মহিউদ্দিন খান মোহন
একসময়ের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ধারাবাহিক রচনা ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ পড়েই ফয়েজ আহমদের ভক্ত হয়ে যাই। তাঁর সাংবাদিক ও রাজনৈতিক জীবনের চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর ঘটনার বিবরণ পাঠ করতে করতে ভাবতাম, একজন মানুষ কতটা সাহসী, মেধাবী ও কুশলী হলে এমন সব ঘটনার মোকাবিলা করতে পারেন! এরও আগে পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা-ছড়া পড়েছি। যখন জানলাম, তাঁর বাড়ি আমাদের পাশের গ্রাম বাসাইলভোগে, তখন একটা অহংবোধ মনে বাসা বাঁধল। ভাবতাম, তাঁর সঙ্গে যদি দেখা করতে পারতাম, কথা বলার সুযোগ পেতাম!
সেই সুযোগও এসে গেল একদিন, ১৯৮৩ সালের শেষ নাগাদ। ফয়েজ আহমদের ছোট ভাই রফিক চৌধুরী তখন দৈনিক সংবাদের শ্রীনগর (বিক্রমপুর) প্রতিনিধি। আমি তখন বর্তমানে লুপ্ত দৈনিক দেশ-এর শ্রীনগর প্রতিনিধি। সে সময় পত্রিকার সংখ্যা যেমন কম ছিল, মফস্বলে সাংবাদিকের সংখ্যাও কম ছিল। রফিক ভাই উদ্যোগ নিলেন শ্রীনগর-লৌহজংয়ের মফস্বল সাংবাদিকদের সমন্বয়ে বিক্রমপুর প্রেসক্লাব গঠনের। রফিক চৌধুরী তখন বড় ভাই ফয়েজ আহমদের তোপখানা রোডের বাসায় সপরিবারে থাকেন। সেখানেই আমরা প্রস্তুতি সভাগুলো করতাম। একদিন ফয়েজ আহমদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেল।
আমরা কারা এবং কেন এসেছি জানতে চাইলে রফিক ভাই তা বলার পর তিনি একে একে আমাদের পরিচয় জানলেন। তাঁর ওই বাসায় বসেই রফিক চৌধুরীকে সভাপতি, বাংলার বাণীর অলক কুমার মিত্রকে সাধারণ সম্পাদক ও আমাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করে বিক্রমপুর প্রেসক্লাবের প্রথম কমিটি গঠিত হয়। ক্লাবটি আজও টিকে আছে। লৌহজং উপজেলার হলদিয়ায় ক্লাবের দ্বিতল ভবন।
উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও ছেলেবেলা থেকেই গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের পক্ষে কথা বলতেন তিনি। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ফয়েজ আহমদ হাইস্কুলের ছাত্রাবস্থায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের বিমানবাহিনীতে। তবে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁর আকাশে ওড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তায় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মেধাবী ফয়েজ আহমদকে লোভনীয় চাকরি বাদ দিয়ে সাংবাদিকতায় যোগ দিতে উৎসাহিত করে। আর সাংবাদিকতায় এসে তিনি তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন পদে পদে।
ফয়েজ আহমদ দীক্ষা নিয়েছিলেন বামপন্থী রাজনীতিতে। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে কারাবাসীও হতে হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করার পর তিনি কারারুদ্ধ হন এবং একটানা চার বছর বন্দী থাকেন। বামপন্থী রাজনীতি করলেও দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি তাঁর কমিটমেন্টের কমতি ছিল না।
তিনি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভাবশিষ্য। একই সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন ছিলেন। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ফয়েজ আহমদকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক করেছিলেন।
চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত ফয়েজ আহমদ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সব সময় অগ্রভাগে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা শুরু হওয়ার সময় তিনি ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের দোতলায়। হানাদার বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলায় পায়ে আঘাত পেয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর ফয়েজ আহমদ পরদিন সকালে দেয়াল টপকে আশ্রয় নেন সচিবালয়ে। সেখানে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় কিছুটা সুস্থ হয়ে পরদিন (২৭ মার্চ) কারফিউ শিথিল হলে বেরিয়ে চলে যান বিক্রমপুরে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে। সেখানে কয়েক দিন থেকে চলে যান ভারতের আগরতলায়।
ফয়েজ আহমদ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, দেশে থেকেই তাঁর যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও পরিস্থিতির কারণে ভারতে যেতে বাধ্য হন।কিন্তু সেখানে গিয়ে ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের (বামপন্থী) কারণে মুখোমুখি হন বিরূপ পরিস্থিতির। আগরতলা থেকে তিনি চলে যান কলকাতায়। সেখানে গিয়ে যোগাযোগ করেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে। কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার কোনো সুযোগই সৃষ্টি করতে পারেন না। ফয়েজ আহমদ তাঁর গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের আচরণে তিনি বুঝতে পারছিলেন, ওই দলের লোক ছাড়া কাউকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ দিতে তাঁরা ইচ্ছুক নন।
এ-সম্পর্কে তিনি তাঁর মধ্যরাতের অশ্বারোহী গ্রন্থের ‘শেষতক পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’ অংশে লিখেছেন, কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া যায়, তার উপায় উদ্ভাবনের জন্য শিয়ালদহের টাওয়ার হোটেলে এক সভায় মিলিত হন। সভায় সর্বসম্মতভাবে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বরাবর একটি স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ফয়েজ আহমদ লিখেছেন, ‘কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ এই স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীকে দেন। মনে হয়েছিল, তাজউদ্দীন সাহেবের এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু অভ্যন্তরীণ দ্বিমতের কথা বিবেচনা করে তিনি প্রতিনিধিদের নানা কথার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এভাবে কোনো নির্দেশ দিতে তিনি সক্ষম নন। তিনি কী বললেন তা বুঝতে প্রতিনিধিদের অসুবিধা হয়নি।’ (পৃষ্ঠা: ৫৯২)
অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ বঞ্চিত হয়ে ভিন্ন পথে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে ফয়েজ আহমদ চলে যান জলপাইগুড়িতে।সেখানে তিনি আশ্রয় নেন তৎকালীন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. মন্মথ নাথ নন্দীর (এম এন নন্দী) বাড়িতে। কয়েক দিন পরে সেখানে বসেই একটি টেলিগ্রাম পান দ্রুত কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের জন্য। কলকাতায় এসে তিনি জানতে পারেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে লেখকের অভাব পূরণের জন্য তাঁকে ডাকা হয়েছে। এ কথা জানার পর ফয়েজ আহমদ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার ইচ্ছার কথা জানান। তাঁর কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জয়ী করার জন্য যে যে পথে এগিয়ে যাবে, তাকেই আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলি।
আপনার অবদান অস্ত্রধারী সৈনিকের সমান। বেতারকেন্দ্রকে যারা তীব্র ও কঠোর কণ্ঠে সজীব করে রাখবে, সৈনিকদের চাইতে তার মূল্য কম কি? আপনি এই বেতারে বিশেষ ধরনের লেখায় অংশ নিন।’ (প্রাগুক্ত) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের অনুরোধে ফয়েজ আহমদ যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সেখানে তিনি ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’ কথিকা রচনা ও স্বকণ্ঠে তা প্রচার শুরু করেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হওয়া পর্যন্ত এই কথিকা প্রতিদিন প্রচারিত হয়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্র এবং সীমান্তসংলগ্ন মুক্তাঞ্চল সফর করে সরেজমিন রিপোর্টেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের চিত্র তুলে ধরতেন। তাঁর রচনায় যেমন স্থান পেত মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা, তেমনি থাকত মুক্তিকামী মানুষকে যুদ্ধে উদ্দীপ্ত করার প্রয়াস।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ফয়েজ আহমদ রেখে গেছেন এক বলিষ্ঠ ভূমিকা; বিশেষ করে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের তিনি উদ্দীপ্ত করেছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তিনি স্বৈরশাসকের রোষানলে পড়েন এবং কারারুদ্ধ হন। আন্দোলনের সফল পরিণতির জন্য দুই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার বৈঠক ছিল সব মানুষের একান্ত চাওয়া। কিন্তু রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে সেই কাঙ্ক্ষিত বৈঠকটি হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ফয়েজ আহমদের ঐকান্তিক চেষ্টায় ১৯৯০-এ সেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দুই নেত্রীর ওই বৈঠকের পর আন্দোলন নতুন গতি লাভ করে এবং এরশাদের পতন নিশ্চিত হয়।
পেশাগত দিক দিয়ে ফয়েজ আহমদ সাংবাদিক হলেও সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি সমধিক পরিচিত। তাঁকে শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। ২০ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। বহুমাত্রিক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই বিরল ব্যক্তিত্ব তাঁর কর্মের জন্য অমর হয়ে থাকবেন।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
একসময়ের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ধারাবাহিক রচনা ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ পড়েই ফয়েজ আহমদের ভক্ত হয়ে যাই। তাঁর সাংবাদিক ও রাজনৈতিক জীবনের চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর ঘটনার বিবরণ পাঠ করতে করতে ভাবতাম, একজন মানুষ কতটা সাহসী, মেধাবী ও কুশলী হলে এমন সব ঘটনার মোকাবিলা করতে পারেন! এরও আগে পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা-ছড়া পড়েছি। যখন জানলাম, তাঁর বাড়ি আমাদের পাশের গ্রাম বাসাইলভোগে, তখন একটা অহংবোধ মনে বাসা বাঁধল। ভাবতাম, তাঁর সঙ্গে যদি দেখা করতে পারতাম, কথা বলার সুযোগ পেতাম!
সেই সুযোগও এসে গেল একদিন, ১৯৮৩ সালের শেষ নাগাদ। ফয়েজ আহমদের ছোট ভাই রফিক চৌধুরী তখন দৈনিক সংবাদের শ্রীনগর (বিক্রমপুর) প্রতিনিধি। আমি তখন বর্তমানে লুপ্ত দৈনিক দেশ-এর শ্রীনগর প্রতিনিধি। সে সময় পত্রিকার সংখ্যা যেমন কম ছিল, মফস্বলে সাংবাদিকের সংখ্যাও কম ছিল। রফিক ভাই উদ্যোগ নিলেন শ্রীনগর-লৌহজংয়ের মফস্বল সাংবাদিকদের সমন্বয়ে বিক্রমপুর প্রেসক্লাব গঠনের। রফিক চৌধুরী তখন বড় ভাই ফয়েজ আহমদের তোপখানা রোডের বাসায় সপরিবারে থাকেন। সেখানেই আমরা প্রস্তুতি সভাগুলো করতাম। একদিন ফয়েজ আহমদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেল।
আমরা কারা এবং কেন এসেছি জানতে চাইলে রফিক ভাই তা বলার পর তিনি একে একে আমাদের পরিচয় জানলেন। তাঁর ওই বাসায় বসেই রফিক চৌধুরীকে সভাপতি, বাংলার বাণীর অলক কুমার মিত্রকে সাধারণ সম্পাদক ও আমাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করে বিক্রমপুর প্রেসক্লাবের প্রথম কমিটি গঠিত হয়। ক্লাবটি আজও টিকে আছে। লৌহজং উপজেলার হলদিয়ায় ক্লাবের দ্বিতল ভবন।
উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও ছেলেবেলা থেকেই গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের পক্ষে কথা বলতেন তিনি। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ফয়েজ আহমদ হাইস্কুলের ছাত্রাবস্থায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের বিমানবাহিনীতে। তবে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁর আকাশে ওড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তায় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মেধাবী ফয়েজ আহমদকে লোভনীয় চাকরি বাদ দিয়ে সাংবাদিকতায় যোগ দিতে উৎসাহিত করে। আর সাংবাদিকতায় এসে তিনি তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন পদে পদে।
ফয়েজ আহমদ দীক্ষা নিয়েছিলেন বামপন্থী রাজনীতিতে। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে কারাবাসীও হতে হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করার পর তিনি কারারুদ্ধ হন এবং একটানা চার বছর বন্দী থাকেন। বামপন্থী রাজনীতি করলেও দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি তাঁর কমিটমেন্টের কমতি ছিল না।
তিনি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভাবশিষ্য। একই সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন ছিলেন। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ফয়েজ আহমদকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক করেছিলেন।
চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত ফয়েজ আহমদ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সব সময় অগ্রভাগে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা শুরু হওয়ার সময় তিনি ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের দোতলায়। হানাদার বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলায় পায়ে আঘাত পেয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর ফয়েজ আহমদ পরদিন সকালে দেয়াল টপকে আশ্রয় নেন সচিবালয়ে। সেখানে বাঙালি পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় কিছুটা সুস্থ হয়ে পরদিন (২৭ মার্চ) কারফিউ শিথিল হলে বেরিয়ে চলে যান বিক্রমপুরে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে। সেখানে কয়েক দিন থেকে চলে যান ভারতের আগরতলায়।
ফয়েজ আহমদ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, দেশে থেকেই তাঁর যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও পরিস্থিতির কারণে ভারতে যেতে বাধ্য হন।কিন্তু সেখানে গিয়ে ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের (বামপন্থী) কারণে মুখোমুখি হন বিরূপ পরিস্থিতির। আগরতলা থেকে তিনি চলে যান কলকাতায়। সেখানে গিয়ে যোগাযোগ করেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে। কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার কোনো সুযোগই সৃষ্টি করতে পারেন না। ফয়েজ আহমদ তাঁর গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের আচরণে তিনি বুঝতে পারছিলেন, ওই দলের লোক ছাড়া কাউকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ দিতে তাঁরা ইচ্ছুক নন।
এ-সম্পর্কে তিনি তাঁর মধ্যরাতের অশ্বারোহী গ্রন্থের ‘শেষতক পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’ অংশে লিখেছেন, কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া যায়, তার উপায় উদ্ভাবনের জন্য শিয়ালদহের টাওয়ার হোটেলে এক সভায় মিলিত হন। সভায় সর্বসম্মতভাবে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বরাবর একটি স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ফয়েজ আহমদ লিখেছেন, ‘কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ এই স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীকে দেন। মনে হয়েছিল, তাজউদ্দীন সাহেবের এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু অভ্যন্তরীণ দ্বিমতের কথা বিবেচনা করে তিনি প্রতিনিধিদের নানা কথার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, এভাবে কোনো নির্দেশ দিতে তিনি সক্ষম নন। তিনি কী বললেন তা বুঝতে প্রতিনিধিদের অসুবিধা হয়নি।’ (পৃষ্ঠা: ৫৯২)
অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ বঞ্চিত হয়ে ভিন্ন পথে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে ফয়েজ আহমদ চলে যান জলপাইগুড়িতে।সেখানে তিনি আশ্রয় নেন তৎকালীন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. মন্মথ নাথ নন্দীর (এম এন নন্দী) বাড়িতে। কয়েক দিন পরে সেখানে বসেই একটি টেলিগ্রাম পান দ্রুত কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের জন্য। কলকাতায় এসে তিনি জানতে পারেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে লেখকের অভাব পূরণের জন্য তাঁকে ডাকা হয়েছে। এ কথা জানার পর ফয়েজ আহমদ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার ইচ্ছার কথা জানান। তাঁর কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জয়ী করার জন্য যে যে পথে এগিয়ে যাবে, তাকেই আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলি।
আপনার অবদান অস্ত্রধারী সৈনিকের সমান। বেতারকেন্দ্রকে যারা তীব্র ও কঠোর কণ্ঠে সজীব করে রাখবে, সৈনিকদের চাইতে তার মূল্য কম কি? আপনি এই বেতারে বিশেষ ধরনের লেখায় অংশ নিন।’ (প্রাগুক্ত) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের অনুরোধে ফয়েজ আহমদ যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সেখানে তিনি ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’ কথিকা রচনা ও স্বকণ্ঠে তা প্রচার শুরু করেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হওয়া পর্যন্ত এই কথিকা প্রতিদিন প্রচারিত হয়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্র এবং সীমান্তসংলগ্ন মুক্তাঞ্চল সফর করে সরেজমিন রিপোর্টেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের চিত্র তুলে ধরতেন। তাঁর রচনায় যেমন স্থান পেত মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা, তেমনি থাকত মুক্তিকামী মানুষকে যুদ্ধে উদ্দীপ্ত করার প্রয়াস।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ফয়েজ আহমদ রেখে গেছেন এক বলিষ্ঠ ভূমিকা; বিশেষ করে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের তিনি উদ্দীপ্ত করেছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তিনি স্বৈরশাসকের রোষানলে পড়েন এবং কারারুদ্ধ হন। আন্দোলনের সফল পরিণতির জন্য দুই নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার বৈঠক ছিল সব মানুষের একান্ত চাওয়া। কিন্তু রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে সেই কাঙ্ক্ষিত বৈঠকটি হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত ফয়েজ আহমদের ঐকান্তিক চেষ্টায় ১৯৯০-এ সেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দুই নেত্রীর ওই বৈঠকের পর আন্দোলন নতুন গতি লাভ করে এবং এরশাদের পতন নিশ্চিত হয়।
পেশাগত দিক দিয়ে ফয়েজ আহমদ সাংবাদিক হলেও সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি সমধিক পরিচিত। তাঁকে শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। ২০ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। বহুমাত্রিক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই বিরল ব্যক্তিত্ব তাঁর কর্মের জন্য অমর হয়ে থাকবেন।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১৮ ঘণ্টা আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২০ ঘণ্টা আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে