ঘাদা আগিল
গাজা উপত্যকার নিচের দিকে উপকূলীয় একটি বিরল সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান ছিল আল-মাওয়াসি। খান ইউনিস ও রাফাহর মধ্যে প্রায় ১২ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকাটি ছিল সবচেয়ে নান্দনিক সমুদ্রসৈকতগুলোর মধ্যে একটি। সেখানকার স্বর্ণালি বালি, সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, অপরূপ সূর্যাস্ত এবং শান্ত সমুদ্রের বাতাস—সব মিলিয়ে আল-মাওয়াসিকে একটি জনপ্রিয় স্থানে পরিণত করেছিল। কিন্তু এখন এর সুন্দর রূপটি আর নেই। ইসরায়েলের গণহত্যার কারণে আল-মাওয়াসি এখন সীমাহীন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে, যখন ইসরায়েলি বিমানগুলো গাজা উপত্যকাজুড়ে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করছিল, তখন ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী (আইওএফ) আল-মাওয়াসিকে ‘একটি নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যেখানে পালিয়ে আসা ভীতসন্ত্রস্ত ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকেরা নিরাপদে থাকবে। ইসরায়েলি কমান্ডাররা পরে দাবি করতে পারে যে তারা এটিকে ‘স্থায়ী নিরাপদ অঞ্চল’ বলে মনে করেছিল।
যদিও আল-মাওয়াসিতে খুব কমই অবকাঠামো ছিল এবং মানবিক সংস্থাগুলো সতর্ক করেছিল যে এলাকাটি শরণার্থীশিবিরের জন্য উপযুক্ত নয়। তবে গাজা, খান ইউনিস এবং পরে রাফাহ থেকে হাজার হাজার মানুষ আল-মাওয়াসিতে জড়ো হয়েছিল, কারণ তাদের যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা ছিল না।
অনেকে হাতের কাছে যা পেয়েছে—প্লাস্টিক, কম্বল তাই দিয়ে মাথা গোঁজার মতো আশ্রয়শিবির বানিয়েছে। এসব শিবিরে জীবন ছিল দুর্বিষহ। অনাহার, রোগ, খাবার পানির অভাব—আশ্রয় নেওয়া বাসিন্দাদের জীবনকে জর্জরিত করে তোলে। দ্রুত এটি স্পষ্ট হয়ে গেল যে ‘স্থায়ী নিরাপদ অঞ্চল’ মোটেই নিরাপদ নয়।
ফেব্রুয়ারিতে আইওএফ আল-মাওয়াসি এলাকায় ইসরায়েল আক্রমণ চালায়, যার মধ্যে ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) একজন কর্মী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের একটি সেফ হাউস ছিল। এতে নারী-শিশুসহ দুজন নিহত এবং ছয়জন আহত হয়।
মে মাসের শেষের দিকে ইসরায়েলি বাহিনী আবারও ওই এলাকায় বোমা হামলা চালায়। এতে ১২ জন নারীসহ কমপক্ষে ২১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) রাফাহয় ইসরায়েলকে তার গণহত্যামূলক আক্রমণ বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার কয়েক দিন পর এ ঘটনা ঘটে। ২১ জুন ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী আবার আল-মাওয়াসি আক্রমণ করে। সেদিন কমপক্ষে ২৫ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৫০ জন আহত হয়।
এগুলো ইসরায়েলি সেনাদের ক্রমাগত আক্রমণের কয়েকটি উদাহরণ মাত্র, যার প্রতি পশ্চিমা গণমাধ্যম খুব কম নজর দিয়েছে। আর ইসরায়েলিরা তো এসব হামলা চালানোর খবর স্বীকারই করেনি।
গত ২৭ জুন আমি আমার পরিবারের একজন ডাক্তারের টেক্সট মেসেজে জেগে উঠি। আল-মাওয়াসির ওপর আরেকটি হামলার বর্ণনা পড়ে আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে। এবার ইসরায়েলি সেনারা আল-শাকুশ এবং স্থানীয় পার্কগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে।
এই এলাকাগুলো বাস্তুচ্যুত মানুষ, তাঁবুর ছাউনি, তাঁবু ও অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে পূর্ণ। যেখানে লোকেরা একে অপরের ঘাড়ের ওপর বাস করছে। আমার পরিবারের সদস্যের বার্তা পড়ুন: ‘ট্যাংকগুলো কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই কয়েকটি তাঁবুর ওপর দিয়ে ঢুকে পড়ে এবং নির্বিচারে গুলি চালায়। দেখলাম মানুষ ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তাদের কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিতে পেরেছে, আবার কেউ কেউ কিছুই নিয়ে যেতে পারেনি—সবাই বাঁচার জন্য প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। অনেকে গোলাগুলি থেকে বাঁচার জন্য মাটিতে শুয়ে পড়ে। অন্যরা যেখানে পেরেছে আশ্রয় নিয়েছে, কেউ কেউ রাস্তায় বসে ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি, যার আসলে কোনো শেষ নেই।’
পরের দিন, আমি অন্য একজন ডাক্তারের কথা শুনতে পেয়েছি, যিনি আল-শাকুশে যা ঘটেছে তা নিজ চোখে দেখেছেন। তিনি একটি হাসপাতাল থেকে আরেকটি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। দেখলেন, ইসরায়েলি ট্যাংকগুলো বিভিন্ন দিক থেকে এসে কোনো সতর্কতা ছাড়াই নির্বিচারে গুলি চালায়। তিনি তাঁর পরিবারকে উদ্ধার করতে ছুটে যান এবং তাদের বের করে আনতে সক্ষম হন।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, আল-মাওয়াসির ওপর ইসরায়েলের নতুন হামলায় ‘অনেক মানুষ হতাহত হয়েছে’ এবং অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আল-মাওয়াসির গণহত্যার কয়েক দিন পর, ১ জুলাই খান ইউনিসের পূর্বাংশে ইসরায়েলি বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, যা গাজা উপত্যকার সবচেয়ে মনোরম এলাকাগুলোর একটি ছিল। ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী আবাসান, বনি সুহাইলা, খুজাআ এবং আল-ফুখারির মতো শহুরে এলাকা খালি করার নির্দেশ দেয়। এখানে ইউরোপীয় হাসপাতালও রয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনী সন্ধ্যায় এ নির্দেশ দেয়। তারা বাসিন্দাদের জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য কোনো সময় দেয়নি। পরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িঘর এবং অস্থায়ী তাঁবুর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে লোকজন চরম দুর্দশার মুখে পড়ে। আর এটা এমনই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা যে আমার এক আত্মীয় একে শেষ বিচারের দিনের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
জাতিসংঘের মতে, ইসরায়েলি বাহিনী এক-চতুর্থাংশ লোককে খান ইউনিস ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে। ইউরোপীয় হাসপাতালটিকেও খালি করতে হয়েছিল। এর অনেক রোগীকে তাদের পরিবারগুলো গাধার গাড়িতে করে বিধ্বস্ত নাসের হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে, যেখানে কিনা সম্প্রতি গণহত্যা চালানো হয়।
প্রতিটি স্থানচ্যুতির পর ফিলিস্তিনিদের নতুন করে অস্থায়ী আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে।
এ সময় পানি, খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সুরক্ষিত রাখতে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আমার ভাইবোন ও তাদের পরিবার, যারা ডিসেম্বর থেকে আল-মাওয়াসিতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তারা আমাকে শিশু, নারী এবং পুরুষ, অসুস্থ ও বয়স্কদের ভয়জড়িত মুখের বর্ণনা দিয়েছে। তারা কোনো দিশা না পেয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আজ গাজার প্রতি ১০ জন ফিলিস্তিনির মধ্যে ৯ জন নিরাপত্তার সন্ধানে বাড়িঘর ছেড়ে দিয়ে কোনো এক তাঁবুতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। আবার আক্রমণের শিকার হয়ে সেখান থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে। গাজা উপত্যকার সব মানুষ অকল্পনীয় কিন্তু একেবারে বাস্তব মাত্রার নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে। এদের অর্ধেকের বেশি শিশু।
তথাকথিত ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ ফিলিস্তিনিদের ওপর নিয়মতান্ত্রিক এবং ক্রমাগত আক্রমণ, তাদের অবকাঠামো ধ্বংস, যতটা সম্ভব বেসামরিক লোককে হত্যা এবং আতঙ্কিত করাই ইসরায়েলিদের উদ্দেশ্য বলে মনে হচ্ছে। আমার বোন আমাকে বলেছে, এখন তারা সবাই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে এবং যেকোনো ধরনের মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত। তবে সম্ভবত নিপীড়নে মারা যাওয়াটা সবচেয়ে কঠিন।
হ্যাঁ, ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি বোমায়, ইসরায়েলি বুলেটে মারা যাচ্ছে, কিন্তু তারা নিপীড়নের শিকার হয়েও মারা যাচ্ছে। এটি সেই অসহনীয় অনুভূতি, যা আপনি যখন চলমান গণহত্যার সাক্ষী হন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই অপেক্ষা। আপনি জানেন যে আপনার এবং আপনার পরিবারের পালা আসছে এবং আপনি তা থামাতে অক্ষম। আহতদের আর্তনাদ শুনে, অঙ্গবিহীন শিশুদের দেখে আপনি কষ্ট পাবেন এবং আপনি তাদের সাহায্য করতে পারবেন না জেনে আপনার অসহনীয় অনুভূতি হবে। গোটা বিশ্ব ৯ মাস ধরে গণহত্যা দেখছে এবং এটি বন্ধ করার জন্য কিছুই করা হয়নি জেনে আপনার অসহনীয় অনুভূতি হবে।
ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করে যে ইসরায়েলি বাহিনীর লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষ, পাথর ও গাছ—অর্থাৎ সবকিছু ধ্বংস করা। এই গণহত্যার ৯ মাসের মধ্যে, এটা স্পষ্ট যে এই আগ্রাসন ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে নয়, যা হামাস নামে পরিচিত। এটি ফিলিস্তিনের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ যুদ্ধ।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরাও এই উপসংহারই টেনেছেন। জানুয়ারিতে ইসরায়েলের গণহত্যা মামলার শুনানির সময় দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবী আদিলা হাসিম আইসিজেকে বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড ফিলিস্তিনিদের জীবন ধ্বংসের থেকে কম কিছু নয়।’
পশ্চিমা বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তা এবং ইসরায়েলিদের কুকর্মে সহযোগিতা, এসব অপরাধের সঠিক তদন্তের অভাব এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এর মধ্যে না রাখা—আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিতে দেরি করা প্রমাণ করে, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচারের প্রতি এরা কতটা অবজ্ঞা করেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের জীবনকে লক্ষ্যবস্তু করা শুধু আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন নয়; বরং মানবিক নীতি ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তির ওপর আক্রমণ।
ঘাদা আগিল, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা, কানাডা
(আল জাজিরার সৌজন্যে লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
গাজা উপত্যকার নিচের দিকে উপকূলীয় একটি বিরল সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান ছিল আল-মাওয়াসি। খান ইউনিস ও রাফাহর মধ্যে প্রায় ১২ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকাটি ছিল সবচেয়ে নান্দনিক সমুদ্রসৈকতগুলোর মধ্যে একটি। সেখানকার স্বর্ণালি বালি, সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, অপরূপ সূর্যাস্ত এবং শান্ত সমুদ্রের বাতাস—সব মিলিয়ে আল-মাওয়াসিকে একটি জনপ্রিয় স্থানে পরিণত করেছিল। কিন্তু এখন এর সুন্দর রূপটি আর নেই। ইসরায়েলের গণহত্যার কারণে আল-মাওয়াসি এখন সীমাহীন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে, যখন ইসরায়েলি বিমানগুলো গাজা উপত্যকাজুড়ে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করছিল, তখন ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী (আইওএফ) আল-মাওয়াসিকে ‘একটি নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যেখানে পালিয়ে আসা ভীতসন্ত্রস্ত ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকেরা নিরাপদে থাকবে। ইসরায়েলি কমান্ডাররা পরে দাবি করতে পারে যে তারা এটিকে ‘স্থায়ী নিরাপদ অঞ্চল’ বলে মনে করেছিল।
যদিও আল-মাওয়াসিতে খুব কমই অবকাঠামো ছিল এবং মানবিক সংস্থাগুলো সতর্ক করেছিল যে এলাকাটি শরণার্থীশিবিরের জন্য উপযুক্ত নয়। তবে গাজা, খান ইউনিস এবং পরে রাফাহ থেকে হাজার হাজার মানুষ আল-মাওয়াসিতে জড়ো হয়েছিল, কারণ তাদের যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা ছিল না।
অনেকে হাতের কাছে যা পেয়েছে—প্লাস্টিক, কম্বল তাই দিয়ে মাথা গোঁজার মতো আশ্রয়শিবির বানিয়েছে। এসব শিবিরে জীবন ছিল দুর্বিষহ। অনাহার, রোগ, খাবার পানির অভাব—আশ্রয় নেওয়া বাসিন্দাদের জীবনকে জর্জরিত করে তোলে। দ্রুত এটি স্পষ্ট হয়ে গেল যে ‘স্থায়ী নিরাপদ অঞ্চল’ মোটেই নিরাপদ নয়।
ফেব্রুয়ারিতে আইওএফ আল-মাওয়াসি এলাকায় ইসরায়েল আক্রমণ চালায়, যার মধ্যে ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) একজন কর্মী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের একটি সেফ হাউস ছিল। এতে নারী-শিশুসহ দুজন নিহত এবং ছয়জন আহত হয়।
মে মাসের শেষের দিকে ইসরায়েলি বাহিনী আবারও ওই এলাকায় বোমা হামলা চালায়। এতে ১২ জন নারীসহ কমপক্ষে ২১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) রাফাহয় ইসরায়েলকে তার গণহত্যামূলক আক্রমণ বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার কয়েক দিন পর এ ঘটনা ঘটে। ২১ জুন ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী আবার আল-মাওয়াসি আক্রমণ করে। সেদিন কমপক্ষে ২৫ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৫০ জন আহত হয়।
এগুলো ইসরায়েলি সেনাদের ক্রমাগত আক্রমণের কয়েকটি উদাহরণ মাত্র, যার প্রতি পশ্চিমা গণমাধ্যম খুব কম নজর দিয়েছে। আর ইসরায়েলিরা তো এসব হামলা চালানোর খবর স্বীকারই করেনি।
গত ২৭ জুন আমি আমার পরিবারের একজন ডাক্তারের টেক্সট মেসেজে জেগে উঠি। আল-মাওয়াসির ওপর আরেকটি হামলার বর্ণনা পড়ে আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে। এবার ইসরায়েলি সেনারা আল-শাকুশ এবং স্থানীয় পার্কগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে।
এই এলাকাগুলো বাস্তুচ্যুত মানুষ, তাঁবুর ছাউনি, তাঁবু ও অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে পূর্ণ। যেখানে লোকেরা একে অপরের ঘাড়ের ওপর বাস করছে। আমার পরিবারের সদস্যের বার্তা পড়ুন: ‘ট্যাংকগুলো কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই কয়েকটি তাঁবুর ওপর দিয়ে ঢুকে পড়ে এবং নির্বিচারে গুলি চালায়। দেখলাম মানুষ ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তাদের কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিতে পেরেছে, আবার কেউ কেউ কিছুই নিয়ে যেতে পারেনি—সবাই বাঁচার জন্য প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। অনেকে গোলাগুলি থেকে বাঁচার জন্য মাটিতে শুয়ে পড়ে। অন্যরা যেখানে পেরেছে আশ্রয় নিয়েছে, কেউ কেউ রাস্তায় বসে ছিল। মনে হচ্ছিল কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি, যার আসলে কোনো শেষ নেই।’
পরের দিন, আমি অন্য একজন ডাক্তারের কথা শুনতে পেয়েছি, যিনি আল-শাকুশে যা ঘটেছে তা নিজ চোখে দেখেছেন। তিনি একটি হাসপাতাল থেকে আরেকটি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। দেখলেন, ইসরায়েলি ট্যাংকগুলো বিভিন্ন দিক থেকে এসে কোনো সতর্কতা ছাড়াই নির্বিচারে গুলি চালায়। তিনি তাঁর পরিবারকে উদ্ধার করতে ছুটে যান এবং তাদের বের করে আনতে সক্ষম হন।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, আল-মাওয়াসির ওপর ইসরায়েলের নতুন হামলায় ‘অনেক মানুষ হতাহত হয়েছে’ এবং অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আল-মাওয়াসির গণহত্যার কয়েক দিন পর, ১ জুলাই খান ইউনিসের পূর্বাংশে ইসরায়েলি বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, যা গাজা উপত্যকার সবচেয়ে মনোরম এলাকাগুলোর একটি ছিল। ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী আবাসান, বনি সুহাইলা, খুজাআ এবং আল-ফুখারির মতো শহুরে এলাকা খালি করার নির্দেশ দেয়। এখানে ইউরোপীয় হাসপাতালও রয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনী সন্ধ্যায় এ নির্দেশ দেয়। তারা বাসিন্দাদের জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য কোনো সময় দেয়নি। পরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িঘর এবং অস্থায়ী তাঁবুর ধ্বংসাবশেষের মধ্যে লোকজন চরম দুর্দশার মুখে পড়ে। আর এটা এমনই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা যে আমার এক আত্মীয় একে শেষ বিচারের দিনের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
জাতিসংঘের মতে, ইসরায়েলি বাহিনী এক-চতুর্থাংশ লোককে খান ইউনিস ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে। ইউরোপীয় হাসপাতালটিকেও খালি করতে হয়েছিল। এর অনেক রোগীকে তাদের পরিবারগুলো গাধার গাড়িতে করে বিধ্বস্ত নাসের হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে, যেখানে কিনা সম্প্রতি গণহত্যা চালানো হয়।
প্রতিটি স্থানচ্যুতির পর ফিলিস্তিনিদের নতুন করে অস্থায়ী আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে।
এ সময় পানি, খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সুরক্ষিত রাখতে ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আমার ভাইবোন ও তাদের পরিবার, যারা ডিসেম্বর থেকে আল-মাওয়াসিতে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তারা আমাকে শিশু, নারী এবং পুরুষ, অসুস্থ ও বয়স্কদের ভয়জড়িত মুখের বর্ণনা দিয়েছে। তারা কোনো দিশা না পেয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আজ গাজার প্রতি ১০ জন ফিলিস্তিনির মধ্যে ৯ জন নিরাপত্তার সন্ধানে বাড়িঘর ছেড়ে দিয়ে কোনো এক তাঁবুতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। আবার আক্রমণের শিকার হয়ে সেখান থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে। গাজা উপত্যকার সব মানুষ অকল্পনীয় কিন্তু একেবারে বাস্তব মাত্রার নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে। এদের অর্ধেকের বেশি শিশু।
তথাকথিত ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ ফিলিস্তিনিদের ওপর নিয়মতান্ত্রিক এবং ক্রমাগত আক্রমণ, তাদের অবকাঠামো ধ্বংস, যতটা সম্ভব বেসামরিক লোককে হত্যা এবং আতঙ্কিত করাই ইসরায়েলিদের উদ্দেশ্য বলে মনে হচ্ছে। আমার বোন আমাকে বলেছে, এখন তারা সবাই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে এবং যেকোনো ধরনের মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত। তবে সম্ভবত নিপীড়নে মারা যাওয়াটা সবচেয়ে কঠিন।
হ্যাঁ, ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি বোমায়, ইসরায়েলি বুলেটে মারা যাচ্ছে, কিন্তু তারা নিপীড়নের শিকার হয়েও মারা যাচ্ছে। এটি সেই অসহনীয় অনুভূতি, যা আপনি যখন চলমান গণহত্যার সাক্ষী হন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই অপেক্ষা। আপনি জানেন যে আপনার এবং আপনার পরিবারের পালা আসছে এবং আপনি তা থামাতে অক্ষম। আহতদের আর্তনাদ শুনে, অঙ্গবিহীন শিশুদের দেখে আপনি কষ্ট পাবেন এবং আপনি তাদের সাহায্য করতে পারবেন না জেনে আপনার অসহনীয় অনুভূতি হবে। গোটা বিশ্ব ৯ মাস ধরে গণহত্যা দেখছে এবং এটি বন্ধ করার জন্য কিছুই করা হয়নি জেনে আপনার অসহনীয় অনুভূতি হবে।
ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করে যে ইসরায়েলি বাহিনীর লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষ, পাথর ও গাছ—অর্থাৎ সবকিছু ধ্বংস করা। এই গণহত্যার ৯ মাসের মধ্যে, এটা স্পষ্ট যে এই আগ্রাসন ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে নয়, যা হামাস নামে পরিচিত। এটি ফিলিস্তিনের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ যুদ্ধ।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরাও এই উপসংহারই টেনেছেন। জানুয়ারিতে ইসরায়েলের গণহত্যা মামলার শুনানির সময় দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবী আদিলা হাসিম আইসিজেকে বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড ফিলিস্তিনিদের জীবন ধ্বংসের থেকে কম কিছু নয়।’
পশ্চিমা বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তা এবং ইসরায়েলিদের কুকর্মে সহযোগিতা, এসব অপরাধের সঠিক তদন্তের অভাব এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এর মধ্যে না রাখা—আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিতে দেরি করা প্রমাণ করে, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচারের প্রতি এরা কতটা অবজ্ঞা করেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের জীবনকে লক্ষ্যবস্তু করা শুধু আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন নয়; বরং মানবিক নীতি ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তির ওপর আক্রমণ।
ঘাদা আগিল, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা, কানাডা
(আল জাজিরার সৌজন্যে লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে