ড. মইনুল ইসলাম
দেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি একতরফা নির্বাচন হয়ে গেল। ২০১৪ সালের নির্বাচনটিও একতরফা ছিল, কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশ ও প্রশাসনের সক্রিয় অংশগ্রহণে ক্ষমতাসীন দল দেশের অধিকাংশ স্থানে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভরে ফেলার মাধ্যমে নির্বাচনটি প্রহসনে পরিণত করেছিল। ফলে সংসদের তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন ক্ষমতাসীন জোটের দখলে চলে যাওয়ার পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোর ৯৬ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল এই অভূতপূর্ব কারচুপির মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছিল যে ক্ষমতাসীন দলকে সরকারে রেখে এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন এ দেশে ১৯৭৩ সাল থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আসছিল। এবারের নির্বাচনটা আবারও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হওয়ায় বিএনপিসহ দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করেছে।
এবারের নির্বাচনে ভোট সম্পন্ন হয়ে ফলাফল ঘোষিত ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হওয়ায় ২৭৯টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। (জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং কল্যাণ পার্টির বিজয়ী প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত)। নির্বাচনের দিন বেলা ৩টায় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল তখন পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে, যেটাকে আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ভোটের পর এখন তারা বলছে, নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের এক ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টি একেবারেই অবিশ্বাস্য! যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং কানাডা নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়নি বলে মত দিয়েছে। তবু বলব, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও এর সাংবিধানিক বৈধতা থাকবে।
এবারের একতরফা নির্বাচনে ভোটার বাড়ানোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছিল। প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। ভোটারসংখ্যা বাড়ানোর জন্য নিঃসন্দেহে এই কৌশল ফলপ্রসূ হয়েছে। তবে মিডিয়ার কল্যাণে দেখা গেল, দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে প্রায় সারা দিন ভোটকেন্দ্রগুলো জনবিরল ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে যে দীর্ঘ ভোটার লাইন দেখা গিয়েছিল এবার তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। প্রকাশিত ফলাফল থেকেও দেখা যাচ্ছে, যেসব আসনে ব্যালটে সিল মারার মহোৎসব চালানো হয়নি, সেখানে ভোটের অনুপাত ২০ শতাংশের আশপাশে ছিল। বিশেষ করে ঢাকা নগরী ও আশপাশের জেলাগুলোয় এ রকম ভোটার অনুপাত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ বা এরও বেশি ভোট যেসব বিজয়ী প্রার্থী পেয়েছেন, সেখানে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে কি না, সহজেই অনুমেয়। ওই সব আসনে ‘ব্যালট-স্টাফিং’ চালানো হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এটা অনস্বীকার্য যে ভোটকেন্দ্রগুলোয় দায়িত্বরত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের মোকাবিলা করার সাহস দেখানো তাঁদের চাকরির জন্য নিশ্চিত বিপদ ডেকে আনা।
নির্বাচনী জালিয়াতির এই সংস্কৃতি থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যেই ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে কেয়ারটেকার সরকার আইন পাস হওয়ার পর ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ওই সরকারের অধীনে। কিন্তু ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি নির্বাচনেই বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমতাসীন দল বা জোটকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘পরিকল্পিত ম্যানিপুলেশনের’ শিকার হয়েছে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৬-০৮ সালে। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল বলে দেশে-বিদেশে বহুল-প্রশংসিত হলেও পরাজয় মেনে নেয়নি বিএনপি। রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ব্যবহার করে খালেদা জিয়া বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, যে ষড়যন্ত্রটি এ দেশে নিযুক্ত কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সহায়তায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন।
২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তিনিই প্রধান উপদেষ্টা হতে যাচ্ছেন, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাসখানেক আগেই তিনি তাঁর ‘হোমওয়ার্ক’ শুরু করে দিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও তাঁর ওই হোমওয়ার্কে অংশগ্রহণ করেছেন আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব লাভের আগেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুঈদ-মঈনুল-শাহজাহান কমিটিকে ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আমলারা দুই মাসেরও কম সময়ে ১ হাজার ৫২৬ জন কর্মকর্তার বদলি সুসম্পন্ন করার কাহিনি পরবর্তীকালে ওই কুশীলবদের কয়েকজনের পত্রপত্রিকায় প্রদত্ত জবানিতেই খোলাসা হয়ে গিয়েছিল। এরপর বিএনপি দাবি তুলল, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে সারা দেশে—নয়তো আওয়ামী লীগের মাস্তানরা নাকি ভোটকেন্দ্র দখল করে রাখবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এ-সম্পর্কীয় সুপারিশ মেনে নিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। সেনাবাহিনী মাঠে গিয়ে ধাওয়া দিল মাস্তান-পাতি মাস্তান-ক্যাডারদের, পালিয়ে বাঁচল বীর-পুঙ্গবরা। কিন্তু আওয়ামী ‘দুষ্টলোকদের’ খালি করা মাঠ বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার ও মাস্তানরা দখল করে নিয়েছিল। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী বিপর্যয়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল যে চরিত্রগতভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ক্ষমতাসীন দলবিরোধী।
বিএনপির প্রাথমিক পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্পাদক বিচারপতি কে এম হাসানকে পুরস্কার হিসেবে হাইকোর্টে বিচারপতি করা হয়েছিল; তাঁকেই ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার অঙ্ক কষে বিএনপির ‘চাণক্য-প্রবররা’ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ধুরন্ধরদের এই ‘অতি চালাকি’ জনগণের কাছে ধরা পড়ে গেল, শুরু হয়ে গেল হাসানবিরোধী প্রাণঘাতী আন্দোলন-সংগ্রাম। আন্দোলনের তীব্রতা উপলব্ধি করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দুপুরেই বিচারপতি হাসান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ব্যাপারে তাঁর অসম্মতি জানিয়ে দিলেন। কিন্তু ওই মহাগুরুত্বপূর্ণ খবরটা জাতিকে না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন মোবাইল ফোনে তা জানালেন শুধু খালেদা জিয়াকে। খালেদা জিয়া তখন নয়াপল্টনের সভামঞ্চে। টিভি ক্যামেরায় আমরাও দেখলাম, তিনি কলটি রিসিভ করে ওই সভায় বক্তৃতা না দিয়েই তড়িঘড়ি মঞ্চ থেকে নেমে গাড়িবহর নিয়ে সোজা চলে গেলেন বঙ্গভবনে। তাঁদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেকই সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধান অনুসারে বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার অনুরোধ না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে গেলেন। তাঁর কট্টর বিএনপি-প্রেমের প্রমাণ পেয়ে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করায় নতুন চার উপদেষ্টা নিয়োগ করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করতে এগিয়ে গেলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার নির্দেশমতো সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে মেজর জেনারেল রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে নিয়োগের বন্দোবস্ত করেছিলেন ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। কিন্তু ওই খবর আগেভাগে ফাঁস হওয়ায় জেনারেল মইন ইউ আহমেদ তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এভাবেই এক-এগারোয় বাংলাদেশ আবারও ছদ্মবেশী সেনাশাসনের কবলে পড়েছিল। এদ্দিনে বুঝতে বাকি নেই, সেনা এস্টাবলিশমেন্টের ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ এবং দীর্ঘদিন শাসন করার খায়েশ ব্যর্থ হওয়ায় তারা ২০০৮ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল।
২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করল অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক, কিন্তু প্রয়োজন মনে করলে আরও দুটো নির্বাচন ওই ব্যবস্থায় হতে পারে। সুযোগ বুঝে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই বাতিল করে দিলেন শেখ হাসিনা। আর তখন থেকেই দেশের বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালকে আন্দোলন-সংগ্রামের মূল দাবিতে পরিণত করলেও তাদের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং বিদেশিদের বিরোধিতাকে তোয়াক্কা না করে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ আরেকটি একতরফা নির্বাচন করে ফেলল। বোঝা প্রয়োজন, গণ-অভ্যুত্থানে বাধ্য না হলে কোনো ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করবে না। জেনেশুনে পরবর্তী নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় কি কোনো সরকার চাইতে পারে? অথচ ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন কখনোই ‘নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা’ পাবে না এ দেশে। এ ধরনের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে পারছে বারবার, কিন্তু জনগণের কাছে সরকার পরিবর্তনের কোনো বৈধ সুযোগ বা সাংবিধানিক অধিকার থাকছে না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আরেকটি একতরফা নির্বাচন হয়ে গেল। ২০১৪ সালের নির্বাচনটিও একতরফা ছিল, কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশ ও প্রশাসনের সক্রিয় অংশগ্রহণে ক্ষমতাসীন দল দেশের অধিকাংশ স্থানে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভরে ফেলার মাধ্যমে নির্বাচনটি প্রহসনে পরিণত করেছিল। ফলে সংসদের তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসন ক্ষমতাসীন জোটের দখলে চলে যাওয়ার পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোর ৯৬ শতাংশ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল এই অভূতপূর্ব কারচুপির মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছিল যে ক্ষমতাসীন দলকে সরকারে রেখে এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন এ দেশে ১৯৭৩ সাল থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আসছিল। এবারের নির্বাচনটা আবারও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হওয়ায় বিএনপিসহ দেশের প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করেছে।
এবারের নির্বাচনে ভোট সম্পন্ন হয়ে ফলাফল ঘোষিত ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে জয়ী হয়েছে। কিন্তু ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হওয়ায় ২৭৯টি আসনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়েছে বলা চলে। (জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং কল্যাণ পার্টির বিজয়ী প্রার্থীরাও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত)। নির্বাচনের দিন বেলা ৩টায় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল তখন পর্যন্ত ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে, যেটাকে আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ভোটের পর এখন তারা বলছে, নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শেষের এক ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ বৈধ ভোট পড়ার বিষয়টি একেবারেই অবিশ্বাস্য! যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং কানাডা নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়নি বলে মত দিয়েছে। তবু বলব, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও এর সাংবিধানিক বৈধতা থাকবে।
এবারের একতরফা নির্বাচনে ভোটার বাড়ানোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছিল। প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। ভোটারসংখ্যা বাড়ানোর জন্য নিঃসন্দেহে এই কৌশল ফলপ্রসূ হয়েছে। তবে মিডিয়ার কল্যাণে দেখা গেল, দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে প্রায় সারা দিন ভোটকেন্দ্রগুলো জনবিরল ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে যে দীর্ঘ ভোটার লাইন দেখা গিয়েছিল এবার তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। প্রকাশিত ফলাফল থেকেও দেখা যাচ্ছে, যেসব আসনে ব্যালটে সিল মারার মহোৎসব চালানো হয়নি, সেখানে ভোটের অনুপাত ২০ শতাংশের আশপাশে ছিল। বিশেষ করে ঢাকা নগরী ও আশপাশের জেলাগুলোয় এ রকম ভোটার অনুপাত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ বা এরও বেশি ভোট যেসব বিজয়ী প্রার্থী পেয়েছেন, সেখানে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে কি না, সহজেই অনুমেয়। ওই সব আসনে ‘ব্যালট-স্টাফিং’ চালানো হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এটা অনস্বীকার্য যে ভোটকেন্দ্রগুলোয় দায়িত্বরত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের মোকাবিলা করার সাহস দেখানো তাঁদের চাকরির জন্য নিশ্চিত বিপদ ডেকে আনা।
নির্বাচনী জালিয়াতির এই সংস্কৃতি থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যেই ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে কেয়ারটেকার সরকার আইন পাস হওয়ার পর ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ওই সরকারের অধীনে। কিন্তু ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি নির্বাচনেই বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমতাসীন দল বা জোটকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘পরিকল্পিত ম্যানিপুলেশনের’ শিকার হয়েছে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৬-০৮ সালে। ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছিল বলে দেশে-বিদেশে বহুল-প্রশংসিত হলেও পরাজয় মেনে নেয়নি বিএনপি। রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ব্যবহার করে খালেদা জিয়া বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন, যে ষড়যন্ত্রটি এ দেশে নিযুক্ত কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সহায়তায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারা ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন।
২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমান যখন নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তিনিই প্রধান উপদেষ্টা হতে যাচ্ছেন, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাসখানেক আগেই তিনি তাঁর ‘হোমওয়ার্ক’ শুরু করে দিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও তাঁর ওই হোমওয়ার্কে অংশগ্রহণ করেছেন আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব লাভের আগেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মুঈদ-মঈনুল-শাহজাহান কমিটিকে ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আমলারা দুই মাসেরও কম সময়ে ১ হাজার ৫২৬ জন কর্মকর্তার বদলি সুসম্পন্ন করার কাহিনি পরবর্তীকালে ওই কুশীলবদের কয়েকজনের পত্রপত্রিকায় প্রদত্ত জবানিতেই খোলাসা হয়ে গিয়েছিল। এরপর বিএনপি দাবি তুলল, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে সারা দেশে—নয়তো আওয়ামী লীগের মাস্তানরা নাকি ভোটকেন্দ্র দখল করে রাখবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এ-সম্পর্কীয় সুপারিশ মেনে নিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। সেনাবাহিনী মাঠে গিয়ে ধাওয়া দিল মাস্তান-পাতি মাস্তান-ক্যাডারদের, পালিয়ে বাঁচল বীর-পুঙ্গবরা। কিন্তু আওয়ামী ‘দুষ্টলোকদের’ খালি করা মাঠ বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার ও মাস্তানরা দখল করে নিয়েছিল। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী বিপর্যয়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল যে চরিত্রগতভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ক্ষমতাসীন দলবিরোধী।
বিএনপির প্রাথমিক পর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্পাদক বিচারপতি কে এম হাসানকে পুরস্কার হিসেবে হাইকোর্টে বিচারপতি করা হয়েছিল; তাঁকেই ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার অঙ্ক কষে বিএনপির ‘চাণক্য-প্রবররা’ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ধুরন্ধরদের এই ‘অতি চালাকি’ জনগণের কাছে ধরা পড়ে গেল, শুরু হয়ে গেল হাসানবিরোধী প্রাণঘাতী আন্দোলন-সংগ্রাম। আন্দোলনের তীব্রতা উপলব্ধি করে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দুপুরেই বিচারপতি হাসান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ব্যাপারে তাঁর অসম্মতি জানিয়ে দিলেন। কিন্তু ওই মহাগুরুত্বপূর্ণ খবরটা জাতিকে না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন মোবাইল ফোনে তা জানালেন শুধু খালেদা জিয়াকে। খালেদা জিয়া তখন নয়াপল্টনের সভামঞ্চে। টিভি ক্যামেরায় আমরাও দেখলাম, তিনি কলটি রিসিভ করে ওই সভায় বক্তৃতা না দিয়েই তড়িঘড়ি মঞ্চ থেকে নেমে গাড়িবহর নিয়ে সোজা চলে গেলেন বঙ্গভবনে। তাঁদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেকই সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধান অনুসারে বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীকে প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার অনুরোধ না জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে গেলেন। তাঁর কট্টর বিএনপি-প্রেমের প্রমাণ পেয়ে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করায় নতুন চার উপদেষ্টা নিয়োগ করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করতে এগিয়ে গেলেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার নির্দেশমতো সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে মেজর জেনারেল রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে নিয়োগের বন্দোবস্ত করেছিলেন ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। কিন্তু ওই খবর আগেভাগে ফাঁস হওয়ায় জেনারেল মইন ইউ আহমেদ তাঁর কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এভাবেই এক-এগারোয় বাংলাদেশ আবারও ছদ্মবেশী সেনাশাসনের কবলে পড়েছিল। এদ্দিনে বুঝতে বাকি নেই, সেনা এস্টাবলিশমেন্টের ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ এবং দীর্ঘদিন শাসন করার খায়েশ ব্যর্থ হওয়ায় তারা ২০০৮ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল।
২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করল অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক, কিন্তু প্রয়োজন মনে করলে আরও দুটো নির্বাচন ওই ব্যবস্থায় হতে পারে। সুযোগ বুঝে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই বাতিল করে দিলেন শেখ হাসিনা। আর তখন থেকেই দেশের বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালকে আন্দোলন-সংগ্রামের মূল দাবিতে পরিণত করলেও তাদের আন্দোলন-সংগ্রাম এবং বিদেশিদের বিরোধিতাকে তোয়াক্কা না করে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ আরেকটি একতরফা নির্বাচন করে ফেলল। বোঝা প্রয়োজন, গণ-অভ্যুত্থানে বাধ্য না হলে কোনো ক্ষমতাসীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করবে না। জেনেশুনে পরবর্তী নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় কি কোনো সরকার চাইতে পারে? অথচ ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন কখনোই ‘নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা’ পাবে না এ দেশে। এ ধরনের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে পারছে বারবার, কিন্তু জনগণের কাছে সরকার পরিবর্তনের কোনো বৈধ সুযোগ বা সাংবিধানিক অধিকার থাকছে না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে