শাইখ সিরাজ
দিগন্তজোড়া খেতে সবুজ কার্পেটের মতো যে ফসলি সৌন্দর্য দেখি, সেটি দৃশ্যত স্বস্তিজাগানিয়া হলেও কোনো কৃষকই আর বেশি জমির মালিক নেই। সবাই সামান্য এক টুকরো জমিতে কৃষিকাজ করছেন। দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে জমি। জমিহীন হয়ে পড়ছেন কৃষক।
চলছে রক্তঝরা মার্চ। বাঙালির সাহস ও সংগ্রামের সবচেয়ে গর্বিত সময়। বহু সংগ্রামের পথ পেরিয়ে এই মাসেই বাঙালি মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পায়। আর দুদিন পরেই স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২তম জন্মবার্ষিকী। এই গর্বিত সময়ে মহান নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ ও এ দেশের সোনার মানুষ কৃষকদের এখনকার জীবন-জীবিকার খোঁজ নিতে তিনটি মাস ধরে যেখানেই গিয়েছি কৃষকদের কাছে, জানতে চেয়েছি তাঁরা আসলে কেমন আছেন? যেমন সপ্তাহ দুই আগে গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জে।
ফাগুন পেরিয়ে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে পড়ে গেছে চৈত্রের বাতাস। মানিকগঞ্জের বৈচিত্র্যময় কৃষির এলাকা সিঙ্গাইর উপজেলার খালাসিপাড়া। এখানকারই একটি গ্রাম খাসেরচর। গাড়ি থেকে নেমে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল একটা বাড়ি। গ্রামের একটা গৃহস্থবাড়ি যেমন হয়। আগে গ্রামাঞ্চলে যেমন জীর্ণ ভাঙা বাড়ি চোখে পড়ত, এখন তেমনটি আর চোখে পড়ে না। এখন গ্রামের অনেক বাড়িই পাকা, নয়তো টিনের চালার ঘর। খাসেরচরের যে বাড়িটির কথা বলছি, এটি আধা পাকা একটি বাড়ি। এগিয়ে এলেন গৃহকর্তা। নাম সিরাজুল ইসলাম। বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হবে। এখনো বেশ শক্ত সামর্থ্য। কথা হলো তাঁর সঙ্গে। আমাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির উঠোনে। ঘরের বারান্দায় বসতে দিলেন। কৃষিজীবী সিরাজুল ইসলাম অল্পস্বল্প ব্যবসা করেন। গত ২৪ বছর তিনি এই বাড়িতে আছেন। বলছিলেন, ‘অসাধারণ সুখী পরিবার তাঁর। জীবনে তৃপ্তিও আছে। উঠোনের চারদিকে চারটি ঘর। দুটি থাকার ঘর। একটি রান্নাবান্নার। আর একটি ঘর গরুর। সেখানে দুটি গরু রয়েছে। ‘প্রতিবছর দুটি করে গরু মোটাতাজা করে কোরবানির সময় বিক্রি করি। এতে হাতে বেশ কিছু নগদ টাকা আসে।’ বলছিলেন সিরাজুল। ‘কৃষিকাজ করে এখন বেশ আয়-উন্নতি হয়।’ সিরাজুল ইসলাম নিজের চোখে দেখা কৃষি উন্নতির কথা বলছিলেন। মাঠে মাঠে ফসলের বৈচিত্র্য বেড়েছে। তবে কৃষকের নিজের জমি কমছে। এই এলাকার প্রতি বাড়িরই কেউ না কেউ বিদেশে থাকে। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায় কৃষিকাজ হয়, গরু কেনে। জানালেন সিরাজুল ইসলাম। তার মানে এই অঞ্চলের কৃষিতে বিনিয়োগের একটা বড় অংশই আসে রেমিট্যান্স থেকে। শুধু এ অঞ্চল নয়, সারা দেশেই কৃষিতে বিনিয়োগের বড় একটা অংশ আসে অকৃষিজ পেশা থেকে। কেউ বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়, কেউ বা গার্মেন্টস বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বাড়িতে টাকা পাঠায়। সেই টাকায় কৃষিকাজ হয়।
সিরাজুল ইসলামের বাড়ি থেকে বের হয়ে এগিয়ে গেলাম কৃষিখেতের দিকে। ফসলের বৈচিত্র্যে অনন্য খাসেরচরের মাঠ। এক জমিতে শিম চাষ হচ্ছে, পাশের জমিতেই বেগুন, পেঁপে, কলা, লালশাক, ধনে, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, ভুট্টা, ধান। মাঠে কাজ করছিলেন কৃষক রজব আলী। তাঁর জমি আছে চার পাখি। কৃষিকাজের পাশাপাশি ব্যবসা আছে। এটিও কৃষকের একধরনের সচ্ছলতা। আরেক কৃষকের নাম তাসের খালাসি। ছোট্ট একটি কুমড়াখেত এখানে তাঁর। দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। করোনার সময় দেশে ফিরে এসে এখন কৃষিকাজই করছেন। বলছিলেন, একই জমিতে সারা বছর চারটি ফসল চাষ করেন। এ ক্ষেত্রে বীজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বল্প সময়ে ফসল উত্তোলনের জাত আবিষ্কারের ফলে কৃষক একই জমিতে বছরে চারটি পর্যন্ত চাষ করতে পারছেন। সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আর একটু এগোতেই চোখে পড়ল পাম্প দিয়ে পানি সেচ দিচ্ছেন কৃষক। মাঠে নানা রকম সেচব্যবস্থা। বিদ্যুৎ চালিত পাম্প যেমন আছে, আছে ডিজেলচালিত পাম্প। সেচব্যবস্থার উন্নয়ন এ দেশের কৃষিকে এগিয়ে এনেছে বহুদূর। পাহাড়ি ভূমিতেও এখন সেচের মাধ্যমে চাষাবাদ হচ্ছে।
যাহোক, চোখে পড়ল কলাগাছ দিয়ে খেত সমতল করছেন এক কৃষক। নাম দেলোয়ার হোসেন। বলছিলেন, এক জমিতে একই সঙ্গে তিনি তিনটি ফসল বুনেছেন। প্রথমে ফলন আসবে মুন্নিশাকের। তারপর ফলবে শসা। এরপর মিলবে ধুন্দুল। এক জমিতে একই চাষে তিনটি ফসল মানে এক খরচে তিন গুণ ফল। তবে দেলোয়ার বলছিলেন কৃষিশ্রমিক পাওয়া ভার। পেলেও কৃষিশ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। শুধু মজুরি নয়, খাবারও ভালো দিতে হয়। খাবার হিসেবে মাছ-মাংস না পেলে কাজ করতে চায় না। এই জায়গাতেই যান্ত্রিক কৃষির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা যাচ্ছে।
পাশের জমিই দুলাল মিয়ার। তিনি জানলেন, বিঘায় বেগুন করে লাখ টাকা পেয়েছেন। শোনালেন লাভের হিসাব। বললেন, কৃষির উন্নতিতে অনেক কৃষক ভালো আছেন। কথা হলো এক শিক্ষিত তরুণ কৃষকের সঙ্গে। সুজন মোল্লা। তিনটি ফসল একসঙ্গে করেছেন। তাঁর কৃষি কৌশলটি বিজ্ঞানসম্মত ও লাভজনক। লেখাপড়া করে বাবার কৃষির দায়িত্ব নিয়েছেন। অল্পদিনেই কৃষির যশ বুঝে গেছেন। জানতে চাইলাম, আপনার ঘরে কী কী আছে? জানালেন, টিভি, ফ্রিজ, সোফা, প্রয়োজনীয় আসবাব। তারপর বললেন, ওয়াই-ফাইও আছে। এখন আর মোবাইল ডেটা কিনতে হয় না। বাহ! শহরের সব সুযোগ-সুবিধাই চলে এসেছে গ্রামে! শুনে বিস্মিত হলাম। এমন স্বপ্নই দেখেছি। বহু ভাঙন আর উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে গেছেন আমাদের কৃষক। তবে কালক্রমে সামনে এগোচ্ছেন। এ কৃতিত্ব তাঁদের নিজের। সরকারের সাপোর্ট ছিল। তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে গণমাধ্যম। আমাদের কৃষক নিজের চেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছেন।
বোরোর খেতে পানি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আরেকজন কৃষক। নাম তাঁর চন্দন মণ্ডল। কৃষির আয়-উন্নতিতে যথেষ্টই সন্তুষ্ট তিনি। বলছিলেন, মধ্যস্বত্বভোগী কমিয়ে আনতে পারলে কৃষক ভালো দাম পাবেন। এই এলাকার কৃষিশ্রমিকেরা যথেষ্টই তুষ্ট। কৃষির বহুমুখী পরিবর্তন ও কৃষকের সুদিনের গল্প রয়েছে তাঁদের কাছেও। সবখানে যে একই চিত্র, তা নয়। কৃষকের প্রাপ্তির সঙ্গে অপ্রাপ্তির অনেক গল্পও রয়েছে। সময় ও অর্থনীতির নানা হিসাব তাঁদের কাছে। সেটিও মূল্যায়নের দাবি রাখছে। এই তো মাস দেড়েক আগে সিঙ্গাইর এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা হয়েছিল। নানান সংকটের বিষয় তুলে ধরেছিলেন এক কৃষক আলী ইব্রাহিম। বলছিলেন, কৃষিজমিতে বসেছে ইটের ভাটা। তাতে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। রোগব্যাধি বাড়ছে ফসলের এবং মানুষের।
নরসিংদীর মিনার হোসেন বলছিলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে কৃষিঋণ পেতে এখনো বেগ পেতে হয়। হতে হয় হয়রানির শিকার। বাধ্য হয়ে এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি। আরও একটি বিষয়ে আলোকপাত করলেন। বললেন, ‘রোগ-বালাই দমনে কীটনাশক দিচ্ছি, কিন্তু পরিমাণে ঠিকঠাক দিচ্ছি কি না, তা বলতে পারব না। কোম্পানির লোকজন যা দিয়ে যায়, তা-ই প্রয়োগ করছি। মনে মনে অস্বস্তি থেকে যায়।’
সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়টির কথা বলেছিলেন নাটোরের আতিক। কৃষিজমি কৃষকের হাতে থাকছে না। নিজের জমি বিক্রি করে দিয়ে অনেকেই হয়ে উঠছেন কৃষিশ্রমিক। এমন একজনের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম মানিকগঞ্জের খাসেরচরে। সুজন নামের এক কৃষক। তিনি ৪০ শতাংশ জমিতে পেঁপের চাষ করে বেশ লাভবান। কিন্তু ভয়ে আছেন, সামনের বছর এ জমিতে চাষ করতে পারবেন কি না। কারণ জমিটি তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন কোনো এক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে। জানালেন আশপাশের অনেক জমিই বিক্রি করে দিয়েছেন কৃষকেরা। এখন পর্যন্ত কৃষকের হাতে থাকলেও কাগজে-কলমে জমির মালিক আর কৃষক নেই।
বাস্তবতা হলো, দিগন্তজোড়া খেতে সবুজ কার্পেটের মতো যে ফসলি সৌন্দর্য দেখি, সেটি দৃশ্যত স্বস্তিজাগানিয়া হলেও কোনো কৃষকই আর বেশি জমির মালিক নেই। সবাই সামান্য এক টুকরো জমিতে কৃষিকাজ করছেন। দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে জমি। জমিহীন হয়ে পড়ছেন কৃষক। এখন যাঁরা বাণিজ্যিক কৃষি করছেন, তাঁরা জমি ভাড়া নিয়ে কৃষিকাজ করছেন। যাঁরা বড় আকারের কৃষি প্রকল্প গড়ে তুলছেন, তাঁরা একরের পর একর জমিতে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি প্রকল্প গড়ে তুলছেন। কিন্তু আবহমান বাংলার সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে যে কৃষকের মাধ্যমে, মহান মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন যে কৃষক, তাঁদের কৃষির পরিধি দিনে দিনে সংকীর্ণ হয়ে আসছে। তারপরও ফসলি বৈচিত্র্য আর শস্যের নিবিড়তা তাঁদের এখনো যথেষ্ট সন্তুষ্ট রেখেছে। বাঙালির নিজস্ব জীবনব্যবস্থার শক্তিকে জাগিয়ে রাখতে এই কৃষকশ্রেণির কথাই বেশি করে ভাবতে হবে আমাদের। ফসলের মাঠে প্রকৃত কৃষকের অংশীদারত্ব বড় হয়ে থাক—এটাই প্রত্যাশা।
দিগন্তজোড়া খেতে সবুজ কার্পেটের মতো যে ফসলি সৌন্দর্য দেখি, সেটি দৃশ্যত স্বস্তিজাগানিয়া হলেও কোনো কৃষকই আর বেশি জমির মালিক নেই। সবাই সামান্য এক টুকরো জমিতে কৃষিকাজ করছেন। দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে জমি। জমিহীন হয়ে পড়ছেন কৃষক।
চলছে রক্তঝরা মার্চ। বাঙালির সাহস ও সংগ্রামের সবচেয়ে গর্বিত সময়। বহু সংগ্রামের পথ পেরিয়ে এই মাসেই বাঙালি মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পায়। আর দুদিন পরেই স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২তম জন্মবার্ষিকী। এই গর্বিত সময়ে মহান নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ ও এ দেশের সোনার মানুষ কৃষকদের এখনকার জীবন-জীবিকার খোঁজ নিতে তিনটি মাস ধরে যেখানেই গিয়েছি কৃষকদের কাছে, জানতে চেয়েছি তাঁরা আসলে কেমন আছেন? যেমন সপ্তাহ দুই আগে গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জে।
ফাগুন পেরিয়ে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে পড়ে গেছে চৈত্রের বাতাস। মানিকগঞ্জের বৈচিত্র্যময় কৃষির এলাকা সিঙ্গাইর উপজেলার খালাসিপাড়া। এখানকারই একটি গ্রাম খাসেরচর। গাড়ি থেকে নেমে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল একটা বাড়ি। গ্রামের একটা গৃহস্থবাড়ি যেমন হয়। আগে গ্রামাঞ্চলে যেমন জীর্ণ ভাঙা বাড়ি চোখে পড়ত, এখন তেমনটি আর চোখে পড়ে না। এখন গ্রামের অনেক বাড়িই পাকা, নয়তো টিনের চালার ঘর। খাসেরচরের যে বাড়িটির কথা বলছি, এটি আধা পাকা একটি বাড়ি। এগিয়ে এলেন গৃহকর্তা। নাম সিরাজুল ইসলাম। বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হবে। এখনো বেশ শক্ত সামর্থ্য। কথা হলো তাঁর সঙ্গে। আমাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির উঠোনে। ঘরের বারান্দায় বসতে দিলেন। কৃষিজীবী সিরাজুল ইসলাম অল্পস্বল্প ব্যবসা করেন। গত ২৪ বছর তিনি এই বাড়িতে আছেন। বলছিলেন, ‘অসাধারণ সুখী পরিবার তাঁর। জীবনে তৃপ্তিও আছে। উঠোনের চারদিকে চারটি ঘর। দুটি থাকার ঘর। একটি রান্নাবান্নার। আর একটি ঘর গরুর। সেখানে দুটি গরু রয়েছে। ‘প্রতিবছর দুটি করে গরু মোটাতাজা করে কোরবানির সময় বিক্রি করি। এতে হাতে বেশ কিছু নগদ টাকা আসে।’ বলছিলেন সিরাজুল। ‘কৃষিকাজ করে এখন বেশ আয়-উন্নতি হয়।’ সিরাজুল ইসলাম নিজের চোখে দেখা কৃষি উন্নতির কথা বলছিলেন। মাঠে মাঠে ফসলের বৈচিত্র্য বেড়েছে। তবে কৃষকের নিজের জমি কমছে। এই এলাকার প্রতি বাড়িরই কেউ না কেউ বিদেশে থাকে। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায় কৃষিকাজ হয়, গরু কেনে। জানালেন সিরাজুল ইসলাম। তার মানে এই অঞ্চলের কৃষিতে বিনিয়োগের একটা বড় অংশই আসে রেমিট্যান্স থেকে। শুধু এ অঞ্চল নয়, সারা দেশেই কৃষিতে বিনিয়োগের বড় একটা অংশ আসে অকৃষিজ পেশা থেকে। কেউ বিদেশ থেকে টাকা পাঠায়, কেউ বা গার্মেন্টস বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বাড়িতে টাকা পাঠায়। সেই টাকায় কৃষিকাজ হয়।
সিরাজুল ইসলামের বাড়ি থেকে বের হয়ে এগিয়ে গেলাম কৃষিখেতের দিকে। ফসলের বৈচিত্র্যে অনন্য খাসেরচরের মাঠ। এক জমিতে শিম চাষ হচ্ছে, পাশের জমিতেই বেগুন, পেঁপে, কলা, লালশাক, ধনে, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, ভুট্টা, ধান। মাঠে কাজ করছিলেন কৃষক রজব আলী। তাঁর জমি আছে চার পাখি। কৃষিকাজের পাশাপাশি ব্যবসা আছে। এটিও কৃষকের একধরনের সচ্ছলতা। আরেক কৃষকের নাম তাসের খালাসি। ছোট্ট একটি কুমড়াখেত এখানে তাঁর। দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। করোনার সময় দেশে ফিরে এসে এখন কৃষিকাজই করছেন। বলছিলেন, একই জমিতে সারা বছর চারটি ফসল চাষ করেন। এ ক্ষেত্রে বীজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বল্প সময়ে ফসল উত্তোলনের জাত আবিষ্কারের ফলে কৃষক একই জমিতে বছরে চারটি পর্যন্ত চাষ করতে পারছেন। সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আর একটু এগোতেই চোখে পড়ল পাম্প দিয়ে পানি সেচ দিচ্ছেন কৃষক। মাঠে নানা রকম সেচব্যবস্থা। বিদ্যুৎ চালিত পাম্প যেমন আছে, আছে ডিজেলচালিত পাম্প। সেচব্যবস্থার উন্নয়ন এ দেশের কৃষিকে এগিয়ে এনেছে বহুদূর। পাহাড়ি ভূমিতেও এখন সেচের মাধ্যমে চাষাবাদ হচ্ছে।
যাহোক, চোখে পড়ল কলাগাছ দিয়ে খেত সমতল করছেন এক কৃষক। নাম দেলোয়ার হোসেন। বলছিলেন, এক জমিতে একই সঙ্গে তিনি তিনটি ফসল বুনেছেন। প্রথমে ফলন আসবে মুন্নিশাকের। তারপর ফলবে শসা। এরপর মিলবে ধুন্দুল। এক জমিতে একই চাষে তিনটি ফসল মানে এক খরচে তিন গুণ ফল। তবে দেলোয়ার বলছিলেন কৃষিশ্রমিক পাওয়া ভার। পেলেও কৃষিশ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। শুধু মজুরি নয়, খাবারও ভালো দিতে হয়। খাবার হিসেবে মাছ-মাংস না পেলে কাজ করতে চায় না। এই জায়গাতেই যান্ত্রিক কৃষির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা যাচ্ছে।
পাশের জমিই দুলাল মিয়ার। তিনি জানলেন, বিঘায় বেগুন করে লাখ টাকা পেয়েছেন। শোনালেন লাভের হিসাব। বললেন, কৃষির উন্নতিতে অনেক কৃষক ভালো আছেন। কথা হলো এক শিক্ষিত তরুণ কৃষকের সঙ্গে। সুজন মোল্লা। তিনটি ফসল একসঙ্গে করেছেন। তাঁর কৃষি কৌশলটি বিজ্ঞানসম্মত ও লাভজনক। লেখাপড়া করে বাবার কৃষির দায়িত্ব নিয়েছেন। অল্পদিনেই কৃষির যশ বুঝে গেছেন। জানতে চাইলাম, আপনার ঘরে কী কী আছে? জানালেন, টিভি, ফ্রিজ, সোফা, প্রয়োজনীয় আসবাব। তারপর বললেন, ওয়াই-ফাইও আছে। এখন আর মোবাইল ডেটা কিনতে হয় না। বাহ! শহরের সব সুযোগ-সুবিধাই চলে এসেছে গ্রামে! শুনে বিস্মিত হলাম। এমন স্বপ্নই দেখেছি। বহু ভাঙন আর উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে গেছেন আমাদের কৃষক। তবে কালক্রমে সামনে এগোচ্ছেন। এ কৃতিত্ব তাঁদের নিজের। সরকারের সাপোর্ট ছিল। তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে গণমাধ্যম। আমাদের কৃষক নিজের চেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছেন।
বোরোর খেতে পানি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আরেকজন কৃষক। নাম তাঁর চন্দন মণ্ডল। কৃষির আয়-উন্নতিতে যথেষ্টই সন্তুষ্ট তিনি। বলছিলেন, মধ্যস্বত্বভোগী কমিয়ে আনতে পারলে কৃষক ভালো দাম পাবেন। এই এলাকার কৃষিশ্রমিকেরা যথেষ্টই তুষ্ট। কৃষির বহুমুখী পরিবর্তন ও কৃষকের সুদিনের গল্প রয়েছে তাঁদের কাছেও। সবখানে যে একই চিত্র, তা নয়। কৃষকের প্রাপ্তির সঙ্গে অপ্রাপ্তির অনেক গল্পও রয়েছে। সময় ও অর্থনীতির নানা হিসাব তাঁদের কাছে। সেটিও মূল্যায়নের দাবি রাখছে। এই তো মাস দেড়েক আগে সিঙ্গাইর এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা হয়েছিল। নানান সংকটের বিষয় তুলে ধরেছিলেন এক কৃষক আলী ইব্রাহিম। বলছিলেন, কৃষিজমিতে বসেছে ইটের ভাটা। তাতে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। রোগব্যাধি বাড়ছে ফসলের এবং মানুষের।
নরসিংদীর মিনার হোসেন বলছিলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে কৃষিঋণ পেতে এখনো বেগ পেতে হয়। হতে হয় হয়রানির শিকার। বাধ্য হয়ে এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি। আরও একটি বিষয়ে আলোকপাত করলেন। বললেন, ‘রোগ-বালাই দমনে কীটনাশক দিচ্ছি, কিন্তু পরিমাণে ঠিকঠাক দিচ্ছি কি না, তা বলতে পারব না। কোম্পানির লোকজন যা দিয়ে যায়, তা-ই প্রয়োগ করছি। মনে মনে অস্বস্তি থেকে যায়।’
সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়টির কথা বলেছিলেন নাটোরের আতিক। কৃষিজমি কৃষকের হাতে থাকছে না। নিজের জমি বিক্রি করে দিয়ে অনেকেই হয়ে উঠছেন কৃষিশ্রমিক। এমন একজনের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম মানিকগঞ্জের খাসেরচরে। সুজন নামের এক কৃষক। তিনি ৪০ শতাংশ জমিতে পেঁপের চাষ করে বেশ লাভবান। কিন্তু ভয়ে আছেন, সামনের বছর এ জমিতে চাষ করতে পারবেন কি না। কারণ জমিটি তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন কোনো এক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে। জানালেন আশপাশের অনেক জমিই বিক্রি করে দিয়েছেন কৃষকেরা। এখন পর্যন্ত কৃষকের হাতে থাকলেও কাগজে-কলমে জমির মালিক আর কৃষক নেই।
বাস্তবতা হলো, দিগন্তজোড়া খেতে সবুজ কার্পেটের মতো যে ফসলি সৌন্দর্য দেখি, সেটি দৃশ্যত স্বস্তিজাগানিয়া হলেও কোনো কৃষকই আর বেশি জমির মালিক নেই। সবাই সামান্য এক টুকরো জমিতে কৃষিকাজ করছেন। দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে জমি। জমিহীন হয়ে পড়ছেন কৃষক। এখন যাঁরা বাণিজ্যিক কৃষি করছেন, তাঁরা জমি ভাড়া নিয়ে কৃষিকাজ করছেন। যাঁরা বড় আকারের কৃষি প্রকল্প গড়ে তুলছেন, তাঁরা একরের পর একর জমিতে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি প্রকল্প গড়ে তুলছেন। কিন্তু আবহমান বাংলার সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে যে কৃষকের মাধ্যমে, মহান মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন যে কৃষক, তাঁদের কৃষির পরিধি দিনে দিনে সংকীর্ণ হয়ে আসছে। তারপরও ফসলি বৈচিত্র্য আর শস্যের নিবিড়তা তাঁদের এখনো যথেষ্ট সন্তুষ্ট রেখেছে। বাঙালির নিজস্ব জীবনব্যবস্থার শক্তিকে জাগিয়ে রাখতে এই কৃষকশ্রেণির কথাই বেশি করে ভাবতে হবে আমাদের। ফসলের মাঠে প্রকৃত কৃষকের অংশীদারত্ব বড় হয়ে থাক—এটাই প্রত্যাশা।
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
৯ ঘণ্টা আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১১ ঘণ্টা আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে