আবু তাহের খান
ঈদের অব্যবহিত আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক প্রাক্কলনে বলা হয়েছিল যে এবারের ঈদে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ লোক ঢাকা ছেড়ে যাবে, যা ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা কমপক্ষে অর্ধেক। শেষ পর্যন্ত কত লোক ঢাকা ছেড়েছিল, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও প্রকৃত সংখ্যা এআরআইয়ের দেওয়া সংখ্যার কাছাকাছি হবে বলেই ধারণা করা চলে। তো সে সংখ্যা সামান্য কম-বেশি যা হোক না কেন, প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত এই ১ কোটি ২০ লাখ লোক বা ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ কেন যানবাহন ও যাতায়াত-পথের এত কষ্ট, দুর্ভোগ ও হয়রানি সহ্য করেও মাত্র তিন-চার দিনের জন্য ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার প্রাণান্ত ‘যুদ্ধে’ নিজেদের প্রায় উৎসর্গ করে দিচ্ছেন? অথচ ঢাকা ত্যাগকারী এ মানুষদের প্রত্যেকেই জানেন, ঈদ পার হতে না হতেই তাঁদের আবার আরেক দফা ফিরতি যুদ্ধে নামতে হবে বসবাস-অযোগ্য ঢাকায় ফিরে আসার জন্য। তাহলে মাত্র তিন-চারটি দিন গ্রামের বাড়িতে কাটানোর জন্য কেন তাঁদের এ প্রাণান্ত প্রয়াস?
একেবারে প্রথম কথা হচ্ছে, এই মানুষদের প্রায় কেউই ঢাকাকে তাঁর নিজের শহর বা আপনস্থান বলে ভাবেন না। মৌসুমি কৃষিশ্রমিক যেমন মজুর ভিত্তিতে ধান কাটার জন্য এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে এসে কাজ শেষে মজুরি নিয়ে দ্রুত নিজ গ্রামে ফিরে যেতে চান, এ-ও অনেকটা তেমনি। ঢাকায় থাকা মানুষেরা চাকরি, ব্যবসা, লেখাপড়া ও অন্য নানা কাজে তথা জীবিকার প্রয়োজনে নিছক বাধ্য হয়ে এখানে থাকছেন বটে। কিন্তু তাঁদের আত্মা কখনোই এ শহরকে ধারণ করতে পারেনি বা এ শহরও কখনো তাঁদের আপন করে নেয়নি। হাকিম হাবিবুর রহমান (১৮৮১-১৯৪৭), কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) বা শিল্পী মুর্তজা বশীরের (১৯৩২-২০২০) মতো দু-চারজনকে ঢাকা তার বুকে জায়গা দিলেও অধিকাংশকেই সে তা দেয়নি। ফলে এখানে কর্মরত মানুষ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে যতই এখানে বছরের পর বছর দিন কাটাক এবং এখানকার জল-হাওয়া যতই তাঁকে বাঁচার রসদ জোগাক, তিনি ভাবেন, এ শহর, এই শহরের দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, খাবারদাবার, নাচ-গান, কলকাকলি এসবের কিছুই তাঁর নয়। এমনকি যে কারখানা, অফিস, দোকান, ফুটপাত বা রাস্তাঘাটে তিনি কাজ করেন, সেসবের সঙ্গেও তাঁর কোনো আত্মিক সম্পর্ক নেই।
দিনের পর দিন এখানে বসবাস করা সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকার সঙ্গে তার মানুষদের একটি আত্মিক সম্পর্ক কেন গড়ে উঠতে পারল না অথবা তার বিপরীতে এমন একটি হৃদয়হীন অস্বাভাবিক সম্পর্ক কেন ও কীভাবে টিকে থাকল, তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রথমেই আসা যাক পোশাকশ্রমিকদের কথায়। দেশের পোশাক কারখানাগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাদের সিংহভাগের কর্মস্থলই ঢাকা ও এর সন্নিহিত এলাকায়। এই শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁদের মালিকেরা যে আচরণ করেন, তাতে করে নিজ কর্মস্থলকে তাঁদের পক্ষে কখনোই আপন ভাবার কোনো কারণ নেই। ফলে শুধু ঈদে কেন, যেকোনো সময় তাঁরা ঢাকা ছাড়তে পারলেই বর্তে যান, কিন্তু পেটের দায়ে তা পারেন না। অন্য কারখানাগুলোর অবস্থা পোশাক খাতের মতো অতটা নাজুক না হলেও তাঁদের পক্ষেও ঢাকাকে আপন ভাবার কোনো কারণ নেই; বরং ভেতরে-ভেতরে এ শহরকে তাঁরাও প্রচণ্ড ঘৃণা করেন, যে ঘৃণা ঈদের এক দিন আগপর্যন্ত কারখানায় কাজ করতে গিয়ে আরও বৃদ্ধি পায়। অতএব হেঁটে হলেও ঢাকার প্রতি ঘৃণা ছিটিয়ে ঈদে বাড়ি তিনি যাবেনই, যেমনটি গিয়েছিলেন করোনার সময়।
পেশা বিবেচনায় পোশাকশ্রমিকের পর ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড়সংখ্যক মানুষ হচ্ছেন নিউমার্কেটের সাম্প্রতিক হিংসাত্মক ঘটনায় নিহত কুরিয়ার সার্ভিসকর্মী নাহিদ হোসেন ও দোকান কর্মচারী মোহাম্মদ মোরসালিনের মতো খুবই সাধারণ পেশার মানুষেরা। মোরসালিনের মতো মানুষেরা ঈদের দু-এক দিন আগে স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে ঈদের আগের মধ্যরাত পর্যন্ত দোকানে কাজ করেন এবং কাজ শেষ করে ওই রাতেই লঞ্চে বা বাসে করে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। পাঠক বলুন, যে শহরের কর্মস্থল ঈদের আগের দিন বা আগের মাঝরাত পর্যন্ত কোনো বাড়তি প্রণোদনা বা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই তার কর্মচারীকে কাজে আটকে রাখে, সে শহরকে নাহিদ বা মোরসালিনেরা কোন যুক্তিতে আপন ভেবে ভালোবাসবেন? তারপরও যদি বেতনের পরিমাণটি উৎসাহব্যঞ্জক হতো, তাহলেও একটি কথা ছিল।
কিন্তু এর কোনো কিছুই তো তাঁকে এ ঢাকা শহরের প্রতি মমতাবান হয়ে উঠতে উৎসাহিত করতে পারছে না। শতভাগ নির্ভরযোগ্য না হলেও মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য হিসাব অনুযায়ী দেশের গণপরিবহন খাতে সড়ক ও নৌপথ মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ শ্রমিক (চালক, সাহায্যকারী ও অন্যান্য) কাজ করেন, যাঁদের সিংহভাগই কর্মরত ঢাকা ও এর সন্নিহিত উপশহরগুলোতে। তাঁদের প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয়, পোশাকশ্রমিকেরা যেখানে মূলত মালিকের দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকেন, সেখানে পরিবহনশ্রমিকেরা একই সঙ্গে চরম অমানবিকভাবে নিগৃহীত হন মালিক, যাত্রী, পুলিশ, চাঁদাবাজ ও অন্যান্য নানা অদৃশ্য ও দৃশ্যমান অংশীজনের দ্বারা। ফলে রাজধানীর আর সবাই মিলে জোট গঠন করেও যদি ঈদে ঢাকা শহরে থেকে যেতে রাজি হন, তাহলেও নিছক বাধ্য না হলে পরিবহনশ্রমিকদের কেউ ঢাকায় থাকতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। কারণ এ শহর তাঁর গতরকেই শুধু ব্যবহার করে—তাঁকে কখনো মানুষ বলে গণ্য করে না। ফলে কেন তিনি ভাববেন যে ঢাকা তাঁর নিজের শহর?
ঢাকা শহরের ফুটপাতে যে হকাররা বসেন, এর বাসস্ট্যান্ড-স্টেশন-টার্মিনালে কুলিমজুরসহ যে ভাসমান মানুষেরা কাজ করেন, এর রাস্তাঘাটে যাঁরা ছিনতাই বা পকেট কাটার মতো কাজে নিয়োজিত আছেন, এর জনসভায় সমাগম বাড়ানোর জন্য যাঁরা ব্যবহৃত হন, দরপত্র ছিনতাই ও চাঁদাবাজির সুযোগ লাভের বিনিময়ে যাঁরা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের লাঠিয়াল বাহিনীর (অবশ্য আজকাল শুধু লাঠি নয়, আগ্নেয়াস্ত্র ও হেলমেট ব্যবহার করেন) সদস্য হিসেবে কাজ করেন, বিভিন্ন অফিস-আদালত ও রাজনৈতিক দলের অফিসে যাঁরা তদবিরকারক হিসেবে ব্যস্ত সময় কাটান, যাঁরা মানব পাচার ও আদম ব্যবসায়ের দালালির সঙ্গে যুক্ত—তাঁরা যতই বছরের পর বছর ঢাকা শহরে বসবাস করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা কেউই এ শহরকে তাঁর নিজের বলে ভাবেন না।
এর বাইরেও রয়েছে শিক্ষিত ও শিক্ষাবঞ্চিত চাকরি অনুসন্ধানী বেকার, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থী, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বড় সংখ্যার ছোট কর্মচারী, বস্তি-ফুটপাত-রেললাইনের পাশে বসবাসকারী ছিন্নমূল মানুষ ইত্যাদি।
তাঁদের কেউই কি ঢাকাকে তাঁর নিজের শহর বলে ভাবেন বা তা ভাবার কোনো কারণ আছে? কস্মিনকালেও না। তাহলে ঢাকাকে আপন ভাবে কারা? সত্যি কথা বলতে কি, গত শতাব্দীর শেষনাগাদ গড়ে ওঠা স্বল্পসংখ্যার ক্ষয়িষ্ণু শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত এবং এর পর থেকে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে রাতারাতি গড়ে ওঠা কালোটাকার বিত্তবান বণিক এবং অসৎ আমলা ও অসৎ রাজনীতিক ব্যতীত ঢাকা শহরে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষই একে তাঁর নিজের শহর বলে গণ্য করেন না। এরই মধ্যে আবার শেষোক্তদের অবৈধ সম্পদের দৌরাত্ম্যে প্রথমোক্ত শ্রেণির সীমিত সংখ্যার শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তও এখন অনেকটাই কোণঠাসা।
আর এমনি একটি অসুস্থ পরিবেশের ভেতর দিয়েই রাজধানীর বিকাশ ঘটছে বিধায় এর রক্ষণাবেক্ষণ, আইনশৃঙ্খলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ, মানুষের মধ্যকার আন্তসম্পর্ক ও মূল্যবোধ কোনো কিছুই সুস্থ ধারায় এগোচ্ছে না বা এগোতে পারছে না। কারণ এসবের কোনোটিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের আন্তরিক সমর্থন বা অংশগ্রহণ নেই। ফলে যে ধারায় ঢাকা শহর এগোচ্ছে, তাতে পরিকল্পনাবিহীন সুউচ্চ ইমারত এবং বিদৃশ্য রাস্তাঘাট ওঅন্যান্যঅবকাঠামো মিলে এর ব্যাপক স্ফীতি ঘটছে বটে। কিন্তু সেই স্ফীতি কতটা আধুনিক ও টেকসই হবে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর এ কথা তো মানতেই হবে যে একটি আধুনিক শহর শুধু ভারী লোহালক্কড় দিয়েই গড়ে ওঠে না, এর জন্য প্রয়োজন উচ্চতর চিন্তা, রুচি, মূল্যবোধ ও মানবিক আচরণসংবলিতএকটিশিক্ষিত আধুনিক নাগরিক সমাজ, যা গড়ে তুলতে সম্ভবত আমরা প্রায় পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছি এবং ব্যর্থতার সে গ্লানিময় ধারা এখনো অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিরা এর রাষ্ট্রকাঠামোর যে স্বপ্ন তাঁদের কল্পনায় এঁকেছিলেন, নিশ্চয় সেখানে একটি রাজধানীর কল্পনাও ছিল। হলফ করে বলতে পারি, এরূপ একটি রাজধানীর কল্পনা তাঁরা করেননি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চরমভাবে বিধ্বস্ত এ ভৌতিক ও সামাজিক দুরবস্থা থেকে ঢাকা শহরকে বের করে আনার উপায় কী? অপ্রিয় সত্য মানতে আপত্তি না থাকলে স্বীকার করতেই হবে, ইতিমধ্যে এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে ন্যূনতম মানের একটি শহর হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলা বা নিদেনপক্ষে যতটুকু ছিল, সেটুকু ফিরে পাওয়া আদৌ সম্ভব হবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তারপরও আশা জিইয়ে রাখা যেতে পারে এ শর্তে যে, এই শহরের সব ভৌত ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে এখানে বসবাসরত সব নাগরিকের অংশগ্রহণের ধারণাকে রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোতে সুস্পষ্ট নীতিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করে সেই অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আরও স্পষ্ট করে বললে বিষয়টি দাঁড়ায় এই, এই নগরীর পরিচালন ও উন্নয়নের সকল পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নাগরিক সাধারণের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ও তাঁদের কাছে পরিচালকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে আর্থিক বিনিয়োগ শুধু ভৌত উন্নয়নের জন্য করলেই হবে না, একই সঙ্গে সমান গুরুত্বের সঙ্গে তা সমাজগঠন ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যও করতে হবে। আর তা করতে না পারলে নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ কবিতার পঙ্ক্তি অনুসরণে আমাদের হয়তো এ কষ্টময় উচ্চারণই বারবার করতে হবে যে ‘এ শহর আমার নয়’।
ঈদের অব্যবহিত আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক প্রাক্কলনে বলা হয়েছিল যে এবারের ঈদে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ লোক ঢাকা ছেড়ে যাবে, যা ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা কমপক্ষে অর্ধেক। শেষ পর্যন্ত কত লোক ঢাকা ছেড়েছিল, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও প্রকৃত সংখ্যা এআরআইয়ের দেওয়া সংখ্যার কাছাকাছি হবে বলেই ধারণা করা চলে। তো সে সংখ্যা সামান্য কম-বেশি যা হোক না কেন, প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত এই ১ কোটি ২০ লাখ লোক বা ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ কেন যানবাহন ও যাতায়াত-পথের এত কষ্ট, দুর্ভোগ ও হয়রানি সহ্য করেও মাত্র তিন-চার দিনের জন্য ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার প্রাণান্ত ‘যুদ্ধে’ নিজেদের প্রায় উৎসর্গ করে দিচ্ছেন? অথচ ঢাকা ত্যাগকারী এ মানুষদের প্রত্যেকেই জানেন, ঈদ পার হতে না হতেই তাঁদের আবার আরেক দফা ফিরতি যুদ্ধে নামতে হবে বসবাস-অযোগ্য ঢাকায় ফিরে আসার জন্য। তাহলে মাত্র তিন-চারটি দিন গ্রামের বাড়িতে কাটানোর জন্য কেন তাঁদের এ প্রাণান্ত প্রয়াস?
একেবারে প্রথম কথা হচ্ছে, এই মানুষদের প্রায় কেউই ঢাকাকে তাঁর নিজের শহর বা আপনস্থান বলে ভাবেন না। মৌসুমি কৃষিশ্রমিক যেমন মজুর ভিত্তিতে ধান কাটার জন্য এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে এসে কাজ শেষে মজুরি নিয়ে দ্রুত নিজ গ্রামে ফিরে যেতে চান, এ-ও অনেকটা তেমনি। ঢাকায় থাকা মানুষেরা চাকরি, ব্যবসা, লেখাপড়া ও অন্য নানা কাজে তথা জীবিকার প্রয়োজনে নিছক বাধ্য হয়ে এখানে থাকছেন বটে। কিন্তু তাঁদের আত্মা কখনোই এ শহরকে ধারণ করতে পারেনি বা এ শহরও কখনো তাঁদের আপন করে নেয়নি। হাকিম হাবিবুর রহমান (১৮৮১-১৯৪৭), কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) বা শিল্পী মুর্তজা বশীরের (১৯৩২-২০২০) মতো দু-চারজনকে ঢাকা তার বুকে জায়গা দিলেও অধিকাংশকেই সে তা দেয়নি। ফলে এখানে কর্মরত মানুষ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে যতই এখানে বছরের পর বছর দিন কাটাক এবং এখানকার জল-হাওয়া যতই তাঁকে বাঁচার রসদ জোগাক, তিনি ভাবেন, এ শহর, এই শহরের দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, খাবারদাবার, নাচ-গান, কলকাকলি এসবের কিছুই তাঁর নয়। এমনকি যে কারখানা, অফিস, দোকান, ফুটপাত বা রাস্তাঘাটে তিনি কাজ করেন, সেসবের সঙ্গেও তাঁর কোনো আত্মিক সম্পর্ক নেই।
দিনের পর দিন এখানে বসবাস করা সত্ত্বেও রাজধানী ঢাকার সঙ্গে তার মানুষদের একটি আত্মিক সম্পর্ক কেন গড়ে উঠতে পারল না অথবা তার বিপরীতে এমন একটি হৃদয়হীন অস্বাভাবিক সম্পর্ক কেন ও কীভাবে টিকে থাকল, তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রথমেই আসা যাক পোশাকশ্রমিকদের কথায়। দেশের পোশাক কারখানাগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাদের সিংহভাগের কর্মস্থলই ঢাকা ও এর সন্নিহিত এলাকায়। এই শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁদের মালিকেরা যে আচরণ করেন, তাতে করে নিজ কর্মস্থলকে তাঁদের পক্ষে কখনোই আপন ভাবার কোনো কারণ নেই। ফলে শুধু ঈদে কেন, যেকোনো সময় তাঁরা ঢাকা ছাড়তে পারলেই বর্তে যান, কিন্তু পেটের দায়ে তা পারেন না। অন্য কারখানাগুলোর অবস্থা পোশাক খাতের মতো অতটা নাজুক না হলেও তাঁদের পক্ষেও ঢাকাকে আপন ভাবার কোনো কারণ নেই; বরং ভেতরে-ভেতরে এ শহরকে তাঁরাও প্রচণ্ড ঘৃণা করেন, যে ঘৃণা ঈদের এক দিন আগপর্যন্ত কারখানায় কাজ করতে গিয়ে আরও বৃদ্ধি পায়। অতএব হেঁটে হলেও ঢাকার প্রতি ঘৃণা ছিটিয়ে ঈদে বাড়ি তিনি যাবেনই, যেমনটি গিয়েছিলেন করোনার সময়।
পেশা বিবেচনায় পোশাকশ্রমিকের পর ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড়সংখ্যক মানুষ হচ্ছেন নিউমার্কেটের সাম্প্রতিক হিংসাত্মক ঘটনায় নিহত কুরিয়ার সার্ভিসকর্মী নাহিদ হোসেন ও দোকান কর্মচারী মোহাম্মদ মোরসালিনের মতো খুবই সাধারণ পেশার মানুষেরা। মোরসালিনের মতো মানুষেরা ঈদের দু-এক দিন আগে স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে ঈদের আগের মধ্যরাত পর্যন্ত দোকানে কাজ করেন এবং কাজ শেষ করে ওই রাতেই লঞ্চে বা বাসে করে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। পাঠক বলুন, যে শহরের কর্মস্থল ঈদের আগের দিন বা আগের মাঝরাত পর্যন্ত কোনো বাড়তি প্রণোদনা বা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই তার কর্মচারীকে কাজে আটকে রাখে, সে শহরকে নাহিদ বা মোরসালিনেরা কোন যুক্তিতে আপন ভেবে ভালোবাসবেন? তারপরও যদি বেতনের পরিমাণটি উৎসাহব্যঞ্জক হতো, তাহলেও একটি কথা ছিল।
কিন্তু এর কোনো কিছুই তো তাঁকে এ ঢাকা শহরের প্রতি মমতাবান হয়ে উঠতে উৎসাহিত করতে পারছে না। শতভাগ নির্ভরযোগ্য না হলেও মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য হিসাব অনুযায়ী দেশের গণপরিবহন খাতে সড়ক ও নৌপথ মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ শ্রমিক (চালক, সাহায্যকারী ও অন্যান্য) কাজ করেন, যাঁদের সিংহভাগই কর্মরত ঢাকা ও এর সন্নিহিত উপশহরগুলোতে। তাঁদের প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয়, পোশাকশ্রমিকেরা যেখানে মূলত মালিকের দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকেন, সেখানে পরিবহনশ্রমিকেরা একই সঙ্গে চরম অমানবিকভাবে নিগৃহীত হন মালিক, যাত্রী, পুলিশ, চাঁদাবাজ ও অন্যান্য নানা অদৃশ্য ও দৃশ্যমান অংশীজনের দ্বারা। ফলে রাজধানীর আর সবাই মিলে জোট গঠন করেও যদি ঈদে ঢাকা শহরে থেকে যেতে রাজি হন, তাহলেও নিছক বাধ্য না হলে পরিবহনশ্রমিকদের কেউ ঢাকায় থাকতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। কারণ এ শহর তাঁর গতরকেই শুধু ব্যবহার করে—তাঁকে কখনো মানুষ বলে গণ্য করে না। ফলে কেন তিনি ভাববেন যে ঢাকা তাঁর নিজের শহর?
ঢাকা শহরের ফুটপাতে যে হকাররা বসেন, এর বাসস্ট্যান্ড-স্টেশন-টার্মিনালে কুলিমজুরসহ যে ভাসমান মানুষেরা কাজ করেন, এর রাস্তাঘাটে যাঁরা ছিনতাই বা পকেট কাটার মতো কাজে নিয়োজিত আছেন, এর জনসভায় সমাগম বাড়ানোর জন্য যাঁরা ব্যবহৃত হন, দরপত্র ছিনতাই ও চাঁদাবাজির সুযোগ লাভের বিনিময়ে যাঁরা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের লাঠিয়াল বাহিনীর (অবশ্য আজকাল শুধু লাঠি নয়, আগ্নেয়াস্ত্র ও হেলমেট ব্যবহার করেন) সদস্য হিসেবে কাজ করেন, বিভিন্ন অফিস-আদালত ও রাজনৈতিক দলের অফিসে যাঁরা তদবিরকারক হিসেবে ব্যস্ত সময় কাটান, যাঁরা মানব পাচার ও আদম ব্যবসায়ের দালালির সঙ্গে যুক্ত—তাঁরা যতই বছরের পর বছর ঢাকা শহরে বসবাস করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা কেউই এ শহরকে তাঁর নিজের বলে ভাবেন না।
এর বাইরেও রয়েছে শিক্ষিত ও শিক্ষাবঞ্চিত চাকরি অনুসন্ধানী বেকার, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থী, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বড় সংখ্যার ছোট কর্মচারী, বস্তি-ফুটপাত-রেললাইনের পাশে বসবাসকারী ছিন্নমূল মানুষ ইত্যাদি।
তাঁদের কেউই কি ঢাকাকে তাঁর নিজের শহর বলে ভাবেন বা তা ভাবার কোনো কারণ আছে? কস্মিনকালেও না। তাহলে ঢাকাকে আপন ভাবে কারা? সত্যি কথা বলতে কি, গত শতাব্দীর শেষনাগাদ গড়ে ওঠা স্বল্পসংখ্যার ক্ষয়িষ্ণু শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্ত এবং এর পর থেকে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে রাতারাতি গড়ে ওঠা কালোটাকার বিত্তবান বণিক এবং অসৎ আমলা ও অসৎ রাজনীতিক ব্যতীত ঢাকা শহরে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষই একে তাঁর নিজের শহর বলে গণ্য করেন না। এরই মধ্যে আবার শেষোক্তদের অবৈধ সম্পদের দৌরাত্ম্যে প্রথমোক্ত শ্রেণির সীমিত সংখ্যার শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তও এখন অনেকটাই কোণঠাসা।
আর এমনি একটি অসুস্থ পরিবেশের ভেতর দিয়েই রাজধানীর বিকাশ ঘটছে বিধায় এর রক্ষণাবেক্ষণ, আইনশৃঙ্খলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ, মানুষের মধ্যকার আন্তসম্পর্ক ও মূল্যবোধ কোনো কিছুই সুস্থ ধারায় এগোচ্ছে না বা এগোতে পারছে না। কারণ এসবের কোনোটিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের আন্তরিক সমর্থন বা অংশগ্রহণ নেই। ফলে যে ধারায় ঢাকা শহর এগোচ্ছে, তাতে পরিকল্পনাবিহীন সুউচ্চ ইমারত এবং বিদৃশ্য রাস্তাঘাট ওঅন্যান্যঅবকাঠামো মিলে এর ব্যাপক স্ফীতি ঘটছে বটে। কিন্তু সেই স্ফীতি কতটা আধুনিক ও টেকসই হবে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর এ কথা তো মানতেই হবে যে একটি আধুনিক শহর শুধু ভারী লোহালক্কড় দিয়েই গড়ে ওঠে না, এর জন্য প্রয়োজন উচ্চতর চিন্তা, রুচি, মূল্যবোধ ও মানবিক আচরণসংবলিতএকটিশিক্ষিত আধুনিক নাগরিক সমাজ, যা গড়ে তুলতে সম্ভবত আমরা প্রায় পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছি এবং ব্যর্থতার সে গ্লানিময় ধারা এখনো অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিরা এর রাষ্ট্রকাঠামোর যে স্বপ্ন তাঁদের কল্পনায় এঁকেছিলেন, নিশ্চয় সেখানে একটি রাজধানীর কল্পনাও ছিল। হলফ করে বলতে পারি, এরূপ একটি রাজধানীর কল্পনা তাঁরা করেননি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চরমভাবে বিধ্বস্ত এ ভৌতিক ও সামাজিক দুরবস্থা থেকে ঢাকা শহরকে বের করে আনার উপায় কী? অপ্রিয় সত্য মানতে আপত্তি না থাকলে স্বীকার করতেই হবে, ইতিমধ্যে এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে ন্যূনতম মানের একটি শহর হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলা বা নিদেনপক্ষে যতটুকু ছিল, সেটুকু ফিরে পাওয়া আদৌ সম্ভব হবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তারপরও আশা জিইয়ে রাখা যেতে পারে এ শর্তে যে, এই শহরের সব ভৌত ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে এখানে বসবাসরত সব নাগরিকের অংশগ্রহণের ধারণাকে রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোতে সুস্পষ্ট নীতিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করে সেই অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করতে হবে। আরও স্পষ্ট করে বললে বিষয়টি দাঁড়ায় এই, এই নগরীর পরিচালন ও উন্নয়নের সকল পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নাগরিক সাধারণের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ও তাঁদের কাছে পরিচালকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে আর্থিক বিনিয়োগ শুধু ভৌত উন্নয়নের জন্য করলেই হবে না, একই সঙ্গে সমান গুরুত্বের সঙ্গে তা সমাজগঠন ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্যও করতে হবে। আর তা করতে না পারলে নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ কবিতার পঙ্ক্তি অনুসরণে আমাদের হয়তো এ কষ্টময় উচ্চারণই বারবার করতে হবে যে ‘এ শহর আমার নয়’।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে