দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: হতাশ বিএনপি তবু আশায়

রেজা করিম, ঢাকা
প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ১০: ০৩
আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২৩, ১০: ০৩

হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিয়েও নির্বাচনের তফসিল ঠেকাতে না পেরে হতাশ বিএনপি। পরিস্থিতি বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। তাঁরা মনে করছেন, নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে চলমান এক দফা আন্দোলন সফল পরিণতির দিকে যাওয়ার সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান গতকাল শুক্রবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সত্যের জয় হবেই। সরকারের সকল রকম উসকানি ও দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে আমাদের এই প্রতিবাদ আন্দোলন চলতেই থাকবে।’

সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের দাবিতে এক দফা আন্দোলন করছে বিএনপি ও দলটির সমমনা অনেক দল ও জোট। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশ ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি এই আন্দোলনের গতিতে পরিবর্তন আনে। সংঘর্ষে পণ্ড হওয়া ওই মহাসমাবেশের পরের দিনই দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে বিএনপিসহ বিরোধীরা। এর পর থেকে বিরতি দিয়ে পাঁচ দফায় দেশব্যাপী ১১ দিনের সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি পালন করে তারা। গতকাল সকালে শেষ দফার অবরোধ শেষ হয়েছে। এর মাঝেই ১৫ নভেম্বর আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এবার তফসিল প্রত্যাখ্যান করে আগামীকাল রোববার থেকে সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে বিএনপি। যথারীতি যুগপৎ আন্দোলনের শরিকেরাসহ আরও অনেক দল একই কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।

বিএনপিসহ এক দফা আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন দল ও জোটের সূত্রগুলো বলছে, পরিকল্পনা ছিল তফসিল ঘোষণার আগেই এক দফা আন্দোলনের চূড়ান্ত দফা শুরু হবে। এই দফায় স্বল্প সময়ে (৭ থেকে ১০ দিন) কঠোর কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সফল পরিণতি ঘটানো হবে। সে অনুযায়ী গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ আয়োজনের মধ্য দিয়ে সেই যাত্রাও শুরু হয়। কিন্তু ওই মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরির মধ্য দিয়ে সেদিন থেকেই হোঁচট খায় আন্দোলনের গতি।

২৮ অক্টোবরের পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ এরই মধ্যে অনেক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন, আসামি হয়েছেন আরও অনেকে। গ্রেপ্তারের ভয়ে নেতা-কর্মীরা বাড়িঘর ছেড়ে যে যার মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আত্মগোপনে থাকা দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছেন না। কর্মসূচি পালন করার মতো নেতা-কর্মীকে মাঠে পাওয়া যাচ্ছে না। হরতাল ও লাগাতার অবরোধ করেও তাই সরকারকে তারা চাপে ফেলতে পারেনি। যে কারণে অনেকটা নির্বিঘ্নেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।

এ অবস্থায় স্বল্পমেয়াদি চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। তাঁরা বলছেন, তফসিল ঠেকানো না গেলে নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করা হবে। এমনকি নির্বাচন হয়ে গেলেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে আবারও দুই দিনের হরতাল ডেকেছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো।

সরকারের বিরুদ্ধে দমন-নিপীড়নের অভিযোগ এনে আবদুল মঈন খান বলেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারের অস্ত্র হচ্ছে টিয়ার গ্যাস, জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেড, বুলেট-বন্দুক। আর আমাদের বিরোধী দলসমূহের অস্ত্র হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ। তা সত্ত্বেও আমাদের নৈতিক সংগ্রাম চলতেই থাকবে। নেতা-কর্মীদের মনোবল সমুচ্চ রেখেই তা চলতে থাকবে।’

গতকাল বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের চিত্র তুলে ধরেন আত্মগোপনে থাকা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, গত ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপির প্রায় ১৩ হাজার নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে এ সময়ে ৪ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন এবং প্রাণ হারিয়েছেন ১৩ জন। গত ২৪ ঘণ্টায়ই বিএনপির অন্তত ৪০০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান রিজভী।

সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, ‘একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করতে জনগণ প্রাণ হাতে নিয়ে সংগ্রাম করছে। জনগণের ক্ষমতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলন সকল স্বৈরাচারীর জন্য হবে সতর্কবার্তা। দেড় দশক ধরে রাজনৈতিক সংকট এখন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’

আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ জানিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে লড়াই শুরু হয়েছে, জনগণই সেই লড়াই চালিয়ে যাবে। এই লড়াইয়ে পরাজয়ের কোনো জায়গা নেই। আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে।’

গ্রেপ্তার-মামলার বাইরেও আগামী নির্বাচন ঘিরে নানা ষড়যন্ত্র চলছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা এই অভিযোগ করেন। তাঁরা বলছেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের জেলে ঢুকিয়ে, দমন-পীড়ন করেই সরকার ক্ষান্ত হচ্ছে না। তারা এখন দলের কিছুসংখ্যক নেতাকে নির্বাচনে আনার চেষ্টা করছে। নতুন দল গঠন, তাতে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতাদের যোগদান এবং অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার বক্তব্যে এর আলামত পাওয়া গেছে। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের ক্ষেত্রেও এমনটা হচ্ছে বলে জানান দলগুলোর নেতারা।

নেতারা বলছেন, এক দফা আন্দোলন থেকে সরে আসতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা আছে, বিভিন্ন দলের প্রভাবশালী এমন নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আন্দোলন থেকে সরে আসতে তাদের সংসদ সদস্য হওয়ার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। কাউকে কাউকে সরাসরি চাপ দেওয়া হচ্ছে, আবার কাউকে অর্থের লোভও দেখানো হচ্ছে। নির্বাচনে এলে টাকা দেবে, এমপি বানাবে। না এলে পুরোনো মামলা সচল করা হবে। প্রয়োজনে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য সর্বাত্মক সহায়তা করা হবে। 

জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সভাপতি লুৎফর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, একতরফা নির্বাচন করতে সরকার এক দফা আন্দোলনকে নেতাশূন্য করার চেষ্টা চলছে। এর অংশ হিসেবে গ্রেপ্তার-মামলার পাশাপাশি অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বিভিন্ন দলকে আন্দোলন থেকে সরে আসতে নানা প্রলোভন দেখানো হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত