মামুনুর রশীদ
বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের ভেঙে যাওয়া সমাজব্যবস্থায় অস্থির নাগরিকদের আহাজারি এবং দুর্দশার মধ্যে একটি শব্দ বারবার বেরিয়ে আসছে, তা হচ্ছে সিন্ডিকেট। যেখানেই অস্থিরতা, দুর্নীতি, বিপুল অসাম্য, সেখানেই বারবার ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হয় একটি শব্দ—সিন্ডিকেট। রাষ্ট্রের সীমিত সুযোগ, নাগরিকদের বঞ্চনার একটি শব্দই বারবার আমরা শুনতে পাই তা হলো—সিন্ডিকেট।
বাসভাড়া বাড়ছে। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায় না, স্কুল-কলেজে শিশুরা ভর্তি হতে পারে না। ঠিকাদারি ব্যবসায়, প্রচারমাধ্যমে, গ্রামপর্যায়ে স্থানীয় সরকারের মধ্যে ব্যাপক সুবিধাবাদী শ্রেণির আগ্রাসনসহ জীবনের সকল পর্যায়েই সিন্ডিকেটের জয়জয়কার। সিন্ডিকেট মানে কিছু দুর্নীতিপরায়ণ লোকের ঐক্য। সেই ঐক্যের মধ্যে রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী সদস্য, আমলা, টাউট-বাটপারদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নানান অপকৌশল লক্ষ করা যায়।
ইতিহাসের সুদীর্ঘ সময় ধরে দেখা যায় যে কখনোই সৎ লোকদের ঐক্য হয় না। অত্যন্ত অবলীলায় বিশ্বাসঘাতক এবং দুর্নীতিপরায়ণদের ঐক্য গড়ে ওঠে। একদা ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল রাজা-বাদশাহদের কাছে। ক্ষমতার খেলা চলত রাজপ্রাসাদে। সেখানেও সিন্ডিকেট হয়ে যেত সৎ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অসৎ ব্যক্তিদের। ইতিহাসের একটা বড় শিক্ষা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে কীভাবে মীরজাফর ইংরেজদের সঙ্গে দ্রুত সিন্ডিকেট তৈরি করে দেশটাকে একটি কোম্পানির হাতে তুলে দিল। সেই থেকে ২০০ বছর একটা লুণ্ঠন-প্রক্রিয়া চলল। ভারতবর্ষকে সর্বস্বান্ত করে গড়ে উঠল ইংরেজের সাম্রাজ্য।
তারপর এ দেশে ইংরেজরা নানা রকম সিন্ডিকেট করেছে, শব্দটা তাদের নিজস্ব ভাষার। ভারতবর্ষ শাসন করার জন্য বহু রকম সিন্ডিকেটের উদ্যোগ তারা নিয়েছে। দেশ স্বাধীন হলেও এই সিন্ডিকেটের কর্তাদের বিরাম নেই। তার বিপরীতে একটি শব্দই চালু হয়েছে—তা হলো, আঙুল ফুলে কলাগাছ। সিন্ডিকেটের মধ্যে যারা ঢুকে যায়, তাদের মধ্যে আর কোনো ধরনের বিবেচনা থাকে না। যেকোনো রাষ্ট্রীয় নিয়মে তারা ভাগ বসায়; বিশেষ করে সম্প্রতি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে তারা বড় বড় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি একজন শিক্ষকের চাকরি ১৬ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকায় তারা বিক্রি করছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল থেকে গ্রামের টাউট-বাটপার-দালাল সবাই এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে।
আবার এই বিপুল অর্থ কোথায় রাখা হবে? একটা উপায় হলো জায়গা-জমি কেনা, আরেকটি উপায় বিদেশে পাচার করা। বাংলাদেশের মতো এই সুযোগ আর কোথাও নেই। আগে বাংলাদেশের পুলিশকে দুর্নীতির জন্য এককভাবে দায়ী করা হতো। কিন্তু এখন তার জায়গায় শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো রাষ্ট্রের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে সিন্ডিকেট করে লাখ লাখ জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। কিন্তু শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ, তা ক্ষমতাবানেরা কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
একদা শিক্ষকতায় কর্মরত সেদিন এক মধ্যবিত্ত নারী তাঁর জীবনের দীর্ঘ বয়ান দিচ্ছিলেন। বয়ানটি ব্যক্তিগত জীবন থেকে তাঁর নানান বঞ্চনার কাহিনি। দরিদ্র পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে কষ্ট করে পড়ালেখা করেছেন, তাঁর মেধাও মধ্যম মানের। কারণ, ভালো কোনো স্কুলে তিনি পড়তে পারেননি, কোচিং করার সাধ্য ছিল না। বহু কষ্টে একটি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পান, সেখানেও বেতন অনিয়মিত। দেখতে মোটামুটি সুন্দরী ছিলেন বলে পড়ে যান এক ক্যাডারের হাতে। ক্যাডারের আয়ের উৎস তিনি জানতেন না। ঘরে নিয়মিত টাকা আসত, ছয় মাস যেতে না যেতে জড়িয়ে পড়েন এক বড় সিন্ডিকেটের হাতে।
এবারে নিয়মিত টাকা আর আসে না। তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং বছর না ঘুরতেই সন্তানের জননী হন। ক্যাডারটির সন্তানের প্রতি কোনো মমতা গড়ে ওঠে না; বরং ভালোবাসা গড়ে ওঠে আরেকজনের প্রতি, নিয়মিত বাসায়ও আসেন না। শোনা যায় তিনি আরেক ক্যাডারের স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন। সেই স্ত্রীর আছে তিনটি ছেলেমেয়ে। ক্যাডারের দামি মোটরসাইকেল আছে।
মোটরসাইকেলে করে মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরেন, নানান মাদকের নেশায় আসক্ত তিনি। কিছু টাকা ছুড়ে দিয়ে চলে যান। নানান ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে স্ত্রী এবং নবজাতককে শাসান। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন, মাস, বছর—এমনি করেই পেরিয়ে যায় সময়। এবারে তাঁর প্রতি নজর দেন আরেক ক্যাডার। নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি বাবার বাড়ি চলে আসেন। দরিদ্র পিতা তাঁকে আশ্রয় দিতে হিমশিম খেতে থাকেন এবং সুবিচারের আশায় বড় ক্যাডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাঁর স্বামী এমনই দুর্ধর্ষ ক্যাডার যে তাঁকে আর কেউ স্পর্শ করতে সাহস পায় না।
এবারে হতভাগ্য পিতা এলাকার থানার ওসির কাছে যান। ওসি বিষয়টি শোনার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বোঝা যায় তাঁর পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। এবারে তাঁর দুই বছরের নাতনিকে নিয়ে এলাকার কমিশনারের কাছে ধরনা দেন। এখানেই হয় বিপদ। সেখানে দেখা যায় ভেতরের ঘরে বসে আছেন তাঁর জামাতা। কমিশনার কোনো সুবিচারের পরামর্শ দিতে পারেন না। কাঁদতে কাঁদতে হতভাগ্য পিতা যখন বেরিয়ে আসছিলেন, তখন দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক বাইরে এসে তাঁকে মামলা করার পরামর্শ দেন। ইতিমধ্যে পিতা বুঝতে পেরেছেন কোথাও তিনি সুবিচার পাবেন না।
এদিকে স্কুলেও নিরাপত্তার অভাবে ওই নারী অনিয়মিত হয়ে গেছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁর জায়গায় আরেকজনকে নিয়োগও দিয়ে দিয়েছে ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে। এবারে তাঁর সামনে আর কোনো পথ বাকি রইল না। গার্মেন্টসে চাকরি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই তাঁর। তা-ও বড়সড় কোনো গার্মেন্টস নয়, একেবারে ছোটখাটো একটা গার্মেন্টস, বেতনও সামান্য। সেই টাকা দিয়ে বাচ্চার দুধটাই শুধু কেনা যায়।শিশুটিকে বাঁচাতে হলে দুধ কেনা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ, মায়ের বুকের দুধ তত দিনে শুকিয়ে গেছে।
সেই নারী এমন সিন্ডিকেটের বর্ণনা দিতে থাকেন। তিনি কিছুতেই ক্যাডারকে বিয়ে করতে চাননি। কিন্তু সেখানে ছিল ক্যাডার সিন্ডিকেটের চাপ। তাঁর স্বামীর জীবনযাপন একটা সিন্ডিকেটের মধ্যে আবদ্ধ। যে সিন্ডিকেটে কোনো মায়া নেই, মমতা নেই, ভালোবাসা নেই, আছে শুধু টাকা আর পেশিশক্তি। আজকাল আর পেশিশক্তিতে চলে না। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবৈধ অস্ত্র। আবার আরেকটি সিন্ডিকেট আছে, যে সিন্ডিকেটের নাম মাদক। শুধু নিজের মাদক সেবন নয়, বিপুল পরিমাণ তরুণের মাদকের জোগান দেওয়া; সেখানেও বিপুল অর্থ এবং শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওই নারীর স্বামী সেই সিন্ডিকেটেরও প্রিয় পাত্র। দু-চারবার তিনি জেলেও গিয়েছেন। কিন্তু সিন্ডিকেটের চাপে মুক্তিও পেয়ে গেছেন।
একদিন সিন্ডিকেটপ্রধানের কাছ থেকে এক প্রস্তাব আসে—তাঁকেও (ওই নারীকে) অন্তর্ভুক্ত করতে চান তাঁদের কাজকর্মে, প্রচুর টাকা তাঁদের। কী রকম একটা জেদের বশবর্তী হয়ে তিনি রাজিও হয়ে যান। দু-চার দিন মাদক সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, তাঁর স্বামী ব্যাপারটি কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না। এ নিয়ে সিন্ডিকেটপ্রধানের সঙ্গে তাঁর স্বামীর প্রবল দ্বন্দ্ব বাধে। সামান্য অস্ত্রের খেলাও হয়। কিন্তু সিন্ডিকেটপ্রধান অস্ত্রের খেলা বাদ দিয়ে বুদ্ধির খেলায় অবতীর্ণ হন এবং প্রমাণসহ তাঁকে খুনের, মাদকের মামলায় জড়িয়ে নিরাপদে জেলে পাঠিয়ে দেন।
কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পেতে তাঁর সময় লাগে না। কারণ জেলে থেকেই আরেকটি সিন্ডিকেটের সন্ধান তিনি পেয়ে যান। এবারে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন রাজনৈতিক নেতার মর্যাদা নিয়ে। ইতিমধ্যে সেই নারীর পিতা গত হয়েছেন, পুরো সংসারের দায়িত্ব তাঁর ওপর। বাড়ির মালিক বাসা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সেখানেও বাড়ির মালিকদের আরেক ধরনের সিন্ডিকেট আছে—বাড়ি আরেকজনের কাছে ভাড়া হয়ে গেছে। এবারে তিনি ওই ছোট্ট গার্মেন্টসে আবার ফিরে আসেন। সেখানেও চাকরির দালালদের সিন্ডিকেট। বেতনের একটা অংশ তাঁকে দিতে হয়, তবে ওই সিন্ডিকেটের হৃদয়বান ব্যক্তিটি তাঁকে বস্তিতে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
কিছুদিন পর বস্তিটিও উচ্ছেদ হয়ে গেল। আরেক সিন্ডিকেট বস্তির দায়িত্ব নিয়ে নিল, যেখানে প্রধান তাঁর স্বামী। একদিন কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে তাঁর স্বামী নতুন বস্তির দায়িত্বভার গ্রহণ করত আসেন, তাঁর সন্তান দূর থেকে তাঁকে দেখে। এভাবেই নানান সিন্ডিকেটের ফলাফলে সেই নারীটি তাঁর সৌন্দর্য, ভালোবাসা, মমতা সবকিছু হারিয়ে একজন ক্যাডারের সন্তানকেই বুকে নিয়ে পথ চলছেন।
কাহিনিটি খুব চমকপ্রদ নয়। কারণ, দৃশ্য এবং অদৃশ্য সিন্ডিকেটের প্রভাবে লক্ষ-কোটি মানুষ কোনোমতে তাদের জীবন ধারণ করছে।রাষ্ট্রের আইন, নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার—কোনো কিছুই সেই নারীর কাছে পৌঁছাতে পারছে না। যা কিছু দৃশ্যমান, তা হচ্ছে সিন্ডিকেট।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের ভেঙে যাওয়া সমাজব্যবস্থায় অস্থির নাগরিকদের আহাজারি এবং দুর্দশার মধ্যে একটি শব্দ বারবার বেরিয়ে আসছে, তা হচ্ছে সিন্ডিকেট। যেখানেই অস্থিরতা, দুর্নীতি, বিপুল অসাম্য, সেখানেই বারবার ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হয় একটি শব্দ—সিন্ডিকেট। রাষ্ট্রের সীমিত সুযোগ, নাগরিকদের বঞ্চনার একটি শব্দই বারবার আমরা শুনতে পাই তা হলো—সিন্ডিকেট।
বাসভাড়া বাড়ছে। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায় না, স্কুল-কলেজে শিশুরা ভর্তি হতে পারে না। ঠিকাদারি ব্যবসায়, প্রচারমাধ্যমে, গ্রামপর্যায়ে স্থানীয় সরকারের মধ্যে ব্যাপক সুবিধাবাদী শ্রেণির আগ্রাসনসহ জীবনের সকল পর্যায়েই সিন্ডিকেটের জয়জয়কার। সিন্ডিকেট মানে কিছু দুর্নীতিপরায়ণ লোকের ঐক্য। সেই ঐক্যের মধ্যে রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী সদস্য, আমলা, টাউট-বাটপারদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নানান অপকৌশল লক্ষ করা যায়।
ইতিহাসের সুদীর্ঘ সময় ধরে দেখা যায় যে কখনোই সৎ লোকদের ঐক্য হয় না। অত্যন্ত অবলীলায় বিশ্বাসঘাতক এবং দুর্নীতিপরায়ণদের ঐক্য গড়ে ওঠে। একদা ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল রাজা-বাদশাহদের কাছে। ক্ষমতার খেলা চলত রাজপ্রাসাদে। সেখানেও সিন্ডিকেট হয়ে যেত সৎ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অসৎ ব্যক্তিদের। ইতিহাসের একটা বড় শিক্ষা নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে কীভাবে মীরজাফর ইংরেজদের সঙ্গে দ্রুত সিন্ডিকেট তৈরি করে দেশটাকে একটি কোম্পানির হাতে তুলে দিল। সেই থেকে ২০০ বছর একটা লুণ্ঠন-প্রক্রিয়া চলল। ভারতবর্ষকে সর্বস্বান্ত করে গড়ে উঠল ইংরেজের সাম্রাজ্য।
তারপর এ দেশে ইংরেজরা নানা রকম সিন্ডিকেট করেছে, শব্দটা তাদের নিজস্ব ভাষার। ভারতবর্ষ শাসন করার জন্য বহু রকম সিন্ডিকেটের উদ্যোগ তারা নিয়েছে। দেশ স্বাধীন হলেও এই সিন্ডিকেটের কর্তাদের বিরাম নেই। তার বিপরীতে একটি শব্দই চালু হয়েছে—তা হলো, আঙুল ফুলে কলাগাছ। সিন্ডিকেটের মধ্যে যারা ঢুকে যায়, তাদের মধ্যে আর কোনো ধরনের বিবেচনা থাকে না। যেকোনো রাষ্ট্রীয় নিয়মে তারা ভাগ বসায়; বিশেষ করে সম্প্রতি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে তারা বড় বড় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি একজন শিক্ষকের চাকরি ১৬ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকায় তারা বিক্রি করছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল থেকে গ্রামের টাউট-বাটপার-দালাল সবাই এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে।
আবার এই বিপুল অর্থ কোথায় রাখা হবে? একটা উপায় হলো জায়গা-জমি কেনা, আরেকটি উপায় বিদেশে পাচার করা। বাংলাদেশের মতো এই সুযোগ আর কোথাও নেই। আগে বাংলাদেশের পুলিশকে দুর্নীতির জন্য এককভাবে দায়ী করা হতো। কিন্তু এখন তার জায়গায় শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো রাষ্ট্রের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত। সেখানে সিন্ডিকেট করে লাখ লাখ জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। কিন্তু শিক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ, তা ক্ষমতাবানেরা কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
একদা শিক্ষকতায় কর্মরত সেদিন এক মধ্যবিত্ত নারী তাঁর জীবনের দীর্ঘ বয়ান দিচ্ছিলেন। বয়ানটি ব্যক্তিগত জীবন থেকে তাঁর নানান বঞ্চনার কাহিনি। দরিদ্র পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে কষ্ট করে পড়ালেখা করেছেন, তাঁর মেধাও মধ্যম মানের। কারণ, ভালো কোনো স্কুলে তিনি পড়তে পারেননি, কোচিং করার সাধ্য ছিল না। বহু কষ্টে একটি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পান, সেখানেও বেতন অনিয়মিত। দেখতে মোটামুটি সুন্দরী ছিলেন বলে পড়ে যান এক ক্যাডারের হাতে। ক্যাডারের আয়ের উৎস তিনি জানতেন না। ঘরে নিয়মিত টাকা আসত, ছয় মাস যেতে না যেতে জড়িয়ে পড়েন এক বড় সিন্ডিকেটের হাতে।
এবারে নিয়মিত টাকা আর আসে না। তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং বছর না ঘুরতেই সন্তানের জননী হন। ক্যাডারটির সন্তানের প্রতি কোনো মমতা গড়ে ওঠে না; বরং ভালোবাসা গড়ে ওঠে আরেকজনের প্রতি, নিয়মিত বাসায়ও আসেন না। শোনা যায় তিনি আরেক ক্যাডারের স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন। সেই স্ত্রীর আছে তিনটি ছেলেমেয়ে। ক্যাডারের দামি মোটরসাইকেল আছে।
মোটরসাইকেলে করে মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরেন, নানান মাদকের নেশায় আসক্ত তিনি। কিছু টাকা ছুড়ে দিয়ে চলে যান। নানান ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে স্ত্রী এবং নবজাতককে শাসান। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন, মাস, বছর—এমনি করেই পেরিয়ে যায় সময়। এবারে তাঁর প্রতি নজর দেন আরেক ক্যাডার। নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি বাবার বাড়ি চলে আসেন। দরিদ্র পিতা তাঁকে আশ্রয় দিতে হিমশিম খেতে থাকেন এবং সুবিচারের আশায় বড় ক্যাডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাঁর স্বামী এমনই দুর্ধর্ষ ক্যাডার যে তাঁকে আর কেউ স্পর্শ করতে সাহস পায় না।
এবারে হতভাগ্য পিতা এলাকার থানার ওসির কাছে যান। ওসি বিষয়টি শোনার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বোঝা যায় তাঁর পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। এবারে তাঁর দুই বছরের নাতনিকে নিয়ে এলাকার কমিশনারের কাছে ধরনা দেন। এখানেই হয় বিপদ। সেখানে দেখা যায় ভেতরের ঘরে বসে আছেন তাঁর জামাতা। কমিশনার কোনো সুবিচারের পরামর্শ দিতে পারেন না। কাঁদতে কাঁদতে হতভাগ্য পিতা যখন বেরিয়ে আসছিলেন, তখন দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক বাইরে এসে তাঁকে মামলা করার পরামর্শ দেন। ইতিমধ্যে পিতা বুঝতে পেরেছেন কোথাও তিনি সুবিচার পাবেন না।
এদিকে স্কুলেও নিরাপত্তার অভাবে ওই নারী অনিয়মিত হয়ে গেছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁর জায়গায় আরেকজনকে নিয়োগও দিয়ে দিয়েছে ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে। এবারে তাঁর সামনে আর কোনো পথ বাকি রইল না। গার্মেন্টসে চাকরি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই তাঁর। তা-ও বড়সড় কোনো গার্মেন্টস নয়, একেবারে ছোটখাটো একটা গার্মেন্টস, বেতনও সামান্য। সেই টাকা দিয়ে বাচ্চার দুধটাই শুধু কেনা যায়।শিশুটিকে বাঁচাতে হলে দুধ কেনা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ, মায়ের বুকের দুধ তত দিনে শুকিয়ে গেছে।
সেই নারী এমন সিন্ডিকেটের বর্ণনা দিতে থাকেন। তিনি কিছুতেই ক্যাডারকে বিয়ে করতে চাননি। কিন্তু সেখানে ছিল ক্যাডার সিন্ডিকেটের চাপ। তাঁর স্বামীর জীবনযাপন একটা সিন্ডিকেটের মধ্যে আবদ্ধ। যে সিন্ডিকেটে কোনো মায়া নেই, মমতা নেই, ভালোবাসা নেই, আছে শুধু টাকা আর পেশিশক্তি। আজকাল আর পেশিশক্তিতে চলে না। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবৈধ অস্ত্র। আবার আরেকটি সিন্ডিকেট আছে, যে সিন্ডিকেটের নাম মাদক। শুধু নিজের মাদক সেবন নয়, বিপুল পরিমাণ তরুণের মাদকের জোগান দেওয়া; সেখানেও বিপুল অর্থ এবং শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওই নারীর স্বামী সেই সিন্ডিকেটেরও প্রিয় পাত্র। দু-চারবার তিনি জেলেও গিয়েছেন। কিন্তু সিন্ডিকেটের চাপে মুক্তিও পেয়ে গেছেন।
একদিন সিন্ডিকেটপ্রধানের কাছ থেকে এক প্রস্তাব আসে—তাঁকেও (ওই নারীকে) অন্তর্ভুক্ত করতে চান তাঁদের কাজকর্মে, প্রচুর টাকা তাঁদের। কী রকম একটা জেদের বশবর্তী হয়ে তিনি রাজিও হয়ে যান। দু-চার দিন মাদক সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, তাঁর স্বামী ব্যাপারটি কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না। এ নিয়ে সিন্ডিকেটপ্রধানের সঙ্গে তাঁর স্বামীর প্রবল দ্বন্দ্ব বাধে। সামান্য অস্ত্রের খেলাও হয়। কিন্তু সিন্ডিকেটপ্রধান অস্ত্রের খেলা বাদ দিয়ে বুদ্ধির খেলায় অবতীর্ণ হন এবং প্রমাণসহ তাঁকে খুনের, মাদকের মামলায় জড়িয়ে নিরাপদে জেলে পাঠিয়ে দেন।
কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পেতে তাঁর সময় লাগে না। কারণ জেলে থেকেই আরেকটি সিন্ডিকেটের সন্ধান তিনি পেয়ে যান। এবারে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন রাজনৈতিক নেতার মর্যাদা নিয়ে। ইতিমধ্যে সেই নারীর পিতা গত হয়েছেন, পুরো সংসারের দায়িত্ব তাঁর ওপর। বাড়ির মালিক বাসা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সেখানেও বাড়ির মালিকদের আরেক ধরনের সিন্ডিকেট আছে—বাড়ি আরেকজনের কাছে ভাড়া হয়ে গেছে। এবারে তিনি ওই ছোট্ট গার্মেন্টসে আবার ফিরে আসেন। সেখানেও চাকরির দালালদের সিন্ডিকেট। বেতনের একটা অংশ তাঁকে দিতে হয়, তবে ওই সিন্ডিকেটের হৃদয়বান ব্যক্তিটি তাঁকে বস্তিতে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
কিছুদিন পর বস্তিটিও উচ্ছেদ হয়ে গেল। আরেক সিন্ডিকেট বস্তির দায়িত্ব নিয়ে নিল, যেখানে প্রধান তাঁর স্বামী। একদিন কোটি টাকার গাড়ি নিয়ে তাঁর স্বামী নতুন বস্তির দায়িত্বভার গ্রহণ করত আসেন, তাঁর সন্তান দূর থেকে তাঁকে দেখে। এভাবেই নানান সিন্ডিকেটের ফলাফলে সেই নারীটি তাঁর সৌন্দর্য, ভালোবাসা, মমতা সবকিছু হারিয়ে একজন ক্যাডারের সন্তানকেই বুকে নিয়ে পথ চলছেন।
কাহিনিটি খুব চমকপ্রদ নয়। কারণ, দৃশ্য এবং অদৃশ্য সিন্ডিকেটের প্রভাবে লক্ষ-কোটি মানুষ কোনোমতে তাদের জীবন ধারণ করছে।রাষ্ট্রের আইন, নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার—কোনো কিছুই সেই নারীর কাছে পৌঁছাতে পারছে না। যা কিছু দৃশ্যমান, তা হচ্ছে সিন্ডিকেট।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে