আজাদুল আদনান, ঢাকা
বছর তিনেক আগে পরীক্ষায় ঢাকার কেরানীগঞ্জের আমিনুল ইসলামের (৩৬) দুটি কিডনিই বিকল দেখতে পান চিকিৎসকেরা। পরে সরকারি বিশেষায়িত জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে (নিকডু) নিয়মিত ডায়ালাইসিস করছিলেন বেসরকারি সংস্থা স্যানডোরের সহযোগিতায়। এ বছরের শুরুর দিকে স্ত্রী কিডনি দিতে আগ্রহ দেখালে নিকডুতেই তা প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন আমিনুল। কিন্তু যন্ত্র নষ্ট থাকাসহ নানা জটিলতায় মাসের পর মাস চলে গেলেও দিনক্ষণ ঠিক করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি খাতে চিকিৎসার প্রতিও কোনো আস্থা না থাকায় চলে যান ভারতে। গত ১০ মে সেখানে তাঁর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
শরীয়তপুরের জাজিরার দিদারুল ইসলামের (৪২) একদিন বুকে ব্যথা শুরু হলে ঢাকার একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে আনা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা জানান, হৃদ্যন্ত্রের একটি ধমনিতে ৯৫ শতাংশের বেশি ব্লক। তাতে স্টেন্ট (রিং) পরানোর পরামর্শ দেন। এ জন্য চাওয়া হয় ২ লাখ টাকা। তাতে আস্থা রাখতে পারেননি দিদারুল। গত ১২ এপ্রিল ভারতের বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক জানান, দিদারুলের হৃদ্যন্ত্রে কোনো ব্লক নেই। তাঁকে দেওয়া হয় কিছু ওষুধ। দিদারুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে এত ভালো প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসার অবস্থা এতটা নিম্নমানের, তা ভাবতেই পারছি না। চিকিৎসকের কথামতো রিং পরালে আমার মৃত্যুও হতে পারত। এখন সুস্থ আছি।’
চোখের কর্নিয়ায় চর্বি জমে থাকায় দৃষ্টিশক্তি কমছিল নীলফামারীর সৈয়দপুরের ১২ বছরের শিশু আওসাফের। ঢাকায় বাংলাদেশ আই হসপিটালে দেখালে সম্পূর্ণ ভালো হওয়ার নিশ্চয়তা ছাড়াই অস্ত্রোপচারের জন্য চাওয়া হয় আড়াই লাখ টাকা। পরে আওসাফকে ভারতে নেন স্বজনেরা। গত ১৫ আগস্ট সেখানে সফল অস্ত্রোপচার হয় ৬৫ হাজার টাকায়।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ঢাকায় ঢুকলেই চারদিকে কেবল হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট চোখে পড়ে। তারপরও চারপাশের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার জন্য বহু মানুষ যাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতে ৮০ শতাংশই যায় চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা রয়েছে। কী কারণে যাচ্ছে, সেটি খুঁজে বের করতে হবে।’
মন্ত্রী এর কারণ খুঁজে না পেলেও সাধারণ মানুষ তা ঠিকই জানে। মূল কারণ হলো দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা। ন্যূনতম সেবা তো দূরের কথা চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ‘খদ্দের’ মনে করেন চিকিৎসকেরা। চিকিৎসক ও কর্মীদের চেষ্টাই থাকে রোগীকে কৌশলে বেসরকারি হাসপাতালে ভাগিয়ে নিয়ে বাড়তি পয়সা কামানো। এ ছাড়া কমিশনের লোভে অহেতুক পরীক্ষা, ত্রুটিপূর্ণ ফল, রোগীর কথা না শোনার অভিযোগ তো আছেই।
রোগীদের বিদেশমুখিনতার কারণ নিয়ে সহজ জবাব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, চিকিৎসার মান না থাকায় বিদেশমুখী হচ্ছে রোগীরা।
এখন প্রশ্ন হলো এর দায় কার? দায় শুধু কি চিকিৎসকের একার? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে যেভাবে দেখা উচিত, সেভাবে দেখেন না রাজনীতিকেরা। কারণ, তারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন না। অধিকাংশ হাসপাতালে এখনো পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য জনবল নেই। কোথাও কোথাও যন্ত্রপাতি আছে তো টেকনিশিয়ান নেই। বহির্বিভাগে একজন কনসালট্যান্টের চিকিৎসা ও কিছু ওষুধ পাওয়া ছাড়া তেমন সেবা মিলছে না। আবার মাত্রাতিরিক্ত খরচ দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে গেলেও অযাচিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ত্রুটিপূর্ণ ফল এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম সময় দেওয়ায় রোগীরা হতাশ হন। এতে পুরো চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে বিদেশ যাচ্ছেন।’
ভারতগামীদের অধিকাংশই রোগী
বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই যায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তবে প্রতিবছর কত রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছে, সে বিষয়ে হালনাগাদ কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে। রাজধানীতে ভারতীয় ভিসা সেন্টারে প্রতিদিন কয়েক হাজার আবেদন জমা পড়ছে। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো মানুষের ৭০ শতাংশই চিকিৎসা ভিসার প্রার্থী।
বাংলাদেশে অবস্থিত ১৫টি ভারতীয় ভিসা অ্যাপলিকেশন সেন্টার পরিচালনা করে থাকে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। সেন্টার ও ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন কারণে ভারতে যাওয়া বাংলাদেশি মানুষের সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। বাংলাদেশে ভারতীয় মিশনগুলো ২০১৭ সালে ১৩ লাখ ৮০ হাজার ভিসা, ২০১৮ সালে ১৪ লাখ ৬০ হাজার ভিসা এবং ২০১৯ সালে প্রায় ১৬ লাখ ভিসা দিয়েছে। এসব ভিসার অন্তত তিন-চতুর্থাংশ চিকিৎসার জন্য রোগী ও তাদের সাহায্যকারীদের দেওয়া হয়েছে বলে হাইকমিশন সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে করোনাকালে ২০২০ ও ২০২১ সালে ভিসাগ্রহীতার সংখ্যা বেশ কমে যায়। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে আবার আগের মতোই ভারতে যেতে ভিসা নিচ্ছে মানুষ।
প্রতিদিন ৬ হাজারের মতো ভিসার আবেদন জমা পড়ছে জানিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, এর দুই-তৃতীয়াংশই মেডিকেল ভিসা এবং সাহায্যকারীদের। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজারের কাছাকাছি মানুষ চিকিৎসাবিষয়ক কাজে যাচ্ছে ভারতে। অর্থাৎ বছরে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ শুধু চিকিৎসা-সম্পর্কিত কাজে ভারত যাচ্ছে। চিকিৎসার জন্য ভারতগামী যাত্রীদের বড় একটি অংশ যায় সড়কপথে ও ট্রেনে।
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরাম (বিওপিওএফ) বলছে, মহামারিতে দীর্ঘদিন ভারতের ভিসা বন্ধ ছিল। অনেকেই সেখানে যেতে পারেনি। বর্তমানে নতুন রোগীর পাশাপাশি পুরোনো রোগীও যাচ্ছে।
বিওপিওএফের সাধারণ সম্পাদক মো. ইমরুল হোসেন ইমন আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি রোগী যাচ্ছে ভারতে। করোনায় বিধিনিষেধে অনেকেরই বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। বর্তমানে সুযোগ হওয়ায় অনেকে ব্যবসা ও ভ্রমণ ভিসায় গিয়েও চিকিৎসা নিচ্ছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে গত বছরের ২৪ জুলাই টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক যুগ আগে চিকিৎসার প্রয়োজনে ভারতে বাংলাদেশি আসার হার ২৩ শতাংশ হলেও ২০২০ সালে তা ৫৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। যোগাযোগ এবং উন্নত চিকিৎসার কারণে বাংলাদেশিরা ভারতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশি বিত্তবানদের অধিকাংশই চিকিৎসার জন্য যান সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়ায়। আর মধ্যবিত্তদের পছন্দের শীর্ষে ভারত। ভারতে জটিল রোগের চিকিৎসা নিতে মেডিকেল ভিসায় যাওয়ার নিয়ম থাকলেও থাইল্যান্ডে ভ্রমণ ভিসায় গিয়েই চিকিৎসা নেওয়া যায়।
থাইল্যান্ডে কয়েকটি হাসপাতালের ঢাকা অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে অন্তত ৩ হাজার রোগী যায় বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে। পছন্দের তালিকায় এরপর আছে ব্যাংকক ও ভেজথানি হাসপাতাল। প্রতিবছর প্রায় সোয়া লাখ বাংলাদেশি চিকিৎসা নিতে যায় দেশটিতে। এ ছাড়া অতি ধনী ও প্রভাবশালী বাংলাদেশিদের পছন্দের শীর্ষে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ ও ফেরার পার্ক হাসপাতাল।
বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি যায়
এই যে এত মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান, তার ব্যয় কত হবে? তার একটা হিসাব দেওয়া যেতে পারে। ২০২০ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের বাইরে ভ্রমণে যাওয়া মানুষের ৬০ দশমিক ৪১ শতাংশ (প্রায় ১৭ লাখ ৬৮ হাজার জন) গেছে ভারতে। এরপর সৌদি আরবে ৮ দশমিক ১২ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং থাইল্যান্ডে ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য দেশে গেছে ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। ওই অর্থবছরে বিদেশগামী যাত্রীরা ব্যয় করেছে প্রায় ৩৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল চিকিৎসার পেছনেই ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসকেরা রোগীদের সময় দেন না। কথা বলার আগেই ব্যবস্থাপত্র লেখা শেষ। এ অবস্থায় মানুষ তো বিদেশে যাবেই।’
পরিস্থিতি বদলায় না
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত দুই যুগে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮০০ ভাগ বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি কেবল গুণগত চিকিৎসা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনা আর সিন্ডিকেটের কবলে মানুষ অসহায়। সেখানে অনেক সময় অহেতুক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ দেওয়া হয়। কেউ অসুস্থ হলে তিনি কী ধরনের জটিলতায় ভুগছেন, কী ওষুধ খেতে হবে, সেটিও জানতে পারেন না। চিকিৎসকেরা রোগীকে অবহেলার চোখে দেখেন। এতে করে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। তখন বাধ্য হয়ে বেশি অর্থ খরচ করে হলেও সঠিক চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এ নিয়ে দায়িত্বে থাকা লোকজন শুধু কথা বলেন, কাজের কাজ কিছুই করেন না।
বছর তিনেক আগে পরীক্ষায় ঢাকার কেরানীগঞ্জের আমিনুল ইসলামের (৩৬) দুটি কিডনিই বিকল দেখতে পান চিকিৎসকেরা। পরে সরকারি বিশেষায়িত জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে (নিকডু) নিয়মিত ডায়ালাইসিস করছিলেন বেসরকারি সংস্থা স্যানডোরের সহযোগিতায়। এ বছরের শুরুর দিকে স্ত্রী কিডনি দিতে আগ্রহ দেখালে নিকডুতেই তা প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন আমিনুল। কিন্তু যন্ত্র নষ্ট থাকাসহ নানা জটিলতায় মাসের পর মাস চলে গেলেও দিনক্ষণ ঠিক করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি খাতে চিকিৎসার প্রতিও কোনো আস্থা না থাকায় চলে যান ভারতে। গত ১০ মে সেখানে তাঁর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
শরীয়তপুরের জাজিরার দিদারুল ইসলামের (৪২) একদিন বুকে ব্যথা শুরু হলে ঢাকার একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে আনা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা জানান, হৃদ্যন্ত্রের একটি ধমনিতে ৯৫ শতাংশের বেশি ব্লক। তাতে স্টেন্ট (রিং) পরানোর পরামর্শ দেন। এ জন্য চাওয়া হয় ২ লাখ টাকা। তাতে আস্থা রাখতে পারেননি দিদারুল। গত ১২ এপ্রিল ভারতের বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক জানান, দিদারুলের হৃদ্যন্ত্রে কোনো ব্লক নেই। তাঁকে দেওয়া হয় কিছু ওষুধ। দিদারুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে এত ভালো প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসার অবস্থা এতটা নিম্নমানের, তা ভাবতেই পারছি না। চিকিৎসকের কথামতো রিং পরালে আমার মৃত্যুও হতে পারত। এখন সুস্থ আছি।’
চোখের কর্নিয়ায় চর্বি জমে থাকায় দৃষ্টিশক্তি কমছিল নীলফামারীর সৈয়দপুরের ১২ বছরের শিশু আওসাফের। ঢাকায় বাংলাদেশ আই হসপিটালে দেখালে সম্পূর্ণ ভালো হওয়ার নিশ্চয়তা ছাড়াই অস্ত্রোপচারের জন্য চাওয়া হয় আড়াই লাখ টাকা। পরে আওসাফকে ভারতে নেন স্বজনেরা। গত ১৫ আগস্ট সেখানে সফল অস্ত্রোপচার হয় ৬৫ হাজার টাকায়।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ঢাকায় ঢুকলেই চারদিকে কেবল হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট চোখে পড়ে। তারপরও চারপাশের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসার জন্য বহু মানুষ যাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতে ৮০ শতাংশই যায় চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা রয়েছে। কী কারণে যাচ্ছে, সেটি খুঁজে বের করতে হবে।’
মন্ত্রী এর কারণ খুঁজে না পেলেও সাধারণ মানুষ তা ঠিকই জানে। মূল কারণ হলো দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা। ন্যূনতম সেবা তো দূরের কথা চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ‘খদ্দের’ মনে করেন চিকিৎসকেরা। চিকিৎসক ও কর্মীদের চেষ্টাই থাকে রোগীকে কৌশলে বেসরকারি হাসপাতালে ভাগিয়ে নিয়ে বাড়তি পয়সা কামানো। এ ছাড়া কমিশনের লোভে অহেতুক পরীক্ষা, ত্রুটিপূর্ণ ফল, রোগীর কথা না শোনার অভিযোগ তো আছেই।
রোগীদের বিদেশমুখিনতার কারণ নিয়ে সহজ জবাব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, চিকিৎসার মান না থাকায় বিদেশমুখী হচ্ছে রোগীরা।
এখন প্রশ্ন হলো এর দায় কার? দায় শুধু কি চিকিৎসকের একার? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে যেভাবে দেখা উচিত, সেভাবে দেখেন না রাজনীতিকেরা। কারণ, তারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন না। অধিকাংশ হাসপাতালে এখনো পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য জনবল নেই। কোথাও কোথাও যন্ত্রপাতি আছে তো টেকনিশিয়ান নেই। বহির্বিভাগে একজন কনসালট্যান্টের চিকিৎসা ও কিছু ওষুধ পাওয়া ছাড়া তেমন সেবা মিলছে না। আবার মাত্রাতিরিক্ত খরচ দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে গেলেও অযাচিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ত্রুটিপূর্ণ ফল এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম সময় দেওয়ায় রোগীরা হতাশ হন। এতে পুরো চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে বিদেশ যাচ্ছেন।’
ভারতগামীদের অধিকাংশই রোগী
বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই যায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তবে প্রতিবছর কত রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছে, সে বিষয়ে হালনাগাদ কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে। রাজধানীতে ভারতীয় ভিসা সেন্টারে প্রতিদিন কয়েক হাজার আবেদন জমা পড়ছে। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো মানুষের ৭০ শতাংশই চিকিৎসা ভিসার প্রার্থী।
বাংলাদেশে অবস্থিত ১৫টি ভারতীয় ভিসা অ্যাপলিকেশন সেন্টার পরিচালনা করে থাকে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। সেন্টার ও ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন কারণে ভারতে যাওয়া বাংলাদেশি মানুষের সংখ্যা প্রতিবছরই বাড়ছে। বাংলাদেশে ভারতীয় মিশনগুলো ২০১৭ সালে ১৩ লাখ ৮০ হাজার ভিসা, ২০১৮ সালে ১৪ লাখ ৬০ হাজার ভিসা এবং ২০১৯ সালে প্রায় ১৬ লাখ ভিসা দিয়েছে। এসব ভিসার অন্তত তিন-চতুর্থাংশ চিকিৎসার জন্য রোগী ও তাদের সাহায্যকারীদের দেওয়া হয়েছে বলে হাইকমিশন সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে করোনাকালে ২০২০ ও ২০২১ সালে ভিসাগ্রহীতার সংখ্যা বেশ কমে যায়। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে আবার আগের মতোই ভারতে যেতে ভিসা নিচ্ছে মানুষ।
প্রতিদিন ৬ হাজারের মতো ভিসার আবেদন জমা পড়ছে জানিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, এর দুই-তৃতীয়াংশই মেডিকেল ভিসা এবং সাহায্যকারীদের। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজারের কাছাকাছি মানুষ চিকিৎসাবিষয়ক কাজে যাচ্ছে ভারতে। অর্থাৎ বছরে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ শুধু চিকিৎসা-সম্পর্কিত কাজে ভারত যাচ্ছে। চিকিৎসার জন্য ভারতগামী যাত্রীদের বড় একটি অংশ যায় সড়কপথে ও ট্রেনে।
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরাম (বিওপিওএফ) বলছে, মহামারিতে দীর্ঘদিন ভারতের ভিসা বন্ধ ছিল। অনেকেই সেখানে যেতে পারেনি। বর্তমানে নতুন রোগীর পাশাপাশি পুরোনো রোগীও যাচ্ছে।
বিওপিওএফের সাধারণ সম্পাদক মো. ইমরুল হোসেন ইমন আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি রোগী যাচ্ছে ভারতে। করোনায় বিধিনিষেধে অনেকেরই বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। বর্তমানে সুযোগ হওয়ায় অনেকে ব্যবসা ও ভ্রমণ ভিসায় গিয়েও চিকিৎসা নিচ্ছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে গত বছরের ২৪ জুলাই টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক যুগ আগে চিকিৎসার প্রয়োজনে ভারতে বাংলাদেশি আসার হার ২৩ শতাংশ হলেও ২০২০ সালে তা ৫৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। যোগাযোগ এবং উন্নত চিকিৎসার কারণে বাংলাদেশিরা ভারতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশি বিত্তবানদের অধিকাংশই চিকিৎসার জন্য যান সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়ায়। আর মধ্যবিত্তদের পছন্দের শীর্ষে ভারত। ভারতে জটিল রোগের চিকিৎসা নিতে মেডিকেল ভিসায় যাওয়ার নিয়ম থাকলেও থাইল্যান্ডে ভ্রমণ ভিসায় গিয়েই চিকিৎসা নেওয়া যায়।
থাইল্যান্ডে কয়েকটি হাসপাতালের ঢাকা অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে অন্তত ৩ হাজার রোগী যায় বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে। পছন্দের তালিকায় এরপর আছে ব্যাংকক ও ভেজথানি হাসপাতাল। প্রতিবছর প্রায় সোয়া লাখ বাংলাদেশি চিকিৎসা নিতে যায় দেশটিতে। এ ছাড়া অতি ধনী ও প্রভাবশালী বাংলাদেশিদের পছন্দের শীর্ষে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ ও ফেরার পার্ক হাসপাতাল।
বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি যায়
এই যে এত মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান, তার ব্যয় কত হবে? তার একটা হিসাব দেওয়া যেতে পারে। ২০২০ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের বাইরে ভ্রমণে যাওয়া মানুষের ৬০ দশমিক ৪১ শতাংশ (প্রায় ১৭ লাখ ৬৮ হাজার জন) গেছে ভারতে। এরপর সৌদি আরবে ৮ দশমিক ১২ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং থাইল্যান্ডে ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য দেশে গেছে ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। ওই অর্থবছরে বিদেশগামী যাত্রীরা ব্যয় করেছে প্রায় ৩৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেবল চিকিৎসার পেছনেই ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসকেরা রোগীদের সময় দেন না। কথা বলার আগেই ব্যবস্থাপত্র লেখা শেষ। এ অবস্থায় মানুষ তো বিদেশে যাবেই।’
পরিস্থিতি বদলায় না
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত দুই যুগে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮০০ ভাগ বেড়েছে, কিন্তু বাড়েনি কেবল গুণগত চিকিৎসা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনা আর সিন্ডিকেটের কবলে মানুষ অসহায়। সেখানে অনেক সময় অহেতুক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ দেওয়া হয়। কেউ অসুস্থ হলে তিনি কী ধরনের জটিলতায় ভুগছেন, কী ওষুধ খেতে হবে, সেটিও জানতে পারেন না। চিকিৎসকেরা রোগীকে অবহেলার চোখে দেখেন। এতে করে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। তখন বাধ্য হয়ে বেশি অর্থ খরচ করে হলেও সঠিক চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এ নিয়ে দায়িত্বে থাকা লোকজন শুধু কথা বলেন, কাজের কাজ কিছুই করেন না।
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
৯ ঘণ্টা আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১১ ঘণ্টা আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে