অরুণাভ পোদ্দার
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় ফিরে এল। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যতটা অভ্যন্তরীণ বিরোধী দলের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল, তার থেকে বহুগুণ বেশি বাইরের দেশগুলোর তীব্র নজরদারিতে ছিল। গত বছর দেড়েক থেকেই বিশ্বমোড়ল আমেরিকাসহ পুরো ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রকাশ্যে নাক গলানো ছিল দৃষ্টিকটু। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারত, চীন ও রাশিয়ার প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারটিও ছিল চোখে পড়ার মতো। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূর্ব-পশ্চিমের সেই চাপ দক্ষ হাতে সামলেছেন নিঃসন্দেহে।
নির্বাচনের পরে সংসদ সদস্যদের শপথ ও নতুন মন্ত্রিসভা যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিরোধী শিবিরের আড়ালে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর চাপ উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এর মধ্যেই কিছু আলামত দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রথমেই এরা সরকারকে চাপে ফেলতে চাইছে সরকারের নতুন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। এই যে ব্র্যাকের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাবকে দিয়ে তৃতীয় লিঙ্গ ইস্যুতে প্রকাশ্যে পাঠ্যবইয়ের পাতা ছিঁড়ে নাটক সাজানো হলো, এর পেছনেও কিন্তু তাদের অদৃশ্য হাতের কারসাজি বিদ্যমান। এর নেপথ্যের কুশীলবেরা কিন্তু সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনা নিয়ে মাঠ গরম করার পরিকল্পনায় নেমেছে। কিন্তু এবারও সরকার তা শক্ত হাতে মোকাবিলা না করে বরং আপস ও সময়ক্ষেপণের কৌশল নিয়েছে দেখে মনে আশঙ্কার মেঘ জমে উঠছে। অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, আওয়ামী লীগ যখন শক্ত হাতে সব ধরনের চক্রান্ত মোকাবিলা করেছে, তখন তাদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, আর যখনই সেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করেছে, তখনই এরা আশকারা পেয়ে মাথায় উঠেছে।
২০০৮-এর সর্বমহল স্বীকৃত নির্বাচনের ভূমিধস বিজয়ের অব্যবহিত পরেই বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে একটি অপশক্তি প্রথমেই সরকারকে চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য সাহসে সে যাত্রায় আওয়ামী লীগ তাদের নৌকার হাল স্থির রেখেছিল। এর পরে ২০১০-১১তে তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের নেতৃত্বে যুগান্তকারী নারীনীতির খসড়া ঘোষিত হয়। আওয়ামী লীগের সরকার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয় মুসলিম নারীদের সম্পত্তিতে সমান অধিকারের। অর্থাৎ, ছেলে-মেয়ে সবার মাঝে সম্পত্তি সমানভাবে বণ্টন করতে হবে। কিন্তু সেই যাত্রায় একটি চিহ্নিত ধর্মান্ধ মহল, চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও তৎকালীন বিরোধী দলের সহায়তায় সরকারের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। মনে রাখতে হবে, সরকার কিন্তু তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ধর্মান্ধদের ব্যবহার করে একটি চিহ্নিত মহল যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে সরকারকে বিব্রত করতে চায়। এর বিপরীতে সরকার নমনীয় কৌশলের রাস্তা গ্রহণ করে। ফলে সেই নারীবান্ধব নীতি পর্দার আড়ালে চলে যায়। এর পরপরই ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে শাহবাগে ঐতিহাসিক গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি। ’৭১-এর পর সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবি নিয়ে লাখো জনতার উত্তাল সমুদ্র স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিপক্ষ শক্তি জামায়াতে ইসলামী ও তাদের দোসরদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। কিন্তু এর পরই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। শুরু হয় মিথ্যা অপবাদে ব্লগার হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়ন। হেফাজতে ইসলামের মতো চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান ঘটে। এদের উন্মত্ততা চরমে ওঠে ২০১৩-এর ৫ মে, যখন সারা দেশ থেকে এরা ঢাকা অবরোধের মতো উচ্ছৃঙ্খল কর্মসূচির ডাক দেয়। সরকার প্রথমে চরম সহনশীলতার পরিচয় দিলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দক্ষভাবে এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মোকাবিলা করেন এবং ঢাকা থেকে উচ্ছেদ করেন। সারা দেশের মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণ যখন এদের বিচারের আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায়, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভুল চাল দিল। বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে নির্বাচন আহ্বান করল। এতে যেন মৃতপ্রায় হেফাজতের দেহে প্রাণ ফিরে এল। জাতি প্রত্যক্ষ করল রক্তবীজের পুনরুত্থান। মে মাসের ৫ তারিখ যে হেফাজত ঢাকা ছেড়ে পালিয়েছিল, তাদের নেপথ্যের পৃষ্ঠপোষকেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, সরকারের নির্বাচন ঘোষণায় তারা প্রকাশ্যে চলে এল। এর ফল তারা হাতেনাতে পেল। চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে গেল আওয়ামী লীগ। সরকারের মধ্যে আতঙ্ক দেখা গেল, তাদের নীতিনির্ধারক মহলে এই ধারণা বদ্ধমূল হলো, হেফাজতকে আর চটানো ঠিক হবে না। ফলে সরকারের ওপরমহল থেকে হেফাজতের মতো উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে আপসের উদ্যোগ নেওয়া হলো। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারি রেলের জমি তাদের নেতাদের কাছে লিজ দেওয়া হলো, নেতাদের ৫ মের মামলা হিমঘরে চলে গেল, কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রির সমমূল্যায়ন করা হলো।
হেফাজতের আড়ালে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এতটাই বেপরোয়া হয়ে গেল যে ২০১৬-১৭তে সাধারণ শিক্ষাক্রমের পাঠ্যসূচিতে কী থাকবে, কী থাকবে না—সেই দাবিও তুলল। শোনা যায়, তাদের দাবির মুখেই শিক্ষাক্রম থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখের লেখা বাদ দেওয়া হয়। তাদের অযৌক্তিক দাবির জন্যই হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারিত হয়। তাদের স্পর্ধা এতটাই বেড়ে গেল যে খোদ রাজধানীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে নির্মীয়মাণ ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুংকার দিল। এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই—স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীকে আশকারা দিলে মাথায় উঠবে।
ইদানীং পাঠ্যপুস্তক ছিঁড়ে ফেলার উসকানি এবং এর বিপক্ষে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই শিক্ষকের বহিষ্কারের বিপরীতে উগ্রবাদী মহলের মাঠ গরমের চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে বেশ তড়িঘড়ি করে পাঠ্যপুস্তকের ব্যাপারে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনে আপসের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছে সচেতন মহল। মজার ব্যাপার, এই পাঁচ সদস্যের কমিটিতে পাঠ্যপুস্তক নীতিমালা বা নতুন শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে রাখা হয়নি। ডাকা হয়নি সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশেষজ্ঞদের। তড়িঘড়ি কমিটি করে যদি ধর্মান্ধ মহলকে খুশি রাখতে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করা হয়, তবে সরকারকে তার মাশুল গুনতে হবে।
ধর্মান্ধ গোষ্ঠী দেশকে শুধু পেছনেই নিয়ে যেতে চায়, সব ধরনের প্রগতিশীলতা, নারীবান্ধব নীতি, তৃতীয় লিঙ্গের সমতার দাবিকে তারা অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করে সরকারের প্রগতিশীল কর্মকাণ্ড রুদ্ধ করতে চায়। এর সঙ্গে প্রকৃত ধর্মাচরণ ও ধর্মচর্চার কোনো সম্পর্ক নেই। নতুন প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম হয়ে উঠেছে তাদের চক্ষুশূল। তাই সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
দেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন যেমন ঘটেছে, তেমনি মানুষের মনমানসিকতায় ধর্মান্ধদের প্রভাব-প্রতিপত্তিও বেড়েছে। পরপর চারবার ক্ষমতাসীন সরকার, সংসদে যার আছে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন, তারা এখনো ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে পারেনি। পারেনি স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে, উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান রহিত করতে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ছয় লেন সড়ক, উড়ালসেতু, বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো শত শত উন্নয়ন যে সরকার করতে পারে, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতি পরিপন্থী কোনো কিছু স্থান পাবে না বলেই জনগণের প্রত্যাশা। লোহা গরম থাকতেই আঘাত করা উচিত—সেই বহুল প্রচলিত আপ্তবাক্য স্মরণ করেই সরকারকে এখনই কিছু মৌলিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। না হলে বারবার সেই ধর্মান্ধ, পশ্চাৎপদ শক্তি সরকারকে পেছনে টেনে ধরবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপামর জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সব চক্রান্তের জাল এবং অপশক্তিকে পরাজিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করবেন।
লেখক: চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মী
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে পঞ্চমবারের মতো ক্ষমতায় ফিরে এল। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যতটা অভ্যন্তরীণ বিরোধী দলের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল, তার থেকে বহুগুণ বেশি বাইরের দেশগুলোর তীব্র নজরদারিতে ছিল। গত বছর দেড়েক থেকেই বিশ্বমোড়ল আমেরিকাসহ পুরো ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রকাশ্যে নাক গলানো ছিল দৃষ্টিকটু। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারত, চীন ও রাশিয়ার প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারটিও ছিল চোখে পড়ার মতো। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূর্ব-পশ্চিমের সেই চাপ দক্ষ হাতে সামলেছেন নিঃসন্দেহে।
নির্বাচনের পরে সংসদ সদস্যদের শপথ ও নতুন মন্ত্রিসভা যাত্রা শুরু করেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিরোধী শিবিরের আড়ালে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর চাপ উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এর মধ্যেই কিছু আলামত দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রথমেই এরা সরকারকে চাপে ফেলতে চাইছে সরকারের নতুন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। এই যে ব্র্যাকের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাবকে দিয়ে তৃতীয় লিঙ্গ ইস্যুতে প্রকাশ্যে পাঠ্যবইয়ের পাতা ছিঁড়ে নাটক সাজানো হলো, এর পেছনেও কিন্তু তাদের অদৃশ্য হাতের কারসাজি বিদ্যমান। এর নেপথ্যের কুশীলবেরা কিন্তু সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনা নিয়ে মাঠ গরম করার পরিকল্পনায় নেমেছে। কিন্তু এবারও সরকার তা শক্ত হাতে মোকাবিলা না করে বরং আপস ও সময়ক্ষেপণের কৌশল নিয়েছে দেখে মনে আশঙ্কার মেঘ জমে উঠছে। অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, আওয়ামী লীগ যখন শক্ত হাতে সব ধরনের চক্রান্ত মোকাবিলা করেছে, তখন তাদের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, আর যখনই সেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করেছে, তখনই এরা আশকারা পেয়ে মাথায় উঠেছে।
২০০৮-এর সর্বমহল স্বীকৃত নির্বাচনের ভূমিধস বিজয়ের অব্যবহিত পরেই বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে একটি অপশক্তি প্রথমেই সরকারকে চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য সাহসে সে যাত্রায় আওয়ামী লীগ তাদের নৌকার হাল স্থির রেখেছিল। এর পরে ২০১০-১১তে তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের নেতৃত্বে যুগান্তকারী নারীনীতির খসড়া ঘোষিত হয়। আওয়ামী লীগের সরকার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয় মুসলিম নারীদের সম্পত্তিতে সমান অধিকারের। অর্থাৎ, ছেলে-মেয়ে সবার মাঝে সম্পত্তি সমানভাবে বণ্টন করতে হবে। কিন্তু সেই যাত্রায় একটি চিহ্নিত ধর্মান্ধ মহল, চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও তৎকালীন বিরোধী দলের সহায়তায় সরকারের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। মনে রাখতে হবে, সরকার কিন্তু তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ধর্মান্ধদের ব্যবহার করে একটি চিহ্নিত মহল যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে সরকারকে বিব্রত করতে চায়। এর বিপরীতে সরকার নমনীয় কৌশলের রাস্তা গ্রহণ করে। ফলে সেই নারীবান্ধব নীতি পর্দার আড়ালে চলে যায়। এর পরপরই ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে শাহবাগে ঐতিহাসিক গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি। ’৭১-এর পর সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবি নিয়ে লাখো জনতার উত্তাল সমুদ্র স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিপক্ষ শক্তি জামায়াতে ইসলামী ও তাদের দোসরদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। কিন্তু এর পরই শুরু হয় ষড়যন্ত্র। শুরু হয় মিথ্যা অপবাদে ব্লগার হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়ন। হেফাজতে ইসলামের মতো চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান ঘটে। এদের উন্মত্ততা চরমে ওঠে ২০১৩-এর ৫ মে, যখন সারা দেশ থেকে এরা ঢাকা অবরোধের মতো উচ্ছৃঙ্খল কর্মসূচির ডাক দেয়। সরকার প্রথমে চরম সহনশীলতার পরিচয় দিলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দক্ষভাবে এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মোকাবিলা করেন এবং ঢাকা থেকে উচ্ছেদ করেন। সারা দেশের মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন জনগণ যখন এদের বিচারের আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায়, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভুল চাল দিল। বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে নির্বাচন আহ্বান করল। এতে যেন মৃতপ্রায় হেফাজতের দেহে প্রাণ ফিরে এল। জাতি প্রত্যক্ষ করল রক্তবীজের পুনরুত্থান। মে মাসের ৫ তারিখ যে হেফাজত ঢাকা ছেড়ে পালিয়েছিল, তাদের নেপথ্যের পৃষ্ঠপোষকেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, সরকারের নির্বাচন ঘোষণায় তারা প্রকাশ্যে চলে এল। এর ফল তারা হাতেনাতে পেল। চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে গেল আওয়ামী লীগ। সরকারের মধ্যে আতঙ্ক দেখা গেল, তাদের নীতিনির্ধারক মহলে এই ধারণা বদ্ধমূল হলো, হেফাজতকে আর চটানো ঠিক হবে না। ফলে সরকারের ওপরমহল থেকে হেফাজতের মতো উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে আপসের উদ্যোগ নেওয়া হলো। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারি রেলের জমি তাদের নেতাদের কাছে লিজ দেওয়া হলো, নেতাদের ৫ মের মামলা হিমঘরে চলে গেল, কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রির সমমূল্যায়ন করা হলো।
হেফাজতের আড়ালে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এতটাই বেপরোয়া হয়ে গেল যে ২০১৬-১৭তে সাধারণ শিক্ষাক্রমের পাঠ্যসূচিতে কী থাকবে, কী থাকবে না—সেই দাবিও তুলল। শোনা যায়, তাদের দাবির মুখেই শিক্ষাক্রম থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখের লেখা বাদ দেওয়া হয়। তাদের অযৌক্তিক দাবির জন্যই হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারিত হয়। তাদের স্পর্ধা এতটাই বেড়ে গেল যে খোদ রাজধানীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে নির্মীয়মাণ ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুংকার দিল। এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই—স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীকে আশকারা দিলে মাথায় উঠবে।
ইদানীং পাঠ্যপুস্তক ছিঁড়ে ফেলার উসকানি এবং এর বিপক্ষে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই শিক্ষকের বহিষ্কারের বিপরীতে উগ্রবাদী মহলের মাঠ গরমের চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে বেশ তড়িঘড়ি করে পাঠ্যপুস্তকের ব্যাপারে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনে আপসের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছে সচেতন মহল। মজার ব্যাপার, এই পাঁচ সদস্যের কমিটিতে পাঠ্যপুস্তক নীতিমালা বা নতুন শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে রাখা হয়নি। ডাকা হয়নি সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশেষজ্ঞদের। তড়িঘড়ি কমিটি করে যদি ধর্মান্ধ মহলকে খুশি রাখতে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করা হয়, তবে সরকারকে তার মাশুল গুনতে হবে।
ধর্মান্ধ গোষ্ঠী দেশকে শুধু পেছনেই নিয়ে যেতে চায়, সব ধরনের প্রগতিশীলতা, নারীবান্ধব নীতি, তৃতীয় লিঙ্গের সমতার দাবিকে তারা অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করে সরকারের প্রগতিশীল কর্মকাণ্ড রুদ্ধ করতে চায়। এর সঙ্গে প্রকৃত ধর্মাচরণ ও ধর্মচর্চার কোনো সম্পর্ক নেই। নতুন প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম হয়ে উঠেছে তাদের চক্ষুশূল। তাই সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
দেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন যেমন ঘটেছে, তেমনি মানুষের মনমানসিকতায় ধর্মান্ধদের প্রভাব-প্রতিপত্তিও বেড়েছে। পরপর চারবার ক্ষমতাসীন সরকার, সংসদে যার আছে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন, তারা এখনো ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে পারেনি। পারেনি স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে, উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান রহিত করতে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ছয় লেন সড়ক, উড়ালসেতু, বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো শত শত উন্নয়ন যে সরকার করতে পারে, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতি পরিপন্থী কোনো কিছু স্থান পাবে না বলেই জনগণের প্রত্যাশা। লোহা গরম থাকতেই আঘাত করা উচিত—সেই বহুল প্রচলিত আপ্তবাক্য স্মরণ করেই সরকারকে এখনই কিছু মৌলিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। না হলে বারবার সেই ধর্মান্ধ, পশ্চাৎপদ শক্তি সরকারকে পেছনে টেনে ধরবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপামর জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সব চক্রান্তের জাল এবং অপশক্তিকে পরাজিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করবেন।
লেখক: চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মী
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে