ড. মইনুল ইসলাম
আইএমএফের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ ২০২০-এর প্রক্ষেপণ মোতাবেক ওই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ মাথাপিছু নমিনাল জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ ভারতকে টপকে গেছে। মহামারির আঘাতে ভারতীয় অর্থনীতি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়ে সে দেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ২০১৯ সালের ২ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৮৭৭ ডলারে নেমে গিয়েছিল।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দ্রুত ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে মাথাপিছু জিডিপিকে ১ হাজার ৮৮৮ ডলারে নিয়ে যাওয়ার কথা। ভারতীয়দের ‘সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ ও মিথ্যা অহমিকাপ্রসূত ‘ইগো’ আইএমএফের এই পূর্বাভাসের ফলে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।
২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশিদের মাথাপিছু জিএনআই ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে পৌঁছেছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তথ্য প্রকাশ করেছে। এই দাবি সত্য হলে এখনো বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই ভারতীয়দের চেয়ে বেশি রয়ে গেছে। অবশ্য গত অর্থবছরে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ছিল।
অতএব বর্তমানে ভারত আবারও মাথাপিছু জিএনআইয়ের বিবেচনায় বাংলাদেশকে টপকে যেতেও পারে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বছর কয়েক আগে বাংলাদেশিদের ‘উইপোকা’ বলে তাচ্ছিল্য করার পর বাংলাদেশিদের মাথাপিছু জিএনআই ভারতীয়দের মাথাপিছু জিএনআইকে টপকে যাওয়ার সম্ভাবনা হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের অনেকের মারাত্মক বদহজম ও অনিদ্রা-ব্যামোর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু এটা শুধু এক বছরের করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাত নয়। ২০১৭ সালেও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি ছিল। এরপর পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছিল।২০২২ সাল থেকে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আবার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হয়েছে।
আমি অবশ্য নমিনাল জিডিপি নিয়ে অতি-উচ্ছ্বসিত হব না। পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) ভিত্তিতে ২০২২ সালে ভারতের প্রাক্কলিত মাথাপিছু জিএনআই ৮ হাজার ২১০ পিপিপি ডলার, আর বাংলাদেশের ৬ হাজার ৮৯০ পিপিপি ডলার। এর মানে, ভারতে বেশির ভাগ পণ্য ও সেবার দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম হওয়ায় ভারতের জনগণের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের চেয়ে উঁচু। প্রথমেই ‘পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি’ বা ‘ক্রয়ক্ষমতার সমতা’ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করছি।
বিশ্বের দেশে দেশে যেহেতু বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম কম-বেশি হয়, সে জন্য বিভিন্ন দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানকে তুলনীয় করার জন্য পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে নমিনাল জিডিপিকে ‘পিপিপি ডলারে জিডিপি’তে রূপান্তরিত করা হয়।
এটা একটা যুগান্তকারী গবেষণার ফসল, কিন্তু পদ্ধতিটি বেশ টেকনিক্যাল হওয়ায় সাধারণ পাঠকের কাছে বিষয়টি জটিল মনে হবে (কম্পিউটার প্রযুক্তি বিপ্লবের কারণেই পদ্ধতিটির প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে)। এই পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক শ পণ্য ও সেবার দামকে তুলনার একক হিসেবে ব্যবহার করে অন্যান্য দেশে একই পণ্য ও সেবাগুলোর দাম কতখানি বেশি বা কম, এর তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিটি দেশের মুদ্রার অভ্যন্তরীণ ক্রয়ক্ষমতাকে মার্কিন ডলারের ক্রয়ক্ষমতার তুলনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। ফলে যেসব দেশে পণ্য ও সেবার দাম যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি, সেই দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপিকে কমিয়ে আনা হয় এবং যেসব দেশে পণ্য ও সেবার দাম যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম, সেই দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপিকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
সাধারণভাবে যেসব দেশের মাথাপিছু জিডিপি কম, সেই সব দেশে অধিকাংশ পণ্য ও সেবার দামও তুলনামূলকভাবে কম হয়, এ ক্ষেত্রে ভারত এবং বাংলাদেশের ব্যাপারটা অনেকখানি ব্যতিক্রম। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ বেশির ভাগ পণ্য ও সেবার দাম ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা—যেগুলোকে ‘মৌল চাহিদা’ বলা হয়, সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব পণ্য ও সেবার দাম ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। উদাহরণ: ১. চাল, আটা, ময়দা, মসলাপাতি, তরিতরকারি, ডাল, মুরগি, ডিম, দুধ, মাখন—সবই ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে সস্তা; ২. শার্ট, ট্রাউজার, জিনস্, টি-শার্ট ও জুতো-স্যান্ডেল ছাড়া নারী-পুরুষ-কিশোর-কিশোরী-শিশুর কাপড়-চোপড় ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে সস্তা; ৩. ভারতে কম্পিউটারসহ অধিকাংশ ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম, মোবাইল টেলিফোন কল অবশ্য বাংলাদেশে সস্তা; ৪. ভারতে বিদেশি ব্র্যান্ডের গাড়ি খুব বেশি পাওয়া না গেলেও সে দেশে উৎপাদিত গাড়ির দাম বাংলাদেশে আমদানি করা গাড়ির তুলনায় অনেক কম; ৫. ভারতের বেশির ভাগ শহরে এবং গ্রামে জমিজমার দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম; ৬. ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলো ব্যতীত অন্যত্র অধিকাংশ নির্মাণসামগ্রীর দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম, তাই অ্যাপার্টমেন্ট বা পাকা বাড়ির দাম এবং নির্মাণ খরচও কম; ৭. ভারতের শিক্ষাখরচ প্রাইমারি থেকে উচ্চতর লেভেল পর্যন্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাংলাদেশের কাছাকাছি হলেও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষাখরচ বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে বেশি; ৮. স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসার খরচ ভারতে বাংলাদেশের তুলনীয় পর্যায়ে হলেও এসব সেবার মান ভারতে উন্নততর এবং ৯. ভারতে বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি ও প্লেনের ভাড়া বাংলাদেশের তুলনায় কম।
আরও অনেক আইটেম পিপিপি পদ্ধতির আওতায় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আমি জনগণের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী কিছু পণ্য ও সেবাকে তুলনার জন্য উল্লেখ করেছি মূল কথাটা বলার জন্য: ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হলেও জীবনযাত্রার ব্যয় ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে কম হওয়ায় ২০২২ সালের হিসাবে পিপিপি পদ্ধতিতে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ৮ হাজার ২১০ পিপিপি ডলার এবং বাংলাদেশের ৬ হাজার ৮৯০ পিপিপি ডলার রয়ে গেছে। ফলে এখন বাংলাদেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ভারতের চেয়ে বেশি হলেও ভারতের জনগণ ভোক্তা হিসেবে বাংলাদেশিদের চেয়ে অনেক সুলভে ও স্বচ্ছন্দে জীবন নির্বাহ করতে পারছেন।
মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয়বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে; ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগণ জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন দেশে বেশি পাচ্ছে, তা জানতে দুই দেশের বিদ্যমান আয় ও সম্পদবৈষম্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এ ব্যাপারে দুই দেশের তুলনা বেশ কঠিন। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত দুই দেশের জিনি সহগগুলো ভিন্ন ভিন্ন বছরের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়ায় তুলনীয় নয়।
শুধু এটুকু বলব, ২০২২ সালের হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে মোতাবেক, বাংলাদেশের আয়বৈষম্য-পরিমাপকারী জিনি সহগ বেড়ে শূন্য দশমিক ৪৯৯-এ পৌঁছে গেছে। এর মানে, এখন বাংলাদেশ উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক ২০১২ থেকে ২০১৭—এই পাঁচ বছরে অতি-ধনী (আলট্রা-হাই নেট ওয়ার্থ ইনডিভিজুয়্যাল, যাঁদের সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে তিন মিলিয়ন ডলার) ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ।
ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে অতি-ধনীর সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। ভারত এ ব্যাপারে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন না হলেও অতি-ধনীর সংখ্যা সেখানেও ক্রমেই বাড়ছে, যা আয়বৈষম্য বাড়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী। আর এটারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে’ বাংলাদেশের অবস্থানের চেয়ে ভারত অনেক পেছনে চলে যাওয়ার ব্যাপারটায়।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ঝাড়খন্ড, ওডিশা, ছত্তিশগড়, সেভেন সিস্টার্সসহ (আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও মিজোরাম) অধিকাংশ রাজ্যের প্রায় আশি কোটি জনগণের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি এবং পিপিপি ডলারে মাথাপিছু জিডিপি উভয়ই বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। আঞ্চলিক আয়বৈষম্য বাংলাদেশেও রয়েছে, তবে ভারতে তা প্রকট।
করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলার সংগ্রামেও আমরা পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে ভালো করেছি। করোনাভাইরাস মহামারিতে ভারতীয় অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ২০২০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের নমিনাল মাথাপিছু জিডিপি ভারতের চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও স্বীকার করতেই হবে, সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে; বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত মোকাবিলায় ভারত বাংলাদেশের তুলনায় সফল হয়েছে। ভারতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ছাড়িয়ে যেতে চাইলে জাতিকে অবিলম্বে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করতেই হবে। আর মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যাপারে দক্ষতা দেখাতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আইএমএফের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ ২০২০-এর প্রক্ষেপণ মোতাবেক ওই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ মাথাপিছু নমিনাল জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ ভারতকে টপকে গেছে। মহামারির আঘাতে ভারতীয় অর্থনীতি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়ে সে দেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ২০১৯ সালের ২ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৮৭৭ ডলারে নেমে গিয়েছিল।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দ্রুত ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে মাথাপিছু জিডিপিকে ১ হাজার ৮৮৮ ডলারে নিয়ে যাওয়ার কথা। ভারতীয়দের ‘সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ ও মিথ্যা অহমিকাপ্রসূত ‘ইগো’ আইএমএফের এই পূর্বাভাসের ফলে মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।
২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশিদের মাথাপিছু জিএনআই ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে পৌঁছেছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তথ্য প্রকাশ করেছে। এই দাবি সত্য হলে এখনো বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই ভারতীয়দের চেয়ে বেশি রয়ে গেছে। অবশ্য গত অর্থবছরে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ছিল।
অতএব বর্তমানে ভারত আবারও মাথাপিছু জিএনআইয়ের বিবেচনায় বাংলাদেশকে টপকে যেতেও পারে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বছর কয়েক আগে বাংলাদেশিদের ‘উইপোকা’ বলে তাচ্ছিল্য করার পর বাংলাদেশিদের মাথাপিছু জিএনআই ভারতীয়দের মাথাপিছু জিএনআইকে টপকে যাওয়ার সম্ভাবনা হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের অনেকের মারাত্মক বদহজম ও অনিদ্রা-ব্যামোর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু এটা শুধু এক বছরের করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাত নয়। ২০১৭ সালেও ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি ছিল। এরপর পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছিল।২০২২ সাল থেকে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আবার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হয়েছে।
আমি অবশ্য নমিনাল জিডিপি নিয়ে অতি-উচ্ছ্বসিত হব না। পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) ভিত্তিতে ২০২২ সালে ভারতের প্রাক্কলিত মাথাপিছু জিএনআই ৮ হাজার ২১০ পিপিপি ডলার, আর বাংলাদেশের ৬ হাজার ৮৯০ পিপিপি ডলার। এর মানে, ভারতে বেশির ভাগ পণ্য ও সেবার দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম হওয়ায় ভারতের জনগণের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের চেয়ে উঁচু। প্রথমেই ‘পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি’ বা ‘ক্রয়ক্ষমতার সমতা’ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করছি।
বিশ্বের দেশে দেশে যেহেতু বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম কম-বেশি হয়, সে জন্য বিভিন্ন দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানকে তুলনীয় করার জন্য পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে নমিনাল জিডিপিকে ‘পিপিপি ডলারে জিডিপি’তে রূপান্তরিত করা হয়।
এটা একটা যুগান্তকারী গবেষণার ফসল, কিন্তু পদ্ধতিটি বেশ টেকনিক্যাল হওয়ায় সাধারণ পাঠকের কাছে বিষয়টি জটিল মনে হবে (কম্পিউটার প্রযুক্তি বিপ্লবের কারণেই পদ্ধতিটির প্রয়োগ সম্ভব হয়েছে)। এই পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক শ পণ্য ও সেবার দামকে তুলনার একক হিসেবে ব্যবহার করে অন্যান্য দেশে একই পণ্য ও সেবাগুলোর দাম কতখানি বেশি বা কম, এর তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিটি দেশের মুদ্রার অভ্যন্তরীণ ক্রয়ক্ষমতাকে মার্কিন ডলারের ক্রয়ক্ষমতার তুলনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। ফলে যেসব দেশে পণ্য ও সেবার দাম যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি, সেই দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপিকে কমিয়ে আনা হয় এবং যেসব দেশে পণ্য ও সেবার দাম যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম, সেই দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপিকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
সাধারণভাবে যেসব দেশের মাথাপিছু জিডিপি কম, সেই সব দেশে অধিকাংশ পণ্য ও সেবার দামও তুলনামূলকভাবে কম হয়, এ ক্ষেত্রে ভারত এবং বাংলাদেশের ব্যাপারটা অনেকখানি ব্যতিক্রম। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ বেশির ভাগ পণ্য ও সেবার দাম ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা—যেগুলোকে ‘মৌল চাহিদা’ বলা হয়, সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব পণ্য ও সেবার দাম ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। উদাহরণ: ১. চাল, আটা, ময়দা, মসলাপাতি, তরিতরকারি, ডাল, মুরগি, ডিম, দুধ, মাখন—সবই ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে সস্তা; ২. শার্ট, ট্রাউজার, জিনস্, টি-শার্ট ও জুতো-স্যান্ডেল ছাড়া নারী-পুরুষ-কিশোর-কিশোরী-শিশুর কাপড়-চোপড় ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে সস্তা; ৩. ভারতে কম্পিউটারসহ অধিকাংশ ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম, মোবাইল টেলিফোন কল অবশ্য বাংলাদেশে সস্তা; ৪. ভারতে বিদেশি ব্র্যান্ডের গাড়ি খুব বেশি পাওয়া না গেলেও সে দেশে উৎপাদিত গাড়ির দাম বাংলাদেশে আমদানি করা গাড়ির তুলনায় অনেক কম; ৫. ভারতের বেশির ভাগ শহরে এবং গ্রামে জমিজমার দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম; ৬. ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলো ব্যতীত অন্যত্র অধিকাংশ নির্মাণসামগ্রীর দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম, তাই অ্যাপার্টমেন্ট বা পাকা বাড়ির দাম এবং নির্মাণ খরচও কম; ৭. ভারতের শিক্ষাখরচ প্রাইমারি থেকে উচ্চতর লেভেল পর্যন্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাংলাদেশের কাছাকাছি হলেও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষাখরচ বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে বেশি; ৮. স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসার খরচ ভারতে বাংলাদেশের তুলনীয় পর্যায়ে হলেও এসব সেবার মান ভারতে উন্নততর এবং ৯. ভারতে বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি ও প্লেনের ভাড়া বাংলাদেশের তুলনায় কম।
আরও অনেক আইটেম পিপিপি পদ্ধতির আওতায় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আমি জনগণের জীবনযাত্রার মান নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী কিছু পণ্য ও সেবাকে তুলনার জন্য উল্লেখ করেছি মূল কথাটা বলার জন্য: ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হলেও জীবনযাত্রার ব্যয় ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে কম হওয়ায় ২০২২ সালের হিসাবে পিপিপি পদ্ধতিতে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ৮ হাজার ২১০ পিপিপি ডলার এবং বাংলাদেশের ৬ হাজার ৮৯০ পিপিপি ডলার রয়ে গেছে। ফলে এখন বাংলাদেশের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ভারতের চেয়ে বেশি হলেও ভারতের জনগণ ভোক্তা হিসেবে বাংলাদেশিদের চেয়ে অনেক সুলভে ও স্বচ্ছন্দে জীবন নির্বাহ করতে পারছেন।
মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয়বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে; ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগণ জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন দেশে বেশি পাচ্ছে, তা জানতে দুই দেশের বিদ্যমান আয় ও সম্পদবৈষম্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এ ব্যাপারে দুই দেশের তুলনা বেশ কঠিন। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত দুই দেশের জিনি সহগগুলো ভিন্ন ভিন্ন বছরের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়ায় তুলনীয় নয়।
শুধু এটুকু বলব, ২০২২ সালের হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে মোতাবেক, বাংলাদেশের আয়বৈষম্য-পরিমাপকারী জিনি সহগ বেড়ে শূন্য দশমিক ৪৯৯-এ পৌঁছে গেছে। এর মানে, এখন বাংলাদেশ উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক ২০১২ থেকে ২০১৭—এই পাঁচ বছরে অতি-ধনী (আলট্রা-হাই নেট ওয়ার্থ ইনডিভিজুয়্যাল, যাঁদের সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে তিন মিলিয়ন ডলার) ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ।
ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে অতি-ধনীর সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। ভারত এ ব্যাপারে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন না হলেও অতি-ধনীর সংখ্যা সেখানেও ক্রমেই বাড়ছে, যা আয়বৈষম্য বাড়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী। আর এটারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে’ বাংলাদেশের অবস্থানের চেয়ে ভারত অনেক পেছনে চলে যাওয়ার ব্যাপারটায়।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ঝাড়খন্ড, ওডিশা, ছত্তিশগড়, সেভেন সিস্টার্সসহ (আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা ও মিজোরাম) অধিকাংশ রাজ্যের প্রায় আশি কোটি জনগণের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি এবং পিপিপি ডলারে মাথাপিছু জিডিপি উভয়ই বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। আঞ্চলিক আয়বৈষম্য বাংলাদেশেও রয়েছে, তবে ভারতে তা প্রকট।
করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলার সংগ্রামেও আমরা পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে ভালো করেছি। করোনাভাইরাস মহামারিতে ভারতীয় অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ২০২০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের নমিনাল মাথাপিছু জিডিপি ভারতের চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও স্বীকার করতেই হবে, সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে; বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত মোকাবিলায় ভারত বাংলাদেশের তুলনায় সফল হয়েছে। ভারতকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ছাড়িয়ে যেতে চাইলে জাতিকে অবিলম্বে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করতেই হবে। আর মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যাপারে দক্ষতা দেখাতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে