সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
তিনটিই সত্য—উন্নতি যে ঘটেছে, সেটা কোনো মিথ্যাবাদীরই সাহস হবে না অস্বীকার করতে; উত্থান ঘটেছে নানা মাত্রায় ও বিভিন্ন প্রকারে; অভ্যুত্থানও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি একাধিক। যে বিদেশিরা আমাদের পছন্দ করেন, তাঁরা অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ যে কেবল উন্নতি করেই ক্ষান্ত হয়েছে তা নয়, দারিদ্র্য ঘুচিয়ে কীভাবে উন্নত হওয়া যায় তার অনুকরণীয় একটি দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে।
উন্নতির চেহারা ঢাকা শহরে বের হলেই হাতেনাতে চোখে-স্পর্শে টের পাওয়া যায়। বাইরে থেকে কয়েক বছর পর, এমনকি এক বছর পরেও যাঁরা আসেন, তাঁরা এমন সব উন্নতি দেখেন যে চিনতে পারেন না, কোথায় এলেন। তবে যাতায়াতটা ভারী কষ্টের। মেট্রো এসেছে, তাতে কারও কারও খুবই সুবিধা হয়েছে। খরচ কিছুটা বেশি, তবু সময় তো বাঁচে। তবে মেট্রোতেও দেখা যাচ্ছে সময়-সময় অচল অবস্থা।
ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল ছেলেরা, সেই ঘুড়ি ছুটে এসে মেট্রোর বিদ্যুতের তারে গিয়ে পড়ে রীতিমতো বিপর্যয় ঘটিয়েছে। যারা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল, তারা যে ষড়যন্ত্রকারী, উন্নয়নে বিঘ্ন ঘটানোই যে তাদের উদ্দেশ্য—এমনটা বোধ হয় নয়। তবু অপরাধ তো করে ফেলেছে, শাস্তি না দিলে ওই কাজ আরও ঘটবে; শুনলাম দুজন অপরাধীকে তাই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এমনিতে ঘুড়ি ওড়ানো অবশ্য কোনো অপরাধ নয়; বরং ভালো কাজই বলা চলে। নিরীহ বিনোদন। কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হয়ে খুনোখুনি করা, ছিনতাই প্রভৃতি বদমাইশি কর্মে লিপ্ত হওয়া এবং মাদকের আসর বসানোর তুলনায় অনেক বেশি সুস্থ কাজ। আমাদের উচিত, ঘুড়ি ওড়ানোতে উৎসাহ দান করা। কিন্তু ঘুড়ি ওড়াবে কোথায়? খোলা মাঠ কই? ঢাকা শহরে বড় বড় পার্কের বেশির ভাগই চলে গেছে লিমিটেড কোম্পানির মালিকানায়, যেখানে কিশোর তো দূরের কথা, প্রবীণদেরও প্রবেশাধিকার নেই। বাকি পার্কের অধিকাংশের বেলাতেই কিশোরেরা প্রবেশাধিকার পায় না। ঘুড়ি ওড়ানো তো স্বর্গীয় কল্পনা। ছাদে উঠে ওড়াবে? আগের দিনে সেটা কিছুটা সম্ভব ছিল; এখন উন্নত শহরে সেটা অত্যন্ত দুষ্কর। আর ওই যে ওড়াতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনা, অপরাধী হওয়া, জেল খাটা, এসব তো ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য নতুন নিষেধাজ্ঞা। সবটাই কিন্তু ঘটছে উন্নতির কারণে। ঘুড়ি ওড়ানোটা অপরাধ নাকি ওড়াতে না-দেওয়া এবং ওড়ানোটাকে বিপজ্জনক কাজ করে তোলাটা অপরাধ, এই বিচারটা কে করবে? উন্নয়ন, নাকি রাষ্ট্র? উন্নয়ন তো ঘটে রাষ্ট্রের হুকুমেই।
উন্নতির কাছে আমাদের প্রত্যাশাটা কী? অবশ্যই সুখ। কিন্তু উন্নয়ন কেবল যে নদীর গলা টিপে ধরছে বা বনভূমি উজাড় করে দিচ্ছে শুধু তা-ই নয়, নাগরিকদের সুখও কেড়ে নিচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় গত এক বছরে প্রাণ হারিয়েছে ৬ হাজার ৫২৪ জন। খবর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের। এ হিসাব সঠিক নয় বলে কেউ কেউ বলেন। তাঁদের বক্তব্য, প্রাণহানির সংখ্যা আরও বেশি। সব ঘটনা খবরে আসে না।
আশাবাদী হওয়াটা খুবই দরকার, আশাবাদী হতে যাঁরা আগ্রহী করছেন, তাঁরা উন্নতির বিষয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারেন এটা লক্ষ করে যে দেশে বড় একটা ভোক্তা শ্রেণির উত্থান ঘটেছে। তাতে বাংলাদেশে পণ্যের চাহিদা বেশ বেড়েছে। আর পণ্যের চাহিদা বাড়া মানেই তো উৎপাদন বাড়া। কিন্তু তাই কি? দুয়ে দুয়ে চার? নির্ভুল অঙ্ক? যদি তেমনটাই ঘটত, তবে আমাদের জন্য আনন্দের অবধি থাকত না। কারণ উৎপাদন বাড়া মানেই তো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু সেটা কি ঘটছে? বিদেশি পণ্যে কি বাজার ছেয়ে যায়নি? যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলোর উৎপাদক কোম্পানির বেশির ভাগের মালিকানা ইতিমধ্যেই কি বিদেশিদের হাতে চলে যায়নি? অন্যরাও কি যাওয়ার পথে উন্মুখ হয়ে নেই? সর্বোপরি উৎপাদন এবং ক্রয়-বিক্রয়ের মুনাফাটা যাচ্ছে কোথায়? বড় একটা অংশই তো পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে।
শিল্পোদ্যোক্তাদের একজনকে জানি ব্যক্তিগতভাবে যিনি অত্যন্ত সজ্জন, পাচারে বিশ্বাসী নন। তিনি একটি বই লিখেছেন, যাতে দেশের যে উন্নতি হচ্ছে তার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবৃদ্ধির। একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকের প্রদত্ত তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের হার অতি শিগগিরই ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। হয়তো তা-ই ঘটবে। কিন্তু এই উত্থানে উৎফুল্ল হব, বুকের এমন পাটা কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নেই। কারণ এই উন্নতির অর্থ দাঁড়াবে একদিকে দেশের সম্পদ পাচার হওয়া, অন্যদিকে বেকার ও দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি। উচ্চবিত্তরা তাদের সম্পদ তো বটেই, এমনকি সন্তানদেরও দেশে রাখবে না; ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে শিক্ষার জন্য বিদেশে গমনার্থীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। একটি পত্রিকা জানাচ্ছে, গত ১০ বছরে ওই স্রোত দ্বিগুণ পরিমাণে স্ফীত ও বেগবান হয়েছে। পাশাপাশি এটাও আমাদের জানা আছে যে বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আসা ক্রমাগত কমছে।
নির্মম সত্যটা হলো যতই উন্নতি ঘটছে, ততই কমছে দেশপ্রেম। তাই বলে দেশপ্রেম কি একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে? না, মোটেই নয়। দেশপ্রেম অবশ্যই আছে। বিশেষভাবে আছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধ্যে। তারা অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করবে, এমনটা ভাবতেই পারে না। বেশির ভাগই দেশে থাকে। পরিশ্রম করে এবং তাদের শ্রমের কারণেই দেশের যেটুকু উন্নতি তা সম্ভব হয়েছে। ভোক্তারা নয়, মেহনতিরাই হচ্ছে উন্নতির চাবিকাঠি। ঋণ করে, জায়গাজমি বেচে দিয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের কেউ কেউ বিদেশে যায়; থাকার জন্য নয়, উপার্জন করে টাকা দেশে পাঠাবে বলে। বিদেশে গিয়ে অনেকেই অমানবিক জীবনযাপন করে, ‘অবৈধ’ পথে গিয়ে এবং প্রতারকদের কবলে পড়ে কেউ কেউ জেল পর্যন্ত খাটে। কিন্তু তারা বুক বাঁধে এই আশায় যে দেশে তাদের আপনজনেরা খেয়েপরে বাঁচতে পারবে।
বিত্তবানেরা যা ছড়ায় তা হলো হতাশা। এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এটাই তাদের স্থির বিশ্বাস। হতাশা কিন্তু তারাই সৃষ্টি করে।
বিশেষভাবে করে সম্পদ পাচার করার মধ্য দিয়ে। এই যে দেশে এখন ডলার-সংকট চলছে এবং যার ফলে সবকিছুর দাম বেড়েছে, তার প্রধান কারণ টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটা বিত্তবানদের কাজ। তারাই হতাশা সৃষ্টি করে এবং দেশের ভবিষ্যৎহীনতার বিশ্বাস ক্রমাগত বলীয়ান হতে থাকে এবং নিজেদের ওই হতাশা তারা যে কেবল নিজেদের মধ্যেই আটকে রাখে তা নয়, অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত করে দেয়। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ হতাশা হচ্ছে একটি রোগ, শুধু রোগ নয়, সংক্রামক রোগ বটে।
একাত্তরে যখন আমরা চরমতম বিপদের মধ্যে ছিলাম, মৃত্যুর শঙ্কায় দিবারাত্র সন্ত্রস্ত থাকতাম, তখন অমন চরমতম বিপদ ও সীমাহীন অত্যাচারের মুখেও আমরা কিন্তু হতাশ হইনি; কারণ আমরা জানতাম, আমরা কেউ একা নই, আমরা সবাই আছি একসঙ্গে এবং লড়ছি একত্র হয়ে। ১৬ ডিসেম্বরেই কিন্তু সেই ঐক্যটা ভাঙার লক্ষণ দেখা দিয়েছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে একেবারে খান খান হয়ে গেছে। সমষ্টি হারিয়ে গেছে, সত্য হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে উন্নতি করা, না পারলে কোনোমতে বেঁচে থাকা।
এমনটা কেন ঘটল? ঘটল এই কারণে যে উত্থান ঘটল লুণ্ঠনের, জবরদখলের, ব্যক্তিগত সুবিধা বৃদ্ধির এবং এসবই প্রধান সত্য হয়ে দাঁড়াল। একাত্তরে আমরা সমাজতন্ত্রী হয়েছিলাম, বাহাত্তরে দেখা গেল সমাজতন্ত্র বিদায় নিচ্ছে, পুঁজিবাদ এসে গেছে এবং পুঁজিবাদেরই অব্যাহত বিকাশ ঘটেছে এই বাংলাদেশে। দেখা গেছে, পরের সরকার আগেরটির তুলনায় অধিক মাত্রায় পুঁজিবাদী এবং একই সরকার যদি টিকে থাকে, তবে আগের বারের তুলনায় পরের বার পুঁজিবাদের জন্য অধিকতর ছাড় দিচ্ছে। পুঁজিবাদের বিকাশের প্রয়োজনে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার জন্য তো আমরা যুদ্ধ করিনি; পুঁজিবাদের বিকাশ তো পাকিস্তান আমলে বেশ গোছগাছ করেই এগোচ্ছিল। আমরা চেয়েছিলাম সবার মুক্তি; চেয়েছিলাম প্রত্যেকেই যাতে মুক্তি পায়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
তিনটিই সত্য—উন্নতি যে ঘটেছে, সেটা কোনো মিথ্যাবাদীরই সাহস হবে না অস্বীকার করতে; উত্থান ঘটেছে নানা মাত্রায় ও বিভিন্ন প্রকারে; অভ্যুত্থানও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি একাধিক। যে বিদেশিরা আমাদের পছন্দ করেন, তাঁরা অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ যে কেবল উন্নতি করেই ক্ষান্ত হয়েছে তা নয়, দারিদ্র্য ঘুচিয়ে কীভাবে উন্নত হওয়া যায় তার অনুকরণীয় একটি দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে।
উন্নতির চেহারা ঢাকা শহরে বের হলেই হাতেনাতে চোখে-স্পর্শে টের পাওয়া যায়। বাইরে থেকে কয়েক বছর পর, এমনকি এক বছর পরেও যাঁরা আসেন, তাঁরা এমন সব উন্নতি দেখেন যে চিনতে পারেন না, কোথায় এলেন। তবে যাতায়াতটা ভারী কষ্টের। মেট্রো এসেছে, তাতে কারও কারও খুবই সুবিধা হয়েছে। খরচ কিছুটা বেশি, তবু সময় তো বাঁচে। তবে মেট্রোতেও দেখা যাচ্ছে সময়-সময় অচল অবস্থা।
ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল ছেলেরা, সেই ঘুড়ি ছুটে এসে মেট্রোর বিদ্যুতের তারে গিয়ে পড়ে রীতিমতো বিপর্যয় ঘটিয়েছে। যারা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল, তারা যে ষড়যন্ত্রকারী, উন্নয়নে বিঘ্ন ঘটানোই যে তাদের উদ্দেশ্য—এমনটা বোধ হয় নয়। তবু অপরাধ তো করে ফেলেছে, শাস্তি না দিলে ওই কাজ আরও ঘটবে; শুনলাম দুজন অপরাধীকে তাই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এমনিতে ঘুড়ি ওড়ানো অবশ্য কোনো অপরাধ নয়; বরং ভালো কাজই বলা চলে। নিরীহ বিনোদন। কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হয়ে খুনোখুনি করা, ছিনতাই প্রভৃতি বদমাইশি কর্মে লিপ্ত হওয়া এবং মাদকের আসর বসানোর তুলনায় অনেক বেশি সুস্থ কাজ। আমাদের উচিত, ঘুড়ি ওড়ানোতে উৎসাহ দান করা। কিন্তু ঘুড়ি ওড়াবে কোথায়? খোলা মাঠ কই? ঢাকা শহরে বড় বড় পার্কের বেশির ভাগই চলে গেছে লিমিটেড কোম্পানির মালিকানায়, যেখানে কিশোর তো দূরের কথা, প্রবীণদেরও প্রবেশাধিকার নেই। বাকি পার্কের অধিকাংশের বেলাতেই কিশোরেরা প্রবেশাধিকার পায় না। ঘুড়ি ওড়ানো তো স্বর্গীয় কল্পনা। ছাদে উঠে ওড়াবে? আগের দিনে সেটা কিছুটা সম্ভব ছিল; এখন উন্নত শহরে সেটা অত্যন্ত দুষ্কর। আর ওই যে ওড়াতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনা, অপরাধী হওয়া, জেল খাটা, এসব তো ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য নতুন নিষেধাজ্ঞা। সবটাই কিন্তু ঘটছে উন্নতির কারণে। ঘুড়ি ওড়ানোটা অপরাধ নাকি ওড়াতে না-দেওয়া এবং ওড়ানোটাকে বিপজ্জনক কাজ করে তোলাটা অপরাধ, এই বিচারটা কে করবে? উন্নয়ন, নাকি রাষ্ট্র? উন্নয়ন তো ঘটে রাষ্ট্রের হুকুমেই।
উন্নতির কাছে আমাদের প্রত্যাশাটা কী? অবশ্যই সুখ। কিন্তু উন্নয়ন কেবল যে নদীর গলা টিপে ধরছে বা বনভূমি উজাড় করে দিচ্ছে শুধু তা-ই নয়, নাগরিকদের সুখও কেড়ে নিচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় গত এক বছরে প্রাণ হারিয়েছে ৬ হাজার ৫২৪ জন। খবর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের। এ হিসাব সঠিক নয় বলে কেউ কেউ বলেন। তাঁদের বক্তব্য, প্রাণহানির সংখ্যা আরও বেশি। সব ঘটনা খবরে আসে না।
আশাবাদী হওয়াটা খুবই দরকার, আশাবাদী হতে যাঁরা আগ্রহী করছেন, তাঁরা উন্নতির বিষয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারেন এটা লক্ষ করে যে দেশে বড় একটা ভোক্তা শ্রেণির উত্থান ঘটেছে। তাতে বাংলাদেশে পণ্যের চাহিদা বেশ বেড়েছে। আর পণ্যের চাহিদা বাড়া মানেই তো উৎপাদন বাড়া। কিন্তু তাই কি? দুয়ে দুয়ে চার? নির্ভুল অঙ্ক? যদি তেমনটাই ঘটত, তবে আমাদের জন্য আনন্দের অবধি থাকত না। কারণ উৎপাদন বাড়া মানেই তো কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু সেটা কি ঘটছে? বিদেশি পণ্যে কি বাজার ছেয়ে যায়নি? যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলোর উৎপাদক কোম্পানির বেশির ভাগের মালিকানা ইতিমধ্যেই কি বিদেশিদের হাতে চলে যায়নি? অন্যরাও কি যাওয়ার পথে উন্মুখ হয়ে নেই? সর্বোপরি উৎপাদন এবং ক্রয়-বিক্রয়ের মুনাফাটা যাচ্ছে কোথায়? বড় একটা অংশই তো পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে।
শিল্পোদ্যোক্তাদের একজনকে জানি ব্যক্তিগতভাবে যিনি অত্যন্ত সজ্জন, পাচারে বিশ্বাসী নন। তিনি একটি বই লিখেছেন, যাতে দেশের যে উন্নতি হচ্ছে তার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবৃদ্ধির। একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকের প্রদত্ত তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানের হার অতি শিগগিরই ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। হয়তো তা-ই ঘটবে। কিন্তু এই উত্থানে উৎফুল্ল হব, বুকের এমন পাটা কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নেই। কারণ এই উন্নতির অর্থ দাঁড়াবে একদিকে দেশের সম্পদ পাচার হওয়া, অন্যদিকে বেকার ও দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি। উচ্চবিত্তরা তাদের সম্পদ তো বটেই, এমনকি সন্তানদেরও দেশে রাখবে না; ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে শিক্ষার জন্য বিদেশে গমনার্থীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। একটি পত্রিকা জানাচ্ছে, গত ১০ বছরে ওই স্রোত দ্বিগুণ পরিমাণে স্ফীত ও বেগবান হয়েছে। পাশাপাশি এটাও আমাদের জানা আছে যে বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আসা ক্রমাগত কমছে।
নির্মম সত্যটা হলো যতই উন্নতি ঘটছে, ততই কমছে দেশপ্রেম। তাই বলে দেশপ্রেম কি একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেছে? না, মোটেই নয়। দেশপ্রেম অবশ্যই আছে। বিশেষভাবে আছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধ্যে। তারা অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করবে, এমনটা ভাবতেই পারে না। বেশির ভাগই দেশে থাকে। পরিশ্রম করে এবং তাদের শ্রমের কারণেই দেশের যেটুকু উন্নতি তা সম্ভব হয়েছে। ভোক্তারা নয়, মেহনতিরাই হচ্ছে উন্নতির চাবিকাঠি। ঋণ করে, জায়গাজমি বেচে দিয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের কেউ কেউ বিদেশে যায়; থাকার জন্য নয়, উপার্জন করে টাকা দেশে পাঠাবে বলে। বিদেশে গিয়ে অনেকেই অমানবিক জীবনযাপন করে, ‘অবৈধ’ পথে গিয়ে এবং প্রতারকদের কবলে পড়ে কেউ কেউ জেল পর্যন্ত খাটে। কিন্তু তারা বুক বাঁধে এই আশায় যে দেশে তাদের আপনজনেরা খেয়েপরে বাঁচতে পারবে।
বিত্তবানেরা যা ছড়ায় তা হলো হতাশা। এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এটাই তাদের স্থির বিশ্বাস। হতাশা কিন্তু তারাই সৃষ্টি করে।
বিশেষভাবে করে সম্পদ পাচার করার মধ্য দিয়ে। এই যে দেশে এখন ডলার-সংকট চলছে এবং যার ফলে সবকিছুর দাম বেড়েছে, তার প্রধান কারণ টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এটা বিত্তবানদের কাজ। তারাই হতাশা সৃষ্টি করে এবং দেশের ভবিষ্যৎহীনতার বিশ্বাস ক্রমাগত বলীয়ান হতে থাকে এবং নিজেদের ওই হতাশা তারা যে কেবল নিজেদের মধ্যেই আটকে রাখে তা নয়, অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত করে দেয়। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ হতাশা হচ্ছে একটি রোগ, শুধু রোগ নয়, সংক্রামক রোগ বটে।
একাত্তরে যখন আমরা চরমতম বিপদের মধ্যে ছিলাম, মৃত্যুর শঙ্কায় দিবারাত্র সন্ত্রস্ত থাকতাম, তখন অমন চরমতম বিপদ ও সীমাহীন অত্যাচারের মুখেও আমরা কিন্তু হতাশ হইনি; কারণ আমরা জানতাম, আমরা কেউ একা নই, আমরা সবাই আছি একসঙ্গে এবং লড়ছি একত্র হয়ে। ১৬ ডিসেম্বরেই কিন্তু সেই ঐক্যটা ভাঙার লক্ষণ দেখা দিয়েছে এবং কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে একেবারে খান খান হয়ে গেছে। সমষ্টি হারিয়ে গেছে, সত্য হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে উন্নতি করা, না পারলে কোনোমতে বেঁচে থাকা।
এমনটা কেন ঘটল? ঘটল এই কারণে যে উত্থান ঘটল লুণ্ঠনের, জবরদখলের, ব্যক্তিগত সুবিধা বৃদ্ধির এবং এসবই প্রধান সত্য হয়ে দাঁড়াল। একাত্তরে আমরা সমাজতন্ত্রী হয়েছিলাম, বাহাত্তরে দেখা গেল সমাজতন্ত্র বিদায় নিচ্ছে, পুঁজিবাদ এসে গেছে এবং পুঁজিবাদেরই অব্যাহত বিকাশ ঘটেছে এই বাংলাদেশে। দেখা গেছে, পরের সরকার আগেরটির তুলনায় অধিক মাত্রায় পুঁজিবাদী এবং একই সরকার যদি টিকে থাকে, তবে আগের বারের তুলনায় পরের বার পুঁজিবাদের জন্য অধিকতর ছাড় দিচ্ছে। পুঁজিবাদের বিকাশের প্রয়োজনে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার জন্য তো আমরা যুদ্ধ করিনি; পুঁজিবাদের বিকাশ তো পাকিস্তান আমলে বেশ গোছগাছ করেই এগোচ্ছিল। আমরা চেয়েছিলাম সবার মুক্তি; চেয়েছিলাম প্রত্যেকেই যাতে মুক্তি পায়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে