এম এম আকাশ
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটকে কেউ কেউ বলছেন, অর্থমন্ত্রীর জন্য ‘অগ্নিপরীক্ষার’ বাজেট। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয়কে সুরক্ষা দেওয়ার দিকে প্রথম নজর দিতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডলারের বিনিময় হার অতিরিক্ত যেন বৃদ্ধি না পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। নানামুখী সমস্যার জন্য নিতে হবে বহুমুখী পদক্ষেপ। যেমন আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, স্বল্প সুদের বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের প্রবাহ বৃদ্ধি ও তার দক্ষ ব্যবহার, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ অনুকূল শর্তে আকৃষ্ট করা এবং সর্বশেষে অবশ্যই যেখানে যতটুকু দক্ষ আমদানি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব, সেখানে তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সুদের হার মুদ্রাস্ফীতির হারের ওপরে রাখতে না পারলে সঞ্চয় উৎসাহিত হবে না। আবার সুদের হার খুব বেশি হয়ে গেলে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। উচ্চ প্রবৃদ্ধির সুবাতাস তখন সহজে বইবে না।
এ কথা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে আমাদের রাজস্ব বাজেটের দুটি প্রধান সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কর জিডিপির অনুপাত এমনকি নেপালের চেয়েও কম। সেটাকে ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে হবে। কিন্তু তা করার জন্য অপ্রত্যক্ষ করের হার ও ব্যাপ্তি না বাড়িয়ে বাড়াতে হবে প্রত্যক্ষ কর এবং বিভিন্ন জায়গায় যে অপচয় ও সিস্টেম লস আছে, তার সাশ্রয় করতে হবে। মনে রাখতে হবে সাধারণ জনগণের কর দেওয়ার ক্ষমতা কম, তাই সম্পদশালী ও অবৈধ সম্পদ অধিকারীদের কাছ থেকে এই অর্থ সরকারকে আদায়ের জন্য অগ্রাধিকার দিতে হবে।
একই সঙ্গে আমাদের উৎপাদনশীল ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তা, উৎপাদনশীল কৃষক সমাজ ও শ্রমিক শ্রেণির জন্য ইতিবাচক সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। এই সব নেতিবাচক ও ইতিবাচক প্যাকেজ বাস্তবায়িত হলে সরকারের রাজস্ব বাজেটে আয় যেমন বাড়বে, উন্নয়ন ব্যয়ও তেমনি বাড়বে এবং ওই আয়-ব্যয়ের মাধ্যমেই সমতাপূর্ণ প্রবৃদ্ধির ধারা সূচিত হবে।
এবারের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে, যদিও তাতে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে (এর একটি বড় অংশই হচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের পেনশনভোগীরা, যাঁরা বয়সে বড় হলেও মোটেও আবশ্যকীয়ভাবে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অংশ নন।)। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারগুলো আরও সঠিকভাবে নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ। উল্লিখিত বিশেষ গ্রুপগুলোর জন্য ইতিবাচক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করতে হবে।
আমদানি করা প্রধান প্রধান পণ্যের দাম ও জাহাজভাড়া বৃদ্ধির জন্য ডলারের চাহিদা বাড়ছে বলে টাকার অবমূল্যায়ন বা ডলারের ঊর্ধ্বমূল্যায়ন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সহনীয় মাত্রায় টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন করা হোক। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে আমদানিকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বা রপ্তানিমুখী পণ্যের আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম অত্যধিক বৃদ্ধি না পায়; তাহলে দেশে অসহনীয় মুদ্রাস্ফীতির উদ্ভব হবে। এ ধরনের সতর্ক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা এবং সেটার পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ধারণ করাও এই বাজেটের একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ।
তবে এবারের বাজেটে সমস্যাগুলোর অকপট স্বীকৃতি আছে। চ্যালেঞ্জগুলোরও বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এগুলো সমাধান করার প্রস্তাব যেটুকু আছে, তা মোটেও যথেষ্ট নয়। বাজেট পড়ে মনে হয় যেন মাখনের মধ্যে ছুরি চালানোর মতো সহজেই অর্থনীতি এবারও সমৃদ্ধির পথে পুনরায় যাত্রা করবে বলে অর্থমন্ত্রী ভাবছেন। এমনকি করোনাপর্ব আমরা শুধু উচ্চ প্রবৃদ্ধি দিয়েই অতিক্রম করে যাব—এ রকম একটি সরলীকরণ বার্তা এই বাজেটে ফুটে উঠেছে। ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংকঋণ ও বিদেশি ঋণের চিরাচরিত প্রস্তাব, করপোরেট করকে ছাড় দেওয়া, প্রবাসীদের কাছ থেকে কর আদায়ের ইউটোপীয় সুপারিশ, গতানুগতিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা বাজেটের মধ্যে অন্যান্য ব্যয় ঢুকিয়ে দেওয়া, কৃষি বাজেটের আপেক্ষিক আয়তন হ্রাস ইত্যাদি থেকে এ সত্য প্রমাণিত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ও ইতিবাচক শক্তির দ্বন্দ্ব রয়েছে। রয়েছে বাজেট বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রবল আশঙ্কা।
এবার পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। কিন্তু ১০ হাজার কোটি টাকা খরচের প্রাথমিক বাজেট তো শেষ পর্যন্ত তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে রেললাইনের অতিরিক্ত প্রকল্প যোগ করার জন্য এবং অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের জন্য এই তিন গুণের বেশি বাজেট ব্যয় হয়েছে। সংসদে বিএনপিদলীয় সদস্যদের প্রদত্ত হিসাবে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতুর দুই পাশের রাস্তার ব্যয় বিশ্ব রেকর্ডে প্রথম হয়েছে। উপকরণের দামও বেশি লেগেছে। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, সব মেগা প্রকল্পে এই সাধারণ দোষটি রয়েছে। এই প্রকল্পগুলো থেকে উচ্চ রিটার্ন বা ফল না পেলে পরে এই প্রকল্পগুলো লোকসানি প্রকল্পে পরিণত হতে পারে। তবে পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে তা হওয়ার আশঙ্কা নেই বা তা খুব ক্ষীণ। কারণ, এর আসলেই উচ্চ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইতিবাচক ফল আছে এবং এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী ফলপ্রসূ জাতীয় প্রকল্প বলে ধরা যেতে পারে। সুতরাং একটি যুক্তিযুক্ত ভাড়া নির্ধারণ করে ব্যাপক মানুষের তা ব্যবহারের সুযোগ দিলে এই প্রকল্পের খরচ সহজেই উঠে আসবে। তবে অনর্থক ইতিহাস টেনে এনে এই প্রকল্প নিয়ে রাজনৈতিক বাদানুবাদ সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। এটি বিদেশি গোষ্ঠীর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশীয় জেদে সম্পন্ন হয়েছে এবং সরকার সেই সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে। সেই কারণে এটি আমাদের জাতীয় গৌরবও বৃদ্ধি করবে বলে আশা করি। তবে ভুলত্রুটি বা ঐতিহাসিক ভ্রান্তিগুলো নিয়ে পরস্পর বাদানুবাদ কম হলে এই গৌরব আরও উজ্জ্বল ও প্রশ্নাতীত হতো।
আমাদের দেশে বাজেট বাস্তবায়নের মাত্রা নির্ধারণ করা হয় বরাদ্দ অর্থের ব্যয়ের শতাংশ দিয়ে! সাধারণত ঠিকভাবে হিসাব করলে এই ব্যয়ের হার হয় ৭৫ থেকে ৯৫ শতাংশ। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, কখনো কখনো ২৫ শতাংশ অর্থ কোনো না কোনো খাতে ব্যয় হয় না; বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এই বেঁচে যাওয়া অর্থের কথা প্রায়ই শোনা যায়। একসময় সরকার ঠিক করেছিল, যেসব মন্ত্রণালয় পুরো অর্থ ব্যয় করতে পারবে না, তাদের অর্থ বরাদ্দ পরবর্তী বছরে কমিয়ে দেওয়া হবে। উল্টো দিক থেকে দাবি ছিল, যারা সব অর্থ ব্যয় করতে পারবে, তাদের বরাদ্দ বাড়িয়ে দিতে হবে। অবশ্য এ কথা ঠিক যেনতেনভাবে শেষ তিন মাসে ব্যয় করলেই হবে না, ব্যয়ের গুণগত ন্যূনতম মানও রক্ষা করতে হবে। আবার কোনো কোনো মন্ত্রণালয় টাকার ছাড় পায় এপ্রিল মাসে; ফলে মাত্র তিন মাসে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন তাদের পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব হয়ে পড়ে। দক্ষতা জিনিসটা নির্ভর করবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি (বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) এবং মন্ত্রণালয়ের সততা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার ওপর। এটা একটা সামগ্রিক সুশাসনের ইস্যু। আসলে এটাই পুরো বাজেটের প্রধান ইস্যু।
কালোটাকা আমদানি পণ্যের ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি পণ্যের আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। অসাধু আমদানিকারকেরা যেমন আমদানি পণ্যের দামের চেয়ে একটু বেশি টাকা বাইরে পাঠিয়ে দেন, তেমনি অসাধু রপ্তানিকারকেরাও রপ্তানি পণ্যের দামের ওপরে একটি অংশ বিদেশে জমা করেন। রপ্তানির সময় বিদেশি সরবরাহকারী প্রকৃত দামের অংশবিশেষ আমদানিকারকের বৈদেশিক অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে বাকিটুকু দেশ থেকে রপ্তানির দাম হিসেবে পাঠিয়ে দেন। এভাবে ডলার বাইরে চলে যায়। এই অসৎ আমদানি-রপ্তানিকেই অবৈধ পাচারকৃত কালোটাকার প্রধান উৎস বলে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া কর ফাঁকি দেওয়া অবৈধ দেশি আয়কেও কালোটাকা বলে গণ্য করা হয়। দুর্নীতি-ঘুষ সংগতিহীন আয়-ব্যয়কেও আমরা কালোটাকা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। এগুলো ধরা বা বোঝা কঠিন নয়, কিন্তু আদালতে প্রমাণ করা কঠিন। দলিলে দেখানো আমদানি বা রপ্তানি মূল্য কতটা প্রকৃত এবং কতটা ভুয়া, তা পরিমাপের জন্য বিশ্ববাজারে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি ও নির্লোভ সৎলোক দরকার। বাংলাদেশে এর অভাব রয়েছে। তাই টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে নানা ছদ্মবেশে। সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের কালোটাকা। সরকার সেই সব কালোটাকা ফেরত বা বাজেয়াপ্ত করার জন্য বর্তমানে দোষীদের শাস্তি না দিয়ে উল্টো কালোটাকাকে সাদা করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। বর্তমানে কেউ ফাঁকি দিয়ে টাকা বাইরে পাঠিয়ে পরে তা রেমিট্যান্স হিসেবে ফেরত আনলে একই সঙ্গে কর মওকুফ এবং নগদ আড়াই শতাংশ প্রণোদনা লাভ করতে পারবেন। এবারের বাজেটে অবশ্য ৭ থেকে ১০ শতাংশ করের একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁরা তা পাঠাতে আদৌ রাজি হবেন কি?
বর্তমান সরকার কিছুটা হলেও গ্রাম ও কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেসক্রিপশনে কৃষকদের জন্য সার বা কৃষিযন্ত্রে ভর্তুকিতে ব্যয় নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে এরশাদের আমল পর্যন্ত এই কৃষি ও কৃষকবিরোধী নীতি অব্যাহত ছিল। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর আমল থেকে এ ক্ষেত্রে এই ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। তবে আরও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কৃষিজমি সংরক্ষণ, ভূমি ব্যাংক ও ভূমিহীনদের মধ্যে ভূমি বণ্টন, সে জন্য ক্ষুদ্র-মাঝারি ও বর্গাচাষিদের সংগঠন তৈরি করা প্রয়োজন। খেতমজুরদের জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনে সংগঠিত করার সুযোগ দেওয়া উচিত।
উৎপাদনশীল কৃষকদের (অনুপস্থিত ভূস্বামী নয়!) নামের তালিকা তৈরি করে ঋণ ও সারের ভর্তুকির অর্থ স্বচ্ছতার সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তাঁদের কাছে নগদে পৌঁছে দেওয়া দরকার। ওই সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে বিশেষ বিশেষ কৃষিপণ্যের, কৃষি উপকরণের বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সমন্বিত পণ্যভিত্তিক সমবায় সমিতি থাকা উচিত। তাঁরা তখন নিজস্ব কৃষিপণ্যের লাভজনক দাম নিশ্চিত করতে পারবেন। সরকার সহজেই প্রকৃত ব্যবহারকারীকে উপকরণ সাবসিডি দিতে পারবে।
বৈষম্য ও দুঃশাসন নিরসনের প্রধান উপায় হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতাকাঠামো থেকে অসৎ ব্যবসায়ী, অসৎ আমলা ও অসৎ রাজনীতিবিদকে সরিয়ে উৎপাদন শক্তির অবাধ বিকাশের বাধাগুলো দূর করা। সে জন্য মৃত শ্রম বা সামাজিক বস্তুগত পুঁজি ও জীবন্ত শ্রম বা মানবসম্পদ—উভয়ের ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এম এম আকাশ। চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটকে কেউ কেউ বলছেন, অর্থমন্ত্রীর জন্য ‘অগ্নিপরীক্ষার’ বাজেট। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয়কে সুরক্ষা দেওয়ার দিকে প্রথম নজর দিতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডলারের বিনিময় হার অতিরিক্ত যেন বৃদ্ধি না পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। নানামুখী সমস্যার জন্য নিতে হবে বহুমুখী পদক্ষেপ। যেমন আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, স্বল্প সুদের বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের প্রবাহ বৃদ্ধি ও তার দক্ষ ব্যবহার, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ অনুকূল শর্তে আকৃষ্ট করা এবং সর্বশেষে অবশ্যই যেখানে যতটুকু দক্ষ আমদানি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব, সেখানে তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সুদের হার মুদ্রাস্ফীতির হারের ওপরে রাখতে না পারলে সঞ্চয় উৎসাহিত হবে না। আবার সুদের হার খুব বেশি হয়ে গেলে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। উচ্চ প্রবৃদ্ধির সুবাতাস তখন সহজে বইবে না।
এ কথা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে আমাদের রাজস্ব বাজেটের দুটি প্রধান সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কর জিডিপির অনুপাত এমনকি নেপালের চেয়েও কম। সেটাকে ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে হবে। কিন্তু তা করার জন্য অপ্রত্যক্ষ করের হার ও ব্যাপ্তি না বাড়িয়ে বাড়াতে হবে প্রত্যক্ষ কর এবং বিভিন্ন জায়গায় যে অপচয় ও সিস্টেম লস আছে, তার সাশ্রয় করতে হবে। মনে রাখতে হবে সাধারণ জনগণের কর দেওয়ার ক্ষমতা কম, তাই সম্পদশালী ও অবৈধ সম্পদ অধিকারীদের কাছ থেকে এই অর্থ সরকারকে আদায়ের জন্য অগ্রাধিকার দিতে হবে।
একই সঙ্গে আমাদের উৎপাদনশীল ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তা, উৎপাদনশীল কৃষক সমাজ ও শ্রমিক শ্রেণির জন্য ইতিবাচক সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে। এই সব নেতিবাচক ও ইতিবাচক প্যাকেজ বাস্তবায়িত হলে সরকারের রাজস্ব বাজেটে আয় যেমন বাড়বে, উন্নয়ন ব্যয়ও তেমনি বাড়বে এবং ওই আয়-ব্যয়ের মাধ্যমেই সমতাপূর্ণ প্রবৃদ্ধির ধারা সূচিত হবে।
এবারের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে, যদিও তাতে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে (এর একটি বড় অংশই হচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের পেনশনভোগীরা, যাঁরা বয়সে বড় হলেও মোটেও আবশ্যকীয়ভাবে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অংশ নন।)। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারগুলো আরও সঠিকভাবে নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ। উল্লিখিত বিশেষ গ্রুপগুলোর জন্য ইতিবাচক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করতে হবে।
আমদানি করা প্রধান প্রধান পণ্যের দাম ও জাহাজভাড়া বৃদ্ধির জন্য ডলারের চাহিদা বাড়ছে বলে টাকার অবমূল্যায়ন বা ডলারের ঊর্ধ্বমূল্যায়ন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সহনীয় মাত্রায় টাকার কিছুটা অবমূল্যায়ন করা হোক। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে আমদানিকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বা রপ্তানিমুখী পণ্যের আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম অত্যধিক বৃদ্ধি না পায়; তাহলে দেশে অসহনীয় মুদ্রাস্ফীতির উদ্ভব হবে। এ ধরনের সতর্ক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা এবং সেটার পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ধারণ করাও এই বাজেটের একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ।
তবে এবারের বাজেটে সমস্যাগুলোর অকপট স্বীকৃতি আছে। চ্যালেঞ্জগুলোরও বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু এগুলো সমাধান করার প্রস্তাব যেটুকু আছে, তা মোটেও যথেষ্ট নয়। বাজেট পড়ে মনে হয় যেন মাখনের মধ্যে ছুরি চালানোর মতো সহজেই অর্থনীতি এবারও সমৃদ্ধির পথে পুনরায় যাত্রা করবে বলে অর্থমন্ত্রী ভাবছেন। এমনকি করোনাপর্ব আমরা শুধু উচ্চ প্রবৃদ্ধি দিয়েই অতিক্রম করে যাব—এ রকম একটি সরলীকরণ বার্তা এই বাজেটে ফুটে উঠেছে। ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংকঋণ ও বিদেশি ঋণের চিরাচরিত প্রস্তাব, করপোরেট করকে ছাড় দেওয়া, প্রবাসীদের কাছ থেকে কর আদায়ের ইউটোপীয় সুপারিশ, গতানুগতিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা বাজেটের মধ্যে অন্যান্য ব্যয় ঢুকিয়ে দেওয়া, কৃষি বাজেটের আপেক্ষিক আয়তন হ্রাস ইত্যাদি থেকে এ সত্য প্রমাণিত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ও ইতিবাচক শক্তির দ্বন্দ্ব রয়েছে। রয়েছে বাজেট বাস্তবায়িত না হওয়ার প্রবল আশঙ্কা।
এবার পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। কিন্তু ১০ হাজার কোটি টাকা খরচের প্রাথমিক বাজেট তো শেষ পর্যন্ত তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে রেললাইনের অতিরিক্ত প্রকল্প যোগ করার জন্য এবং অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের জন্য এই তিন গুণের বেশি বাজেট ব্যয় হয়েছে। সংসদে বিএনপিদলীয় সদস্যদের প্রদত্ত হিসাবে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতুর দুই পাশের রাস্তার ব্যয় বিশ্ব রেকর্ডে প্রথম হয়েছে। উপকরণের দামও বেশি লেগেছে। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, সব মেগা প্রকল্পে এই সাধারণ দোষটি রয়েছে। এই প্রকল্পগুলো থেকে উচ্চ রিটার্ন বা ফল না পেলে পরে এই প্রকল্পগুলো লোকসানি প্রকল্পে পরিণত হতে পারে। তবে পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে তা হওয়ার আশঙ্কা নেই বা তা খুব ক্ষীণ। কারণ, এর আসলেই উচ্চ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইতিবাচক ফল আছে এবং এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী ফলপ্রসূ জাতীয় প্রকল্প বলে ধরা যেতে পারে। সুতরাং একটি যুক্তিযুক্ত ভাড়া নির্ধারণ করে ব্যাপক মানুষের তা ব্যবহারের সুযোগ দিলে এই প্রকল্পের খরচ সহজেই উঠে আসবে। তবে অনর্থক ইতিহাস টেনে এনে এই প্রকল্প নিয়ে রাজনৈতিক বাদানুবাদ সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। এটি বিদেশি গোষ্ঠীর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশীয় জেদে সম্পন্ন হয়েছে এবং সরকার সেই সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে। সেই কারণে এটি আমাদের জাতীয় গৌরবও বৃদ্ধি করবে বলে আশা করি। তবে ভুলত্রুটি বা ঐতিহাসিক ভ্রান্তিগুলো নিয়ে পরস্পর বাদানুবাদ কম হলে এই গৌরব আরও উজ্জ্বল ও প্রশ্নাতীত হতো।
আমাদের দেশে বাজেট বাস্তবায়নের মাত্রা নির্ধারণ করা হয় বরাদ্দ অর্থের ব্যয়ের শতাংশ দিয়ে! সাধারণত ঠিকভাবে হিসাব করলে এই ব্যয়ের হার হয় ৭৫ থেকে ৯৫ শতাংশ। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, কখনো কখনো ২৫ শতাংশ অর্থ কোনো না কোনো খাতে ব্যয় হয় না; বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এই বেঁচে যাওয়া অর্থের কথা প্রায়ই শোনা যায়। একসময় সরকার ঠিক করেছিল, যেসব মন্ত্রণালয় পুরো অর্থ ব্যয় করতে পারবে না, তাদের অর্থ বরাদ্দ পরবর্তী বছরে কমিয়ে দেওয়া হবে। উল্টো দিক থেকে দাবি ছিল, যারা সব অর্থ ব্যয় করতে পারবে, তাদের বরাদ্দ বাড়িয়ে দিতে হবে। অবশ্য এ কথা ঠিক যেনতেনভাবে শেষ তিন মাসে ব্যয় করলেই হবে না, ব্যয়ের গুণগত ন্যূনতম মানও রক্ষা করতে হবে। আবার কোনো কোনো মন্ত্রণালয় টাকার ছাড় পায় এপ্রিল মাসে; ফলে মাত্র তিন মাসে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন তাদের পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব হয়ে পড়ে। দক্ষতা জিনিসটা নির্ভর করবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি (বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) এবং মন্ত্রণালয়ের সততা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার ওপর। এটা একটা সামগ্রিক সুশাসনের ইস্যু। আসলে এটাই পুরো বাজেটের প্রধান ইস্যু।
কালোটাকা আমদানি পণ্যের ওভার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি পণ্যের আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। অসাধু আমদানিকারকেরা যেমন আমদানি পণ্যের দামের চেয়ে একটু বেশি টাকা বাইরে পাঠিয়ে দেন, তেমনি অসাধু রপ্তানিকারকেরাও রপ্তানি পণ্যের দামের ওপরে একটি অংশ বিদেশে জমা করেন। রপ্তানির সময় বিদেশি সরবরাহকারী প্রকৃত দামের অংশবিশেষ আমদানিকারকের বৈদেশিক অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে বাকিটুকু দেশ থেকে রপ্তানির দাম হিসেবে পাঠিয়ে দেন। এভাবে ডলার বাইরে চলে যায়। এই অসৎ আমদানি-রপ্তানিকেই অবৈধ পাচারকৃত কালোটাকার প্রধান উৎস বলে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া কর ফাঁকি দেওয়া অবৈধ দেশি আয়কেও কালোটাকা বলে গণ্য করা হয়। দুর্নীতি-ঘুষ সংগতিহীন আয়-ব্যয়কেও আমরা কালোটাকা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। এগুলো ধরা বা বোঝা কঠিন নয়, কিন্তু আদালতে প্রমাণ করা কঠিন। দলিলে দেখানো আমদানি বা রপ্তানি মূল্য কতটা প্রকৃত এবং কতটা ভুয়া, তা পরিমাপের জন্য বিশ্ববাজারে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি ও নির্লোভ সৎলোক দরকার। বাংলাদেশে এর অভাব রয়েছে। তাই টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে নানা ছদ্মবেশে। সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের কালোটাকা। সরকার সেই সব কালোটাকা ফেরত বা বাজেয়াপ্ত করার জন্য বর্তমানে দোষীদের শাস্তি না দিয়ে উল্টো কালোটাকাকে সাদা করার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। বর্তমানে কেউ ফাঁকি দিয়ে টাকা বাইরে পাঠিয়ে পরে তা রেমিট্যান্স হিসেবে ফেরত আনলে একই সঙ্গে কর মওকুফ এবং নগদ আড়াই শতাংশ প্রণোদনা লাভ করতে পারবেন। এবারের বাজেটে অবশ্য ৭ থেকে ১০ শতাংশ করের একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁরা তা পাঠাতে আদৌ রাজি হবেন কি?
বর্তমান সরকার কিছুটা হলেও গ্রাম ও কৃষি খাতকে গুরুত্ব দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেসক্রিপশনে কৃষকদের জন্য সার বা কৃষিযন্ত্রে ভর্তুকিতে ব্যয় নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে এরশাদের আমল পর্যন্ত এই কৃষি ও কৃষকবিরোধী নীতি অব্যাহত ছিল। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর আমল থেকে এ ক্ষেত্রে এই ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। তবে আরও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কৃষিজমি সংরক্ষণ, ভূমি ব্যাংক ও ভূমিহীনদের মধ্যে ভূমি বণ্টন, সে জন্য ক্ষুদ্র-মাঝারি ও বর্গাচাষিদের সংগঠন তৈরি করা প্রয়োজন। খেতমজুরদের জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনে সংগঠিত করার সুযোগ দেওয়া উচিত।
উৎপাদনশীল কৃষকদের (অনুপস্থিত ভূস্বামী নয়!) নামের তালিকা তৈরি করে ঋণ ও সারের ভর্তুকির অর্থ স্বচ্ছতার সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তাঁদের কাছে নগদে পৌঁছে দেওয়া দরকার। ওই সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে বিশেষ বিশেষ কৃষিপণ্যের, কৃষি উপকরণের বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সমন্বিত পণ্যভিত্তিক সমবায় সমিতি থাকা উচিত। তাঁরা তখন নিজস্ব কৃষিপণ্যের লাভজনক দাম নিশ্চিত করতে পারবেন। সরকার সহজেই প্রকৃত ব্যবহারকারীকে উপকরণ সাবসিডি দিতে পারবে।
বৈষম্য ও দুঃশাসন নিরসনের প্রধান উপায় হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতাকাঠামো থেকে অসৎ ব্যবসায়ী, অসৎ আমলা ও অসৎ রাজনীতিবিদকে সরিয়ে উৎপাদন শক্তির অবাধ বিকাশের বাধাগুলো দূর করা। সে জন্য মৃত শ্রম বা সামাজিক বস্তুগত পুঁজি ও জীবন্ত শ্রম বা মানবসম্পদ—উভয়ের ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এম এম আকাশ। চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে