বিভুরঞ্জন সরকার
গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনে উপনির্বাচন এখন রাজনৈতিক মহলে প্রধান আলোচনার বিষয়। ১২ অক্টোবর সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণ শুরুর পর বেলা আড়াইটার দিকে নানা অনিয়মের অভিযোগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করেন। এই উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন চারজন। একজন জাতীয় পার্টির, একজন বিকল্পধারার এবং দুজন স্বতন্ত্র। ইসির বাতিল ঘোষণার আগেই এই চার প্রার্থী ভোট বর্জনের কথা জানিয়েছিলেন। এই চারজনের ভোট বর্জনের দুটি কারণ হতে পারে। এক. তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, ভোটে তাঁদের জেতার সম্ভাবনা নেই। দুই. তাঁদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে সরকারদলীয় প্রার্থীর সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রে ঢুকে নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে ভোট জালিয়াতি করছিলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে কারণে ভোট বাতিল করেছেন, তাতে এটাই মনে হয় যে তাঁদের অভিযোগ অমূলক ছিল না।
ভোটকেন্দ্র ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর দখলে নিয়ে খুশিমতো ভোট নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের দেশে একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া বিরোধী দলের প্রার্থীর প্রচারে বাধা দেওয়া, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, কেন্দ্র দখল, কেন্দ্র থেকে বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দেওয়া, ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করা গত কয়েকটি নির্বাচনে ব্যাপকভাবেই হয়েছে। এসব নিয়ে কারও কাছে অভিযোগ জানিয়ে এত দিন কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। কিন্তু এবার গাইবান্ধার উপনির্বাচনে এমন কী নতুন ঘটনা ঘটল, যার জন্য নির্বাচন কমিশন ভোট বাতিলের মতো একটি বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো? কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশনকে তো আওয়ামী লীগঘেঁষা অপবাদই শুনতে হচ্ছে। এই কমিশনের প্রতি সব মহলের আস্থা ও সমর্থনও নেই।
তাহলে এই নির্বাচন কমিশনের তো আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়, তেমন সিদ্ধান্তই নেওয়ার কথা। আগের দুটি নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে তো তা-ই হয়েছে। এবার গাইবান্ধা উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নিশ্চিত বিজয় বাতিল করে দিয়ে নির্বাচন কমিশন কি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল? কেউ কেউ অবশ্য এটাকে একটি সাজানো নাটকও বলছেন। এর পেছনে বিশেষ কোনো ‘রাজনীতি’ থাকতে পারে না, তা অবশ্যই নয়। এখন দেখার বিষয়, উপনির্বাচনটি বাতিল হওয়ায় লাভ-ক্ষতি কার কেমন হলো? বিরোধী প্রার্থীরা খুশি হয়েছেন, এটা নিশ্চিত। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাখোশ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, সবকিছু ঠিক থাকার পরও কেন ভোট বাতিল করা হলো, তা তাঁদের কাছে বোধগম্য নয়।
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট গ্রহণের কথা ছিল। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে সিইসিসহ অন্যান্য কমিশনার ভোট গ্রহণের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
ভোটের নানা অনিয়ম তুলে ধরে ১৩ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘ভোট শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা তিনটি কেন্দ্রে দেখতে পাই, ভোটকক্ষে প্রার্থীর পুরুষ এজেন্টগণ একই রকম গেঞ্জি বুকে ও পিঠে প্রার্থীর মার্কা ইত্যাদি প্রিন্ট করা, পরে আছেন এবং মহিলা এজেন্টগণ একই রকম শাড়ি পরা, যা আচরণবিধিমালার ১০ (ঙ) ভঙ্গের মধ্যে পড়ে। এই সকল এজেন্ট ছাড়াও আরও অনেক অবৈধ লোকজন ভোটকক্ষে অবস্থান করে ভোটারদের ভোট দিতে প্রভাবিত করছেন। ভোটারদের কন্ট্রোল ইউনিটে (ইভিএমের অংশ) আঙুলের ছাপ দেওয়ার পরপরই এজেন্টগণ গোপন ভোটকক্ষে প্রবেশ করে ভোটারদের ভোটদানের সুযোগ না দিয়ে নিজেই ভোট দিয়ে দিচ্ছেন, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ একই কাজ করছেন।’
ঢাকায় বসে ভিডিও দেখে ভোট গ্রহণ বন্ধ করা কতটুকু যৌক্তিক—সেই প্রশ্ন তুলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তটি প্রশ্নবিদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন। ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যের জবাবে সিইসি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমাদের সঙ্গে বসে প্রত্যক্ষ (ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা সিসিটিভির মাধ্যমে নির্বাচন ভবনে স্থাপিত মনিটরে দেখা) করতে পারতেন। অনেকের বক্তব্য শুনেছি, এটা কী করে সম্ভব হলো, অফিসে বসে এতগুলো কেন্দ্র দেখা। সিসিটিভি দেখে রাস্তার নিয়ন্ত্রণও বিভিন্ন দেশে করা হয়। সিস্টেমটাকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে একটা জায়গায় বসে ২০০, ৪০০ জায়গার ফ্যাক্টস (ঘটনা) সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। আমরা মনে করি, এটা জুতসই একটা প্রযুক্তি।’
প্রযুক্তি নিয়ে কথা নয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের প্রশ্ন, ঢাকায় বসে আপনারা এভাবে কেন্দ্র বন্ধ করতে পারেন কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেছেন, ‘আইনের ৯১ ধারায় বলেছে, আমরা যদি মনে করি, কী দিয়ে মনে করলাম, ঢাকায় বসে মনে করব, না কুমিল্লায় বসে করব, না চট্টগ্রামে বসে করব বা আমরা জাহাজে বসে মনে করতে পারি, তা নয়; আমাদের কাছে যদি অনুমিত হয়, নির্বাচনটা সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না, তাহলে নির্বাচন কমিশন যেকোনো কেন্দ্রের বা সব কেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘বিভ্রান্তিটা এ কারণে হতে পারে, আমি কীভাবে দেখেছি বা আপনারা কীভাবে দেখেছেন। আমি যদি ওদের একজন হতাম, তাহলে আমার কাছে নিশ্চয় এ প্রশ্নই উঠত। কাজেই জিনিসটা পরিষ্কার হওয়া উচিত সবার কাছে যে আমরা দেখে-শুনে, চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এসব বাহাস থেকে মনে হতে পারে, এত দিন শুধু বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরাই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ছিল। এবার আওয়ামী লীগও বুঝি ওই বিরোধিতায় শামিল হলো। কিন্তু ১৫ অক্টোবর আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কমিশনের ঝামেলা বাড়াতে চায় না আওয়ামী লীগ’ শিরোনামের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনের সমালোচনার দিকে বেশি এগোবে না। দলটির কোনো কোনো নেতা মনে করছেন, এখন ইসির বিরুদ্ধে কথা বললে হিতে বিপরীত হতে পারে। আওয়ামী লীগ ইসির সমালোচনা করলে বিএনপিসহ বিরোধীদের সুবিধা হবে। বিএনপির কোনো সুবিধা আওয়ামী লীগ করবে না আবার বিএনপিও আওয়ামী লীগের সুবিধা হয়, এমন কিছু করবে না।
তবে গাইবান্ধার উপনির্বাচন নতুন করে কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে। প্রথম প্রশ্ন, একটি আসনের নির্বাচনই যেখানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে শেষ করতে ইসি সফল হলো না, তখন ৩০০ আসনের বেলায় কী হবে? তখনো কি এভাবে নির্বাচন বাতিল করে সমাধান খোঁজা হবে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, গাইবান্ধায় দেখা গেছে, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ওপর নির্বাচন কমিশনের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। ইসি সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখেছেন ভোট ভালো হয়নি। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন তা বলছে না। তারা শান্তিপূর্ণ ভোট চলছিল বলে দাবি করেছে। আবার আজকের পত্রিকার ‘সদর গোছানো, অন্দরে ডাকাতি’ শিরোনামের খবরেও বলা হয়েছে এমন কথা—কেউ কেউ বলেছেন যে বাইরে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও বুথের ভেতরে জালিয়াতি হয়েছে। মানুষ নিজের ভোট পছন্দের প্রার্থীকে দিতে পারেননি। একই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের লোকজনও ইসির কথায় পাত্তা দেননি।
প্রশ্ন হলো, এই সমস্যার সমাধান কী? নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে প্রশাসন বাধ্য। কিন্তু গাইবান্ধায় প্রশাসনের ওপর নির্বাচন কমিশনআইনি কর্তৃত্ব দেখাতে সফল হয়নি।
অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা মহলের ক্রীড়নক হতে যাচ্ছে কি না, তেমন প্রশ্নও নাগরিক সমাজের কারও কারও মধ্যে উঠেছে। দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর অতি উৎসাহী হয়ে নিরপেক্ষতা দেখাতে গিয়ে হঠকারিতা ও উদ্ভট পদক্ষেপ নিতে আগে কি দেখা যায়নি? ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরবর্তী ঘটনার কথা মনে করে কারও মনে শঙ্কা তৈরি হওয়া অমূলক নয়। গাইবান্ধার উপনির্বাচন বাতিল করায় অনেকে ইসির দৃঢ়তার প্রশংসা করছেন। তা থেকে এটাও মনে হতে পারে যে নির্বাচন কমিশন নিজেদের প্রতি সব মহলের আস্থা ফিরিয়ে আনার একটি পরিকল্পনা হিসেবেই গাইবান্ধার উপনির্বাচন বাতিল করে চমক দেখিয়েছে।
নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবিতর্কিত হোক—এটা আমরা সবাই চাই। কিন্তু দেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু রয়েছে, তাতে শতভাগ সহিংসতা ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাস্তবতা বর্তমানে নেই। ক্ষমতা ও প্রভাব থাকলে তা না দেখিয়ে কেউ থাকতে চায় না। তাই নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা শুধু নির্বাচন কমিশনের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই আন্তরিকতা থাকতে হবে; বিশেষ করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং সমর্থকদের সহনশীলতা ও ফলাফল মেনে নেওয়ার মানসিকতা অবশ্যই থাকতে হবে।
ডিসি-এসপিদের সঙ্গে নির্বাচনের বৈঠকে একজন কমিশনারের বক্তব্যের সময় যে হইচই হয়েছে তা ছিল অনভিপ্রেত। সাংবিধানিক পদে থেকেও নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান যে তাঁর বক্তব্য শেষ করতে পারেননি, সেটা আমাদের অন্যের কথা না শোনার অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ। একজন দায়িত্বশীল পদাধিকারী ব্যক্তির কোনো বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য হলে তা প্রতিবাদেরও সহবতসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করাই ছিল বাঞ্ছনীয়।
প্রশাসনের দলনিরপেক্ষতা কাম্য হলেও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে না থাকলেও এখন পদে পদে বিপদে পড়ার আশঙ্কা থাকে! সে জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সরকার ও সরকারি দলের আজ্ঞাবাহী হওয়া সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছরে প্রশাসনকে যেভাবে সাজানো হয়েছে, সেখানে একটি বড় পরিবর্তন আনা জরুরি হলেও সেটা করার মতো সৎ ও নির্ভীক নেতৃত্ব এখন বিরল। সব মিলিয়ে আপাতত এটুকু বলার কথা যে সবার আস্থাভাজন হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে গাইবান্ধার উপনির্বাচনকে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে।
গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনে উপনির্বাচন এখন রাজনৈতিক মহলে প্রধান আলোচনার বিষয়। ১২ অক্টোবর সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণ শুরুর পর বেলা আড়াইটার দিকে নানা অনিয়মের অভিযোগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করেন। এই উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন চারজন। একজন জাতীয় পার্টির, একজন বিকল্পধারার এবং দুজন স্বতন্ত্র। ইসির বাতিল ঘোষণার আগেই এই চার প্রার্থী ভোট বর্জনের কথা জানিয়েছিলেন। এই চারজনের ভোট বর্জনের দুটি কারণ হতে পারে। এক. তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, ভোটে তাঁদের জেতার সম্ভাবনা নেই। দুই. তাঁদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে সরকারদলীয় প্রার্থীর সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রে ঢুকে নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে ভোট জালিয়াতি করছিলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে কারণে ভোট বাতিল করেছেন, তাতে এটাই মনে হয় যে তাঁদের অভিযোগ অমূলক ছিল না।
ভোটকেন্দ্র ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর দখলে নিয়ে খুশিমতো ভোট নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের দেশে একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া বিরোধী দলের প্রার্থীর প্রচারে বাধা দেওয়া, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, কেন্দ্র দখল, কেন্দ্র থেকে বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দেওয়া, ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করা গত কয়েকটি নির্বাচনে ব্যাপকভাবেই হয়েছে। এসব নিয়ে কারও কাছে অভিযোগ জানিয়ে এত দিন কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। কিন্তু এবার গাইবান্ধার উপনির্বাচনে এমন কী নতুন ঘটনা ঘটল, যার জন্য নির্বাচন কমিশন ভোট বাতিলের মতো একটি বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো? কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশনকে তো আওয়ামী লীগঘেঁষা অপবাদই শুনতে হচ্ছে। এই কমিশনের প্রতি সব মহলের আস্থা ও সমর্থনও নেই।
তাহলে এই নির্বাচন কমিশনের তো আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়, তেমন সিদ্ধান্তই নেওয়ার কথা। আগের দুটি নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে তো তা-ই হয়েছে। এবার গাইবান্ধা উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নিশ্চিত বিজয় বাতিল করে দিয়ে নির্বাচন কমিশন কি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল? কেউ কেউ অবশ্য এটাকে একটি সাজানো নাটকও বলছেন। এর পেছনে বিশেষ কোনো ‘রাজনীতি’ থাকতে পারে না, তা অবশ্যই নয়। এখন দেখার বিষয়, উপনির্বাচনটি বাতিল হওয়ায় লাভ-ক্ষতি কার কেমন হলো? বিরোধী প্রার্থীরা খুশি হয়েছেন, এটা নিশ্চিত। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাখোশ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতা মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, সবকিছু ঠিক থাকার পরও কেন ভোট বাতিল করা হলো, তা তাঁদের কাছে বোধগম্য নয়।
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট গ্রহণের কথা ছিল। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে সিইসিসহ অন্যান্য কমিশনার ভোট গ্রহণের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
ভোটের নানা অনিয়ম তুলে ধরে ১৩ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘ভোট শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা তিনটি কেন্দ্রে দেখতে পাই, ভোটকক্ষে প্রার্থীর পুরুষ এজেন্টগণ একই রকম গেঞ্জি বুকে ও পিঠে প্রার্থীর মার্কা ইত্যাদি প্রিন্ট করা, পরে আছেন এবং মহিলা এজেন্টগণ একই রকম শাড়ি পরা, যা আচরণবিধিমালার ১০ (ঙ) ভঙ্গের মধ্যে পড়ে। এই সকল এজেন্ট ছাড়াও আরও অনেক অবৈধ লোকজন ভোটকক্ষে অবস্থান করে ভোটারদের ভোট দিতে প্রভাবিত করছেন। ভোটারদের কন্ট্রোল ইউনিটে (ইভিএমের অংশ) আঙুলের ছাপ দেওয়ার পরপরই এজেন্টগণ গোপন ভোটকক্ষে প্রবেশ করে ভোটারদের ভোটদানের সুযোগ না দিয়ে নিজেই ভোট দিয়ে দিচ্ছেন, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ একই কাজ করছেন।’
ঢাকায় বসে ভিডিও দেখে ভোট গ্রহণ বন্ধ করা কতটুকু যৌক্তিক—সেই প্রশ্ন তুলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তটি প্রশ্নবিদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন। ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যের জবাবে সিইসি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমাদের সঙ্গে বসে প্রত্যক্ষ (ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা সিসিটিভির মাধ্যমে নির্বাচন ভবনে স্থাপিত মনিটরে দেখা) করতে পারতেন। অনেকের বক্তব্য শুনেছি, এটা কী করে সম্ভব হলো, অফিসে বসে এতগুলো কেন্দ্র দেখা। সিসিটিভি দেখে রাস্তার নিয়ন্ত্রণও বিভিন্ন দেশে করা হয়। সিস্টেমটাকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে একটা জায়গায় বসে ২০০, ৪০০ জায়গার ফ্যাক্টস (ঘটনা) সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। আমরা মনে করি, এটা জুতসই একটা প্রযুক্তি।’
প্রযুক্তি নিয়ে কথা নয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের প্রশ্ন, ঢাকায় বসে আপনারা এভাবে কেন্দ্র বন্ধ করতে পারেন কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেছেন, ‘আইনের ৯১ ধারায় বলেছে, আমরা যদি মনে করি, কী দিয়ে মনে করলাম, ঢাকায় বসে মনে করব, না কুমিল্লায় বসে করব, না চট্টগ্রামে বসে করব বা আমরা জাহাজে বসে মনে করতে পারি, তা নয়; আমাদের কাছে যদি অনুমিত হয়, নির্বাচনটা সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না, তাহলে নির্বাচন কমিশন যেকোনো কেন্দ্রের বা সব কেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে।’
কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘বিভ্রান্তিটা এ কারণে হতে পারে, আমি কীভাবে দেখেছি বা আপনারা কীভাবে দেখেছেন। আমি যদি ওদের একজন হতাম, তাহলে আমার কাছে নিশ্চয় এ প্রশ্নই উঠত। কাজেই জিনিসটা পরিষ্কার হওয়া উচিত সবার কাছে যে আমরা দেখে-শুনে, চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এসব বাহাস থেকে মনে হতে পারে, এত দিন শুধু বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরাই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ছিল। এবার আওয়ামী লীগও বুঝি ওই বিরোধিতায় শামিল হলো। কিন্তু ১৫ অক্টোবর আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কমিশনের ঝামেলা বাড়াতে চায় না আওয়ামী লীগ’ শিরোনামের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনের সমালোচনার দিকে বেশি এগোবে না। দলটির কোনো কোনো নেতা মনে করছেন, এখন ইসির বিরুদ্ধে কথা বললে হিতে বিপরীত হতে পারে। আওয়ামী লীগ ইসির সমালোচনা করলে বিএনপিসহ বিরোধীদের সুবিধা হবে। বিএনপির কোনো সুবিধা আওয়ামী লীগ করবে না আবার বিএনপিও আওয়ামী লীগের সুবিধা হয়, এমন কিছু করবে না।
তবে গাইবান্ধার উপনির্বাচন নতুন করে কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে। প্রথম প্রশ্ন, একটি আসনের নির্বাচনই যেখানে শান্তিপূর্ণ উপায়ে শেষ করতে ইসি সফল হলো না, তখন ৩০০ আসনের বেলায় কী হবে? তখনো কি এভাবে নির্বাচন বাতিল করে সমাধান খোঁজা হবে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, গাইবান্ধায় দেখা গেছে, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ওপর নির্বাচন কমিশনের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। ইসি সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখেছেন ভোট ভালো হয়নি। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন তা বলছে না। তারা শান্তিপূর্ণ ভোট চলছিল বলে দাবি করেছে। আবার আজকের পত্রিকার ‘সদর গোছানো, অন্দরে ডাকাতি’ শিরোনামের খবরেও বলা হয়েছে এমন কথা—কেউ কেউ বলেছেন যে বাইরে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও বুথের ভেতরে জালিয়াতি হয়েছে। মানুষ নিজের ভোট পছন্দের প্রার্থীকে দিতে পারেননি। একই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের লোকজনও ইসির কথায় পাত্তা দেননি।
প্রশ্ন হলো, এই সমস্যার সমাধান কী? নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে প্রশাসন বাধ্য। কিন্তু গাইবান্ধায় প্রশাসনের ওপর নির্বাচন কমিশনআইনি কর্তৃত্ব দেখাতে সফল হয়নি।
অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা মহলের ক্রীড়নক হতে যাচ্ছে কি না, তেমন প্রশ্নও নাগরিক সমাজের কারও কারও মধ্যে উঠেছে। দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর অতি উৎসাহী হয়ে নিরপেক্ষতা দেখাতে গিয়ে হঠকারিতা ও উদ্ভট পদক্ষেপ নিতে আগে কি দেখা যায়নি? ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরবর্তী ঘটনার কথা মনে করে কারও মনে শঙ্কা তৈরি হওয়া অমূলক নয়। গাইবান্ধার উপনির্বাচন বাতিল করায় অনেকে ইসির দৃঢ়তার প্রশংসা করছেন। তা থেকে এটাও মনে হতে পারে যে নির্বাচন কমিশন নিজেদের প্রতি সব মহলের আস্থা ফিরিয়ে আনার একটি পরিকল্পনা হিসেবেই গাইবান্ধার উপনির্বাচন বাতিল করে চমক দেখিয়েছে।
নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবিতর্কিত হোক—এটা আমরা সবাই চাই। কিন্তু দেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু রয়েছে, তাতে শতভাগ সহিংসতা ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাস্তবতা বর্তমানে নেই। ক্ষমতা ও প্রভাব থাকলে তা না দেখিয়ে কেউ থাকতে চায় না। তাই নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা শুধু নির্বাচন কমিশনের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই আন্তরিকতা থাকতে হবে; বিশেষ করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং সমর্থকদের সহনশীলতা ও ফলাফল মেনে নেওয়ার মানসিকতা অবশ্যই থাকতে হবে।
ডিসি-এসপিদের সঙ্গে নির্বাচনের বৈঠকে একজন কমিশনারের বক্তব্যের সময় যে হইচই হয়েছে তা ছিল অনভিপ্রেত। সাংবিধানিক পদে থেকেও নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান যে তাঁর বক্তব্য শেষ করতে পারেননি, সেটা আমাদের অন্যের কথা না শোনার অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ। একজন দায়িত্বশীল পদাধিকারী ব্যক্তির কোনো বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য হলে তা প্রতিবাদেরও সহবতসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করাই ছিল বাঞ্ছনীয়।
প্রশাসনের দলনিরপেক্ষতা কাম্য হলেও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে না থাকলেও এখন পদে পদে বিপদে পড়ার আশঙ্কা থাকে! সে জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সরকার ও সরকারি দলের আজ্ঞাবাহী হওয়া সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছরে প্রশাসনকে যেভাবে সাজানো হয়েছে, সেখানে একটি বড় পরিবর্তন আনা জরুরি হলেও সেটা করার মতো সৎ ও নির্ভীক নেতৃত্ব এখন বিরল। সব মিলিয়ে আপাতত এটুকু বলার কথা যে সবার আস্থাভাজন হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে গাইবান্ধার উপনির্বাচনকে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে