মাসুদ উর রহমান
নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে রীতিমতো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বিপক্ষেই বেশি হচ্ছে। পক্ষে যা হচ্ছে তা অবস্থাদৃষ্টে বিপক্ষ দলকে ডিফেন্ড করারই যেন ক্ষীণ প্রচেষ্টা। এ নিয়ে আগেও জাতীয় পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখেছি।অনেকেই লিখেছেন, লিখছেন। আসলে এ দেশে লেখালেখিতে খুব একটা কাজ হয় না। কর্তার ইচ্ছাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে কাটাছেঁড়া তো আর কম হয়নি, কিন্তু সাফল্য কই? মূলত তাড়াহুড়া আর বাস্তবতার নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ না করে অনেকটা কাচবেষ্টিত শীতল কক্ষের কাল্পনিক পরিকল্পনা হচ্ছে বলেই কি এমনটি হচ্ছে? ২০০১ সালে হঠাৎ করেই ঠিক মাধ্যমিক পরীক্ষার আগমুহূর্তে নম্বর পদ্ধতি বাদ দিয়ে গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফলাফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। প্রথমবার সারা দেশে এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।
এরপর লাফিয়ে লাফিয়ে সেই এ প্লাস বাড়তে বাড়তে একসময় লাখ ছাড়িয়ে গেল। বর্তমানে এ প্লাসের সামাজিক মূল্যায়ন এমন পর্যায়ে যে অভিভাবকেরা এ প্লাস না বলে ফেবুতে পোস্ট দেন শুধু ‘আলহামদুলিল্লাহ’ কিংবা ‘কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে!’ রেজাল্টের এই সর্বোচ্চ মানদণ্ডের হাজার হাজার এ প্লাস পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন দূরে থাক, পাস নম্বরই পাচ্ছে না।
এরও আগে ১৯৯২ সালে চালু হয় পঞ্চাশ নম্বরের এমসিকিউ। পরীক্ষার দিন সকালে নির্দিষ্ট পাঁচ শ এমসিকিউয়ে চোখ বুলিয়ে গেলেই পাস মিলেছে। শুধু তা-ই না, কিছু না পড়ে এমনকি লিখিত পঞ্চাশ নম্বরে শূন্য পেয়ে এমসিকিউতে আন্দাজে গোল্লা ভরাট করে এসএসসিতে সে বছর পাস করেছিল প্রায় শতভাগ! টনক নড়ল দুই বছর পর, যখন পাসের হার এইচএসসিতে গিয়ে দাঁড়াল ১৮ শতাংশ!
গ্রেডিং সিস্টেমের লেটার গ্রেড দিয়ে যখন শিক্ষার্থীদের মেধা ঠিকভাবে যাচাই করা যাচ্ছিল না, তখন গ্রেডের পাশাপাশি আবার নম্বর ফেরত এল। যা এখন চলমান। প্রায় এক যুগ আগে শিক্ষকদের সৃজন করার ব্যবস্থা না করে হঠাৎ করেই চালু হয়ে গেল সৃজনশীল পদ্ধতি।
কেউ কেউ সৃজনশীল হওয়ার জন্য পেলেন মাত্র তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণ। বারো বছর পর যখন সৃজনশীল পদ্ধতি বন্ধ হওয়ার কথাবার্তা চলছে, তখনো কার্যকর প্রশিক্ষণের অভাবে শিক্ষকদের অনেকেই সৃজনশীল পদ্ধতি ঠিক কী তা বুঝতে অপারগই রয়ে গেছেন বোধ করি!
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে মমতামাখা বুলিতে আমরা বলি মাতৃভূমি তথা মাদারল্যান্ড। সেই মাদারল্যান্ড হঠাৎই শিক্ষায় তুলনীয় হয়ে গেল ফিনল্যান্ডের! কথায় আছে না, কোথায় আসমানতলা আর কোথায় জমিনতলা! শুনতে খারাপ লাগলেও শ্রেণিকক্ষের বিচারে, শিক্ষকদের শিক্ষাদানের যোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা আর আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এই তুলনার জন্য যথার্থ।
সার্বিক বিচারে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা যোগ্য বলে বিবেচিত, কিন্তু বিসিএস নামক পরীক্ষাপদ্ধতির জন্য অনেকের চোখে শিক্ষাদানের যোগ্যতায় তাঁরা প্রশ্নবিদ্ধ। ফিনল্যান্ডের বিচারে তো অবশ্যই। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হতে গেলেই ফিনল্যান্ডের শিক্ষা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করার পাশাপাশি ‘পেডেগজি’ এবং চাইন্ড সাইকোলজির ওপর পড়াশোনা থাকতে হয়।
পেডেগজি হলো শিল্প, বিজ্ঞান বা শিক্ষাদানের পেশা। ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের সম্মান ও বেতন দুটোই যেহেতু বিশ্বসেরা, সেহেতু ক্লাসের সেরা শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দই থাকে শিক্ষক হওয়া। বিপরীতে আমাদের দেশের চিত্রটি একটু ভাবুন!
শিক্ষা এখানে পণ্য। পণ্যের পৃথিবীতে যেকোনো কাজ এবং সেই কাজের ফলকে যেমন লাভ-ক্ষতির মূল্যে বিচার করা হয়, শিক্ষাও হয়ে দাঁড়াল লাভ-ক্ষতির একটা যোগফলবিশেষ। অবশ্য আরও স্পষ্ট করে বললে পণ্যের পৃথিবীতে লোকসানের ঝুঁকি থাকলেও শিক্ষা-বাণিজ্যে সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আর তাই তো ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অর্থ আর ক্ষমতার যোগসূত্রে বোর্ড থেকে একটি ইআইআইএন নম্বর জোগাড় করতে পারলেই কেল্লা ফতে! আর প্রাইমারিতে তো সেসবেরও দরকার নেই।
সরকারি প্রাইমারি স্কুল আর এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের নিয়োগ-প্রক্রিয়া এখন একটা মানদণ্ডে পৌঁছেছে। বলা ভালো, বাংলাদেশি মানদণ্ড! কিন্তু বাকিগুলোতে? সংখ্যার বিচারে বাকিগুলোই সর্বাধিক। এদের হয়তো শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা আছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোনো তদারকি নেই। সেই কর্তৃপক্ষের কাছে সবচেয়ে অযোগ্য এখানে যোগ্য বলে বিবেচিত হন, কেননা তাঁকে দিয়ে যাচ্ছেতাই করানো যাবে! কোনো প্রতিক্রিয়া প্রতিবাদ যেমন আসবে না, বেতনও অনেক কম দিয়ে রাখা যাবে।
যাঁদের নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় কিছুটা মানদণ্ড অর্জিত হয়েছে, সেই সরকারি প্রাইমারি আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা কি রাখেন নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের যোগ্যতা? আছে কোনো স্বকীয়তা, স্বাধীনতা? কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক মালিক-শ্রমিকের সমতুল্য।আগে এমনকি আমাদের সময়েও গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসগুলো নিতেন প্রতিষ্ঠানপ্রধানেরা। এখন তাঁদের অধিকাংশ ক্লাসের ধারেকাছেও যান না।
শিক্ষক পরিচয়ের বদলে কর্মকর্তা পরিচয়ে স্বস্তিবোধ করেন। নিজেকে প্রশাসক জ্ঞান করে কমিটি (যাঁদের অধিকাংশ সদস্য সরকারদলীয়) ও কিছু মেরুদণ্ডহীন শিক্ষককে ভাগে নিয়ে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে যান। তাঁদের একমাত্র চাওয়া সকাল ৯টায় ঢুকে ৪টায় বের হওয়া।
তথাকথিত ম্যানেজিং কমিটি ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কাছে পাঠদানের কোনো মূল্য নেই। ক্লাস থাকুক বা না থাকুক নির্মাণশ্রমিকের মতোই হাজিরা পূর্ণ করতে হয় শিক্ষকদের। এই ডিসেম্বরে প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস-পরীক্ষা কিছুই নেই কিন্তু শিক্ষকদের ৯টা-৪টায় স্কুল পাহারায় থাকতে হয়। যে আমলাতান্ত্রিক মোটা বুদ্ধি শিক্ষককে গতরে খাটিয়ে পুষিয়ে নেওয়ার মানসিকতা পোষণ করে, সেখানে নিজেকে সৃজন করার সুযোগ থাকে কেমন করে?
শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থান আর আর্থিক সুযোগের কথা যদি বলি—মর্যাদায় তৃতীয় শ্রেণি আর আর্থিক সুবিধালাভে নির্মাণশ্রমিক, পোশাকশ্রমিক এমনকি সরকারি অফিসের ড্রাইভারের চেয়েও পিছিয়ে। সে কারণেই সায়ীদ স্যার অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই বলেছেন—যে সমাজে উকিল, দারোগা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, কেরানি এমনকি সরকারি অফিসের পিয়নের চাকরিটি যিনি জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেই সমাজে তিনি আজ মহান পেশায় অবতীর্ণ। শিক্ষকতা এখন তাঁর গর্বিত পেশা!
নতুন শিক্ষা কারিকুলামে ততটুকু ক্ষতি হয়তো হবে না, যতটুকু অপপ্রচার হচ্ছে। বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ থেকে বেরিয়ে আসবে, আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে কর্মে সৃজন লাভ করবে। কিংবা এআই প্রযুক্তিনির্ভর কমিউটারের সিমুলেশন, রোবট, বৈদ্যুতিক সার্কিট, গ্রিনহাউস, প্রাণিকুলের বাস্তুভিটা, আগামী দিনের বিকল্প জ্বালানির মডেল নির্মাণ করবে, শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু বাস্তবে তার কতটুকু হচ্ছে বা হওয়ার মতো অবকাঠামোগত পরিবেশ বা প্রশিক্ষক কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি?
পূর্বোক্ত প্রতিটি পরিকল্পনায়ও এমন আশার ফানুস ছিল, কিন্তু আমরা তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি বলেই সেই ফানুস উড়তে ব্যর্থ হয়েছে। আবারও ব্যর্থ হলে তার মাশুল গুনতে হবে বহুগুণে। কাজেই এত এত অসংগতি ও সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় না নিয়ে এগিয়ে গেলে এই ব্যর্থতা-বিতর্ক চলতেই থাকবে।
লেখক: কলেজশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে রীতিমতো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বিপক্ষেই বেশি হচ্ছে। পক্ষে যা হচ্ছে তা অবস্থাদৃষ্টে বিপক্ষ দলকে ডিফেন্ড করারই যেন ক্ষীণ প্রচেষ্টা। এ নিয়ে আগেও জাতীয় পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখেছি।অনেকেই লিখেছেন, লিখছেন। আসলে এ দেশে লেখালেখিতে খুব একটা কাজ হয় না। কর্তার ইচ্ছাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে কাটাছেঁড়া তো আর কম হয়নি, কিন্তু সাফল্য কই? মূলত তাড়াহুড়া আর বাস্তবতার নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ না করে অনেকটা কাচবেষ্টিত শীতল কক্ষের কাল্পনিক পরিকল্পনা হচ্ছে বলেই কি এমনটি হচ্ছে? ২০০১ সালে হঠাৎ করেই ঠিক মাধ্যমিক পরীক্ষার আগমুহূর্তে নম্বর পদ্ধতি বাদ দিয়ে গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফলাফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। প্রথমবার সারা দেশে এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।
এরপর লাফিয়ে লাফিয়ে সেই এ প্লাস বাড়তে বাড়তে একসময় লাখ ছাড়িয়ে গেল। বর্তমানে এ প্লাসের সামাজিক মূল্যায়ন এমন পর্যায়ে যে অভিভাবকেরা এ প্লাস না বলে ফেবুতে পোস্ট দেন শুধু ‘আলহামদুলিল্লাহ’ কিংবা ‘কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে!’ রেজাল্টের এই সর্বোচ্চ মানদণ্ডের হাজার হাজার এ প্লাস পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন দূরে থাক, পাস নম্বরই পাচ্ছে না।
এরও আগে ১৯৯২ সালে চালু হয় পঞ্চাশ নম্বরের এমসিকিউ। পরীক্ষার দিন সকালে নির্দিষ্ট পাঁচ শ এমসিকিউয়ে চোখ বুলিয়ে গেলেই পাস মিলেছে। শুধু তা-ই না, কিছু না পড়ে এমনকি লিখিত পঞ্চাশ নম্বরে শূন্য পেয়ে এমসিকিউতে আন্দাজে গোল্লা ভরাট করে এসএসসিতে সে বছর পাস করেছিল প্রায় শতভাগ! টনক নড়ল দুই বছর পর, যখন পাসের হার এইচএসসিতে গিয়ে দাঁড়াল ১৮ শতাংশ!
গ্রেডিং সিস্টেমের লেটার গ্রেড দিয়ে যখন শিক্ষার্থীদের মেধা ঠিকভাবে যাচাই করা যাচ্ছিল না, তখন গ্রেডের পাশাপাশি আবার নম্বর ফেরত এল। যা এখন চলমান। প্রায় এক যুগ আগে শিক্ষকদের সৃজন করার ব্যবস্থা না করে হঠাৎ করেই চালু হয়ে গেল সৃজনশীল পদ্ধতি।
কেউ কেউ সৃজনশীল হওয়ার জন্য পেলেন মাত্র তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণ। বারো বছর পর যখন সৃজনশীল পদ্ধতি বন্ধ হওয়ার কথাবার্তা চলছে, তখনো কার্যকর প্রশিক্ষণের অভাবে শিক্ষকদের অনেকেই সৃজনশীল পদ্ধতি ঠিক কী তা বুঝতে অপারগই রয়ে গেছেন বোধ করি!
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে মমতামাখা বুলিতে আমরা বলি মাতৃভূমি তথা মাদারল্যান্ড। সেই মাদারল্যান্ড হঠাৎই শিক্ষায় তুলনীয় হয়ে গেল ফিনল্যান্ডের! কথায় আছে না, কোথায় আসমানতলা আর কোথায় জমিনতলা! শুনতে খারাপ লাগলেও শ্রেণিকক্ষের বিচারে, শিক্ষকদের শিক্ষাদানের যোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা আর আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এই তুলনার জন্য যথার্থ।
সার্বিক বিচারে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা যোগ্য বলে বিবেচিত, কিন্তু বিসিএস নামক পরীক্ষাপদ্ধতির জন্য অনেকের চোখে শিক্ষাদানের যোগ্যতায় তাঁরা প্রশ্নবিদ্ধ। ফিনল্যান্ডের বিচারে তো অবশ্যই। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হতে গেলেই ফিনল্যান্ডের শিক্ষা বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করার পাশাপাশি ‘পেডেগজি’ এবং চাইন্ড সাইকোলজির ওপর পড়াশোনা থাকতে হয়।
পেডেগজি হলো শিল্প, বিজ্ঞান বা শিক্ষাদানের পেশা। ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের সম্মান ও বেতন দুটোই যেহেতু বিশ্বসেরা, সেহেতু ক্লাসের সেরা শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দই থাকে শিক্ষক হওয়া। বিপরীতে আমাদের দেশের চিত্রটি একটু ভাবুন!
শিক্ষা এখানে পণ্য। পণ্যের পৃথিবীতে যেকোনো কাজ এবং সেই কাজের ফলকে যেমন লাভ-ক্ষতির মূল্যে বিচার করা হয়, শিক্ষাও হয়ে দাঁড়াল লাভ-ক্ষতির একটা যোগফলবিশেষ। অবশ্য আরও স্পষ্ট করে বললে পণ্যের পৃথিবীতে লোকসানের ঝুঁকি থাকলেও শিক্ষা-বাণিজ্যে সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আর তাই তো ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অর্থ আর ক্ষমতার যোগসূত্রে বোর্ড থেকে একটি ইআইআইএন নম্বর জোগাড় করতে পারলেই কেল্লা ফতে! আর প্রাইমারিতে তো সেসবেরও দরকার নেই।
সরকারি প্রাইমারি স্কুল আর এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের নিয়োগ-প্রক্রিয়া এখন একটা মানদণ্ডে পৌঁছেছে। বলা ভালো, বাংলাদেশি মানদণ্ড! কিন্তু বাকিগুলোতে? সংখ্যার বিচারে বাকিগুলোই সর্বাধিক। এদের হয়তো শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা আছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোনো তদারকি নেই। সেই কর্তৃপক্ষের কাছে সবচেয়ে অযোগ্য এখানে যোগ্য বলে বিবেচিত হন, কেননা তাঁকে দিয়ে যাচ্ছেতাই করানো যাবে! কোনো প্রতিক্রিয়া প্রতিবাদ যেমন আসবে না, বেতনও অনেক কম দিয়ে রাখা যাবে।
যাঁদের নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় কিছুটা মানদণ্ড অর্জিত হয়েছে, সেই সরকারি প্রাইমারি আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা কি রাখেন নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের যোগ্যতা? আছে কোনো স্বকীয়তা, স্বাধীনতা? কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক মালিক-শ্রমিকের সমতুল্য।আগে এমনকি আমাদের সময়েও গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসগুলো নিতেন প্রতিষ্ঠানপ্রধানেরা। এখন তাঁদের অধিকাংশ ক্লাসের ধারেকাছেও যান না।
শিক্ষক পরিচয়ের বদলে কর্মকর্তা পরিচয়ে স্বস্তিবোধ করেন। নিজেকে প্রশাসক জ্ঞান করে কমিটি (যাঁদের অধিকাংশ সদস্য সরকারদলীয়) ও কিছু মেরুদণ্ডহীন শিক্ষককে ভাগে নিয়ে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে যান। তাঁদের একমাত্র চাওয়া সকাল ৯টায় ঢুকে ৪টায় বের হওয়া।
তথাকথিত ম্যানেজিং কমিটি ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কাছে পাঠদানের কোনো মূল্য নেই। ক্লাস থাকুক বা না থাকুক নির্মাণশ্রমিকের মতোই হাজিরা পূর্ণ করতে হয় শিক্ষকদের। এই ডিসেম্বরে প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস-পরীক্ষা কিছুই নেই কিন্তু শিক্ষকদের ৯টা-৪টায় স্কুল পাহারায় থাকতে হয়। যে আমলাতান্ত্রিক মোটা বুদ্ধি শিক্ষককে গতরে খাটিয়ে পুষিয়ে নেওয়ার মানসিকতা পোষণ করে, সেখানে নিজেকে সৃজন করার সুযোগ থাকে কেমন করে?
শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থান আর আর্থিক সুযোগের কথা যদি বলি—মর্যাদায় তৃতীয় শ্রেণি আর আর্থিক সুবিধালাভে নির্মাণশ্রমিক, পোশাকশ্রমিক এমনকি সরকারি অফিসের ড্রাইভারের চেয়েও পিছিয়ে। সে কারণেই সায়ীদ স্যার অনেকটা তাচ্ছিল্য করেই বলেছেন—যে সমাজে উকিল, দারোগা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, কেরানি এমনকি সরকারি অফিসের পিয়নের চাকরিটি যিনি জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেই সমাজে তিনি আজ মহান পেশায় অবতীর্ণ। শিক্ষকতা এখন তাঁর গর্বিত পেশা!
নতুন শিক্ষা কারিকুলামে ততটুকু ক্ষতি হয়তো হবে না, যতটুকু অপপ্রচার হচ্ছে। বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ থেকে বেরিয়ে আসবে, আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে কর্মে সৃজন লাভ করবে। কিংবা এআই প্রযুক্তিনির্ভর কমিউটারের সিমুলেশন, রোবট, বৈদ্যুতিক সার্কিট, গ্রিনহাউস, প্রাণিকুলের বাস্তুভিটা, আগামী দিনের বিকল্প জ্বালানির মডেল নির্মাণ করবে, শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু বাস্তবে তার কতটুকু হচ্ছে বা হওয়ার মতো অবকাঠামোগত পরিবেশ বা প্রশিক্ষক কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি?
পূর্বোক্ত প্রতিটি পরিকল্পনায়ও এমন আশার ফানুস ছিল, কিন্তু আমরা তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি বলেই সেই ফানুস উড়তে ব্যর্থ হয়েছে। আবারও ব্যর্থ হলে তার মাশুল গুনতে হবে বহুগুণে। কাজেই এত এত অসংগতি ও সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় না নিয়ে এগিয়ে গেলে এই ব্যর্থতা-বিতর্ক চলতেই থাকবে।
লেখক: কলেজশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৬ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে