সেলিম জাহান
তিনটি কথা প্রথমেই বলে নেই। প্রথমত আমি শিবরাম চক্রবর্তীর পরম ভক্ত। তাঁর শব্দের খেলা আমার ভারি ভালো লাগে। ওই যে, ‘ধার করি আমরা উদ্ধার পাওয়ার জন্য’ কিংবা ‘স্বামী মানেই আসামি’। এবার ভাবলাম আমিও সে রকম একটু চেষ্টা করে দেখি না! বেশ ধস্তাধস্তির পরে বোঝা গেল, ও আমার কম্ম নয়। এখন যেমন ‘লেজেগোবরে’ অবস্থা আমার, তখন আমাকে বাঁচিয়ে দিল আমাদের শামীম—সতীর্থ বন্ধু শামীম আজাদ।
সেটাই আমার দ্বিতীয় কথা, তাঁর একটা লেখার শিরোনাম দেখেছিলাম, ‘নারী মানেই আনাড়ি নয়’। সেটাই চেয়েচিন্তে নিলাম তাঁর কাছ থেকে। অনেকটা ধার করলাম উদ্ধার পাওয়ার জন্য। ‘বাহ্, দোষের কী হলো?’ ‘বন্ধুকে বন্ধু না দেখিলে আর কে দেখিত?’ ওই আবারও শিবরাম, ‘চক্কোত্তিকে চক্কোন্তি না দেখিলে আর কে দেখিবে?’
আর তৃতীয়ত, হাসি-ঠাট্টা ছেড়ে দিয়ে গুরুগম্ভীরতার সঙ্গে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা প্রয়োজন। পুত্রবধূ নির্বাচনী পরীক্ষা নিচ্ছেন এক ভদ্রলোক। ‘রান্না জানো?’ ‘সামান্য’, মেয়েটির শান্ত উত্তর। ‘বড়ি দিয়ে কুমড়োশাক কী করে রাঁধতে হয়?’ কিছু একটা বলল মেয়েটি। কিন্তু নিঃসন্দেহে সেটি সঠিক উত্তর নয়। ‘সেলাই করতে পারো?’ প্রশ্নের রেলগাড়ি চলতেই থাকে। ‘না’—চোখভরা জল মেয়েটির। ‘তুমি তো দেখছি একেবারেই আনাড়ি’—রায় ঘোষিত হয়ে গেল।
বড় মায়া হয় মেয়েটির জন্য আমার—আমারই তো এক ভ্রাতুষ্পুত্রী সে। ‘আপনি আবৃত্তি করতে পাবেন?’ জানতে চাই আমি ভদ্রলোকটির কাছে। সারা ঘরের সব কথা থেমে যায়। ভদ্রলোক হতবাক! ‘না’, অবাক গলায় বলেন তিনি। ‘পিরিচে একটুকুও চা না ফেলে ভরা কাপ চা নিয়ে আসতে পারেন?’ আমার ভাবির রক্তচক্ষু সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রশ্নবান ছুড়ে দিই আমি ওই ভদ্রজনের প্রতি। ‘চেষ্টা করিনি কখনো!’ তাঁর কণ্ঠের কাঠিন্য টের পাই আমি। ‘ছোট্ট একটা হাতুড়ি দিয়ে দেয়ালে একটুও ক্ষত না করে এক বাড়িতে পেরেক লাগাতে পারেন?’ ভদ্রলোকের চোখে চোখ রেখে বলি আমি। রাগে ভদ্রলোক কথা পর্যন্ত কন না। এবার শক্ত গলায় বলি আমি, ‘আপনি তো ওর চাইতেও আনাড়ি। ও তো এই সবকিছু পারে অনায়াসে।’
ওই পক্ষ চলে গেলে তিরস্কারের বন্যা বয়ে যায় আমার ওপর দিয়ে। ভাই-ভাবি আমার সঙ্গে এক মাস কথা কননি। আমার বাচালতায় বিরক্ত হয়েছিলেন আমার খালা। শুধু যখন চলে আসি, তখন মেয়েটি আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, ‘চাচা, আজ একমাত্র তুমিই আমার সম্মান রক্ষা করলে।’ ওর চিবুকে আলতো করে আদর করে বেরিয়ে আসি।
এই আখ্যানের একটি পাদটীকা আছে। সেদিনের সেই তরুণী পশ্চিমের এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগে। সেখানে বিভাগীয় প্রধানও সে। যে দক্ষতায় সে বিভাগীয় প্রশাসন চালায়, সেই একই দক্ষতায় সে অনেক সুরম্য ভবনের নকশা করেছে! দুর্দান্ত রাঁধুনি সে, সূচিকর্মেও তার জুড়ি নেই, বড়ির পাঁচ রকমের রান্না সে আমাকে খাইয়েছে। সে নারী নিঃসন্দেহে, কিন্তু আনাড়ি নয় কোনোমতেই।
নারী যে আনাড়ি নয়, তার প্রচুর প্রমাণ ইতিহাসে আছে, আছে গল্পগাথায়, আছে আমাদের চোখের সামনে নিত্যদিন। নারী শুধু রাজ্য শাসন করেনি, ‘রাজারে শাসিছে নারী’, ঘরে-বাইরে জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর ধ্যানধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা, কর্মধারা প্রতিনিয়তই প্রমাণ করেছে যে তারা আনাড়ি নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার মতো সামষ্টিক ব্যাপারেই শুধু নয়, জীবন ও জগতের নানা ক্ষেত্রে নারীর দক্ষতা অর্জন সুবিদিত।
কী না করেছে নারী? তথাকথিত পুরুষের কাজের ক্ষেত্রেও তারা প্রমাণ করেছে যে, কোনো অংশেই তারা আনাড়ি নয়। তাদের সক্ষমতা বাড়ালে এবং তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হলে তারা যে আনাড়ি নয়, তা তারা প্রমাণ করতে পারে। ‘নারী আনাড়ি’—এজাতীয় একটি বায়বীয় ধারণা সৃষ্টি করার জন্য পুরুষ কতগুলো কল্পকথা বানিয়েছে:
এক. নারী দুর্বল, তাই বহু কাজ তাদের সাধ্যের বা আয়ত্তের বাইরে।
দুই. তথাকথিত পুরুষের কাজগুলো নারী করতে পারবে না।
তিন. নারী আবেগপ্রবণ। অতএব, শান্ত ও জটিল চিন্তার কাজগুলো তাদের জন্য নয়।
চার. ঘরের ভেতরের কাজগুলো নারীদের উপযোগী, সুতরাং সেখানেই তাদের অবস্থান কাম্য।
পাঁচ. নারীর বুদ্ধি কম, সুতরাং বিজ্ঞান বা প্রকৌশলের মতো ব্যাপারগুলো তাদের আয়ত্তের বাইরে।
এই পাঁচটি যুক্তি যে শুধু খোঁড়া তাই নয়, নারীর প্রতি এগুলো অত্যন্ত অবমাননাকরও বটে। প্রথমত, নারী-পুরুষের শারীরিক গঠন ও মনোজগতে নানান পার্থক্য আছে। সে কারণে নানান কাজ করার আয়াসসাধ্যতারও হেরফের আছে। কিন্তু তার মানে এই নয়, নারী আনাড়ি। পুরুষের আনাড়িপনার তালিকা যদি প্রস্তুত করা যায়, তাহলে এক ইতিহাস লেখা যাবে। নারীকে দুর্বল করে তার মনে একধরনের হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করাই এই বক্তব্যের মূল লক্ষ্য।
দ্বিতীয়ত, তথাকথিত ‘পুরুষের কাজগুলো’ নারীরা করছে শুধু দক্ষতার সঙ্গে নয়, সৌষ্ঠব্য নিয়েও। বিমান চালনা থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীতে, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ থেকে মহাকাশযাত্রা, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা—সব ক্ষেত্রেই নারী প্রমাণ করেছে যে, তথাকথিত ‘পুরুষের কাজগুলো’ তারা সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করতে পারে—চাই শুধু সুযোগের, সক্ষমতা বৃদ্ধির এবং কর্মের পরিধি বিস্তারের। সর্বত্র নারী প্রমাণ করেছে যে ‘নারীর কাজ’, ‘পুরুষের কাজ’ বলে কোনো বিভাজন নেই, ওটা পুরুষের সৃষ্টি তার তথাকথিত ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রমাণের জন্য। একটা কথা বলি, ‘পুরুষের কাজ’ বলে যেগুলো পুরুষ সনাতন কাল ধরে চিহ্নিত করেছে, সেগুলোর দেয়াল নারী এক এক করে ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু ‘নারীর কাজ’ বলে পুরুষ যে কাজগুলো চিহ্নিত করেছে, তার কতটুকু করার দক্ষতা পুরুষ অর্জন করেছে? তার একটি কাজ তো পুরুষ কখনোই করতে পারবে না। পুরুষকে যদি সন্তান ধারণ করতে হতো, তাহলে পৃথিবীর জনসংখ্যা চল্লিশের বেশি হতো না।
তৃতীয়ত, ‘আবেগ’ ও ‘সংবেদনশীলতা’ এক বস্তু নয়। নারীর ‘সংবেদনশীলতা’কে ভুল করে ‘আবেগ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। নারী ‘সংবেদনশীল’, কিন্তু ‘অতি আবেগপ্রবণ’ নয় নিঃসন্দেহে। আসলে সত্যিকারের আবেগপ্রবণ হচ্ছে পুরুষেরা। এবং তাদের আবেগ বড়ই তীব্র। তাদের অতি আবেগপ্রবণতার ভার নারীকেই বহন করতে হয়। নারীর আবেগের প্রমাণ হিসেবে তাদের কান্নাকে চিহ্নিত করা হয়। ওটা তাদের সংবেদনশীলতার প্রমাণ, অতি আবেগপ্রবণ পুরুষের আবেগের জল যদি ধরে রাখা হয়, তাহলে তা দিয়ে আরেকটি গঙ্গা বইয়ে দেওয়া যাবে।
চতুর্থত, ‘ঘরের কাজগুলো’ নারীর উপযোগী—এ ব্যাপারটিও পুরুষের সৃষ্টি। নারীকে গৃহাভ্যন্তরে আটকে রাখার এক চমকপ্রদ ফন্দি। ঘরের কাজগুলো যে পুরুষ করতে পারে অতি সুন্দরভাবে, তার প্রমাণ বহু পুরুষ দিয়েছে। আসলে ঘরের ভেতরের কাজগুলোর বিরাট ভার যদি পুরুষ সহভাগ করে নেয়, তাহলে নারীর পক্ষে বহু উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল কাজ করা সম্ভব। গৃহাভ্যন্তরের কাজগুলোতে পুরুষের সহভাগ নারীমুক্তির আবশ্যিক শর্ত, পর্যাপ্ত শর্ত নয় অবশ্য।
পঞ্চমত, ‘নারীর বুদ্ধি কম, সুতরাং বিজ্ঞান তাদের আয়ত্তের বাইরে’, এমন একটি অকল্পনীয় কথা বলেছিলেন একদা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান, বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী লরেন্স সামার্স। আমার পরিচিত এক অর্থনীতিবিদের এমন একটি অশোভন উক্তিতে লজ্জায় মুখ লুকাই। তবে এমন নির্বোধ অবমাননাকর উক্তির জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এমন উক্তি উত্তরের যোগ্য নয়।
এখন মোক্ষম প্রশ্ন হচ্ছে, এত সব যুক্তি ও সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নারীকে আনাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করার এবং সেটাই প্রতিষ্ঠিত করার ক্রমাগত প্রয়াসের কারণটা কী? আমার মনে হয়, সে কারণের একটি মনস্তাত্ত্বিক দিক আছে এবং সেই সঙ্গে একটি বাস্তবতার দিকও আছে। মনে রাখা দরকার যে, ‘নারী মানেই আনাড়ি’ এমন কথা কিন্তু নারীরা বলছে না, বলবেও না। কথাটি উচ্চারিত হচ্ছে প্রবলভাবে পুরুষের দ্বারা। এবং এই পর্যবেক্ষণের মধ্যে উল্লেখিত প্রশ্নটির উত্তর লুকিয়ে আছে।
আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে অবদমন করাটা জরুরি পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য। সেই অবদমনের একটি সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক মাত্রিকতা আছে। নারীকে যদি জীবনের বহু ক্ষেত্রে ক্রমাগতভাবে আনাড়ি বলে পরিহাস করা হয়, তিরস্কার করা হয়, তাহলে তার মধ্যে একটি হীনম্মন্যতাবোধের জন্ম হবে। একটা সময়ে তার মনে হবে, সে বোধ হয় অযোগ্য, অদক্ষ এবং আনাড়ি। তার প্রত্যয়ের ভিতে ফাটল ধরবে এবং তার ক্ষমতায় সে আর আস্থা রাখতে পারবে না। নারীর এই সংশয়িত অবস্থান তাকে অবদমনের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্ষেত্রে বড় প্রয়োজন।
কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি ছাড়াও ‘নারী মানেই আনাড়ি’ বক্তব্যটির একটি বাস্তবভিত্তিক প্রায়োগিক দিকও আছে। একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবদমনের জন্য গৃহের বাইরের বহু কাজেই নারী যোগ্য নয় কথাটির ধুয়ো তুলেই বলা হয়, নারীর প্রকৃত অবস্থান গৃহের অভ্যন্তরে, গৃহকাজই তার যোগ্য কাজ। এই বক্তব্যের দুটো দিক আছে। এক, এমন একটি কথা বলে আমরা নারীকে ঘরের মধ্যে আটকে ফেলি, বাইরের বিশাল পৃথিবীতে তার সক্ষমতার প্রয়োগ এবং তা থেকে প্রাপ্তব্য সুফলের ক্ষেত্রকে আমরা সীমিত করে ফেলি। দুই, নারী গৃহকর্মই সবচেয়ে ভালো করতে পারে—এমন কথা বলে গৃহাভ্যন্তরেই সব রকমের মজুরিবিহীন কাজ আমরা নারীকে দিয়েই করিয়ে নিই। বিনা মূল্য শ্রমের এমন নজির খুব বেশি নেই। প্রায়োগিক দিক থেকে পুরুষের গৃহবহির্ভূত কাজের জন্য এজাতীয় শ্রম একান্ত প্রয়োজনীয়। নারী ঘরের ভেতরে, সেবামূলক কাজে ব্যাপৃত থাকে বলেই পুরুষ ঘরের বাইরের কাজ করতে পারে। নিজেদের কাজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুরুষ তার ঘরের বাইরের কাজকে সংজ্ঞায়িত করেছে ‘উৎপাদনশীল কাজ’ হিসেবে, যেন ঘরের ভেতরে নারীর কাজটি অনুৎপাদনশীল!
নারীকে আনাড়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তাকে অবদমনের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চেষ্টার অন্ত নেই। নারীর সক্ষমতা বাড়তে দিও না, সুযোগ গ্রহণের আগেই তাকে আটক ফেলো। তাই ১৮ বছর হওয়ার আগেই সারা বিশ্বে ১ কোটি ৫০ লাখ মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। প্রতি দুই মিনিটে একটি বালিকাবধূ। নারীর বাইরের কাজ করার সুযোগকে আটকাও, যে কারণে বিশ্বের ১৮টি দেশে ঘরের বাইরের কাজ করার জন্য নারীকে স্বামীর অনুমতি নিতে হয়। নারীর বহির্বিশ্ব পরিভ্রমণের সুযোগও নিয়ন্ত্রণ করো—৩২টি দেশে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য তাই নারীর ক্ষেত্রে বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া ভিন্ন। নারীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করো, যার জন্য উন্নয়নশীল বিশ্বে মাত্র ১০ শতাংশ নারীর ভূমির মালিকানা আছে।
নারীকে আনাড়ি প্রমাণের লক্ষ্যে অবদমন পন্থার আরও তো অস্ত্র আছে। সহিংসতা তেমনই একটি অস্ত্র। সেই অস্ত্র ব্যবহৃত হয় নানানভাবে। বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে গৃহাভ্যন্তরে সহিংসতার শিকার হয়েছে। ২০ কোটি নারী শিকার হয় যৌনাঙ্গচ্ছেদের মতো ক্ষতিকর প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর। পরিবারের তথাকথিত সম্মান রক্ষার জন্য প্রতিবছর ৫ হাজার নারীকে আত্মাহুতি দিতে হয় বিভিন্ন দেশে।
নারীর প্রতি পুরুষের সহিংসতার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, যুক্তি ও বাস্তব বিচার-বুদ্ধি হচ্ছে নারীর অস্ত্র আর পেশিশক্তি হচ্ছে পুরুষের অস্ত্র, যার যা ‘অস্ত্র পিত, তা তার সম্বল’—এটা পুরুষ খুব ভালো করেই জানে। তাই নারীর বুদ্ধিবৃত্তি, যুক্তি আর বাস্তব চিন্তার সঙ্গে পুরুষ যখন পেরে ওঠে না, তখনই সে হিংস্র হয়ে ওঠে পেশিশক্তি প্রয়োগ করে এবং সহিংসতার আশ্রয় নেয়।
নারীর প্রতি সহিংসতার একটি চরম রূপ হচ্ছে ধর্ষণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে দেখা হয় পুরুষের উপভোগের পণ্য হিসেবে। নারী মহলে থাকবে, তাই সে মহিলা। নারী রমণযোগ্য, তাই সে রমণী। নারী যেহেতু উপভোগের সামগ্রী ও পণ্য, তাই তাকে উপভোগ করা যেতে পারে, সেই প্রক্রিয়া স্বেচ্ছাকৃতই হোক কিংবা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই হোক—এই ধারণা বহু পরুষের চিন্তা-চেতনায় বিদ্যমান। ধর্ষণের মনস্তত্ত্বের একটি কেন্দ্রবিন্দু সেখানেই।
‘নারী যে আনাড়ি নয়’—এই সত্য প্রমাণ করার জন্য কী করা যেতে পারে? এর মূল কাজটি নারীরাই করছে তাদের অতুলনীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। জীবন ও জগতের প্রতিটি অঙ্গনে তাদের দৃপ্ত পদক্ষেপ। ‘শার্সি উপতল’ তারা এখনো ভাঙতে পারেনি তা ঠিক, কিন্তু ফাটল তো ধরিয়েছে আস্তে আস্তে। জানি, বিশ্বের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উচ্চতম পদগুলোতে দুই-তৃতীয়াংশ এখনো পুরুষের দখলে, কিন্তু সেখানেও ধীরে ধীরে নারীর আরও আগমন ঘটছে।
দ্বিতীয়ত সন্দেহ নেই, যখন আমরা নারীকে জায়া-জননী-আত্মজা হিসেবে চিহ্নিত করি, তখন আমরা তাদের মহিমান্বিত করি। কিন্তু এর কোনোটাই নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় নয়। নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ। নারীর মানুষ পরিচয় পেছনে রেখে আমরা যদি তার জায়া-জননী-আত্মজা পরিচয়কেই তাদের একমাত্র আত্মসত্তা হিসেবে চিহ্নিত করি, তখন কিন্তু মানুষ হিসেবে তাদের সক্ষমতা, সম্ভাবনা ও আত্মপরিচয়কে আমরা সীমাবদ্ধ করে ফেলি। সে অবস্থায় জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে ও মানবিকতার বিভিন্ন মাত্রিকতায় নারীর ঘাটতিকে বড় করে দেখানো সহজ, তাদের আনাড়িপনার প্রমাণ দেওয়া কষ্টকর নয়। সুতরাং নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার মতো দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।
তৃতীয়ত, একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর জীবনের বহু বাস্তবতা নির্ধারিত হয় পুরুষের কর্মকাণ্ডের দ্বারা। কখনো ইতিবাচকভাবে, কখনো নেতিবাচকভাবে। যেমন—রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথাই ধার করা যাক। তাঁকে লিখতে-পড়তে শিখিয়েছিলেন তাঁর অগ্রজ একজন। সুতরাং তাঁর জীবনের ইতিবাচক বাস্তবতার শুরু একজন পুরুষের হাত ধরেই। অন্যদিকে, একজন পুরুষের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড একজন নারীকে ‘আনাড়ি’ নামক হীনম্মন্যতার সৃষ্টি করতে পারে। নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মকাণ্ডের পরিবর্তন একান্তই আবশ্যক।
চতুর্থত, একজন পুরুষকে বুঝতে হবে যে তার পৌরুষের উৎস তার পেশিশক্তি নয়; তার সংবেদনশীলতা, তার বিবেচনাবোধ, তার বিবেক। ক্রোধ নয়, মমতা; ঔদাসীন্য নয়, বিবেচনা; স্পর্শকাতরতা নয়, সংবেদনশীলতা; সন্দেহ নয়, আস্থা একজন পুরুষকে সত্যিকারের পুরুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তাই আমি বলি, একজন পুরুষের মধ্যে কিছুটা নারীসত্তা থাকা একান্ত প্রয়োজন; একজন নারীর যেমন কিছুটা পুরুষালি হওয়া ভালো তার শক্তিকে প্রকাশের জন্য।
নারী আনাড়ি নয়, তাকে আনাড়ি বলে ভাবা বা উপস্থাপনের চেষ্টাও অনভিপ্রেত। পুরুষের বুঝতে হবে, এই লক্ষ্যে নারীকে অবদমন তার যাত্রাকেও ব্যাহত করবে। সমাজের অর্ধেক অংশকে অবদমিত করে সমাজ এগোবে না। নারীকে তার আপন শক্তিতে জাগতে দিতে হবে, আর সেই ক্ষেত্র তৈরি করার দায়িত্ব পুরুষেরও। পুরুষের মন-মানসিকতা আর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখানে অত্যাবশ্যক।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
তিনটি কথা প্রথমেই বলে নেই। প্রথমত আমি শিবরাম চক্রবর্তীর পরম ভক্ত। তাঁর শব্দের খেলা আমার ভারি ভালো লাগে। ওই যে, ‘ধার করি আমরা উদ্ধার পাওয়ার জন্য’ কিংবা ‘স্বামী মানেই আসামি’। এবার ভাবলাম আমিও সে রকম একটু চেষ্টা করে দেখি না! বেশ ধস্তাধস্তির পরে বোঝা গেল, ও আমার কম্ম নয়। এখন যেমন ‘লেজেগোবরে’ অবস্থা আমার, তখন আমাকে বাঁচিয়ে দিল আমাদের শামীম—সতীর্থ বন্ধু শামীম আজাদ।
সেটাই আমার দ্বিতীয় কথা, তাঁর একটা লেখার শিরোনাম দেখেছিলাম, ‘নারী মানেই আনাড়ি নয়’। সেটাই চেয়েচিন্তে নিলাম তাঁর কাছ থেকে। অনেকটা ধার করলাম উদ্ধার পাওয়ার জন্য। ‘বাহ্, দোষের কী হলো?’ ‘বন্ধুকে বন্ধু না দেখিলে আর কে দেখিত?’ ওই আবারও শিবরাম, ‘চক্কোত্তিকে চক্কোন্তি না দেখিলে আর কে দেখিবে?’
আর তৃতীয়ত, হাসি-ঠাট্টা ছেড়ে দিয়ে গুরুগম্ভীরতার সঙ্গে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা প্রয়োজন। পুত্রবধূ নির্বাচনী পরীক্ষা নিচ্ছেন এক ভদ্রলোক। ‘রান্না জানো?’ ‘সামান্য’, মেয়েটির শান্ত উত্তর। ‘বড়ি দিয়ে কুমড়োশাক কী করে রাঁধতে হয়?’ কিছু একটা বলল মেয়েটি। কিন্তু নিঃসন্দেহে সেটি সঠিক উত্তর নয়। ‘সেলাই করতে পারো?’ প্রশ্নের রেলগাড়ি চলতেই থাকে। ‘না’—চোখভরা জল মেয়েটির। ‘তুমি তো দেখছি একেবারেই আনাড়ি’—রায় ঘোষিত হয়ে গেল।
বড় মায়া হয় মেয়েটির জন্য আমার—আমারই তো এক ভ্রাতুষ্পুত্রী সে। ‘আপনি আবৃত্তি করতে পাবেন?’ জানতে চাই আমি ভদ্রলোকটির কাছে। সারা ঘরের সব কথা থেমে যায়। ভদ্রলোক হতবাক! ‘না’, অবাক গলায় বলেন তিনি। ‘পিরিচে একটুকুও চা না ফেলে ভরা কাপ চা নিয়ে আসতে পারেন?’ আমার ভাবির রক্তচক্ষু সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রশ্নবান ছুড়ে দিই আমি ওই ভদ্রজনের প্রতি। ‘চেষ্টা করিনি কখনো!’ তাঁর কণ্ঠের কাঠিন্য টের পাই আমি। ‘ছোট্ট একটা হাতুড়ি দিয়ে দেয়ালে একটুও ক্ষত না করে এক বাড়িতে পেরেক লাগাতে পারেন?’ ভদ্রলোকের চোখে চোখ রেখে বলি আমি। রাগে ভদ্রলোক কথা পর্যন্ত কন না। এবার শক্ত গলায় বলি আমি, ‘আপনি তো ওর চাইতেও আনাড়ি। ও তো এই সবকিছু পারে অনায়াসে।’
ওই পক্ষ চলে গেলে তিরস্কারের বন্যা বয়ে যায় আমার ওপর দিয়ে। ভাই-ভাবি আমার সঙ্গে এক মাস কথা কননি। আমার বাচালতায় বিরক্ত হয়েছিলেন আমার খালা। শুধু যখন চলে আসি, তখন মেয়েটি আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, ‘চাচা, আজ একমাত্র তুমিই আমার সম্মান রক্ষা করলে।’ ওর চিবুকে আলতো করে আদর করে বেরিয়ে আসি।
এই আখ্যানের একটি পাদটীকা আছে। সেদিনের সেই তরুণী পশ্চিমের এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগে। সেখানে বিভাগীয় প্রধানও সে। যে দক্ষতায় সে বিভাগীয় প্রশাসন চালায়, সেই একই দক্ষতায় সে অনেক সুরম্য ভবনের নকশা করেছে! দুর্দান্ত রাঁধুনি সে, সূচিকর্মেও তার জুড়ি নেই, বড়ির পাঁচ রকমের রান্না সে আমাকে খাইয়েছে। সে নারী নিঃসন্দেহে, কিন্তু আনাড়ি নয় কোনোমতেই।
নারী যে আনাড়ি নয়, তার প্রচুর প্রমাণ ইতিহাসে আছে, আছে গল্পগাথায়, আছে আমাদের চোখের সামনে নিত্যদিন। নারী শুধু রাজ্য শাসন করেনি, ‘রাজারে শাসিছে নারী’, ঘরে-বাইরে জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর ধ্যানধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা-চেতনা, কর্মধারা প্রতিনিয়তই প্রমাণ করেছে যে তারা আনাড়ি নয়। রাষ্ট্র পরিচালনার মতো সামষ্টিক ব্যাপারেই শুধু নয়, জীবন ও জগতের নানা ক্ষেত্রে নারীর দক্ষতা অর্জন সুবিদিত।
কী না করেছে নারী? তথাকথিত পুরুষের কাজের ক্ষেত্রেও তারা প্রমাণ করেছে যে, কোনো অংশেই তারা আনাড়ি নয়। তাদের সক্ষমতা বাড়ালে এবং তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হলে তারা যে আনাড়ি নয়, তা তারা প্রমাণ করতে পারে। ‘নারী আনাড়ি’—এজাতীয় একটি বায়বীয় ধারণা সৃষ্টি করার জন্য পুরুষ কতগুলো কল্পকথা বানিয়েছে:
এক. নারী দুর্বল, তাই বহু কাজ তাদের সাধ্যের বা আয়ত্তের বাইরে।
দুই. তথাকথিত পুরুষের কাজগুলো নারী করতে পারবে না।
তিন. নারী আবেগপ্রবণ। অতএব, শান্ত ও জটিল চিন্তার কাজগুলো তাদের জন্য নয়।
চার. ঘরের ভেতরের কাজগুলো নারীদের উপযোগী, সুতরাং সেখানেই তাদের অবস্থান কাম্য।
পাঁচ. নারীর বুদ্ধি কম, সুতরাং বিজ্ঞান বা প্রকৌশলের মতো ব্যাপারগুলো তাদের আয়ত্তের বাইরে।
এই পাঁচটি যুক্তি যে শুধু খোঁড়া তাই নয়, নারীর প্রতি এগুলো অত্যন্ত অবমাননাকরও বটে। প্রথমত, নারী-পুরুষের শারীরিক গঠন ও মনোজগতে নানান পার্থক্য আছে। সে কারণে নানান কাজ করার আয়াসসাধ্যতারও হেরফের আছে। কিন্তু তার মানে এই নয়, নারী আনাড়ি। পুরুষের আনাড়িপনার তালিকা যদি প্রস্তুত করা যায়, তাহলে এক ইতিহাস লেখা যাবে। নারীকে দুর্বল করে তার মনে একধরনের হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করাই এই বক্তব্যের মূল লক্ষ্য।
দ্বিতীয়ত, তথাকথিত ‘পুরুষের কাজগুলো’ নারীরা করছে শুধু দক্ষতার সঙ্গে নয়, সৌষ্ঠব্য নিয়েও। বিমান চালনা থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীতে, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ থেকে মহাকাশযাত্রা, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা—সব ক্ষেত্রেই নারী প্রমাণ করেছে যে, তথাকথিত ‘পুরুষের কাজগুলো’ তারা সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন করতে পারে—চাই শুধু সুযোগের, সক্ষমতা বৃদ্ধির এবং কর্মের পরিধি বিস্তারের। সর্বত্র নারী প্রমাণ করেছে যে ‘নারীর কাজ’, ‘পুরুষের কাজ’ বলে কোনো বিভাজন নেই, ওটা পুরুষের সৃষ্টি তার তথাকথিত ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রমাণের জন্য। একটা কথা বলি, ‘পুরুষের কাজ’ বলে যেগুলো পুরুষ সনাতন কাল ধরে চিহ্নিত করেছে, সেগুলোর দেয়াল নারী এক এক করে ভেঙে দিচ্ছে। কিন্তু ‘নারীর কাজ’ বলে পুরুষ যে কাজগুলো চিহ্নিত করেছে, তার কতটুকু করার দক্ষতা পুরুষ অর্জন করেছে? তার একটি কাজ তো পুরুষ কখনোই করতে পারবে না। পুরুষকে যদি সন্তান ধারণ করতে হতো, তাহলে পৃথিবীর জনসংখ্যা চল্লিশের বেশি হতো না।
তৃতীয়ত, ‘আবেগ’ ও ‘সংবেদনশীলতা’ এক বস্তু নয়। নারীর ‘সংবেদনশীলতা’কে ভুল করে ‘আবেগ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। নারী ‘সংবেদনশীল’, কিন্তু ‘অতি আবেগপ্রবণ’ নয় নিঃসন্দেহে। আসলে সত্যিকারের আবেগপ্রবণ হচ্ছে পুরুষেরা। এবং তাদের আবেগ বড়ই তীব্র। তাদের অতি আবেগপ্রবণতার ভার নারীকেই বহন করতে হয়। নারীর আবেগের প্রমাণ হিসেবে তাদের কান্নাকে চিহ্নিত করা হয়। ওটা তাদের সংবেদনশীলতার প্রমাণ, অতি আবেগপ্রবণ পুরুষের আবেগের জল যদি ধরে রাখা হয়, তাহলে তা দিয়ে আরেকটি গঙ্গা বইয়ে দেওয়া যাবে।
চতুর্থত, ‘ঘরের কাজগুলো’ নারীর উপযোগী—এ ব্যাপারটিও পুরুষের সৃষ্টি। নারীকে গৃহাভ্যন্তরে আটকে রাখার এক চমকপ্রদ ফন্দি। ঘরের কাজগুলো যে পুরুষ করতে পারে অতি সুন্দরভাবে, তার প্রমাণ বহু পুরুষ দিয়েছে। আসলে ঘরের ভেতরের কাজগুলোর বিরাট ভার যদি পুরুষ সহভাগ করে নেয়, তাহলে নারীর পক্ষে বহু উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল কাজ করা সম্ভব। গৃহাভ্যন্তরের কাজগুলোতে পুরুষের সহভাগ নারীমুক্তির আবশ্যিক শর্ত, পর্যাপ্ত শর্ত নয় অবশ্য।
পঞ্চমত, ‘নারীর বুদ্ধি কম, সুতরাং বিজ্ঞান তাদের আয়ত্তের বাইরে’, এমন একটি অকল্পনীয় কথা বলেছিলেন একদা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান, বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী লরেন্স সামার্স। আমার পরিচিত এক অর্থনীতিবিদের এমন একটি অশোভন উক্তিতে লজ্জায় মুখ লুকাই। তবে এমন নির্বোধ অবমাননাকর উক্তির জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এমন উক্তি উত্তরের যোগ্য নয়।
এখন মোক্ষম প্রশ্ন হচ্ছে, এত সব যুক্তি ও সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নারীকে আনাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করার এবং সেটাই প্রতিষ্ঠিত করার ক্রমাগত প্রয়াসের কারণটা কী? আমার মনে হয়, সে কারণের একটি মনস্তাত্ত্বিক দিক আছে এবং সেই সঙ্গে একটি বাস্তবতার দিকও আছে। মনে রাখা দরকার যে, ‘নারী মানেই আনাড়ি’ এমন কথা কিন্তু নারীরা বলছে না, বলবেও না। কথাটি উচ্চারিত হচ্ছে প্রবলভাবে পুরুষের দ্বারা। এবং এই পর্যবেক্ষণের মধ্যে উল্লেখিত প্রশ্নটির উত্তর লুকিয়ে আছে।
আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে অবদমন করাটা জরুরি পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য। সেই অবদমনের একটি সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক মাত্রিকতা আছে। নারীকে যদি জীবনের বহু ক্ষেত্রে ক্রমাগতভাবে আনাড়ি বলে পরিহাস করা হয়, তিরস্কার করা হয়, তাহলে তার মধ্যে একটি হীনম্মন্যতাবোধের জন্ম হবে। একটা সময়ে তার মনে হবে, সে বোধ হয় অযোগ্য, অদক্ষ এবং আনাড়ি। তার প্রত্যয়ের ভিতে ফাটল ধরবে এবং তার ক্ষমতায় সে আর আস্থা রাখতে পারবে না। নারীর এই সংশয়িত অবস্থান তাকে অবদমনের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ক্ষেত্রে বড় প্রয়োজন।
কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি ছাড়াও ‘নারী মানেই আনাড়ি’ বক্তব্যটির একটি বাস্তবভিত্তিক প্রায়োগিক দিকও আছে। একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবদমনের জন্য গৃহের বাইরের বহু কাজেই নারী যোগ্য নয় কথাটির ধুয়ো তুলেই বলা হয়, নারীর প্রকৃত অবস্থান গৃহের অভ্যন্তরে, গৃহকাজই তার যোগ্য কাজ। এই বক্তব্যের দুটো দিক আছে। এক, এমন একটি কথা বলে আমরা নারীকে ঘরের মধ্যে আটকে ফেলি, বাইরের বিশাল পৃথিবীতে তার সক্ষমতার প্রয়োগ এবং তা থেকে প্রাপ্তব্য সুফলের ক্ষেত্রকে আমরা সীমিত করে ফেলি। দুই, নারী গৃহকর্মই সবচেয়ে ভালো করতে পারে—এমন কথা বলে গৃহাভ্যন্তরেই সব রকমের মজুরিবিহীন কাজ আমরা নারীকে দিয়েই করিয়ে নিই। বিনা মূল্য শ্রমের এমন নজির খুব বেশি নেই। প্রায়োগিক দিক থেকে পুরুষের গৃহবহির্ভূত কাজের জন্য এজাতীয় শ্রম একান্ত প্রয়োজনীয়। নারী ঘরের ভেতরে, সেবামূলক কাজে ব্যাপৃত থাকে বলেই পুরুষ ঘরের বাইরের কাজ করতে পারে। নিজেদের কাজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুরুষ তার ঘরের বাইরের কাজকে সংজ্ঞায়িত করেছে ‘উৎপাদনশীল কাজ’ হিসেবে, যেন ঘরের ভেতরে নারীর কাজটি অনুৎপাদনশীল!
নারীকে আনাড়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তাকে অবদমনের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চেষ্টার অন্ত নেই। নারীর সক্ষমতা বাড়তে দিও না, সুযোগ গ্রহণের আগেই তাকে আটক ফেলো। তাই ১৮ বছর হওয়ার আগেই সারা বিশ্বে ১ কোটি ৫০ লাখ মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। প্রতি দুই মিনিটে একটি বালিকাবধূ। নারীর বাইরের কাজ করার সুযোগকে আটকাও, যে কারণে বিশ্বের ১৮টি দেশে ঘরের বাইরের কাজ করার জন্য নারীকে স্বামীর অনুমতি নিতে হয়। নারীর বহির্বিশ্ব পরিভ্রমণের সুযোগও নিয়ন্ত্রণ করো—৩২টি দেশে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য তাই নারীর ক্ষেত্রে বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া ভিন্ন। নারীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করো, যার জন্য উন্নয়নশীল বিশ্বে মাত্র ১০ শতাংশ নারীর ভূমির মালিকানা আছে।
নারীকে আনাড়ি প্রমাণের লক্ষ্যে অবদমন পন্থার আরও তো অস্ত্র আছে। সহিংসতা তেমনই একটি অস্ত্র। সেই অস্ত্র ব্যবহৃত হয় নানানভাবে। বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে গৃহাভ্যন্তরে সহিংসতার শিকার হয়েছে। ২০ কোটি নারী শিকার হয় যৌনাঙ্গচ্ছেদের মতো ক্ষতিকর প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর। পরিবারের তথাকথিত সম্মান রক্ষার জন্য প্রতিবছর ৫ হাজার নারীকে আত্মাহুতি দিতে হয় বিভিন্ন দেশে।
নারীর প্রতি পুরুষের সহিংসতার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, যুক্তি ও বাস্তব বিচার-বুদ্ধি হচ্ছে নারীর অস্ত্র আর পেশিশক্তি হচ্ছে পুরুষের অস্ত্র, যার যা ‘অস্ত্র পিত, তা তার সম্বল’—এটা পুরুষ খুব ভালো করেই জানে। তাই নারীর বুদ্ধিবৃত্তি, যুক্তি আর বাস্তব চিন্তার সঙ্গে পুরুষ যখন পেরে ওঠে না, তখনই সে হিংস্র হয়ে ওঠে পেশিশক্তি প্রয়োগ করে এবং সহিংসতার আশ্রয় নেয়।
নারীর প্রতি সহিংসতার একটি চরম রূপ হচ্ছে ধর্ষণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে দেখা হয় পুরুষের উপভোগের পণ্য হিসেবে। নারী মহলে থাকবে, তাই সে মহিলা। নারী রমণযোগ্য, তাই সে রমণী। নারী যেহেতু উপভোগের সামগ্রী ও পণ্য, তাই তাকে উপভোগ করা যেতে পারে, সেই প্রক্রিয়া স্বেচ্ছাকৃতই হোক কিংবা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেই হোক—এই ধারণা বহু পরুষের চিন্তা-চেতনায় বিদ্যমান। ধর্ষণের মনস্তত্ত্বের একটি কেন্দ্রবিন্দু সেখানেই।
‘নারী যে আনাড়ি নয়’—এই সত্য প্রমাণ করার জন্য কী করা যেতে পারে? এর মূল কাজটি নারীরাই করছে তাদের অতুলনীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। জীবন ও জগতের প্রতিটি অঙ্গনে তাদের দৃপ্ত পদক্ষেপ। ‘শার্সি উপতল’ তারা এখনো ভাঙতে পারেনি তা ঠিক, কিন্তু ফাটল তো ধরিয়েছে আস্তে আস্তে। জানি, বিশ্বের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উচ্চতম পদগুলোতে দুই-তৃতীয়াংশ এখনো পুরুষের দখলে, কিন্তু সেখানেও ধীরে ধীরে নারীর আরও আগমন ঘটছে।
দ্বিতীয়ত সন্দেহ নেই, যখন আমরা নারীকে জায়া-জননী-আত্মজা হিসেবে চিহ্নিত করি, তখন আমরা তাদের মহিমান্বিত করি। কিন্তু এর কোনোটাই নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় নয়। নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ। নারীর মানুষ পরিচয় পেছনে রেখে আমরা যদি তার জায়া-জননী-আত্মজা পরিচয়কেই তাদের একমাত্র আত্মসত্তা হিসেবে চিহ্নিত করি, তখন কিন্তু মানুষ হিসেবে তাদের সক্ষমতা, সম্ভাবনা ও আত্মপরিচয়কে আমরা সীমাবদ্ধ করে ফেলি। সে অবস্থায় জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে ও মানবিকতার বিভিন্ন মাত্রিকতায় নারীর ঘাটতিকে বড় করে দেখানো সহজ, তাদের আনাড়িপনার প্রমাণ দেওয়া কষ্টকর নয়। সুতরাং নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার মতো দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।
তৃতীয়ত, একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর জীবনের বহু বাস্তবতা নির্ধারিত হয় পুরুষের কর্মকাণ্ডের দ্বারা। কখনো ইতিবাচকভাবে, কখনো নেতিবাচকভাবে। যেমন—রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কথাই ধার করা যাক। তাঁকে লিখতে-পড়তে শিখিয়েছিলেন তাঁর অগ্রজ একজন। সুতরাং তাঁর জীবনের ইতিবাচক বাস্তবতার শুরু একজন পুরুষের হাত ধরেই। অন্যদিকে, একজন পুরুষের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড একজন নারীকে ‘আনাড়ি’ নামক হীনম্মন্যতার সৃষ্টি করতে পারে। নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মকাণ্ডের পরিবর্তন একান্তই আবশ্যক।
চতুর্থত, একজন পুরুষকে বুঝতে হবে যে তার পৌরুষের উৎস তার পেশিশক্তি নয়; তার সংবেদনশীলতা, তার বিবেচনাবোধ, তার বিবেক। ক্রোধ নয়, মমতা; ঔদাসীন্য নয়, বিবেচনা; স্পর্শকাতরতা নয়, সংবেদনশীলতা; সন্দেহ নয়, আস্থা একজন পুরুষকে সত্যিকারের পুরুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তাই আমি বলি, একজন পুরুষের মধ্যে কিছুটা নারীসত্তা থাকা একান্ত প্রয়োজন; একজন নারীর যেমন কিছুটা পুরুষালি হওয়া ভালো তার শক্তিকে প্রকাশের জন্য।
নারী আনাড়ি নয়, তাকে আনাড়ি বলে ভাবা বা উপস্থাপনের চেষ্টাও অনভিপ্রেত। পুরুষের বুঝতে হবে, এই লক্ষ্যে নারীকে অবদমন তার যাত্রাকেও ব্যাহত করবে। সমাজের অর্ধেক অংশকে অবদমিত করে সমাজ এগোবে না। নারীকে তার আপন শক্তিতে জাগতে দিতে হবে, আর সেই ক্ষেত্র তৈরি করার দায়িত্ব পুরুষেরও। পুরুষের মন-মানসিকতা আর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখানে অত্যাবশ্যক।
লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর ও দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১৪ ঘণ্টা আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১৬ ঘণ্টা আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে