ঘাদা আদিল
প্রিয় প্রেসিডেন্ট বাইডেন,
এ নিয়ে দ্বিতীয়বার আপনাকে লিখছি। ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর শুধু একটি হামলায় আমার নিজের পরিবারের ৩৬ জনসহ আমাদের কমিউনিটির ৪৭ জন সদস্য নিহত হওয়ার পরে গত ৪ নভেম্বর আমি আপনাকে প্রথম লিখেছিলাম। গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে খান ইউনিস শরণার্থীশিবিরে এই গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে কিনা আপনার মিত্র ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী মানুষের নিরাপদ থাকার কথা।
আমার প্রথম চিঠি আপনার কাছে পৌঁছেছে কি না, এটা আমি নিশ্চিত না। অথবা আপনার মিডিয়া টিম এই চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে আপনাকে অবগত করেছে কি না, তা-ও জানি না। যা-ই হোক না কেন, আপনি আপনার অবস্থান বদলাননি। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সাহায্যসহ ইসরায়েলের প্রতি আপনার দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের মানে এটাই বোঝায় যে, তখন থেকে আপনার সহযোগিতায় আরও অনেক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।
সেই চিঠি লেখার পর আমি আমার নিজের পরিবারের আরও ২২০ জন সদস্যকে হারিয়েছি।
মাত্র এক মাস আগে, ৩১ জানুয়ারি, আমার বাবার চাচাতো ভাই, খালেদ আম্মার (৪০) একটি ইসরায়েলি ট্যাংকের গোলায় তিনিসহ তাঁর পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হামলায় তাঁর স্ত্রী মাজদোলিন (৩৮), তাঁদের চার মেয়ে মালাক (১৭), সারাহ (১৬), আয়া (৯), রাফিফ (৭) এবং তাঁদের দুই ছেলে ওসামা (১৪) এবং আনাস (২) সবাই খুন হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে খালেদের প্রতিবন্ধী ভাই মোহাম্মদ (৪২) এবং তাঁদের মা ফাতিয়াও (৬০) ছিলেন। তাঁদের লাশ এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দাফন করা সম্ভব হয়নি। খালেদের জীবিত ভাই বিলাল (৩৫) ফিলিস্তিনি রেড ক্রস সোসাইটির কাছে সাহায্যের জন্য বারবার ফোন করেছিলেন। কিন্তু বেঁচে থাকাদের জন্য কোনো উদ্ধারকারী দল তারা পাঠাতে পারেনি। কারণ ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী তাদের সে অনুমতি দেয়নি।
গত গ্রীষ্মে যখন আমি গাজায় গিয়েছিলাম, তখন মাজদোলিন, তাঁর দুই মেয়ে রাফিফ ও আয়া আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমার এখনো মনে আছে, রাফিফ আমার ছোট ভাইঝি রাশার সাইকেলটা চালানোর চেষ্টা করেছিল। আমার মনে আছে, তারা রাস্তায় দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। আমার চাচাতো ভাই আসাদের দোকান থেকে ক্যান্ডি কিনে খাচ্ছিল তারা। আহা! তাদের সেই হাসি এখনো আমার কানে বাজে।
কিন্তু মি. প্রেসিডেন্ট, আজ সেখানে কোনো আয়া নেই, রাফিফ নেই, আসাদ নেই, যিনি কিনা তাঁর স্ত্রী, সন্তান, মা, দুই বোন, শ্যালিকা ও তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন। সেখানে রাস্তা নেই, বাড়ি নেই, দোকান নেই, হাসি নেই। শুধু ধ্বংসের প্রতিধ্বনি এবং ক্ষতির বধির নীরবতা।
আমি যে খান ইউনিস শরণার্থীশিবিরে বড় হয়েছি তা আজ ধ্বংসস্তূপ। আমার বৃহত্তর পরিবারের সব জীবিত সদস্যসহ হাজার হাজার শরণার্থী এখন আল মাওয়াসি ও রাফাহতে যেতে বাধ্য হয়েছে। তারা তাঁবুতে বসবাস করছে। তারা ভালো নেই মিস্টার প্রেসিডেন্ট।
ইসরায়েল যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ায় আমি তাদের কোনো খবর পাচ্ছি না। গত ১০ ফেব্রুয়ারি, আমার ভাগনে আজিজ (২৩) ইন্টারনেট ব্যবহার করতে রাফাহ প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য বিপজ্জনক জানা সত্ত্বেও তিন কিলোমিটার পথ হেঁটেছিল। সে আমাকে বলেছে, মৃত্যু অনেকবার তাদের পাশ দিয়ে গেছে, তবে আপাতত রেহাই দিয়েছে। তারা ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত এবং ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছে।
ইসরায়েলকে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে—আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এমন রায় সত্ত্বেও তাদের কাছে কোনো বিদ্যুৎ নেই, কোনো স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই, কোনো ওষুধ নেই, যোগাযোগের কোনো উপায় নেই বা কোনো পরিষেবা নেই। অনেকে ইসরায়েলি বোমা থেকে বেঁচে গেলেও সংক্রামক-অসংক্রামক রোগের হাত থেকে বাঁচতে পারছে না। ইসরায়েলি হামলায় গাজার স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী গাজা উপত্যকার খান ইউনিসের দ্বিতীয় বৃহত্তম নাসের হাসপাতাল অবরোধ করে। এখানে ৪৫০ জন রোগীর পাশাপাশি ৩০০ জন চিকিৎসাকর্মী ছিলেন। আর ছিল প্রায় ১০ হাজার অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষ। হাসপাতালের ভেতরে বা আশপাশে আশ্রয় নিয়ে সবাই আটকা পড়ে।
সেখানে ইসরায়েলি বাহিনী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একটি উদ্ধারকারী দলকে রোগী ও কর্মীদের সরিয়ে নিতে বা প্রয়োজনীয় খাবার, চিকিৎসা ও জ্বালানি সরবরাহ করতে দেয়নি। এই সময়ে চিকিৎসাকর্মীরা তাঁদের রোগীদের জন্য যে সাহস ও নিষ্ঠা দেখিয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ। ইসরায়েলি আক্রমণের মুখে তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছেন ডা. আমিরা আল আসুলি। তিনি হাসপাতালের উঠানে আহতদের একজনকে সাহায্য করার জন্য ইসরায়েলি আগুনের নিচে ছুটে এসেছিলেন। হাসপাতাল চত্বরে আশ্রয় প্রার্থনাকারী অসংখ্য মানুষ নিহত বা আহত হয়েছে। সেসব হত্যার চিত্র ক্যামেরায় রেকর্ড করা হয়েছে।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েলি বাহিনী জামাল আবু আল ওলা নামে এক যুবককে আটকে রেখে নির্যাতন করে। কারণ কেন তিনি আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনিদের হাসপাতাল থেকে চলে যেতে বলছেন না। একটি সাদা পিপিই পোশাক পরে তিনি এই নির্দেশের কথা বলতে বলতে হাসপাতালের গেটের দিকে এগিয়ে যান। এরপরই তাঁকে গুলি করে খুন করা হয়। এ দৃশ্য হাসপাতালের একজন সাংবাদিক ক্যামেরাবন্দী করে পরে তা প্রকাশ করেন।
আপনি কি এসব ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেবেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট? আপনি কি নাসের হাসপাতালে জামাল ও অন্য অনেককে হত্যার জন্য দায়ীদের শাস্তির দাবি করবেন, নাকি ইসরায়েলি বাহিনীর এমন হত্যাকাণ্ড ফের মেনে নেবেন?
১৫ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী নাসের হাসপাতালে অভিযান চালায়। ভারী বোমাবর্ষণ করে। হাজার হাজার মানুষ তাড়িয়ে দেয়। গুম করে শত শত মানুষকে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৭০ জন চিকিৎসাকর্মী। ইসরায়েলি বাহিনী আল শিফা হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন কর্মীকে আটক করে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আবু সালমিয়া। তিনি বর্তমানে ইসরায়েলি কারাগারে রয়েছেন। এ ধরনের অভিযানের অজুহাত হিসেবে ইসরায়েল সব সময় বলেছে তারা হামাস কমান্ড সেন্টারের সন্ধান করছিল—এটা ডাহা মিথ্যা কথা মিস্টার প্রেসিডেন্ট, যা আপনি সহজেই মেনে নিয়েছেন।
নাসের হাসপাতালে অভিযানের সময় বিদ্যুৎসংযোগ কেটে দেওয়ায় এবং অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করায় অন্তত আট রোগীর মৃত্যু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি দলকে যখন অবশেষে হাসপাতালে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়, তখন এর কর্মীরা একে ‘মৃত্যুপুরী’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কয়েক শ রোগীকে সরিয়ে নেওয়ার পরে, প্রায় ২৫ জন চিকিৎসাকর্মী হাসপাতালে অবশিষ্ট ১২০ রোগীর সেবার জন্য থেকে যান। যদিও সেখানে খাবার, পানি বা ওষুধ ছিল না।
নাসের হাসপাতালের নিয়মিত রোগীদের মধ্যে আমার আত্মীয় ইনশিরাহ ছিলেন, যিনি কিডনির রোগে ভুগছিলেন এবং প্রতি সপ্তাহে ডায়ালাইসিস করতেন। তিনি খান ইউনিসের পূর্বে আল কারারাহ এলাকায় থাকতেন। যখন ইসরায়েলি বাহিনী তাঁর এলাকায় বোমা হামলা চালায়, তখন তিনি বাস্তুচ্যুত মানুষের একটি ক্যাম্পে চলে যান। ইসরায়েলি বাহিনী ক্যাম্প আক্রমণ করলে, তিনি হায় আল আমালে চলে যান। যখন সেখানে বোমা হামলা হয়, তখন তাঁর সন্তানেরা তাঁকে নাসের হাসপাতালের আশপাশে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
হাসপাতালের অবস্থার অবনতি হওয়ায়, তাঁর ডায়ালাইসিস করার বিষয়টি প্রতি দুই সপ্তাহে একবারে নেমে আসে এবং তারপর প্রতি তিন সপ্তাহে একবার করা হতো, যার ফলে তাঁকে ব্যাপক ভুগতে হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতাল ঘেরাও করলে ইনশিরাহ হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য হন। তারপর আমরা তাঁর ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলি। তিনি বেঁচে আছেন কি না, আমরা জানি না।
গাজার স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থাকে ইসরায়েল ধ্বংস করার পর ইনশিরাহর মতো অসুস্থ ব্যক্তিদের বেশির ভাগই যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। এটা তাঁদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের শামিল। স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা ধ্বংস করা একটি যুদ্ধাপরাধ, আপনি কি তা জানেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট?
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, গাজার ২৩ লাখ মানুষ বন্দিশিবিরে বসবাস করছে। তারা ক্ষুধার জ্বালায় পুড়ছে। কারও সে জ্বালা নিভছে নির্বিচারে খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে। তাদের বাড়িতে, রাস্তায়, পানি সংগ্রহের সময়, তাঁবুতে ঘুমানোর সময়, ত্রাণ নেওয়ার সময়, এমনকি রান্নার সময়ও বোমা মেরে হত্যা করা হয়। গাজার লোকেরা আমাকে বলেছে, পানির বিনিময় মূল্য আসলে রক্ত, একটি রুটিও রক্তে ডুবে থাকে। আর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া মানেই রক্তপাত।
এমনকি সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য খাবার খোঁজার সময়ও তাদের হত্যা করা হতে পারে—যেমনটি অনেক মা-বাবার সঙ্গে ঘটেছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। প্রায় ১১২ ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী হত্যা করেছে, যখন তারা নিজের ও তাদের পরিবারের জন্য আটা পাওয়ার অপেক্ষা করছিল।
তাদের মৃত্যু বেদনাদায়কভাবে বাস্তব। আনাস ও আয়ার মতো শিশু, মাজদোলিনের মতো মা এবং ফাতিয়ার মতো বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ইতিমধ্যে ৩০ হাজারের বেশি মারা গেছে। আরও হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে, কিন্তু তাদের ‘নিখোঁজ’ হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার শিশু। অনেকেই এখন অনাহারে মারা যাচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় ছয়টি শিশুকে হত্যা করছে ইসরায়েল। এই শিশুদের প্রত্যেকের একটি নাম, একটি গল্প এবং একটি স্বপ্ন ছিল, যা কখনো আর পূরণ হওয়ার নয়। গাজার এই শিশুদের কি একটি সুন্দর জীবন প্রাপ্য না মিস্টার প্রেসিডেন্ট?
ফিলিস্তিনিরা গোটা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত জাতির একটি। তারা খুব কৌতূহলী। আজ তাদের সবচেয়ে জ্বলন্ত প্রশ্ন হলো, কেন ফিলিস্তিনি জনগণকে আপনার মিত্রের হাতে মরতে হবে? আপনার দেওয়া অস্ত্র দিয়ে এসব হামলা চালানো হয়েছে। আপনি যুদ্ধবিরতির ডাক দিতে অস্বীকার করেছেন। এটা কেন, বলবেন কি মিস্টার প্রেসিডেন্ট?
লেখক: ফিলিস্তিনি শরণার্থী ও অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা, কানাডা
(আল-জাজিরায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
প্রিয় প্রেসিডেন্ট বাইডেন,
এ নিয়ে দ্বিতীয়বার আপনাকে লিখছি। ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর শুধু একটি হামলায় আমার নিজের পরিবারের ৩৬ জনসহ আমাদের কমিউনিটির ৪৭ জন সদস্য নিহত হওয়ার পরে গত ৪ নভেম্বর আমি আপনাকে প্রথম লিখেছিলাম। গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে খান ইউনিস শরণার্থীশিবিরে এই গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে কিনা আপনার মিত্র ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী মানুষের নিরাপদ থাকার কথা।
আমার প্রথম চিঠি আপনার কাছে পৌঁছেছে কি না, এটা আমি নিশ্চিত না। অথবা আপনার মিডিয়া টিম এই চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে আপনাকে অবগত করেছে কি না, তা-ও জানি না। যা-ই হোক না কেন, আপনি আপনার অবস্থান বদলাননি। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সাহায্যসহ ইসরায়েলের প্রতি আপনার দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের মানে এটাই বোঝায় যে, তখন থেকে আপনার সহযোগিতায় আরও অনেক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।
সেই চিঠি লেখার পর আমি আমার নিজের পরিবারের আরও ২২০ জন সদস্যকে হারিয়েছি।
মাত্র এক মাস আগে, ৩১ জানুয়ারি, আমার বাবার চাচাতো ভাই, খালেদ আম্মার (৪০) একটি ইসরায়েলি ট্যাংকের গোলায় তিনিসহ তাঁর পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। হামলায় তাঁর স্ত্রী মাজদোলিন (৩৮), তাঁদের চার মেয়ে মালাক (১৭), সারাহ (১৬), আয়া (৯), রাফিফ (৭) এবং তাঁদের দুই ছেলে ওসামা (১৪) এবং আনাস (২) সবাই খুন হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে খালেদের প্রতিবন্ধী ভাই মোহাম্মদ (৪২) এবং তাঁদের মা ফাতিয়াও (৬০) ছিলেন। তাঁদের লাশ এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দাফন করা সম্ভব হয়নি। খালেদের জীবিত ভাই বিলাল (৩৫) ফিলিস্তিনি রেড ক্রস সোসাইটির কাছে সাহায্যের জন্য বারবার ফোন করেছিলেন। কিন্তু বেঁচে থাকাদের জন্য কোনো উদ্ধারকারী দল তারা পাঠাতে পারেনি। কারণ ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী তাদের সে অনুমতি দেয়নি।
গত গ্রীষ্মে যখন আমি গাজায় গিয়েছিলাম, তখন মাজদোলিন, তাঁর দুই মেয়ে রাফিফ ও আয়া আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমার এখনো মনে আছে, রাফিফ আমার ছোট ভাইঝি রাশার সাইকেলটা চালানোর চেষ্টা করেছিল। আমার মনে আছে, তারা রাস্তায় দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। আমার চাচাতো ভাই আসাদের দোকান থেকে ক্যান্ডি কিনে খাচ্ছিল তারা। আহা! তাদের সেই হাসি এখনো আমার কানে বাজে।
কিন্তু মি. প্রেসিডেন্ট, আজ সেখানে কোনো আয়া নেই, রাফিফ নেই, আসাদ নেই, যিনি কিনা তাঁর স্ত্রী, সন্তান, মা, দুই বোন, শ্যালিকা ও তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন। সেখানে রাস্তা নেই, বাড়ি নেই, দোকান নেই, হাসি নেই। শুধু ধ্বংসের প্রতিধ্বনি এবং ক্ষতির বধির নীরবতা।
আমি যে খান ইউনিস শরণার্থীশিবিরে বড় হয়েছি তা আজ ধ্বংসস্তূপ। আমার বৃহত্তর পরিবারের সব জীবিত সদস্যসহ হাজার হাজার শরণার্থী এখন আল মাওয়াসি ও রাফাহতে যেতে বাধ্য হয়েছে। তারা তাঁবুতে বসবাস করছে। তারা ভালো নেই মিস্টার প্রেসিডেন্ট।
ইসরায়েল যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ায় আমি তাদের কোনো খবর পাচ্ছি না। গত ১০ ফেব্রুয়ারি, আমার ভাগনে আজিজ (২৩) ইন্টারনেট ব্যবহার করতে রাফাহ প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য বিপজ্জনক জানা সত্ত্বেও তিন কিলোমিটার পথ হেঁটেছিল। সে আমাকে বলেছে, মৃত্যু অনেকবার তাদের পাশ দিয়ে গেছে, তবে আপাতত রেহাই দিয়েছে। তারা ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত এবং ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছে।
ইসরায়েলকে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে—আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের এমন রায় সত্ত্বেও তাদের কাছে কোনো বিদ্যুৎ নেই, কোনো স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নেই, কোনো ওষুধ নেই, যোগাযোগের কোনো উপায় নেই বা কোনো পরিষেবা নেই। অনেকে ইসরায়েলি বোমা থেকে বেঁচে গেলেও সংক্রামক-অসংক্রামক রোগের হাত থেকে বাঁচতে পারছে না। ইসরায়েলি হামলায় গাজার স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী গাজা উপত্যকার খান ইউনিসের দ্বিতীয় বৃহত্তম নাসের হাসপাতাল অবরোধ করে। এখানে ৪৫০ জন রোগীর পাশাপাশি ৩০০ জন চিকিৎসাকর্মী ছিলেন। আর ছিল প্রায় ১০ হাজার অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষ। হাসপাতালের ভেতরে বা আশপাশে আশ্রয় নিয়ে সবাই আটকা পড়ে।
সেখানে ইসরায়েলি বাহিনী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একটি উদ্ধারকারী দলকে রোগী ও কর্মীদের সরিয়ে নিতে বা প্রয়োজনীয় খাবার, চিকিৎসা ও জ্বালানি সরবরাহ করতে দেয়নি। এই সময়ে চিকিৎসাকর্মীরা তাঁদের রোগীদের জন্য যে সাহস ও নিষ্ঠা দেখিয়েছেন তা এক কথায় অসাধারণ। ইসরায়েলি আক্রমণের মুখে তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছেন ডা. আমিরা আল আসুলি। তিনি হাসপাতালের উঠানে আহতদের একজনকে সাহায্য করার জন্য ইসরায়েলি আগুনের নিচে ছুটে এসেছিলেন। হাসপাতাল চত্বরে আশ্রয় প্রার্থনাকারী অসংখ্য মানুষ নিহত বা আহত হয়েছে। সেসব হত্যার চিত্র ক্যামেরায় রেকর্ড করা হয়েছে।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েলি বাহিনী জামাল আবু আল ওলা নামে এক যুবককে আটকে রেখে নির্যাতন করে। কারণ কেন তিনি আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনিদের হাসপাতাল থেকে চলে যেতে বলছেন না। একটি সাদা পিপিই পোশাক পরে তিনি এই নির্দেশের কথা বলতে বলতে হাসপাতালের গেটের দিকে এগিয়ে যান। এরপরই তাঁকে গুলি করে খুন করা হয়। এ দৃশ্য হাসপাতালের একজন সাংবাদিক ক্যামেরাবন্দী করে পরে তা প্রকাশ করেন।
আপনি কি এসব ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেবেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট? আপনি কি নাসের হাসপাতালে জামাল ও অন্য অনেককে হত্যার জন্য দায়ীদের শাস্তির দাবি করবেন, নাকি ইসরায়েলি বাহিনীর এমন হত্যাকাণ্ড ফের মেনে নেবেন?
১৫ ফেব্রুয়ারি ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী নাসের হাসপাতালে অভিযান চালায়। ভারী বোমাবর্ষণ করে। হাজার হাজার মানুষ তাড়িয়ে দেয়। গুম করে শত শত মানুষকে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৭০ জন চিকিৎসাকর্মী। ইসরায়েলি বাহিনী আল শিফা হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন কর্মীকে আটক করে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আবু সালমিয়া। তিনি বর্তমানে ইসরায়েলি কারাগারে রয়েছেন। এ ধরনের অভিযানের অজুহাত হিসেবে ইসরায়েল সব সময় বলেছে তারা হামাস কমান্ড সেন্টারের সন্ধান করছিল—এটা ডাহা মিথ্যা কথা মিস্টার প্রেসিডেন্ট, যা আপনি সহজেই মেনে নিয়েছেন।
নাসের হাসপাতালে অভিযানের সময় বিদ্যুৎসংযোগ কেটে দেওয়ায় এবং অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করায় অন্তত আট রোগীর মৃত্যু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি দলকে যখন অবশেষে হাসপাতালে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়, তখন এর কর্মীরা একে ‘মৃত্যুপুরী’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কয়েক শ রোগীকে সরিয়ে নেওয়ার পরে, প্রায় ২৫ জন চিকিৎসাকর্মী হাসপাতালে অবশিষ্ট ১২০ রোগীর সেবার জন্য থেকে যান। যদিও সেখানে খাবার, পানি বা ওষুধ ছিল না।
নাসের হাসপাতালের নিয়মিত রোগীদের মধ্যে আমার আত্মীয় ইনশিরাহ ছিলেন, যিনি কিডনির রোগে ভুগছিলেন এবং প্রতি সপ্তাহে ডায়ালাইসিস করতেন। তিনি খান ইউনিসের পূর্বে আল কারারাহ এলাকায় থাকতেন। যখন ইসরায়েলি বাহিনী তাঁর এলাকায় বোমা হামলা চালায়, তখন তিনি বাস্তুচ্যুত মানুষের একটি ক্যাম্পে চলে যান। ইসরায়েলি বাহিনী ক্যাম্প আক্রমণ করলে, তিনি হায় আল আমালে চলে যান। যখন সেখানে বোমা হামলা হয়, তখন তাঁর সন্তানেরা তাঁকে নাসের হাসপাতালের আশপাশে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
হাসপাতালের অবস্থার অবনতি হওয়ায়, তাঁর ডায়ালাইসিস করার বিষয়টি প্রতি দুই সপ্তাহে একবারে নেমে আসে এবং তারপর প্রতি তিন সপ্তাহে একবার করা হতো, যার ফলে তাঁকে ব্যাপক ভুগতে হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতাল ঘেরাও করলে ইনশিরাহ হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য হন। তারপর আমরা তাঁর ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলি। তিনি বেঁচে আছেন কি না, আমরা জানি না।
গাজার স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থাকে ইসরায়েল ধ্বংস করার পর ইনশিরাহর মতো অসুস্থ ব্যক্তিদের বেশির ভাগই যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না। এটা তাঁদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের শামিল। স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা ধ্বংস করা একটি যুদ্ধাপরাধ, আপনি কি তা জানেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট?
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, গাজার ২৩ লাখ মানুষ বন্দিশিবিরে বসবাস করছে। তারা ক্ষুধার জ্বালায় পুড়ছে। কারও সে জ্বালা নিভছে নির্বিচারে খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে। তাদের বাড়িতে, রাস্তায়, পানি সংগ্রহের সময়, তাঁবুতে ঘুমানোর সময়, ত্রাণ নেওয়ার সময়, এমনকি রান্নার সময়ও বোমা মেরে হত্যা করা হয়। গাজার লোকেরা আমাকে বলেছে, পানির বিনিময় মূল্য আসলে রক্ত, একটি রুটিও রক্তে ডুবে থাকে। আর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া মানেই রক্তপাত।
এমনকি সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য খাবার খোঁজার সময়ও তাদের হত্যা করা হতে পারে—যেমনটি অনেক মা-বাবার সঙ্গে ঘটেছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। প্রায় ১১২ ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী হত্যা করেছে, যখন তারা নিজের ও তাদের পরিবারের জন্য আটা পাওয়ার অপেক্ষা করছিল।
তাদের মৃত্যু বেদনাদায়কভাবে বাস্তব। আনাস ও আয়ার মতো শিশু, মাজদোলিনের মতো মা এবং ফাতিয়ার মতো বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ইতিমধ্যে ৩০ হাজারের বেশি মারা গেছে। আরও হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে, কিন্তু তাদের ‘নিখোঁজ’ হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার শিশু। অনেকেই এখন অনাহারে মারা যাচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় ছয়টি শিশুকে হত্যা করছে ইসরায়েল। এই শিশুদের প্রত্যেকের একটি নাম, একটি গল্প এবং একটি স্বপ্ন ছিল, যা কখনো আর পূরণ হওয়ার নয়। গাজার এই শিশুদের কি একটি সুন্দর জীবন প্রাপ্য না মিস্টার প্রেসিডেন্ট?
ফিলিস্তিনিরা গোটা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত জাতির একটি। তারা খুব কৌতূহলী। আজ তাদের সবচেয়ে জ্বলন্ত প্রশ্ন হলো, কেন ফিলিস্তিনি জনগণকে আপনার মিত্রের হাতে মরতে হবে? আপনার দেওয়া অস্ত্র দিয়ে এসব হামলা চালানো হয়েছে। আপনি যুদ্ধবিরতির ডাক দিতে অস্বীকার করেছেন। এটা কেন, বলবেন কি মিস্টার প্রেসিডেন্ট?
লেখক: ফিলিস্তিনি শরণার্থী ও অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা, কানাডা
(আল-জাজিরায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১৩ ঘণ্টা আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১৬ ঘণ্টা আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে