অজয় দাশগুপ্ত
আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে মাঝে মাঝে এমন সব নারী জন্ম নেন, যাঁরা দেশ সমাজ কালের গণ্ডি পেরিয়ে বড় হয়ে ওঠেন। সেই কবে এ দেশে বেগম রোকেয়ার জন্ম হয়েছিল। ভাবা যায়, সে সময় অবরোধবাসিনী এমন সব কথা লিখেছেন, যা এখনো পুরুষেরা নিতে পারে না? ১৮৮০ সালে জন্মেছিলেন তিনি। পিতার ভয়ে চৌহদ্দি পার হতেন না, ষোলো বছরে উর্দুভাষী সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে নিকাহ, অথচ মাথায় ঢুকে ছিল স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। কী সেই বাণী? ‘পাখি কখনো এক ডানায় উড়িতে পারে না।’
একটি ডানার নাম পুরুষ, তো আরেকটি নারী। কী দুঃসাহস! বললেন কিনা, জাগো মা তুমি দাসী নও, জাগো বোন তুমি কোনো জড়োয়া গহনার বাক্স নও। নও সাজানো অলংকার। সে যুগের মুসলিম নারীদের স্যালুট জানাই। রংপুরের পায়রাবন্দের মেয়ের ‘সুলতানা’স ড্রিম’ হয়ে গেল ইউরোপস্বীকৃত ক্ল্যাসিক।
তিনি ছিলেন বটে কালজয়ী বাঙালি নারী এবং অলৌকিক এক শক্তির আধার। না হলে কি ৯ ডিসেম্বর জন্মে ৯ ডিসেম্বরেই বিদায় নিতেন?
২.
রবীন্দ্রনাথ কেন জানি সব জানতেন। এই লোকটা মনে হয় মনোবিজ্ঞানী, ঈশ্বরের দূতও। কত আগে লিখে রেখে গেছেন,
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে,
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু
নিভাইছে তব আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ
তুমি কি বেসেছো ভালো?
প্রীতিলতা যখন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তখন আমরা ছিলাম ব্রিটিশ শাসনের অধীনে পরাধীন কিন্তু অন্তর্জগতে স্বাধীন একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি। বাঙালির ধারণা ছিল ব্রিটিশ গেলেই বাংলা মুক্ত হবে, আবার পাল, সেন বা আকবর আমলের সৌন্দর্যে এক হয়ে বসবাস করবে। কিংবা ভেবেছিল স্বাধীন দেশে বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান থাকবে আত্মীয়ের মতো।
প্রীতিলতা চাইলেই একটা স্বাভাবিক সুন্দর জীবন যাপন করতে পারতেন। পিতা জগদ্বন্ধু বাবু হেড কেরানি। কিন্তু মেয়ে তাঁর প্রতিভাময়ী। মেয়ের মায়ের নামও যে প্রতিভা দেবী। মেয়েটি ঢাকা ইডেন কলেজে আইএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম, সম্মিলিত মেধাতালিকায় পঞ্চম। জলপানির বিশ টাকায় তাঁর পড়ার খরচ চলবে বলে চলে গেলেন বেথুন কলেজে। সেই কলেজে তাঁর অধীত প্রিয় বিষয় ছিল দর্শন। এ নিয়ে অনার্স করার ইচ্ছে থাকলেও দেশপ্রেমের বিপ্লবী চেতনা তখন তাঁর মগজকে প্রভাবিত করে ফেলায় তা পারেননি। কিন্তু বিএ পাস করেন ডিস্টিংশন নিয়ে।
এগুলো বলার উদ্দেশ্য একটাই। এত মেধাবী এক নারী যিনি কিনা নব্বই বছর আগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেন, তিনি চাইলে কত কিছু হতে পারতেন। নাটক লিখেছেন সে বয়সে। বেথুন কলেজের ছাদে বসে বাঁশি বাজিয়ে মন জয় করেছিলেন সবার। কিন্তু তাঁর মনজুড়ে তখন স্বদেশ আর বিপ্লবী সূর্য সেনের চেতনা। সে বয়সে বেপরোয়া এই তরুণী কেন এমন একটি অপারেশনে যোগ দিয়েছিলেন, যা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি? এর কারণ জাতির জন্য, বাঙালির আত্মমর্যাদার জন্য তাঁর ভালোবাসাবোধ।
পাহাড়তলীর চূড়ায় ব্রিটিশদের ক্লাবঘরে কী সাইনবোর্ড ঝুলত জানেন? ‘কুকুর ও দেশীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। এই ‘দেশীয়’ মানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা। প্রীতিলতা এই অপমান মেনে নিতে পারেননি। দুবারের ব্যর্থতার পর তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় মরণ অভিযান। একপর্যায়ে যখন ধরা পড়ার সময় এল, তিনি বেছে নিলেন স্বেচ্ছামরণ। পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দিলেন বটে, হয়ে রইলেন প্রথম নারী শহীদ।
কিন্তু তিনি জানেন না আজকের স্বাধীন সমাজে সৌজন্যের ফুলমালা আর পুষ্পস্তবকের আড়ালে মুছে যাওয়া এক নাম ‘প্রীতিলতা’; যে নামের সঙ্গে ধর্ম পরিচয় জড়িয়ে তাঁকে নিরন্তর অপমান আর এড়িয়ে চলাই নিয়ম। তাঁর কথা কবিতা, গদ্যে, নাটক, গানে মিটিমিটি তারার মতো জ্বললেও খবর পায় না মানুষ।
জানি না, চলে যাওয়ার পর মানুষের আত্মা বলে আসলেই কিছু আছে কি নেই। থাকলে তিনি আজ শোকার্ত হতেন। এই বাংলায় নারীশক্তির মতো আতঙ্ক আর বিপদে কে আছে এখন? তার ঘরে-বাইরে-সমাজে শুধু হায়েনা আর লোভীদের বিচরণ।
প্রীতিলতার বিদায়ের পর এই ভূখণ্ড দু-দুবার স্বাধীন হওয়ার পরও নুসরাত, মিতু কিংবা এমন অনেকে নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারে না। জেনে অবাক হতে হয় না, ঝুমন দাসের মতো নিরীহ মানুষও পচে মরে অন্ধকারে। মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান বলে যতই গর্ব করি না কেন, প্রীতিলতার আত্মদান আজ সত্যি বিবর্ণ, শুধু ইতিহাসে আর কিছু মানুষের মনে সে এক শক্তির আধার। বীরকন্যাকে প্রণাম।
৩.
রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে মধ্যপন্থী ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ও ভাবনা কী, সেটা তাঁর বাড়িতে আসা একটি টেলিফোন কলেই বোঝা গিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদ লিখছেন, কন্যার ব্যগ্রতা ও ছোটাছুটি দেখে তিনি বুঝতে পারছিলেন বিশেষ কেউ ফোন করেছেন। এবং ফোন তুলে তিনি যখন শুনলেন এই মহীয়সী রমণীর কণ্ঠ, নিজেও আপ্লুত হয়েছিলেন। তিনি ফোন করেছিলেন, এই আনন্দ একজন বিখ্যাত জনপ্রিয় লেখক ও তাঁর পরিবারকে এতটা আপ্লুত করার কারণ অনেক। এমনই ক্যারিশমা ছিল এই নারীর। দেশের জনপ্রিয়তম লেখক থেকে কথা শুনতে ও কথা রাখতে অবাধ্য নেতাদেরও তিনি এক কাতারে এনেছিলেন।
সাধারণ মানুষ যাঁরা ধরে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ চলবে ককটেলে। যে ককটেলের কিছু পাকিস্তান, কিছু ভারত, বাকিটা ধর্ম। এ দেশে রাজাকার-দালালদের সে নামে ডাকা যাবে না। পাকিস্তানি বাহিনীকে বলতে হবে হানাদার বাহিনী। মুজাহিদ ও নিজামীর গাড়িতে উড়বে পতাকা ও সাকা চৌধুরীর মুখ থেকে শুনতে হবে অশ্রাব্য সব মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কথা।
এমন কঠিন সময়ে জাতিকে উজ্জীবিত করা নারীটি এলেন কোথা থেকে? পিতার আনুকূল্যে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে উচ্চশিক্ষা শেষ করে ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলের টিচার। টানা চোখ, উন্নত ললাট, বাঁশির মতো নাক। সুচিত্রা সেনের আদলে সুখী নারী। স্বামী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। নিজে তখন ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লসের প্রধান।
দুই পুত্র নিয়ে এলিফ্যান্ট রোডে সোনার সংসার। কিন্তু ইতিহাস যে বসে ছিল কণিকা নামের ওই বাড়িতে ঢোকার অপেক্ষায়। পুত্র রুমী এসে দাঁড়িয়ে ছিল মায়ের কাছে। অনুমতি চায়, কিসের অনুমতি? রুমীর কথা একটাই। বিদেশ গিয়ে পড়াশোনা করে বিত্ত সুখ সব হবে কিন্তু বিবেক তো শান্তি পাবে না। তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সে যদি তার যৌবন দেশমুক্তির জন্য উৎসর্গ না করে, এই পাপ বহন করতে হবে আজীবন। ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ানো মা একমুহূর্তে হয়ে উঠেছিলেন জননী। পুত্রকে কোরবানি দিলেন দেশমাতৃকার জন্য। রুমী হয়ে গেল ইতিহাস। পুত্রশোকে পিতাও হলেন লোকান্তরিত। পড়ে রইল কুরুক্ষেত্র বাংলাদেশ, পড়ে রইলেন মা।
তিনি আমাদের জননী জাহানারা। জাহানারা নামের মতোই ইতিহাসের শোভিত বাগান। যিনি না হলে পুরুষ নেতৃত্ব মুখে যা-ই বলুক, ইতিহাস শুদ্ধ হতো না। যুদ্ধাপরাধীর বিচার বা শাস্তিও হতো না এ দেশে। রাজনীতি কী বলে, কেন বলে, কখন বলে তার ধার ধারি না। শুধু জানি শহীদ জননী আমাদের মা।
৪.
এখনো দেখুন, চারদিকে পুরুষতন্ত্রের বাড়াবাড়ি। অথচ এ দেশ চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে নারীশক্তি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আপনি যা বলেন বা ভাবেন, তাতে কিছু আসে-যায় না। তিনি নারীশক্তির এক উজ্জ্বল প্রতীক। ভালোভাবে বিবেচনা করলে ইন্দিরা গান্ধী ও বেনজির ভুট্টোর পর এমন সাহসী স্বাধীনচেতা নারী নেতা আর পায়নি এই উপমহাদেশ। তিনি আছেন বলেই তরতর করে এগিয়ে চলেছে দেশ। আজ বিশ্বের সব মোড়লের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারা এই নেতা একজন নারী।
৫.
শেষ করব ক্রীড়া ও বিজ্ঞানে নারী অগ্রগতির কথা বলে। কলসিন্দুরের সেই মেয়েগুলো—ক্রিকেটের অজনপ্রিয়, অচেনা মেয়েরা আমাদের বারবার বড় করে তোলে। আমরা যখন পুরুষদের খেলাধুলায় মুখ লুকিয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসি, তখন এরা একেকবার জ্বলে ওঠে। তারার মতো ফুটে থাকে বাংলার আকাশে। বিজ্ঞান থাকবে কি থাকবে না, এমন একটা বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে সেঁজুতি সাহা যখন বিশ্বলোকের আলোয় উদ্ভাসিত হয়, তখন আমরা জেনে যাই বাংলাদেশের দুর্ভাবনার কারণ নেই। তার মেয়েরা জয়িতা, যেকোনো অন্ধকারে আলোর সন্ধান দিতে পারে।
আমি কন্যা জায়া জননীর এই শক্তিকে শ্রদ্ধা জানাই। তাদের কাছেই শক্তি ও সাহসের ভরসা রাখি।
লেখক: অজয় দাশগুপ্ত, অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট
আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে মাঝে মাঝে এমন সব নারী জন্ম নেন, যাঁরা দেশ সমাজ কালের গণ্ডি পেরিয়ে বড় হয়ে ওঠেন। সেই কবে এ দেশে বেগম রোকেয়ার জন্ম হয়েছিল। ভাবা যায়, সে সময় অবরোধবাসিনী এমন সব কথা লিখেছেন, যা এখনো পুরুষেরা নিতে পারে না? ১৮৮০ সালে জন্মেছিলেন তিনি। পিতার ভয়ে চৌহদ্দি পার হতেন না, ষোলো বছরে উর্দুভাষী সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে নিকাহ, অথচ মাথায় ঢুকে ছিল স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। কী সেই বাণী? ‘পাখি কখনো এক ডানায় উড়িতে পারে না।’
একটি ডানার নাম পুরুষ, তো আরেকটি নারী। কী দুঃসাহস! বললেন কিনা, জাগো মা তুমি দাসী নও, জাগো বোন তুমি কোনো জড়োয়া গহনার বাক্স নও। নও সাজানো অলংকার। সে যুগের মুসলিম নারীদের স্যালুট জানাই। রংপুরের পায়রাবন্দের মেয়ের ‘সুলতানা’স ড্রিম’ হয়ে গেল ইউরোপস্বীকৃত ক্ল্যাসিক।
তিনি ছিলেন বটে কালজয়ী বাঙালি নারী এবং অলৌকিক এক শক্তির আধার। না হলে কি ৯ ডিসেম্বর জন্মে ৯ ডিসেম্বরেই বিদায় নিতেন?
২.
রবীন্দ্রনাথ কেন জানি সব জানতেন। এই লোকটা মনে হয় মনোবিজ্ঞানী, ঈশ্বরের দূতও। কত আগে লিখে রেখে গেছেন,
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে,
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু
নিভাইছে তব আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ
তুমি কি বেসেছো ভালো?
প্রীতিলতা যখন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তখন আমরা ছিলাম ব্রিটিশ শাসনের অধীনে পরাধীন কিন্তু অন্তর্জগতে স্বাধীন একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি। বাঙালির ধারণা ছিল ব্রিটিশ গেলেই বাংলা মুক্ত হবে, আবার পাল, সেন বা আকবর আমলের সৌন্দর্যে এক হয়ে বসবাস করবে। কিংবা ভেবেছিল স্বাধীন দেশে বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান থাকবে আত্মীয়ের মতো।
প্রীতিলতা চাইলেই একটা স্বাভাবিক সুন্দর জীবন যাপন করতে পারতেন। পিতা জগদ্বন্ধু বাবু হেড কেরানি। কিন্তু মেয়ে তাঁর প্রতিভাময়ী। মেয়ের মায়ের নামও যে প্রতিভা দেবী। মেয়েটি ঢাকা ইডেন কলেজে আইএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম, সম্মিলিত মেধাতালিকায় পঞ্চম। জলপানির বিশ টাকায় তাঁর পড়ার খরচ চলবে বলে চলে গেলেন বেথুন কলেজে। সেই কলেজে তাঁর অধীত প্রিয় বিষয় ছিল দর্শন। এ নিয়ে অনার্স করার ইচ্ছে থাকলেও দেশপ্রেমের বিপ্লবী চেতনা তখন তাঁর মগজকে প্রভাবিত করে ফেলায় তা পারেননি। কিন্তু বিএ পাস করেন ডিস্টিংশন নিয়ে।
এগুলো বলার উদ্দেশ্য একটাই। এত মেধাবী এক নারী যিনি কিনা নব্বই বছর আগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেন, তিনি চাইলে কত কিছু হতে পারতেন। নাটক লিখেছেন সে বয়সে। বেথুন কলেজের ছাদে বসে বাঁশি বাজিয়ে মন জয় করেছিলেন সবার। কিন্তু তাঁর মনজুড়ে তখন স্বদেশ আর বিপ্লবী সূর্য সেনের চেতনা। সে বয়সে বেপরোয়া এই তরুণী কেন এমন একটি অপারেশনে যোগ দিয়েছিলেন, যা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি? এর কারণ জাতির জন্য, বাঙালির আত্মমর্যাদার জন্য তাঁর ভালোবাসাবোধ।
পাহাড়তলীর চূড়ায় ব্রিটিশদের ক্লাবঘরে কী সাইনবোর্ড ঝুলত জানেন? ‘কুকুর ও দেশীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। এই ‘দেশীয়’ মানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা। প্রীতিলতা এই অপমান মেনে নিতে পারেননি। দুবারের ব্যর্থতার পর তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় মরণ অভিযান। একপর্যায়ে যখন ধরা পড়ার সময় এল, তিনি বেছে নিলেন স্বেচ্ছামরণ। পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দিলেন বটে, হয়ে রইলেন প্রথম নারী শহীদ।
কিন্তু তিনি জানেন না আজকের স্বাধীন সমাজে সৌজন্যের ফুলমালা আর পুষ্পস্তবকের আড়ালে মুছে যাওয়া এক নাম ‘প্রীতিলতা’; যে নামের সঙ্গে ধর্ম পরিচয় জড়িয়ে তাঁকে নিরন্তর অপমান আর এড়িয়ে চলাই নিয়ম। তাঁর কথা কবিতা, গদ্যে, নাটক, গানে মিটিমিটি তারার মতো জ্বললেও খবর পায় না মানুষ।
জানি না, চলে যাওয়ার পর মানুষের আত্মা বলে আসলেই কিছু আছে কি নেই। থাকলে তিনি আজ শোকার্ত হতেন। এই বাংলায় নারীশক্তির মতো আতঙ্ক আর বিপদে কে আছে এখন? তার ঘরে-বাইরে-সমাজে শুধু হায়েনা আর লোভীদের বিচরণ।
প্রীতিলতার বিদায়ের পর এই ভূখণ্ড দু-দুবার স্বাধীন হওয়ার পরও নুসরাত, মিতু কিংবা এমন অনেকে নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারে না। জেনে অবাক হতে হয় না, ঝুমন দাসের মতো নিরীহ মানুষও পচে মরে অন্ধকারে। মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান বলে যতই গর্ব করি না কেন, প্রীতিলতার আত্মদান আজ সত্যি বিবর্ণ, শুধু ইতিহাসে আর কিছু মানুষের মনে সে এক শক্তির আধার। বীরকন্যাকে প্রণাম।
৩.
রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে মধ্যপন্থী ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ও ভাবনা কী, সেটা তাঁর বাড়িতে আসা একটি টেলিফোন কলেই বোঝা গিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদ লিখছেন, কন্যার ব্যগ্রতা ও ছোটাছুটি দেখে তিনি বুঝতে পারছিলেন বিশেষ কেউ ফোন করেছেন। এবং ফোন তুলে তিনি যখন শুনলেন এই মহীয়সী রমণীর কণ্ঠ, নিজেও আপ্লুত হয়েছিলেন। তিনি ফোন করেছিলেন, এই আনন্দ একজন বিখ্যাত জনপ্রিয় লেখক ও তাঁর পরিবারকে এতটা আপ্লুত করার কারণ অনেক। এমনই ক্যারিশমা ছিল এই নারীর। দেশের জনপ্রিয়তম লেখক থেকে কথা শুনতে ও কথা রাখতে অবাধ্য নেতাদেরও তিনি এক কাতারে এনেছিলেন।
সাধারণ মানুষ যাঁরা ধরে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ চলবে ককটেলে। যে ককটেলের কিছু পাকিস্তান, কিছু ভারত, বাকিটা ধর্ম। এ দেশে রাজাকার-দালালদের সে নামে ডাকা যাবে না। পাকিস্তানি বাহিনীকে বলতে হবে হানাদার বাহিনী। মুজাহিদ ও নিজামীর গাড়িতে উড়বে পতাকা ও সাকা চৌধুরীর মুখ থেকে শুনতে হবে অশ্রাব্য সব মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কথা।
এমন কঠিন সময়ে জাতিকে উজ্জীবিত করা নারীটি এলেন কোথা থেকে? পিতার আনুকূল্যে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে উচ্চশিক্ষা শেষ করে ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুলের টিচার। টানা চোখ, উন্নত ললাট, বাঁশির মতো নাক। সুচিত্রা সেনের আদলে সুখী নারী। স্বামী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। নিজে তখন ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লসের প্রধান।
দুই পুত্র নিয়ে এলিফ্যান্ট রোডে সোনার সংসার। কিন্তু ইতিহাস যে বসে ছিল কণিকা নামের ওই বাড়িতে ঢোকার অপেক্ষায়। পুত্র রুমী এসে দাঁড়িয়ে ছিল মায়ের কাছে। অনুমতি চায়, কিসের অনুমতি? রুমীর কথা একটাই। বিদেশ গিয়ে পড়াশোনা করে বিত্ত সুখ সব হবে কিন্তু বিবেক তো শান্তি পাবে না। তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সে যদি তার যৌবন দেশমুক্তির জন্য উৎসর্গ না করে, এই পাপ বহন করতে হবে আজীবন। ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ানো মা একমুহূর্তে হয়ে উঠেছিলেন জননী। পুত্রকে কোরবানি দিলেন দেশমাতৃকার জন্য। রুমী হয়ে গেল ইতিহাস। পুত্রশোকে পিতাও হলেন লোকান্তরিত। পড়ে রইল কুরুক্ষেত্র বাংলাদেশ, পড়ে রইলেন মা।
তিনি আমাদের জননী জাহানারা। জাহানারা নামের মতোই ইতিহাসের শোভিত বাগান। যিনি না হলে পুরুষ নেতৃত্ব মুখে যা-ই বলুক, ইতিহাস শুদ্ধ হতো না। যুদ্ধাপরাধীর বিচার বা শাস্তিও হতো না এ দেশে। রাজনীতি কী বলে, কেন বলে, কখন বলে তার ধার ধারি না। শুধু জানি শহীদ জননী আমাদের মা।
৪.
এখনো দেখুন, চারদিকে পুরুষতন্ত্রের বাড়াবাড়ি। অথচ এ দেশ চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে নারীশক্তি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আপনি যা বলেন বা ভাবেন, তাতে কিছু আসে-যায় না। তিনি নারীশক্তির এক উজ্জ্বল প্রতীক। ভালোভাবে বিবেচনা করলে ইন্দিরা গান্ধী ও বেনজির ভুট্টোর পর এমন সাহসী স্বাধীনচেতা নারী নেতা আর পায়নি এই উপমহাদেশ। তিনি আছেন বলেই তরতর করে এগিয়ে চলেছে দেশ। আজ বিশ্বের সব মোড়লের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারা এই নেতা একজন নারী।
৫.
শেষ করব ক্রীড়া ও বিজ্ঞানে নারী অগ্রগতির কথা বলে। কলসিন্দুরের সেই মেয়েগুলো—ক্রিকেটের অজনপ্রিয়, অচেনা মেয়েরা আমাদের বারবার বড় করে তোলে। আমরা যখন পুরুষদের খেলাধুলায় মুখ লুকিয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসি, তখন এরা একেকবার জ্বলে ওঠে। তারার মতো ফুটে থাকে বাংলার আকাশে। বিজ্ঞান থাকবে কি থাকবে না, এমন একটা বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে সেঁজুতি সাহা যখন বিশ্বলোকের আলোয় উদ্ভাসিত হয়, তখন আমরা জেনে যাই বাংলাদেশের দুর্ভাবনার কারণ নেই। তার মেয়েরা জয়িতা, যেকোনো অন্ধকারে আলোর সন্ধান দিতে পারে।
আমি কন্যা জায়া জননীর এই শক্তিকে শ্রদ্ধা জানাই। তাদের কাছেই শক্তি ও সাহসের ভরসা রাখি।
লেখক: অজয় দাশগুপ্ত, অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে