সাগরে ডাকাতের উৎপাত

বরগুনা প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০৭: ৫০
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১২: ২৭

মুক্তিপণ দিয়ে ফিরলেন দুই জেলে। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে দুই জেলে অপহরণ হন। এরপর আটকের চারদিন পর তাঁরা ফিরে আসেন।

সম্প্রতি ইলিশ শিকারে গিয়ে ডাকাতের হামলার শিকার হয়েছেন অর্ধশতাধিক জেলে। ১৭ নভেম্বর ডাকাতের হামলায় পাথরঘাটার চরলাঠিমারা গ্রামের মুছা নামের এক জেলে নিহত হন। আহত হন আরও ১৪ জেলে। এ ছাড়া নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে ডাকাতের হামলার শিকার হয়ে ২০ জনের মতো জেলে আহত হন, এ সময় ডাকাতেরা ট্রলারের লোপাট চালায়। মুক্তিপণের দাবিতে ৫ জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সংঘবদ্ধ ডাকাতদল।

গত ২৭ নভেম্বর বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হাঁড়িটানা গ্রামের নেছার খান নামের এক ট্রলার মালিক ও তাফালবাড়িয়া এলাকার কামাল মাঝি পাথরঘাটা থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার এজাহারে ডাকাতির শিকার হামলা ও লুণ্ঠনের বিবরণ তুলে ধরেন।

মামলার এজাহারের বিবরণীতে কামাল মাঝি বলেন, ‘গত ২০ নভেম্বর সাগরে মাছ শিকারের সময় ট্রলারে হামলার পর ডাকাতেরা আমার চোখ বেঁধে তাদের ট্রলারে উঠিয়ে অন্য জেলেদের জানিয়ে দেয় আমাকে (কামাল মাঝিকে) ফেরত পেতে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হবে। এরপর গভীর জঙ্গলে নিয়ে আটকে রেখে তাঁর স্ত্রীর কাছে ফোনে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। তারপর কামালের স্ত্রী ০১৭৭৯৯৮৮১৪৬ নম্বরে প্রথমে ২০ হাজার এবং পরে ৩০ হাজার মোট ৫০ হাজার টাকার মুক্তিপণ পরিশোধ করেন।’ মুক্তিপণের সব টাকা না দেওয়ায় পায়ে হাতুড়ি পেটা করে চার দিন পর ২৪ নভেম্বর চোখ বেঁধে সাগরের পাড়ে ফেলে যায়। পরে একটি ট্রলারের সহায়তায় মহিপুর নৌপুলিশ ফাঁড়িতে আসেন তিনি। এরপর সেখান থেকে তাঁকে বাড়িতে পাঠায় পুলিশ। একই ঘটনা পাথরঘাটার অপর জেলে নেছার খানের বেলায়ও। একই দিন পাথরঘাটার বিষখালীর মোহনা থেকে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ১৭ থেকে ১৮ জনের সংঘবদ্ধ দল ট্রলারে হামলা ও লুটপাট শেষে নেছার খানকে চোখ বেঁধে ডাকাতেরা অপহরণ করে জঙ্গলে নিয়ে যায়। পরে তাঁর স্ত্রীর কাছে মোবাইল ফোনে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। ০১৯৯৩৮৬৪৩৮২ নম্বরে দুই দফায় ২৭ হাজার ও ১৯ হাজার ৫০০ টাকা, ০১৭৩৩১২৫৩৮৪ নম্বরে দুই দফায় ৩০ ও ২৫ হাজার মোট ৫৫ হাজার টাকা, ০১৭৪৬৭৮১৩১০ নম্বরে দুই দফায় ৫০ হাজার এবং ০১৯২০২৭০৪৫৬ নম্বরে চার দফায় ২৫ হাজার করে মোট আড়াই লাখ টাকা মুক্তিপণ নেছারের স্ত্রী পাঠান। চার দিন আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের পর তাঁকেও চোখ বেঁধে সাগরের পাড়ে ফেলে রেখে যায় ডাকাতেরা। পরে অন্য ট্রলারের সহায়তায় তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন।

নেছার বলেন, ‘ডাকাতদল চার দিন ধরে আমার ওপর নির্যাতন চালিয়ে মোবাইল ফোনে আমার স্ত্রীকে ডাক-চিৎকার শোনায়। জীবন বাঁচানোর তাগিদে কাউকে না জানিয়ে আমার স্ত্রী ধারদেনা করে আড়াই লাখ টাকা মুক্তিপণ জোগাড় করে পাঠিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ডাকাতির সময় সবাই মুখোশ পরা ছিল। আমাকে অপহরণের সময় চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। এক মুহূর্তও আমার চোখ খোলা হয়নি। চার দিন আমি কোথায় ছিলাম কিছু বলতে পারব না।’

একই অভিজ্ঞতা কামাল মাঝির। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার মুক্তিপণের টাকা সব শোধ না করায় আমার হাঁটুতে হাতুড়ি পেটা করা হয়। পরে যখন আমার স্ত্রী জানান, আর টাকা দিতে পারবে না, তখন তারা আমাকে মারধর করে সাগরের পাড়ে রেখে যায়।’

বাংলাদেশ ট্রলার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বরগুনার পাথরঘাটার মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘নভেম্বর মাসের শেষের দিকে হঠাৎই সাগরে ডাকাতির ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। আমরা একপ্রকার অসহায় অবস্থায় পড়ে যাই। এরপর জেলেরা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসার খবর পেয়ে আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলে থানায় মামলা করাই। আমার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন লোকজনের কথা হয়েছে। আশা করছি এই চক্র দ্রুত ধরা পড়বে।’

এ ঘটনার পর ৩০ নভেম্বর দেশের অন্যতম বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র পাথরঘাটায় জেলে, ট্রলার মালিক ও মৎস্যজীবীদের নিয়ে বৈঠক করে জেলা পুলিশ। সেখানে উপস্থিত বরগুনার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক জানান, বঙ্গোপসাগরে ট্রলারে ডাকাতি বন্ধে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডের পাশাপাশি পুলিশ ও র‍্যাব তৎপর রয়েছে।

পাথরঘাটা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাশার বলেন, ‘সাগরে জলদস্যুতা ও অপহরণের শিকার দুজন জেলে থানায় দুটি মামলা করেছেন। গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত