বিভুরঞ্জন সরকার
আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগের দুটি নির্বাচন নিয়ে যেমন রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, হুবহু সে রকম না হলেও আগামী নির্বাচনটাও একেবারে সংকটমুক্ত পরিবেশে হচ্ছে, সেটা বলা যাচ্ছে না। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনেই অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল।
সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিনা ভোটে অর্জনের পর বাকি আসনগুলোর ভোট গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ওই নির্বাচন ভন্ডুল করার জন্য বিএনপি-জামায়াত ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছিল। তা সত্ত্বেও নির্বাচন হয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দল অংশ নিলেও, অসংখ্য ভোটার নিজেদের ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ শোনা গেছে। ওই নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ, ক্ষোভ-অসন্তোষ যা-ই থাক, সরকার তার মেয়াদকাল ঠিকই শেষ করছে।
তবে ওই দুটি নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মরক্ষার গণতন্ত্রের একটি বিশেষ ধরন আমাদের দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে সংযোজিত হয়েছে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ে বোদ্ধামহলে বিতর্ক থাকলেও সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে গোপন ব্যালটে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি বাছাই করা যে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য, সেটা নিয়ে খুব বিতর্ক আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে গত দুই নির্বাচনে গণতন্ত্রের এই সৌন্দর্যের হানি ঘটেছে।
আগামী নির্বাচনেও বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল অংশ নিচ্ছে না। তাহলে কি আগামী নির্বাচনও সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না? এবার দেখা যাক সুষ্ঠু বা ভালো নির্বাচন বলতে সাধারণভাবে আমরা কী বুঝি। নির্বাচন মানে হলো কিছু মানুষ একটি নির্দিষ্ট পদের জন্য প্রার্থী হবেন এবং একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ভোট দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে যাঁকে যোগ্য বিবেচনা করবেন, তাঁকে নির্বাচিত করবেন। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে, ভোটে একজন নয়, একাধিক প্রার্থী থাকতে হবে এবং ভোটারদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা থাকতে হবে। যাঁরা প্রার্থী হবেন, তাঁদের নিজ নিজ বক্তব্য প্রচারের সুযোগ থাকতে হবে এবং যাঁদের উদ্দেশে বলবেন, তাঁদের সেই বক্তব্য অবাধে শোনার সুযোগও থাকতে হবে। প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে যেমন কাউকে বাধা দেওয়া যাবে না, তেমনি ভোটারদেরও নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া চলবে না।
আর প্রার্থী ও ভোটারদের এই অধিকার নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব যদি কমিশন যথাযথভাবে পালন করে এবং ভোটে দাঁড়ানো ও ভোট দেওয়া যদি নির্বিঘ্ন হয়, তাহলেই সুষ্ঠু বা ভালো ভোট হয়। আরও একটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো, একটি নির্দিষ্ট আসন বা পদে ভোটে দাঁড়ান অনেকে, কিন্তু জয়লাভ করেন একজন। কাজেই নির্বাচন মানেই জয়-পরাজয়। জয়ের জন্য চেষ্টা করতে হবে এবং পরাজয় মেনে নিতে হবে। এটাও ভালো নির্বাচনের মাপকাঠি। জেতার জন্য যেমন বল প্রয়োগ করা চলবে না, তেমনি হেরে গেলেও কারও ওপর বদলা নেওয়ার মানসিকতা বাঞ্ছনীয় নয়।
এই জয়-পরাজয়ের খেলায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা রেফারির, ইসি কোনো বিশেষ পক্ষ নয়। খেলায় কেউ ফাউল করলে, খেলার নিয়ম ভঙ্গ করলে তাঁকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করার ক্ষমতা যেমন নির্বাচন কমিশনের আছে, তেমনি গুরুতর নিয়ম ভঙ্গ করলে লাল কার্ড দেখিয়ে ফাউল খেলোয়াড়কে মাঠ থেকে বের করে দেওয়ার ক্ষমতাও রেফারি বা নির্বাচন কমিশনের আছে। কিন্তু এই রেফারিংয়ের কাজটি নির্বাচন কমিশন ঠিকমতো করতে পারে না বলেই আমাদের দেশে নির্বাচন, ইসি, সিইসি—সবকিছু নিয়েই এখন চারদিকে ছি ছি শোনা যায়। আগামী নির্বাচন কেমন হবে, আমরা এখন তা দেখার অপেক্ষায়।
আমাদের দেশের রাজনীতি প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের, অন্য ভাগের নেতৃত্ব বিএনপির। দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে যে সংকট বা ঝামেলা, বিতর্ক, সেগুলোর সমাধান নির্ভর করে মূলত এ দুই দলের ওপরই। সমস্যা তৈরি হয়েছে এ দুই দলের ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার একরোখা প্রতিযোগিতা থেকেই। দুই দল হয়তো সমভাবে দোষী নয়। নিশ্চয়ই এক পক্ষের অন্যায্য আচরণের প্রতি কিছু মানুষের যুক্তিহীন পক্ষপাতিত্ব, অন্য পক্ষকেও অন্যায্যতার পথে চলতে প্ররোচিত করেছে।
যদি আমরা বলি, দেশের রাজনীতি সঠিক ধারায় চলছে না, রাজনীতিতে চলছে নীতিহীনতার উৎসব, তাহলে এটাও বলতে হবে যে রাজনীতিকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে সমান চাপ দিতে হবে ওই দুই দলের ওপরই। কিন্তু এখানেও আমাদের সমস্যা আছে। নানা কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে একধরনের অন্ধত্ব বেড়েছে। এই অন্ধ সমর্থকেরা যে অপরাধের জন্য প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে, নিজ দলের সেই একই অপরাধে কোনো দোষ খুঁজে পায় না।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, টানা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ নিয়ে মানুষের মধ্যে সমালোচনা বেড়েছে। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, এই দেশকে যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য শেখ হাসিনার এখনো বিকল্প নেই, তিনিই আমাদের শেষ ভরসা।
আবার এটা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ কম যে শেখ হাসিনা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যেভাবে নিরলস কাজ করছেন, সেভাবে তিনি প্রশংসিত হচ্ছেন না। বিশেষ করে বিএনপি ও তার মিত্ররা তো সারাক্ষণ শেখ হাসিনারই নিন্দা-সমালোচনা করছে। শেখ হাসিনার কোনো ভালোই তাদের চোখে পড়ে না। এই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি দুঃখজনক। কেন এটা ঘটছে?
আমার ইদানীং মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানে কোথাও বুঝি খামতি বা ঘাটতি আছে। মাঝে মাঝে দু-একজন চোর-বাটপার ধরা পড়লেও কারোরই বিচার হওয়ার নজির নেই। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটার দলকে হয়তো প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে দেখা যাওয়ার কথাও শোনা যায়। বিএনপি-জামায়াত আমলে দেশে জঙ্গি উত্থানের ঘটনা ঘটেছিল। আবার ওই আমলেই বাংলা ভাইসহ জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে তাদের বিচারও শুরু হয়েছিল। কিন্তু এ জন্য কি আমরা বিএনপি বা খালেদা জিয়ার ভূমিকাকে জঙ্গিবিরোধী বলে তারিফ করি? করি না। কারণ, ওটা ছিল রাজনৈতিক কৌশল, আন্তর্জাতিক চাপ এবং ক্ষমতায় থাকার হিসাব-নিকাশ।
শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতিবাজ বা চোরদের কেউ কেউ ধরা পড়ছে। কিন্তু বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে কতজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে? দুদক কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু করে বলে খবর শোনা যায়, কিন্তু ওই তদন্ত শেষ হওয়ার খবর আর শোনা যায় না। কোনোটা শেষ হলেও অভিযোগ প্রমাণিত হয় না। যারা ফেঁসে যায়, তারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই ফাঁসে। তার মানে, গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে। তো, এই তথ্য থাকার পরও চোরদের বছরের পর বছর চুরি করার সুযোগ দেওয়া হয় কেন?
আমি বারবার বলি, আওয়ামী লীগের অনেক সঞ্চয় আছে। কিন্তু সেই সঞ্চয়ের যেভাবে অপচয় হচ্ছে, তাতে দেউলিয়া হতেও বেশি সময় লাগবে না। মানুষের কাছে অসংগতিগুলো যখন ধরা পড়ে, তখন তারা হতাশ হয়, প্রশংসার পরিবর্তে তখন নিন্দা করে অথবা যারা নিন্দা করে, তাদের ‘সহমত’ ভাই-বোন হয়ে যায়!
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও যে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, তাতে সন্দেহ নেই। আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপি ক্ষমতার রাজনীতি থেকেও বছরের পর বছর দূরে থাকায় দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে দুশ্চিন্তা করছেন। এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, টানা চতুর্থ দফায় ক্ষমতাসীন হওয়া আওয়ামী লীগের জন্য কতটা মঙ্গলজনক হবে, সে আলোচনাটাও সামনে আসা উচিত।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল আলম সজলের একটি বক্তব্য ১২ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। নাজমুল আলম দলীয় এক সভায় বলেছেন, ‘রাজনীতিটা এমন অবস্থা হইছে যে, কোন দিকে কী করমু? কোন কথা কইলে নেতায় খুশি হইব, এটা বুঝতে বুঝতে ১৫ বছর গেছে গা। সামনের যেই রাজনীতি, তাতে আমার মনে হয় এবারের পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাটা ভালো হইব না, আওয়ামী লীগের জন্যেই। এখানে মিডিয়া আছে নাকি? যা-ই হোক, সত্য কথা কইয়া যদি হাইরা যাই, তাইলে যামু। কারণ, সংগঠন দুর্বল হইয়া যাইতাছে। নেতাদের ভালো হইতাছে আর কর্মীদের ভালো হইতাছে না। মুজিব আদর্শের যেই সংগঠন, সেই সংগঠন আমরা পাইতাছি না। আর ভবিষ্যতেও পামু না আমার মনে হয়। তাই মাঝে মাঝে বিরোধী দল থাকাটাই সংগঠনের জন্য প্রয়োজন।’
নাজমুল আলম দলের কোনো বড় নেতা না হলেও তাঁর বক্তব্যটি যদি নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হয়, তাহলে মন্দ হবে না। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকাই কোনো রাজনৈতিক দলের শক্তি বা জনপ্রিয়তার পরিচয় বহন করে না। ভারতের কয়েকটি রাজ্যে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে তিন দশকের বেশি সময় বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকার পর এখন কী অবস্থা?
শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে রোগে ধরেছে। মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদ কী পরিমাণে বেড়েছে, সেই খবর প্রতিদিন সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। এ অবস্থায় দরকার সরকারি প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে ধারাবাহিক শুদ্ধি অভিযান। যেখানে রোগমুক্তির জন্য শল্যচিকিৎসা দরকার, সেখানে টোটকা চিকিৎসা করালে উপকার পাওয়া যাবে কীভাবে?
বলা হয় ‘সিস্টেম’ বদল করা সহজ নয়। তাই ‘সমঝোতা’ করেই চলতে হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সমঝোতার পথ আত্মঘাতী। চিলির আলেন্দে বাঁচেননি, কিউবার কাস্ত্রো বেঁচেছেন। মৌচাকে ঢিল দিয়ে মৌমাছির কামড় সহ্য করলেই না মধু পাওয়া যায়। যাঁরা দেশপ্রেম থেকে, দায়িত্ববোধ থেকে কথা বলার চেষ্টা করেন, তাঁদের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু অতি অনুগতরা বিপদের দিনে লাপাত্তা হলেও যাঁদের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তাঁরা বিপদের মুহূর্তেও ঠিকই পাশে থাকবেন। খারাপ সময়ে কাছে পাওয়া যাবে না ‘চাটার দল’কে। তাই চাটার দল হতে সময় থাকতেই সাবধান হওয়া জরুরি!
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগের দুটি নির্বাচন নিয়ে যেমন রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, হুবহু সে রকম না হলেও আগামী নির্বাচনটাও একেবারে সংকটমুক্ত পরিবেশে হচ্ছে, সেটা বলা যাচ্ছে না। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনেই অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল।
সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিনা ভোটে অর্জনের পর বাকি আসনগুলোর ভোট গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ওই নির্বাচন ভন্ডুল করার জন্য বিএনপি-জামায়াত ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছিল। তা সত্ত্বেও নির্বাচন হয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দল অংশ নিলেও, অসংখ্য ভোটার নিজেদের ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ শোনা গেছে। ওই নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ, ক্ষোভ-অসন্তোষ যা-ই থাক, সরকার তার মেয়াদকাল ঠিকই শেষ করছে।
তবে ওই দুটি নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মরক্ষার গণতন্ত্রের একটি বিশেষ ধরন আমাদের দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে সংযোজিত হয়েছে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ে বোদ্ধামহলে বিতর্ক থাকলেও সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে গোপন ব্যালটে ভোট দিয়ে প্রতিনিধি বাছাই করা যে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য, সেটা নিয়ে খুব বিতর্ক আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে গত দুই নির্বাচনে গণতন্ত্রের এই সৌন্দর্যের হানি ঘটেছে।
আগামী নির্বাচনেও বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল অংশ নিচ্ছে না। তাহলে কি আগামী নির্বাচনও সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না? এবার দেখা যাক সুষ্ঠু বা ভালো নির্বাচন বলতে সাধারণভাবে আমরা কী বুঝি। নির্বাচন মানে হলো কিছু মানুষ একটি নির্দিষ্ট পদের জন্য প্রার্থী হবেন এবং একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী ভোট দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে যাঁকে যোগ্য বিবেচনা করবেন, তাঁকে নির্বাচিত করবেন। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে, ভোটে একজন নয়, একাধিক প্রার্থী থাকতে হবে এবং ভোটারদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা থাকতে হবে। যাঁরা প্রার্থী হবেন, তাঁদের নিজ নিজ বক্তব্য প্রচারের সুযোগ থাকতে হবে এবং যাঁদের উদ্দেশে বলবেন, তাঁদের সেই বক্তব্য অবাধে শোনার সুযোগও থাকতে হবে। প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে যেমন কাউকে বাধা দেওয়া যাবে না, তেমনি ভোটারদেরও নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া চলবে না।
আর প্রার্থী ও ভোটারদের এই অধিকার নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব যদি কমিশন যথাযথভাবে পালন করে এবং ভোটে দাঁড়ানো ও ভোট দেওয়া যদি নির্বিঘ্ন হয়, তাহলেই সুষ্ঠু বা ভালো ভোট হয়। আরও একটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো, একটি নির্দিষ্ট আসন বা পদে ভোটে দাঁড়ান অনেকে, কিন্তু জয়লাভ করেন একজন। কাজেই নির্বাচন মানেই জয়-পরাজয়। জয়ের জন্য চেষ্টা করতে হবে এবং পরাজয় মেনে নিতে হবে। এটাও ভালো নির্বাচনের মাপকাঠি। জেতার জন্য যেমন বল প্রয়োগ করা চলবে না, তেমনি হেরে গেলেও কারও ওপর বদলা নেওয়ার মানসিকতা বাঞ্ছনীয় নয়।
এই জয়-পরাজয়ের খেলায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা রেফারির, ইসি কোনো বিশেষ পক্ষ নয়। খেলায় কেউ ফাউল করলে, খেলার নিয়ম ভঙ্গ করলে তাঁকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করার ক্ষমতা যেমন নির্বাচন কমিশনের আছে, তেমনি গুরুতর নিয়ম ভঙ্গ করলে লাল কার্ড দেখিয়ে ফাউল খেলোয়াড়কে মাঠ থেকে বের করে দেওয়ার ক্ষমতাও রেফারি বা নির্বাচন কমিশনের আছে। কিন্তু এই রেফারিংয়ের কাজটি নির্বাচন কমিশন ঠিকমতো করতে পারে না বলেই আমাদের দেশে নির্বাচন, ইসি, সিইসি—সবকিছু নিয়েই এখন চারদিকে ছি ছি শোনা যায়। আগামী নির্বাচন কেমন হবে, আমরা এখন তা দেখার অপেক্ষায়।
আমাদের দেশের রাজনীতি প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের, অন্য ভাগের নেতৃত্ব বিএনপির। দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে যে সংকট বা ঝামেলা, বিতর্ক, সেগুলোর সমাধান নির্ভর করে মূলত এ দুই দলের ওপরই। সমস্যা তৈরি হয়েছে এ দুই দলের ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার একরোখা প্রতিযোগিতা থেকেই। দুই দল হয়তো সমভাবে দোষী নয়। নিশ্চয়ই এক পক্ষের অন্যায্য আচরণের প্রতি কিছু মানুষের যুক্তিহীন পক্ষপাতিত্ব, অন্য পক্ষকেও অন্যায্যতার পথে চলতে প্ররোচিত করেছে।
যদি আমরা বলি, দেশের রাজনীতি সঠিক ধারায় চলছে না, রাজনীতিতে চলছে নীতিহীনতার উৎসব, তাহলে এটাও বলতে হবে যে রাজনীতিকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে সমান চাপ দিতে হবে ওই দুই দলের ওপরই। কিন্তু এখানেও আমাদের সমস্যা আছে। নানা কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে একধরনের অন্ধত্ব বেড়েছে। এই অন্ধ সমর্থকেরা যে অপরাধের জন্য প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে, নিজ দলের সেই একই অপরাধে কোনো দোষ খুঁজে পায় না।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, টানা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগ নিয়ে মানুষের মধ্যে সমালোচনা বেড়েছে। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, এই দেশকে যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য শেখ হাসিনার এখনো বিকল্প নেই, তিনিই আমাদের শেষ ভরসা।
আবার এটা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ কম যে শেখ হাসিনা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যেভাবে নিরলস কাজ করছেন, সেভাবে তিনি প্রশংসিত হচ্ছেন না। বিশেষ করে বিএনপি ও তার মিত্ররা তো সারাক্ষণ শেখ হাসিনারই নিন্দা-সমালোচনা করছে। শেখ হাসিনার কোনো ভালোই তাদের চোখে পড়ে না। এই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি দুঃখজনক। কেন এটা ঘটছে?
আমার ইদানীং মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানে কোথাও বুঝি খামতি বা ঘাটতি আছে। মাঝে মাঝে দু-একজন চোর-বাটপার ধরা পড়লেও কারোরই বিচার হওয়ার নজির নেই। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটার দলকে হয়তো প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে দেখা যাওয়ার কথাও শোনা যায়। বিএনপি-জামায়াত আমলে দেশে জঙ্গি উত্থানের ঘটনা ঘটেছিল। আবার ওই আমলেই বাংলা ভাইসহ জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে তাদের বিচারও শুরু হয়েছিল। কিন্তু এ জন্য কি আমরা বিএনপি বা খালেদা জিয়ার ভূমিকাকে জঙ্গিবিরোধী বলে তারিফ করি? করি না। কারণ, ওটা ছিল রাজনৈতিক কৌশল, আন্তর্জাতিক চাপ এবং ক্ষমতায় থাকার হিসাব-নিকাশ।
শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতিবাজ বা চোরদের কেউ কেউ ধরা পড়ছে। কিন্তু বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে কতজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে? দুদক কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু করে বলে খবর শোনা যায়, কিন্তু ওই তদন্ত শেষ হওয়ার খবর আর শোনা যায় না। কোনোটা শেষ হলেও অভিযোগ প্রমাণিত হয় না। যারা ফেঁসে যায়, তারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই ফাঁসে। তার মানে, গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য আছে। তো, এই তথ্য থাকার পরও চোরদের বছরের পর বছর চুরি করার সুযোগ দেওয়া হয় কেন?
আমি বারবার বলি, আওয়ামী লীগের অনেক সঞ্চয় আছে। কিন্তু সেই সঞ্চয়ের যেভাবে অপচয় হচ্ছে, তাতে দেউলিয়া হতেও বেশি সময় লাগবে না। মানুষের কাছে অসংগতিগুলো যখন ধরা পড়ে, তখন তারা হতাশ হয়, প্রশংসার পরিবর্তে তখন নিন্দা করে অথবা যারা নিন্দা করে, তাদের ‘সহমত’ ভাই-বোন হয়ে যায়!
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও যে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, তাতে সন্দেহ নেই। আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপি ক্ষমতার রাজনীতি থেকেও বছরের পর বছর দূরে থাকায় দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে দুশ্চিন্তা করছেন। এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, টানা চতুর্থ দফায় ক্ষমতাসীন হওয়া আওয়ামী লীগের জন্য কতটা মঙ্গলজনক হবে, সে আলোচনাটাও সামনে আসা উচিত।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল আলম সজলের একটি বক্তব্য ১২ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। নাজমুল আলম দলীয় এক সভায় বলেছেন, ‘রাজনীতিটা এমন অবস্থা হইছে যে, কোন দিকে কী করমু? কোন কথা কইলে নেতায় খুশি হইব, এটা বুঝতে বুঝতে ১৫ বছর গেছে গা। সামনের যেই রাজনীতি, তাতে আমার মনে হয় এবারের পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাটা ভালো হইব না, আওয়ামী লীগের জন্যেই। এখানে মিডিয়া আছে নাকি? যা-ই হোক, সত্য কথা কইয়া যদি হাইরা যাই, তাইলে যামু। কারণ, সংগঠন দুর্বল হইয়া যাইতাছে। নেতাদের ভালো হইতাছে আর কর্মীদের ভালো হইতাছে না। মুজিব আদর্শের যেই সংগঠন, সেই সংগঠন আমরা পাইতাছি না। আর ভবিষ্যতেও পামু না আমার মনে হয়। তাই মাঝে মাঝে বিরোধী দল থাকাটাই সংগঠনের জন্য প্রয়োজন।’
নাজমুল আলম দলের কোনো বড় নেতা না হলেও তাঁর বক্তব্যটি যদি নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হয়, তাহলে মন্দ হবে না। দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকাই কোনো রাজনৈতিক দলের শক্তি বা জনপ্রিয়তার পরিচয় বহন করে না। ভারতের কয়েকটি রাজ্যে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে তিন দশকের বেশি সময় বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকার পর এখন কী অবস্থা?
শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে রোগে ধরেছে। মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদ কী পরিমাণে বেড়েছে, সেই খবর প্রতিদিন সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। এ অবস্থায় দরকার সরকারি প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে ধারাবাহিক শুদ্ধি অভিযান। যেখানে রোগমুক্তির জন্য শল্যচিকিৎসা দরকার, সেখানে টোটকা চিকিৎসা করালে উপকার পাওয়া যাবে কীভাবে?
বলা হয় ‘সিস্টেম’ বদল করা সহজ নয়। তাই ‘সমঝোতা’ করেই চলতে হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সমঝোতার পথ আত্মঘাতী। চিলির আলেন্দে বাঁচেননি, কিউবার কাস্ত্রো বেঁচেছেন। মৌচাকে ঢিল দিয়ে মৌমাছির কামড় সহ্য করলেই না মধু পাওয়া যায়। যাঁরা দেশপ্রেম থেকে, দায়িত্ববোধ থেকে কথা বলার চেষ্টা করেন, তাঁদের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। কিন্তু অতি অনুগতরা বিপদের দিনে লাপাত্তা হলেও যাঁদের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তাঁরা বিপদের মুহূর্তেও ঠিকই পাশে থাকবেন। খারাপ সময়ে কাছে পাওয়া যাবে না ‘চাটার দল’কে। তাই চাটার দল হতে সময় থাকতেই সাবধান হওয়া জরুরি!
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে