হয় না। মেধাবী শিক্ষার্থীরা এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাচ্ছে না। আমি একটা উদাহরণ দিতে পারি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ছেলে তাঁর বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। দ্বিতীয় স্থান অধিকারীর সঙ্গে তাঁর নম্বরের পার্থক্য ছিল ৯২। এত ভালো রেজাল্ট করার পরেও বিএনপির আমলে তাঁকে কিন্তু চাকরি দেওয়া হয়নি। শেষে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর তিনি নিয়োগ পান। এটা আমার নিজের দেখা। তিনি সম্প্রতি ইউজিসি থেকে শ্রেষ্ঠ গবেষকের পুরস্কার পেয়েছেন। এমনিভাবে এখনো বর্তমান সরকারদলীয় সমর্থক না হওয়ার কারণে অনেকে নিয়োগ পাচ্ছে না।
আজকের পত্রিকা: প্রথম প্রশ্নের সূত্র ধরে বলতে চাই, প্রকৃতিগত শিক্ষা আবার আমরা কীভাবে শুরু করতে পারি?
শহিদুল ইসলাম: ১৮৩৫ সালে যে কাঠামোটা ইংরেজরা মেকলের মাধ্যমে চালু করল, এখন আমরা সে অবস্থায় ইচ্ছে করলেও ফিরে যেতে পারব না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেন ‘শান্তিনিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করলেন? তিনি নিজেও কেন স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করলেন না? রবীন্দ্রনাথও চেয়েছিলেন প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষা নিতে। ছোটবেলায় আমি নিজেও পুকুর-নদীতে জাল দিয়ে মাছ ধরেছি, লাঙল দিয়ে জমি চাষ করেছি। এটা আমি আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। যেহেতু তিনি কৃষক ছিলেন। এখনকার ছেলেরা নিশ্চয় সেটা পারবে না।
আদিম বা শিকারি যুগে যারা বাস করছিল, তাদের সন্তানেরা কিন্তু বড়দের অনুকরণ করেছে। অনুকরণ করা শিশুদের মস্ত বড় একটা চরিত্র। তারা কিন্তু অনুকরণ করা থেকে শেখে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি আমার ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রে না বুঝলেও আমার নাতির কাছ থেকে বুঝি, সে কীভাবে জিনিসগুলো শিখে ফেলছে। এখনকার শিশুরা মোবাইল ও ইউটিউব থেকে অনেক কিছু শিখছে।
৬ কোটি বছর পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে ডাইনোসর। এরপর ৩০০ থেকে ৪০০ বছর পর তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কিন্তু মনুষ্য সভ্যতার বয়স এখনো দেড় লাখ বছরও হয়নি। আমি এখানে আধুনিক বা হোমো সেপিয়েন্সের কথা বলছি। তার মধ্যে ১২ হাজার বছর আগে আমরা সভ্যতা শুরু করলাম। তার আগে আমরা ছিলাম বন্য। আদিম সমাজের লেখক মর্গানের বই পড়লে জানা যায় মানুষের সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসের কালপর্ব। কীভাবে মানুষ লড়াই করে এ অবস্থায় পৌঁছাল। সেখানে তো প্রকৃতির পাঠই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
শহিদুল ইসলাম: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে