জাহীদ রেজা নূর
দ্বিতীয় পর্ব
বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে যে আলোচনা হয়, তাতে এই ভাষায় নিজেকে ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারছি কি পারছি না, সে আলোচনা হয় কম। আমরা অকারণেই প্রমিত-অপ্রমিত ভাষা নিয়ে বেশি বাক্যব্যয় করি। মূলত সেটা বাংলা ভাষার মূল সংকট নয়।
বাংলা ভাষা মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে, হাসপাতালেই তার ভাগ্য নির্ধারিত হবে—এতটা ভয়ংকর কিছু ভাবার কারণ নেই। কিন্তু ভাষা বহন করছে যারা, তাদের ভাষা-শরীরে যে অসুখ এসে জুটেছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। শহুরে শিক্ষিত মানুষ তাদের মুখের ভাষা নিয়ে দ্বিধান্বিত। যে সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে সত্যিই উঁচুদরের খুব বেশি কিছু হচ্ছে কি না, তা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু দেশের খেটে খাওয়া মানুষ এখনো ইংরেজির নাগাল পায়নি বলেই তারা আরও অনেক দিন বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখবে বলে মনে হয়।
কেন একটা ভাষা মরে যায়, সে কথা কমবেশি সবাই জানে। কোনো ভাষার ওপর যখন অন্য ভাষার প্রভাব পড়ে, সেই অন্য ভাষায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দ হয় মানুষ, তখন নিজের ভাষা ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়। আমরা যে জীবনযাপন করছি, তাতে ভাষাকে নান্দনিক করে তোলার প্রয়োজন পড়ে না। যখন মানুষ সেই ভাষায় কিছু বলে, তখনই তো ‘কী বলব’, সেটা প্রধান হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন নিজেকে প্রকাশ করার জন্য ভিন্ন ভাষায় কথা বলা সহজ, তখন কেন নিজের ভাষার শব্দভান্ডার স্ফীত করার প্রক্রিয়ায় জড়াবে মানুষ? নিজের ভাষাকে সম্মান করলে সমাজে একটা স্থান হবে—এ রকম পরিবেশ কি আদৌ সৃষ্টি হয়েছে আমাদের দেশে?
দুই. একটা কেক এসেছিল বাড়িতে। কেকের ওপর লেখা, ‘আবার দেখা হবে’। কেকটা কাটার আগে একজন বললেন, ‘ফের মিলেঙ্গে’ এবং কারও কারও কাছে মনে হলো, ‘ফের মিলেঙ্গে’ কথাটা খুব যায় এই পরিবেশের সঙ্গে। তাহলে ‘আবার দেখা হবে’ কি তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলল?
এখন তো সবাই ‘মিস’ করে। কারও জন্য কারও মন হাহাকার করে ওঠে না। ‘মিস ইউ’ বললেই সব সমস্যা মিটে যায়। তাহলে কি ‘ফের মিলেঙ্গে’ কিংবা ‘মিস ইউ’ বললে ভাষা কলুষিত হয়ে যায়? একেবারেই না। মানুষ কথা বলে যোগাযোগের জন্য। ভাষা শুধু সেই যোগাযোগকে নিবিড় করে। যে যেই ভাষায় অভ্যস্ত, সে সেই ভাষাকেই যোগাযোগের মাধ্যম করে নেয়। এখানে শুধু একটা প্রশ্নই উঠে আসতে পারে—নিজের ভাষায় কেন নিজেকে প্রকাশ করা যাচ্ছে না?
এর একটা কারণ হতে পারে, ইদানীং বন্ধুবান্ধবদের আলোচনায় ব্যাখ্যামূলক কথা খুব কম থাকছে। দু-এক শব্দে উত্তর দেওয়া যায়, কিংবা উত্তর দিতে হলে ভাবার প্রয়োজন হয় না, যান্ত্রিকভাবে তৈরি থাকা উত্তরটাই উঠে আসে ঠোঁটের কিনারে, এমন হলে ভাষাকে আর বেড়ে উঠতে হয় না। যেটুকু বেড়ে উঠেছে, সেটুকুতেই থেমে থাকা যায়। কারণ, নিজেকে প্রকাশ করার ভাষা তখন অন্য কোনো ভাষা। নিজের ভাষা নয়।
তিন. কোনো কোনো ভাষায় কথা বলার লোকই নেই। এমন অনেক ভাষা আছে, যে ভাষায় কথা বলার জন্য বেঁচে আছে কেবল একজন মানুষ। তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন তাঁর ভাষাটা বেঁচে থাকবে পৃথিবীতে। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সে ভাষার মৃত্যু হবে। আমরা তো দেখেছি আগে, শক্তিশালী ভাষার চাপে কীভাবে মরে যায় কিংবা অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে জায়গা করে নেয় দুর্বল ভাষা। যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে ইংরেজি ভাষা এসে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে স্থানীয় ভাষাগুলোকে, সেই বেদনাময় ইতিহাস নিশ্চয় নতুন করে বলতে হবে না। মেক্সিকোকে কীভাবে গ্রাস করে নিল স্প্যানিশ ভাষা—সে গল্পও কি কম বেদনার?
তরুণেরা যদি নিজের ভাষায় কথা না বলে, তাহলে ভাষার ধমনি শুকিয়ে যায়, ভাষা তখন মরে যায়। আচ্ছা, প্রাচীন লাতিন, স্লাভ বা গ্রিকের মতো ভাষাগুলোর এখনকার অবস্থা কী? তাদের প্রতাপের কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি আমরা। গ্রিক ভাষা নিয়ে তো বলাই যায়, প্রাকৃত থেকে ক্রমান্বয়ে বাংলায় রূপান্তরের মতোই প্রাচীন গ্রিক থেকে জন্ম নিয়েছে আধুনিক গ্রিক ভাষা।
প্রাচীন বই-পত্তরের দিকে চোখ রাখলে এখন খুব কম গ্রিক নাগরিকই সেটা পড়তে পারবে, বুঝতে পারবে। আর লাতিন? সে তো পরিবর্তিত হতে হতে ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, রোমিনিয়ানসহ আরও কয়েকটি ভাষার জন্ম দিয়েছে। ইংরেজরাও এখন নিশ্চয় চসারের ভাষায় লেখে না, পড়ে না। প্রাচীন রুশ ভাষা থেকেই তো জন্ম নিয়েছে রুশ, বেলারুশ ও ইউক্রেনীয় ভাষা।
ভাষা-বিলুপ্তির একটা কারণ তো জেনোসাইড। আর এই জেনোসাইডের জন্য মূলত দায়ী উপনিবেশবাদ। এ ব্যাপারেও নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু এক ভাষাভাষী মানুষ অন্য ভাষাভাষী মানুষের ভাষাকে একেবারে বিলুপ্ত করে দিতে পারে, এর চেয়ে বড় নৃশংসতা আর কী হতে পারে? ঊনবিংশ শতকে তাসমানিয়ার ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেল ইউরোপীয় উপনিবেশকারীদের দ্বারা। আফ্রিকার বহু জাতিকেই তাদের ভাষা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ আমাদের সংস্কৃতি, ভাষাকে উচ্ছেদ করতে পারেনি বটে, আমরাই ধীরে ধীরে ইংরেজির কাছে আত্মসমর্পণ করেছি।
চার. সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন পড়তাম, তখন আমার দুই সিরিয়ান বন্ধু ছিল। ফরিদ আর আলী। ওরা জাতিগতভাবে কুর্দি। সে সময় জেনেছিলাম, তুরস্কে কুর্দরা নিজেদের ভাষায় কিছু ছাপাতে পারে না, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিজেদের ভাষা শিক্ষা দিতে পারে না। ফলে নিজেদের মধ্যে কুর্দি ভাষায় কথা বললেও পড়াশোনা চালাতে হয় তুর্কি ভাষায়। ফরিদ আর আলীকেও সিরিয়ায় মূলত পড়াশোনা করতে হয়েছে আরবি ভাষায়। উচ্চশিক্ষায় কুর্দি ভাষার মর্যাদা নেই।
নিজের ভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষা শেখায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেই নতুন ভাষা যখন নিজের ভাষাকে একেবারেই অচল করে দেয়, তখন তা হয়ে ওঠে ভয়ংকর। ভাষা সচল না থাকলে তা মানুষের ইতিহাস আর সংস্কৃতিকেও ভুলিয়ে দেয়। এবার একটি অন্য রকম খবরের সঙ্গে পরিচিত হই। পৃথিবীতে কতগুলো ভাষা আছে, তা নিয়ে একটা গবেষণা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। সে সময় বলা হয়েছিল ৬ হাজার
৭০৩টি জীবিত ভাষা রয়েছে। ২০১১ সালে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় এক হাজার জীবিত ভাষা ছিল, ২২৫টি ভাষা ছিল ইউরোপে,
২ হাজার ১১টি ভাষা আফ্রিকায় আর ২ হাজার ১৬৫টি ভাষা ছিল এশিয়ায়। অস্ট্রেলিয়াসহ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ছিল ১ হাজার
৩২০টি ভাষা। তবে অস্ট্রেলিয়ার হিসাবটা একটু অনির্দিষ্ট ছিল, কারণ সেখানে এমন কিছু ভাষা আছে, যা একই ভাষার উপভাষা কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।
এখন অনেক গবেষকই মনে করেন, পৃথিবীতে বর্তমানে ৫ হাজারের চেয়ে কিছু বেশি ভাষা জীবিত রয়েছে। গবেষকেরা এটাও মনে করেন, এক শ বছর পর এই ভাষাগুলোর মধ্যে অনেক ভাষারই আর অস্তিত্ব থাকবে না। কেউ কেউ বলছেন, ভাষা কমে একেবারে অর্ধেক হয়ে যেতে পারে। যে ভাষাগুলো মরে যাবে, সেই ভাষাভাষী মানুষদের বেশির ভাগই তখন কথা বলবে ইংরেজি, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, চীনা, রুশ, ইন্দোনেশিয়ান, আরব, সুয়াহিলি আর হিন্দি ভাষায়। ভাষাতাত্ত্বিকদের একটা দল মনে করে, এক শ বছর পর ৮০ শতাংশ ভাষাই আর থাকবে না।
উত্তর আমেরিকায় যে শত শত ভাষা ছিল, তার বেশির ভাগই মরে গেছে। এখন পর্যন্ত টিকে আছে মাত্র ১৯৪টি ভাষা। এর মধ্যে মাত্র ৩৩টি ভাষায় বড়রা আর ছোটরা কথা বলে। ৩৪টি ভাষায় কথা বলে বড়রা আর ছোটদের ছোট্ট একটা অংশ। আর ৭৩টি ভাষায় কথা বলে শুধু পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষ। যে ভাষাগুলোয় শিশুরা কথা বলে না, তারা যে অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যারা এই ভাষাগুলোয় কথা বলে, তারা কেন্দ্র থেকে এত বেশি দূরে অবস্থান করে যে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে হলে যে ভাষাটা সবাই জানে, সেই ভাষাটাই শিখে ফেলে। ফলে নিজের ভাষাটা গোল্লায় যায়।
পাঁচ. এত কথা বলার পর বলতে হচ্ছে, এসব আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষার হাল কী, সে প্রশ্ন এলে কী জবাব দেব? এখন ভাষা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে নতুন যে বিষয়গুলো যুক্ত হয়েছে, সেদিকে চোখ রাখা যাক। নিজের ভাষাকে যথেষ্ট সম্মান দেবে বলেও যদি মনে করে কেউ, সে কি টেলিভিশন, রেডিও দেখতে, শুনতে এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে নিজের বাংলা ভাষার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারবে? এই সব মাধ্যম দিয়ে বিশ্বের সর্বত্র যাওয়া সম্ভব এবং সেটা ইংরেজির মাধ্যমেই সহজ। ইংরেজিকে ফ্যাশনের অন্তর্গত করে নিলে আধুনিক বা অত্যাধুনিক হওয়া যায়, নিজের সমাজ বা সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও বিকশিত হওয়ার পথে কেউ বাদ সাধবে না। আর একজন তরুণ যখন নিজের সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করে ভিন্ন সংস্কৃতি থেকেই জীবনের রসদ জোগাড় করে নিতে পারে, তখন নিজের ভাষাও আর নিজের ভাষা থাকে না। তা হারিয়ে যেতে থাকে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক পরিচয়ও লুপ্ত হতে থাকে।
শিকড়বিহীন হয়ে যায় অস্তিত্ব। এও একধরনের পরাজয়। এই পরাজয়ের সঙ্গী হয় ঐতিহ্য, প্রচলিত কিংবদন্তি, লোকায়ত উৎসব, কবিতা, গান, বাগ্মিতা, ঐতিহ্যগত কৌতুকবোধ ইত্যাদি। অন্য ভাষায় এই অর্জনগুলোকে প্রকাশ করা দুরূহ। ভাষার মাধ্যমে জাতির যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়, সেটাও লুপ্ত হয়ে যায়। ভাষা যত কমে আসবে, মানুষের প্রজ্ঞাও তত কমে আসবে। তাই রাষ্ট্রীয় ভাষা যেটাই হোক না কেন, নিজের ভাষা ধরে রাখা খুব দরকার। মনে হচ্ছে, বাংলা ভাষার হাল নিয়ে আরও কিছু বলার আছে। সামনে সেটাই বলা হবে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দ্বিতীয় পর্ব
বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে যে আলোচনা হয়, তাতে এই ভাষায় নিজেকে ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারছি কি পারছি না, সে আলোচনা হয় কম। আমরা অকারণেই প্রমিত-অপ্রমিত ভাষা নিয়ে বেশি বাক্যব্যয় করি। মূলত সেটা বাংলা ভাষার মূল সংকট নয়।
বাংলা ভাষা মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে, হাসপাতালেই তার ভাগ্য নির্ধারিত হবে—এতটা ভয়ংকর কিছু ভাবার কারণ নেই। কিন্তু ভাষা বহন করছে যারা, তাদের ভাষা-শরীরে যে অসুখ এসে জুটেছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। শহুরে শিক্ষিত মানুষ তাদের মুখের ভাষা নিয়ে দ্বিধান্বিত। যে সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে সত্যিই উঁচুদরের খুব বেশি কিছু হচ্ছে কি না, তা নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু দেশের খেটে খাওয়া মানুষ এখনো ইংরেজির নাগাল পায়নি বলেই তারা আরও অনেক দিন বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখবে বলে মনে হয়।
কেন একটা ভাষা মরে যায়, সে কথা কমবেশি সবাই জানে। কোনো ভাষার ওপর যখন অন্য ভাষার প্রভাব পড়ে, সেই অন্য ভাষায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দ হয় মানুষ, তখন নিজের ভাষা ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়। আমরা যে জীবনযাপন করছি, তাতে ভাষাকে নান্দনিক করে তোলার প্রয়োজন পড়ে না। যখন মানুষ সেই ভাষায় কিছু বলে, তখনই তো ‘কী বলব’, সেটা প্রধান হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন নিজেকে প্রকাশ করার জন্য ভিন্ন ভাষায় কথা বলা সহজ, তখন কেন নিজের ভাষার শব্দভান্ডার স্ফীত করার প্রক্রিয়ায় জড়াবে মানুষ? নিজের ভাষাকে সম্মান করলে সমাজে একটা স্থান হবে—এ রকম পরিবেশ কি আদৌ সৃষ্টি হয়েছে আমাদের দেশে?
দুই. একটা কেক এসেছিল বাড়িতে। কেকের ওপর লেখা, ‘আবার দেখা হবে’। কেকটা কাটার আগে একজন বললেন, ‘ফের মিলেঙ্গে’ এবং কারও কারও কাছে মনে হলো, ‘ফের মিলেঙ্গে’ কথাটা খুব যায় এই পরিবেশের সঙ্গে। তাহলে ‘আবার দেখা হবে’ কি তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলল?
এখন তো সবাই ‘মিস’ করে। কারও জন্য কারও মন হাহাকার করে ওঠে না। ‘মিস ইউ’ বললেই সব সমস্যা মিটে যায়। তাহলে কি ‘ফের মিলেঙ্গে’ কিংবা ‘মিস ইউ’ বললে ভাষা কলুষিত হয়ে যায়? একেবারেই না। মানুষ কথা বলে যোগাযোগের জন্য। ভাষা শুধু সেই যোগাযোগকে নিবিড় করে। যে যেই ভাষায় অভ্যস্ত, সে সেই ভাষাকেই যোগাযোগের মাধ্যম করে নেয়। এখানে শুধু একটা প্রশ্নই উঠে আসতে পারে—নিজের ভাষায় কেন নিজেকে প্রকাশ করা যাচ্ছে না?
এর একটা কারণ হতে পারে, ইদানীং বন্ধুবান্ধবদের আলোচনায় ব্যাখ্যামূলক কথা খুব কম থাকছে। দু-এক শব্দে উত্তর দেওয়া যায়, কিংবা উত্তর দিতে হলে ভাবার প্রয়োজন হয় না, যান্ত্রিকভাবে তৈরি থাকা উত্তরটাই উঠে আসে ঠোঁটের কিনারে, এমন হলে ভাষাকে আর বেড়ে উঠতে হয় না। যেটুকু বেড়ে উঠেছে, সেটুকুতেই থেমে থাকা যায়। কারণ, নিজেকে প্রকাশ করার ভাষা তখন অন্য কোনো ভাষা। নিজের ভাষা নয়।
তিন. কোনো কোনো ভাষায় কথা বলার লোকই নেই। এমন অনেক ভাষা আছে, যে ভাষায় কথা বলার জন্য বেঁচে আছে কেবল একজন মানুষ। তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন তাঁর ভাষাটা বেঁচে থাকবে পৃথিবীতে। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সে ভাষার মৃত্যু হবে। আমরা তো দেখেছি আগে, শক্তিশালী ভাষার চাপে কীভাবে মরে যায় কিংবা অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে জায়গা করে নেয় দুর্বল ভাষা। যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে ইংরেজি ভাষা এসে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে স্থানীয় ভাষাগুলোকে, সেই বেদনাময় ইতিহাস নিশ্চয় নতুন করে বলতে হবে না। মেক্সিকোকে কীভাবে গ্রাস করে নিল স্প্যানিশ ভাষা—সে গল্পও কি কম বেদনার?
তরুণেরা যদি নিজের ভাষায় কথা না বলে, তাহলে ভাষার ধমনি শুকিয়ে যায়, ভাষা তখন মরে যায়। আচ্ছা, প্রাচীন লাতিন, স্লাভ বা গ্রিকের মতো ভাষাগুলোর এখনকার অবস্থা কী? তাদের প্রতাপের কথা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি আমরা। গ্রিক ভাষা নিয়ে তো বলাই যায়, প্রাকৃত থেকে ক্রমান্বয়ে বাংলায় রূপান্তরের মতোই প্রাচীন গ্রিক থেকে জন্ম নিয়েছে আধুনিক গ্রিক ভাষা।
প্রাচীন বই-পত্তরের দিকে চোখ রাখলে এখন খুব কম গ্রিক নাগরিকই সেটা পড়তে পারবে, বুঝতে পারবে। আর লাতিন? সে তো পরিবর্তিত হতে হতে ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, রোমিনিয়ানসহ আরও কয়েকটি ভাষার জন্ম দিয়েছে। ইংরেজরাও এখন নিশ্চয় চসারের ভাষায় লেখে না, পড়ে না। প্রাচীন রুশ ভাষা থেকেই তো জন্ম নিয়েছে রুশ, বেলারুশ ও ইউক্রেনীয় ভাষা।
ভাষা-বিলুপ্তির একটা কারণ তো জেনোসাইড। আর এই জেনোসাইডের জন্য মূলত দায়ী উপনিবেশবাদ। এ ব্যাপারেও নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু এক ভাষাভাষী মানুষ অন্য ভাষাভাষী মানুষের ভাষাকে একেবারে বিলুপ্ত করে দিতে পারে, এর চেয়ে বড় নৃশংসতা আর কী হতে পারে? ঊনবিংশ শতকে তাসমানিয়ার ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেল ইউরোপীয় উপনিবেশকারীদের দ্বারা। আফ্রিকার বহু জাতিকেই তাদের ভাষা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ আমাদের সংস্কৃতি, ভাষাকে উচ্ছেদ করতে পারেনি বটে, আমরাই ধীরে ধীরে ইংরেজির কাছে আত্মসমর্পণ করেছি।
চার. সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন পড়তাম, তখন আমার দুই সিরিয়ান বন্ধু ছিল। ফরিদ আর আলী। ওরা জাতিগতভাবে কুর্দি। সে সময় জেনেছিলাম, তুরস্কে কুর্দরা নিজেদের ভাষায় কিছু ছাপাতে পারে না, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিজেদের ভাষা শিক্ষা দিতে পারে না। ফলে নিজেদের মধ্যে কুর্দি ভাষায় কথা বললেও পড়াশোনা চালাতে হয় তুর্কি ভাষায়। ফরিদ আর আলীকেও সিরিয়ায় মূলত পড়াশোনা করতে হয়েছে আরবি ভাষায়। উচ্চশিক্ষায় কুর্দি ভাষার মর্যাদা নেই।
নিজের ভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষা শেখায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেই নতুন ভাষা যখন নিজের ভাষাকে একেবারেই অচল করে দেয়, তখন তা হয়ে ওঠে ভয়ংকর। ভাষা সচল না থাকলে তা মানুষের ইতিহাস আর সংস্কৃতিকেও ভুলিয়ে দেয়। এবার একটি অন্য রকম খবরের সঙ্গে পরিচিত হই। পৃথিবীতে কতগুলো ভাষা আছে, তা নিয়ে একটা গবেষণা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। সে সময় বলা হয়েছিল ৬ হাজার
৭০৩টি জীবিত ভাষা রয়েছে। ২০১১ সালে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় এক হাজার জীবিত ভাষা ছিল, ২২৫টি ভাষা ছিল ইউরোপে,
২ হাজার ১১টি ভাষা আফ্রিকায় আর ২ হাজার ১৬৫টি ভাষা ছিল এশিয়ায়। অস্ট্রেলিয়াসহ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ছিল ১ হাজার
৩২০টি ভাষা। তবে অস্ট্রেলিয়ার হিসাবটা একটু অনির্দিষ্ট ছিল, কারণ সেখানে এমন কিছু ভাষা আছে, যা একই ভাষার উপভাষা কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।
এখন অনেক গবেষকই মনে করেন, পৃথিবীতে বর্তমানে ৫ হাজারের চেয়ে কিছু বেশি ভাষা জীবিত রয়েছে। গবেষকেরা এটাও মনে করেন, এক শ বছর পর এই ভাষাগুলোর মধ্যে অনেক ভাষারই আর অস্তিত্ব থাকবে না। কেউ কেউ বলছেন, ভাষা কমে একেবারে অর্ধেক হয়ে যেতে পারে। যে ভাষাগুলো মরে যাবে, সেই ভাষাভাষী মানুষদের বেশির ভাগই তখন কথা বলবে ইংরেজি, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, চীনা, রুশ, ইন্দোনেশিয়ান, আরব, সুয়াহিলি আর হিন্দি ভাষায়। ভাষাতাত্ত্বিকদের একটা দল মনে করে, এক শ বছর পর ৮০ শতাংশ ভাষাই আর থাকবে না।
উত্তর আমেরিকায় যে শত শত ভাষা ছিল, তার বেশির ভাগই মরে গেছে। এখন পর্যন্ত টিকে আছে মাত্র ১৯৪টি ভাষা। এর মধ্যে মাত্র ৩৩টি ভাষায় বড়রা আর ছোটরা কথা বলে। ৩৪টি ভাষায় কথা বলে বড়রা আর ছোটদের ছোট্ট একটা অংশ। আর ৭৩টি ভাষায় কথা বলে শুধু পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষ। যে ভাষাগুলোয় শিশুরা কথা বলে না, তারা যে অদূর ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যারা এই ভাষাগুলোয় কথা বলে, তারা কেন্দ্র থেকে এত বেশি দূরে অবস্থান করে যে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে হলে যে ভাষাটা সবাই জানে, সেই ভাষাটাই শিখে ফেলে। ফলে নিজের ভাষাটা গোল্লায় যায়।
পাঁচ. এত কথা বলার পর বলতে হচ্ছে, এসব আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা ভাষার হাল কী, সে প্রশ্ন এলে কী জবাব দেব? এখন ভাষা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে নতুন যে বিষয়গুলো যুক্ত হয়েছে, সেদিকে চোখ রাখা যাক। নিজের ভাষাকে যথেষ্ট সম্মান দেবে বলেও যদি মনে করে কেউ, সে কি টেলিভিশন, রেডিও দেখতে, শুনতে এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে নিজের বাংলা ভাষার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারবে? এই সব মাধ্যম দিয়ে বিশ্বের সর্বত্র যাওয়া সম্ভব এবং সেটা ইংরেজির মাধ্যমেই সহজ। ইংরেজিকে ফ্যাশনের অন্তর্গত করে নিলে আধুনিক বা অত্যাধুনিক হওয়া যায়, নিজের সমাজ বা সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও বিকশিত হওয়ার পথে কেউ বাদ সাধবে না। আর একজন তরুণ যখন নিজের সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করে ভিন্ন সংস্কৃতি থেকেই জীবনের রসদ জোগাড় করে নিতে পারে, তখন নিজের ভাষাও আর নিজের ভাষা থাকে না। তা হারিয়ে যেতে থাকে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক পরিচয়ও লুপ্ত হতে থাকে।
শিকড়বিহীন হয়ে যায় অস্তিত্ব। এও একধরনের পরাজয়। এই পরাজয়ের সঙ্গী হয় ঐতিহ্য, প্রচলিত কিংবদন্তি, লোকায়ত উৎসব, কবিতা, গান, বাগ্মিতা, ঐতিহ্যগত কৌতুকবোধ ইত্যাদি। অন্য ভাষায় এই অর্জনগুলোকে প্রকাশ করা দুরূহ। ভাষার মাধ্যমে জাতির যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়, সেটাও লুপ্ত হয়ে যায়। ভাষা যত কমে আসবে, মানুষের প্রজ্ঞাও তত কমে আসবে। তাই রাষ্ট্রীয় ভাষা যেটাই হোক না কেন, নিজের ভাষা ধরে রাখা খুব দরকার। মনে হচ্ছে, বাংলা ভাষার হাল নিয়ে আরও কিছু বলার আছে। সামনে সেটাই বলা হবে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২১ ঘণ্টা আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে