ফাহাদ বিন সিদ্দিক
ছোটবেলায় নিলুফার ছিল আর দশজন শিশুর মতো হাস্যোজ্জ্বল। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করত। নিলুফারকে চার বছর বয়সে তার মা-বাবা ভর্তি করেন একটি স্কুলে। প্রতিদিন যখন ছোট্ট নিলুফার স্কুলে যেত, তখন মা-বাবার সে কী আনন্দ! কিন্তু এই আনন্দ ফিকে হয়ে ওঠে হঠাৎ করেই। একদিন ছোট্ট নিলুফার ঘুম থেকে উঠে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে জানান, নিলুফার মাসকুলার ডিসট্রোফি নামের একটি রোগ হয়েছে। যে রোগের ফলে নিলুফার ধীরে ধীরে চলনশক্তি হারিয়ে ফেলে, ছোট হয়ে আসে তার চলাচলের পরিসর। কিন্তু দমে না গিয়ে হুইলচেয়ারে বসেই স্বপ্ন ডানায় আকাশ পাড়ি দিতে চায় নিলুফার।
নিলুফার নিজে নিজেই পড়াশোনা শুরু করে এবং বিভিন্ন জিনিস শিখতে ও জানতে থাকে। একসময় সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চায়, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত অব্যবস্থাপনা তাকে শেখার কিংবা চলাফেরার স্বাধীনতা দেয় না। নিলুফার বুঝতে পারে, তার শিক্ষকেরাই চান যে সে আলাদা পড়াশোনা করুক, সবার সঙ্গে নয়। এমন বৈষম্যমূলক ব্যবহারের কারণে নিলুফার ভেঙে পড়ে। সে জানে না কার কাছে যাবে তার অভিযোগ নিয়ে। ভাঙা মন নিয়েও পাখা মেলতে চাওয়া নিলুফার প্রতিটি ধাপেই বাধার সম্মুখীন হয়।
শহরের ফুটপাতগুলো নিলুফারের হুইলচেয়ারবান্ধব নয়, যখন-তখন কোথাও যেতে পারে না সে। লোকাল বাসগুলোর দরজা ফুটপাত থেকে উঁচুতে এবং প্রবেশপথ সরু হওয়ার কারণে নিলুফার হুইলচেয়ার নিয়ে বাসে উঠতে পারে না। টেবিল টেনিসে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেনি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় তার জন্য উপযোগী করে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেনি।
নিলুফারের মতো আরও অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন যাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তেমনি একজন নিলুফারের বন্ধু শামসুল আলম, একজন বাক প্রতিবন্ধী। আলম যখন একটি আইনগত সমস্যায় পড়েন তখন থানায় ইশারা ভাষার সুবিধা না থাকার কারণে তাঁর কথা বুঝিয়ে বলতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন। থানায় এমন অভিজ্ঞতার কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আলম বিষয়টি নিয়ে আদালতে পর্যন্ত যেতে চাননি। এত বৈষম্যের সম্মুখীন হওয়ার পরও নিলুফাররা স্বপ্ন দেখেন এক বৈষম্যহীন সমাজের, যেখানে তাঁদের স্বপ্নের ডানা মেলায় কোনো বাধা আসবে না। এই পৃথিবীতে নিলুফার কিংবা অন্য যেকোনো মানুষ অধিকার ও মানব মর্যাদার দিক থেকে সমান এবং সবার অধিকার রয়েছে সমান সুযোগ ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার।
নিলুফাররা হয়তো জানেন না যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের অর্জিত সংবিধান নারী বা শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে রাষ্ট্রকে [অনুচ্ছেদ ২৮]। এ ছাড়া সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে ঐতিহাসিক বা সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর (যেমন প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী) অনুকূলে [অনুচ্ছেদ ২৮]। যে কারণে রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা রয়েছে শহরের সব ফুটপাত প্রতিবন্ধীবান্ধব করা কিংবা বাসে ওঠার পথ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য উপযোগীভাবে তৈরি করতে নির্দেশ দেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে নিলুফাররা ক্রমাগত অধিকারহীনতা ও বৈষম্যের মাঝে পিষ্ট হচ্ছেন। আমার মতে, এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করে নিলুফারদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবেশগত বাধা।
চরম উপেক্ষা ও প্রান্তিক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদ’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সনদ তৈরি করে, যা ২০০৬ সালে অনুমোদিত হয়। এই সনদের আলোকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবেশগত বাধা দূরীকরণে এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে ২০১৩ সালে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার এবং সুরক্ষা আইনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, এর মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ—তাঁরা যেকোনো বয়স বা লিঙ্গ বা সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর হোক না কেন।
এই আইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ২১ ধরনের অধিকার সংরক্ষিত করা হয়েছে [ধারা ১৬ (১)]। এই ২১ ধরনের অধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কোনো ধরনের বৈষম্য প্রদর্শন বা বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না [ধারা ১৬ (২) ]। এই ২১ ধরনের অধিকারের মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সর্বক্ষেত্রে সমান আইনি স্বীকৃতি এবং বিচারপ্রাপ্তির পথ সুগম করা; স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ; সব স্থানে প্রবেশের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তি; সংস্কৃতি, বিনোদন, পর্যটন, অবকাশ ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ; শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বাক্প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ইশারা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার মতো বিষয়গুলোকে অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে [ধারা ১৬ (১)]।
আইনে আরও বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো প্রকার বৈষম্য প্রদর্শন বা বৈষম্যমূলক আচরণ করলে অথবা এই আইনে উল্লিখিত কোনো অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষাসংক্রান্ত কমিটির কাছে আবেদন করতে পারেন। জেলা কমিটি বিষয়টি অনুসন্ধান করে এবং দুই পক্ষকে শুনে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য বা অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আদেশ প্রদান করার ক্ষমতা রয়েছে। আদেশ অনুযায়ী বৈষম্য দূর করা না হলে বা অধিকার বাস্তবায়ন করা না হলে জেলা কমিটি ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্যও আদেশ দিতে পারে [ধারা ৩৬]।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে জেলা কমিটির ভূমিকা কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। ২০২৩ সালে, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) কর্তৃক একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। এই গবেষণায় তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর মাধ্যমে জেলা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা কমিটি গঠন এবং কমিটির সভার বিষয়ক তথ্য ১৫টি জেলার কাছে জানতে চেয়ে সমাজসেবা কার্যালয়ে আবেদন দাখিল করা হয়। সেই গবেষণা সূত্রে জানা যায়, প্রায় প্রতিটি জেলাতেই কমিটি বিদ্যমান হলেও কমিটির বৈঠক নিয়মিত হয় না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ২৭ (২) ধারা অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষাসংক্রান্ত জেলা কমিটির অন্যূন চারটি সভা হওয়ার বিধান থাকলেও, ৭টি জেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১ মে ২০২১ থেকে ৩০ মে ২০২২ পর্যন্ত বাস্তবিক অর্থে কোনো জেলাতেই কমিটির পর্যাপ্ত সভা হয়নি। বেশির ভাগ জেলাতেই মাত্র একবার করে সভা হয়েছে। জেলা কমিটির এ ধরনের অনিয়মিত সভা একদিকে যেমন আইনের সুস্পষ্ট ব্যত্যয়, ঠিক তেমনি এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষাসংক্রান্ত জেলা কমিটি প্রতিটি জেলায় সঠিকভাবে গঠন করা হলেও এর কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হচ্ছে না।
ফলে নিলুফারদের মতো হাজারো অধিকারবঞ্চিতদের জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো নিয়ে এই কমিটির যে উদ্যোগগুলো নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলো তারা নিতে পারছে না। নিয়মিত সভা না হওয়ার ফলে বর্তমানে জেলা কমিটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। হয়তো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারলে নিলুফাররা পৌঁছে যেতেন এই কমিটির কাছে। এ ছাড়া এর ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে জেলা কমিটির ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কার্যাবলি (যেমন সরকার বা জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা বাস্তবায়ন, সব উপজেলা কমিটি বা শহর কমিটি কার্যাবলির সমন্বয় ও তদারকি ইত্যাদি) [ধারা ২২] কতটুকু সুচারুরূপে পালন হচ্ছে, সে বিষয়েও অস্পষ্টতা রয়ে যায়।
আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের প্রণীত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০’ পূরণের লক্ষ্যে সচেষ্ট ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রতিবন্ধী কল্যাণের বিষয়টিও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে প্রতীয়মান হয়; যেমন প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা, অসমতা দূরীকরণ ও প্রতিবন্ধী মানুষের অবারিত প্রবেশাধিকার। ২০৩০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের ক্ষেত্রে যেমন সরকারি পরিষেবার দপ্তরগুলো প্রতিবন্ধীবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষাসংক্রান্ত জেলা কমিটিগুলোর কার্যক্রমগুলো আরও সুসংগঠিত ও বেগবান করা প্রয়োজন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ লেখায় উল্লিখিত চরিত্রগুলো কাল্পনিক।
ফাহাদ বিন সিদ্দিক, গবেষণা কর্মকর্তা, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট
ছোটবেলায় নিলুফার ছিল আর দশজন শিশুর মতো হাস্যোজ্জ্বল। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করত। নিলুফারকে চার বছর বয়সে তার মা-বাবা ভর্তি করেন একটি স্কুলে। প্রতিদিন যখন ছোট্ট নিলুফার স্কুলে যেত, তখন মা-বাবার সে কী আনন্দ! কিন্তু এই আনন্দ ফিকে হয়ে ওঠে হঠাৎ করেই। একদিন ছোট্ট নিলুফার ঘুম থেকে উঠে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে জানান, নিলুফার মাসকুলার ডিসট্রোফি নামের একটি রোগ হয়েছে। যে রোগের ফলে নিলুফার ধীরে ধীরে চলনশক্তি হারিয়ে ফেলে, ছোট হয়ে আসে তার চলাচলের পরিসর। কিন্তু দমে না গিয়ে হুইলচেয়ারে বসেই স্বপ্ন ডানায় আকাশ পাড়ি দিতে চায় নিলুফার।
নিলুফার নিজে নিজেই পড়াশোনা শুরু করে এবং বিভিন্ন জিনিস শিখতে ও জানতে থাকে। একসময় সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চায়, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত অব্যবস্থাপনা তাকে শেখার কিংবা চলাফেরার স্বাধীনতা দেয় না। নিলুফার বুঝতে পারে, তার শিক্ষকেরাই চান যে সে আলাদা পড়াশোনা করুক, সবার সঙ্গে নয়। এমন বৈষম্যমূলক ব্যবহারের কারণে নিলুফার ভেঙে পড়ে। সে জানে না কার কাছে যাবে তার অভিযোগ নিয়ে। ভাঙা মন নিয়েও পাখা মেলতে চাওয়া নিলুফার প্রতিটি ধাপেই বাধার সম্মুখীন হয়।
শহরের ফুটপাতগুলো নিলুফারের হুইলচেয়ারবান্ধব নয়, যখন-তখন কোথাও যেতে পারে না সে। লোকাল বাসগুলোর দরজা ফুটপাত থেকে উঁচুতে এবং প্রবেশপথ সরু হওয়ার কারণে নিলুফার হুইলচেয়ার নিয়ে বাসে উঠতে পারে না। টেবিল টেনিসে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেনি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় তার জন্য উপযোগী করে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেনি।
নিলুফারের মতো আরও অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন যাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তেমনি একজন নিলুফারের বন্ধু শামসুল আলম, একজন বাক প্রতিবন্ধী। আলম যখন একটি আইনগত সমস্যায় পড়েন তখন থানায় ইশারা ভাষার সুবিধা না থাকার কারণে তাঁর কথা বুঝিয়ে বলতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন। থানায় এমন অভিজ্ঞতার কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আলম বিষয়টি নিয়ে আদালতে পর্যন্ত যেতে চাননি। এত বৈষম্যের সম্মুখীন হওয়ার পরও নিলুফাররা স্বপ্ন দেখেন এক বৈষম্যহীন সমাজের, যেখানে তাঁদের স্বপ্নের ডানা মেলায় কোনো বাধা আসবে না। এই পৃথিবীতে নিলুফার কিংবা অন্য যেকোনো মানুষ অধিকার ও মানব মর্যাদার দিক থেকে সমান এবং সবার অধিকার রয়েছে সমান সুযোগ ও সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার।
নিলুফাররা হয়তো জানেন না যে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের অর্জিত সংবিধান নারী বা শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে রাষ্ট্রকে [অনুচ্ছেদ ২৮]। এ ছাড়া সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারে ঐতিহাসিক বা সামাজিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর (যেমন প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী) অনুকূলে [অনুচ্ছেদ ২৮]। যে কারণে রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা রয়েছে শহরের সব ফুটপাত প্রতিবন্ধীবান্ধব করা কিংবা বাসে ওঠার পথ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য উপযোগীভাবে তৈরি করতে নির্দেশ দেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে নিলুফাররা ক্রমাগত অধিকারহীনতা ও বৈষম্যের মাঝে পিষ্ট হচ্ছেন। আমার মতে, এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করে নিলুফারদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবেশগত বাধা।
চরম উপেক্ষা ও প্রান্তিক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের অধিকার সনদ’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সনদ তৈরি করে, যা ২০০৬ সালে অনুমোদিত হয়। এই সনদের আলোকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবেশগত বাধা দূরীকরণে এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে ২০১৩ সালে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার এবং সুরক্ষা আইনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, এর মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ—তাঁরা যেকোনো বয়স বা লিঙ্গ বা সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর হোক না কেন।
এই আইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ২১ ধরনের অধিকার সংরক্ষিত করা হয়েছে [ধারা ১৬ (১)]। এই ২১ ধরনের অধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা কোনো ধরনের বৈষম্য প্রদর্শন বা বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না [ধারা ১৬ (২) ]। এই ২১ ধরনের অধিকারের মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সর্বক্ষেত্রে সমান আইনি স্বীকৃতি এবং বিচারপ্রাপ্তির পথ সুগম করা; স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ; সব স্থানে প্রবেশের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তি; সংস্কৃতি, বিনোদন, পর্যটন, অবকাশ ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ; শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বাক্প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ইশারা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার মতো বিষয়গুলোকে অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে [ধারা ১৬ (১)]।
আইনে আরও বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো প্রকার বৈষম্য প্রদর্শন বা বৈষম্যমূলক আচরণ করলে অথবা এই আইনে উল্লিখিত কোনো অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষাসংক্রান্ত কমিটির কাছে আবেদন করতে পারেন। জেলা কমিটি বিষয়টি অনুসন্ধান করে এবং দুই পক্ষকে শুনে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য বা অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আদেশ প্রদান করার ক্ষমতা রয়েছে। আদেশ অনুযায়ী বৈষম্য দূর করা না হলে বা অধিকার বাস্তবায়ন করা না হলে জেলা কমিটি ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্যও আদেশ দিতে পারে [ধারা ৩৬]।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে জেলা কমিটির ভূমিকা কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। ২০২৩ সালে, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) কর্তৃক একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। এই গবেষণায় তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর মাধ্যমে জেলা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা কমিটি গঠন এবং কমিটির সভার বিষয়ক তথ্য ১৫টি জেলার কাছে জানতে চেয়ে সমাজসেবা কার্যালয়ে আবেদন দাখিল করা হয়। সেই গবেষণা সূত্রে জানা যায়, প্রায় প্রতিটি জেলাতেই কমিটি বিদ্যমান হলেও কমিটির বৈঠক নিয়মিত হয় না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের ২৭ (২) ধারা অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষাসংক্রান্ত জেলা কমিটির অন্যূন চারটি সভা হওয়ার বিধান থাকলেও, ৭টি জেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১ মে ২০২১ থেকে ৩০ মে ২০২২ পর্যন্ত বাস্তবিক অর্থে কোনো জেলাতেই কমিটির পর্যাপ্ত সভা হয়নি। বেশির ভাগ জেলাতেই মাত্র একবার করে সভা হয়েছে। জেলা কমিটির এ ধরনের অনিয়মিত সভা একদিকে যেমন আইনের সুস্পষ্ট ব্যত্যয়, ঠিক তেমনি এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষাসংক্রান্ত জেলা কমিটি প্রতিটি জেলায় সঠিকভাবে গঠন করা হলেও এর কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হচ্ছে না।
ফলে নিলুফারদের মতো হাজারো অধিকারবঞ্চিতদের জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো নিয়ে এই কমিটির যে উদ্যোগগুলো নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলো তারা নিতে পারছে না। নিয়মিত সভা না হওয়ার ফলে বর্তমানে জেলা কমিটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। হয়তো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারলে নিলুফাররা পৌঁছে যেতেন এই কমিটির কাছে। এ ছাড়া এর ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে জেলা কমিটির ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কার্যাবলি (যেমন সরকার বা জাতীয় কমিটির সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা বাস্তবায়ন, সব উপজেলা কমিটি বা শহর কমিটি কার্যাবলির সমন্বয় ও তদারকি ইত্যাদি) [ধারা ২২] কতটুকু সুচারুরূপে পালন হচ্ছে, সে বিষয়েও অস্পষ্টতা রয়ে যায়।
আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের প্রণীত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০’ পূরণের লক্ষ্যে সচেষ্ট ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রতিবন্ধী কল্যাণের বিষয়টিও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে প্রতীয়মান হয়; যেমন প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা, অসমতা দূরীকরণ ও প্রতিবন্ধী মানুষের অবারিত প্রবেশাধিকার। ২০৩০ সালের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের ক্ষেত্রে যেমন সরকারি পরিষেবার দপ্তরগুলো প্রতিবন্ধীবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা প্রয়োজন, ঠিক তেমনি করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষাসংক্রান্ত জেলা কমিটিগুলোর কার্যক্রমগুলো আরও সুসংগঠিত ও বেগবান করা প্রয়োজন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এ লেখায় উল্লিখিত চরিত্রগুলো কাল্পনিক।
ফাহাদ বিন সিদ্দিক, গবেষণা কর্মকর্তা, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে