নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা, কুড়িগ্রাম দিনাজপুর ও সৈয়দপুর প্রতিনিধি
করোনা ও বন্যা পরিস্থিতির কারণে এবারের এসএসসি পরীক্ষা এমনিতেই শুরু হলো দেরিতে। সেই দেরিতে শুরু হওয়া পরীক্ষা মাঝপথে এসে হোঁচট খেল, আবারও ফাঁস হয়ে গেল প্রশ্নপত্র। তবুও রক্ষে যে এ অপকর্ম শুধু দিনাজপুর বোর্ডেই হয়েছে। সারা দেশে হলে পরিস্থিতি কী হতো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস করা নিয়ে সব সময়ে যে অভিযোগ ছিল, এবারও সেই ‘বেড়াতে খেত খেয়েছে’। ফাঁস করেছেন পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিবের দায়িত্বে থাকা এক প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকেরা। বিষয়টি ধরা পড়ার পর দিনাজপুর বোর্ড কর্তৃপক্ষ গণিত, পদার্থ, কৃষি ও রসায়ন বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করেছে। চার শিক্ষকের নাম ধরে ১৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। পাঁচ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনার পর শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হলো, তার কী হবে?
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা দেশে নতুন কিছু নয়। ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছিল। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরীক্ষার্থী, কোচিং শিক্ষক, অভিভাবক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্কুলশিক্ষকসহ বেশ কিছু লোককে গ্রেপ্তার করে। ফাঁস ঠেকাতে সরকার এসএসসি পরীক্ষা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেয়।
পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে প্রবেশে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে, মোবাইল ফোনের ব্যবহারও সীমিত করা হয়। এসব করার পর ধরে নেওয়া হয়েছিল, এবার হয়তো প্রশ্নপত্র ফাঁস থামবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল কোনো দাওয়াইতেও কাজ হচ্ছে না।
তবে এবারের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটি কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম। প্রথম দুটি পরীক্ষা ভালোই চলছিল। কেউ কোনো কিছু বুঝতে পারছিলেন না। মঙ্গলবার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা চলার সময়ে চারদিকে কানাকানি শুরু হয়। সে খবর কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ট্যাগ কর্মকর্তা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আদম মালিক চৌধুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মাকে জানান। তিনি এসে কেন্দ্রসচিব ও স্কুলের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানের কক্ষে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু তিনি সব অস্বীকার করেন। পরে তিনি সবার উপস্থিতিতে সবকিছু স্বীকার করে তাঁর রুমের বুকশেলফের নিচের তাক থেকে একটি কাপড়ের ব্যাগ বের করে দেন। তার ভেতরে পাওয়া যায় কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র।
যেভাবে ফাঁস হয় প্রশ্নপত্র
এখন প্রশ্ন হতে পারে, এই শিক্ষক সব প্রশ্নপত্র পেলেন কী করে? সে জবাবও প্রধান শিক্ষক দিয়েছেন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থানায় বাছাইয়ের (সর্টিং) সময় বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের ভেতর বাংলা দ্বিতীয় পত্র, ইংরেজি প্রথম পত্র ও দ্বিতীয় পত্র, গণিত (আবশ্যিক), উচ্চতর গণিত, রসায়ন, কৃষি, জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্নপত্র ঢুকিয়ে নেন। এরপর সিলগালা করা প্যাকেটের ওপর সই করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার দিন থানা থেকে বাংলা প্রথম পত্রের প্যাকেট এনে তা খুলে অন্য প্রশ্নগুলো কৌশলে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তরমালা তৈরি করে ওই পরীক্ষার্থীদের কাছে বিভিন্ন মূল্যে বিক্রি করেন। এর মধ্যে ইংরেজি প্রথম পত্র পরীক্ষার সময় পরীক্ষার আগেই কিছু শিক্ষার্থীর কাছে হাতে লেখা উত্তরপত্র পৌঁছে যায়। এতে স্থানীয় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি পরীক্ষা কমিটি প্রথমে আমলে না নিলেও ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার আগে বের হওয়া উত্তরপত্রের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মিলে গেলে সবাই নড়েচড়ে বসে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসে কারা জড়িত
প্রশ্ন বাছাইয়ের পর খামে ভরিয়ে সেই খামের ওপর ভূরুঙ্গামারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহিম স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু স্বাক্ষরের আগে তিনি সেই খামের ভেতর কোন কোন প্রশ্ন ভরানো হয়েছে, তা যাচাই করেছিলেন কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ট্যাগ কর্মকর্তা ও অন্য শিক্ষকদের উপস্থিতিতে কীভাবে একটি বিষয়ের প্রশ্নপত্রের খামের ভেতর অন্যান্য বিষয়ের প্রশ্নপত্র ঢোকানো হলো, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান এবং সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের ট্যাগ কর্মকর্তা আদম মালিক চৌধুরীসহ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কমিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায় এড়াতে পারেন কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন জেলার শিক্ষক ও অভিভাবকেরা।
মামলার এজাহার ও সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নজরে এলে নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমানের অফিসকক্ষে অভিযান চালিয়ে গণিত (আবশ্যিক), উচ্চতর গণিত, রসায়ন, কৃষি, জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্নপত্র উদ্ধার করে পুলিশ।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর পেয়ে ভূরুঙ্গামারী ছুটে যান দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. কামরুল ইসলাম, সচিব প্রফেসর মো. জহির উদ্দিন, কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিইও) শামসুল আলম। তারা সবাইকে মধ্যরাত অবধি জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরপর ট্যাগ কর্মকর্তা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আদম মালিক চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা করেন। ছয় বিষয়ের প্রশ্নপত্র উদ্ধার হলেও বুধবার সকালে চার বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করে শিক্ষা বোর্ড।
ভূরুঙ্গামারী থানার ওসি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এজাহারের ভিত্তিতে তিন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছি। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও দুই শিক্ষককে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে।’
শিক্ষাসচিব ও বোর্ডের চেয়ারম্যান যা বললেন
জানতে চাইলে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আমরা চার বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করেছি। এ পরীক্ষাগুলোর মধ্যে গণিতে (সব বিভাগের) প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮৪২ জন এবং অন্যান্য বিষয়ে ৮২ হাজার ৪৭ জন শিক্ষার্থীর অংশ নেওয়ার কথা ছিল।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বোর্ড থেকে কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক মো. ফারাজ উদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর স্থগিত পরীক্ষাগুলোর রুটিন খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।
রুটিন অনুযায়ী গণিত পরীক্ষা আজ বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর), পদার্থবিজ্ঞান (তত্ত্বীয়) শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর), কৃষিশিক্ষা রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) এবং রসায়ন (তত্ত্বীয়) সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) হওয়ার কথা ছিল। এর আগে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীন নড়াইল ও লোহাগড়ার দুটি পরীক্ষাকেন্দ্রে বাংলা প্রথম পত্রের এমসিকিউ প্রশ্নপত্রের জায়গায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রের এমসিকিউ প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হয়েছিল। পরে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের এমসিকিউ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। স্থগিত হওয়া বাংলা (আবশ্যিক) দ্বিতীয় পত্রের এমসিকিউ পরীক্ষা ৩০ সেপ্টেম্বর নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক আজকের পত্রিকাকে বলেন, আগের থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের এবারের ধরন ভিন্ন। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে যে প্রশ্নফাঁস হলো, তা থানার লকার থেকে আনার সময় ফাঁস হয়েছে। মূলত সেখানকার কেন্দ্রসচিব এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। তিনি বিজ্ঞান বিভাগের বাড়তি কিছু প্রশ্ন নিয়ে নেন। তবে প্রশ্নগুলো এখনো ছড়িয়ে পড়েনি।
প্রশ্নপত্র ফাঁসে গ্রেপ্তার ৫
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যাগ কর্মকর্তা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আদম মালিক চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিব মো. লুৎফর রহমান, একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. জোবাইর হোসেন, মো. আবু হানিফ ও মো. আমিনুর রহমান। এজাহারে ১০ থেকে ১৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় একজন শিক্ষকের জড়িত থাকা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। একজন শিক্ষকের কাজ তো এটি নয়। এটি দেখে আমার একটি কথাই মনে পড়ছে, তা হলো আমাদের সমাজে পচন ধরেছে। এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে এখনো পচন ধরেনি। শিক্ষকেরাও সমাজের বাইরের কেউ নন। তারপরও একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এ ধরনের কাজ কখনোই কাম্য নয়।’
করোনা ও বন্যা পরিস্থিতির কারণে এবারের এসএসসি পরীক্ষা এমনিতেই শুরু হলো দেরিতে। সেই দেরিতে শুরু হওয়া পরীক্ষা মাঝপথে এসে হোঁচট খেল, আবারও ফাঁস হয়ে গেল প্রশ্নপত্র। তবুও রক্ষে যে এ অপকর্ম শুধু দিনাজপুর বোর্ডেই হয়েছে। সারা দেশে হলে পরিস্থিতি কী হতো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস করা নিয়ে সব সময়ে যে অভিযোগ ছিল, এবারও সেই ‘বেড়াতে খেত খেয়েছে’। ফাঁস করেছেন পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিবের দায়িত্বে থাকা এক প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকেরা। বিষয়টি ধরা পড়ার পর দিনাজপুর বোর্ড কর্তৃপক্ষ গণিত, পদার্থ, কৃষি ও রসায়ন বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করেছে। চার শিক্ষকের নাম ধরে ১৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। পাঁচ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনার পর শিক্ষক ও অভিভাবকের মধ্যে যে হতাশা তৈরি হলো, তার কী হবে?
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা দেশে নতুন কিছু নয়। ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছিল। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরীক্ষার্থী, কোচিং শিক্ষক, অভিভাবক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্কুলশিক্ষকসহ বেশ কিছু লোককে গ্রেপ্তার করে। ফাঁস ঠেকাতে সরকার এসএসসি পরীক্ষা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেয়।
পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে প্রবেশে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে, মোবাইল ফোনের ব্যবহারও সীমিত করা হয়। এসব করার পর ধরে নেওয়া হয়েছিল, এবার হয়তো প্রশ্নপত্র ফাঁস থামবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল কোনো দাওয়াইতেও কাজ হচ্ছে না।
তবে এবারের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটি কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম। প্রথম দুটি পরীক্ষা ভালোই চলছিল। কেউ কোনো কিছু বুঝতে পারছিলেন না। মঙ্গলবার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা চলার সময়ে চারদিকে কানাকানি শুরু হয়। সে খবর কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ট্যাগ কর্মকর্তা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আদম মালিক চৌধুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মাকে জানান। তিনি এসে কেন্দ্রসচিব ও স্কুলের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানের কক্ষে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিন্তু তিনি সব অস্বীকার করেন। পরে তিনি সবার উপস্থিতিতে সবকিছু স্বীকার করে তাঁর রুমের বুকশেলফের নিচের তাক থেকে একটি কাপড়ের ব্যাগ বের করে দেন। তার ভেতরে পাওয়া যায় কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র।
যেভাবে ফাঁস হয় প্রশ্নপত্র
এখন প্রশ্ন হতে পারে, এই শিক্ষক সব প্রশ্নপত্র পেলেন কী করে? সে জবাবও প্রধান শিক্ষক দিয়েছেন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থানায় বাছাইয়ের (সর্টিং) সময় বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের ভেতর বাংলা দ্বিতীয় পত্র, ইংরেজি প্রথম পত্র ও দ্বিতীয় পত্র, গণিত (আবশ্যিক), উচ্চতর গণিত, রসায়ন, কৃষি, জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্নপত্র ঢুকিয়ে নেন। এরপর সিলগালা করা প্যাকেটের ওপর সই করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান। বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার দিন থানা থেকে বাংলা প্রথম পত্রের প্যাকেট এনে তা খুলে অন্য প্রশ্নগুলো কৌশলে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তরমালা তৈরি করে ওই পরীক্ষার্থীদের কাছে বিভিন্ন মূল্যে বিক্রি করেন। এর মধ্যে ইংরেজি প্রথম পত্র পরীক্ষার সময় পরীক্ষার আগেই কিছু শিক্ষার্থীর কাছে হাতে লেখা উত্তরপত্র পৌঁছে যায়। এতে স্থানীয় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি পরীক্ষা কমিটি প্রথমে আমলে না নিলেও ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার আগে বের হওয়া উত্তরপত্রের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মিলে গেলে সবাই নড়েচড়ে বসে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসে কারা জড়িত
প্রশ্ন বাছাইয়ের পর খামে ভরিয়ে সেই খামের ওপর ভূরুঙ্গামারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহিম স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু স্বাক্ষরের আগে তিনি সেই খামের ভেতর কোন কোন প্রশ্ন ভরানো হয়েছে, তা যাচাই করেছিলেন কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ট্যাগ কর্মকর্তা ও অন্য শিক্ষকদের উপস্থিতিতে কীভাবে একটি বিষয়ের প্রশ্নপত্রের খামের ভেতর অন্যান্য বিষয়ের প্রশ্নপত্র ঢোকানো হলো, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান এবং সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের ট্যাগ কর্মকর্তা আদম মালিক চৌধুরীসহ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কমিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায় এড়াতে পারেন কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন জেলার শিক্ষক ও অভিভাবকেরা।
মামলার এজাহার ও সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নজরে এলে নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমানের অফিসকক্ষে অভিযান চালিয়ে গণিত (আবশ্যিক), উচ্চতর গণিত, রসায়ন, কৃষি, জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের প্রশ্নপত্র উদ্ধার করে পুলিশ।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর পেয়ে ভূরুঙ্গামারী ছুটে যান দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. কামরুল ইসলাম, সচিব প্রফেসর মো. জহির উদ্দিন, কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিইও) শামসুল আলম। তারা সবাইকে মধ্যরাত অবধি জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরপর ট্যাগ কর্মকর্তা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আদম মালিক চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা করেন। ছয় বিষয়ের প্রশ্নপত্র উদ্ধার হলেও বুধবার সকালে চার বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করে শিক্ষা বোর্ড।
ভূরুঙ্গামারী থানার ওসি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এজাহারের ভিত্তিতে তিন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছি। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আরও দুই শিক্ষককে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে।’
শিক্ষাসচিব ও বোর্ডের চেয়ারম্যান যা বললেন
জানতে চাইলে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আমরা চার বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করেছি। এ পরীক্ষাগুলোর মধ্যে গণিতে (সব বিভাগের) প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮৪২ জন এবং অন্যান্য বিষয়ে ৮২ হাজার ৪৭ জন শিক্ষার্থীর অংশ নেওয়ার কথা ছিল।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বোর্ড থেকে কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক মো. ফারাজ উদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর স্থগিত পরীক্ষাগুলোর রুটিন খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।
রুটিন অনুযায়ী গণিত পরীক্ষা আজ বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর), পদার্থবিজ্ঞান (তত্ত্বীয়) শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর), কৃষিশিক্ষা রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) এবং রসায়ন (তত্ত্বীয়) সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) হওয়ার কথা ছিল। এর আগে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীন নড়াইল ও লোহাগড়ার দুটি পরীক্ষাকেন্দ্রে বাংলা প্রথম পত্রের এমসিকিউ প্রশ্নপত্রের জায়গায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রের এমসিকিউ প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হয়েছিল। পরে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের এমসিকিউ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। স্থগিত হওয়া বাংলা (আবশ্যিক) দ্বিতীয় পত্রের এমসিকিউ পরীক্ষা ৩০ সেপ্টেম্বর নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক আজকের পত্রিকাকে বলেন, আগের থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের এবারের ধরন ভিন্ন। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে যে প্রশ্নফাঁস হলো, তা থানার লকার থেকে আনার সময় ফাঁস হয়েছে। মূলত সেখানকার কেন্দ্রসচিব এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। তিনি বিজ্ঞান বিভাগের বাড়তি কিছু প্রশ্ন নিয়ে নেন। তবে প্রশ্নগুলো এখনো ছড়িয়ে পড়েনি।
প্রশ্নপত্র ফাঁসে গ্রেপ্তার ৫
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যাগ কর্মকর্তা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আদম মালিক চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিব মো. লুৎফর রহমান, একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. জোবাইর হোসেন, মো. আবু হানিফ ও মো. আমিনুর রহমান। এজাহারে ১০ থেকে ১৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় একজন শিক্ষকের জড়িত থাকা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। একজন শিক্ষকের কাজ তো এটি নয়। এটি দেখে আমার একটি কথাই মনে পড়ছে, তা হলো আমাদের সমাজে পচন ধরেছে। এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে এখনো পচন ধরেনি। শিক্ষকেরাও সমাজের বাইরের কেউ নন। তারপরও একজন শিক্ষকের কাছ থেকে এ ধরনের কাজ কখনোই কাম্য নয়।’
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে