আলতাফ পারভেজ
২০২৪ সালের ‘আগস্টে’র প্রতিটি দিন যেন এক-একটা মাসের মতো দীর্ঘ। কত কিছু যে ঘটছে প্রতিদিন। উত্তেজনায় টগবগ করছে দেশ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের পর এমন সময় আর আসেনি এ দেশে।
বাংলাদেশে একই সঙ্গে বিপুল চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে এবারের আগস্ট। সেই সব সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে ইতিমধ্যে ভাবুকেরা লিখছেন, বলছেন। পুরো দেশ এখন তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে মেতে আছে।
এর মাঝেই এল ‘১৫ আগস্ট’। আগে থেকেই এটা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক স্পর্শকাতর দিন। আলোচিত দিন। এবারের আগস্টে এই দিনকে ঘিরে মনোযোগ, আলোচনা ও উত্তেজনা আগের চেয়ে বেড়েছে।
এসব আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গ—কীভাবে আমরা দেখব তাঁকে, কীভাবে তাঁর জীবন ও মৃত্যুকে স্মরণ করব আমরা, ভবিষ্যতে তাঁকে কোথায় রাখব? এসব নিয়ে নতুন করে সমাজে বিতর্ক উঠেছে। আলোচনা-অনুমান হচ্ছে। সামনে এ রকম আলোচনা আরও হবে বলে মনে করছি।
বিতর্ক মানেই খারাপ নয়। ‘পাবলিক ফিগার’ বা জননেতাদের নিয়ে ইতিহাসে বিতর্ক থাকে। বিশ্বজুড়ে ইতিহাসবিদেরা এসবকে স্বাস্থ্যকর হিসেবেই দেখেন। অন্তত একটা উদাহরণ দিই। লেনিনকে পুঁজিবাদী বিশ্ব পছন্দ করছে না। বহু আগে তিনি মারাও গেছেন। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াও নেই। কিন্তু গত কয়েক বছর লেনিনকে নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখেছি, খোদ আমেরিকায় তাঁকে নিয়ে শত শত একাডেমিক গবেষণা চলছে এখনো এবং সেসব গবেষণার মানও দুর্দান্ত। যতটুকু পড়েছি, প্রতিমুহূর্তে মনে হতো কত কম জানতাম ওনার সম্পর্কে।
একই কথা বলা যায়, এম কে গান্ধীর বেলায়। প্রতিবছর তাঁকে নিয়ে নতুন নতুন গবেষণাকাজ হচ্ছে। কেউ তথ্য-উপাত্ত হাজির করে দেখাচ্ছেন গান্ধী বর্ণবাদী ছিলেন, আবার অন্য কেউ দেখাচ্ছেন কীভাবে বিশ্বজুড়ে তাঁর আদর্শ ও রাজনৈতিক পদ্ধতি এখনো বিপুলভাবে প্রাসঙ্গিক। ভারতবর্ষের গান্ধীকে নিয়ে আফ্রিকাজুড়ে কী পরিমাণ যে লেখালেখি ও গবেষণা হচ্ছে, সেটা দক্ষিণ এশিয়ায় বসে আমরা অনুমানও করতে পারব না। এভাবে প্রতিদিন দুনিয়াজুড়ে ইতিহাসের গঠন ও পুনর্গঠন হয়। কোথাও কেউ সাইবার অ্যাক্ট করে সেই সব আটকানোর চেষ্টা করে না।
বাংলাদেশের পাকস্থলী এতটা শক্তিশালী নয়। এখানে বিতর্ক ও মতভেদকে নেতিবাচকভাবে দেখার রেওয়াজ। ইতিহাস নিয়ে, একাত্তর নিয়ে, মুজিবকে নিয়ে যেকোনো নতুন অনুসন্ধানের আগে ভাবতে হয় সমাজ কীভাবে নেবে সেটা, আওয়ামী লীগ কীভাবে নেবে, সাইবার অ্যাক্ট ঝামেলা করবে কি না, ডিজিটাল আইনে মামলা হবে কি না, মার খেতে হবে কি না।
অথচ বিশ্বের অন্যত্র রেওয়াজটা পুরোপুরি ভিন্ন। যে পাবলিক ফিগার বিশ্বের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতে যত প্রাসঙ্গিক, তাঁকে নিয়ে তত বিতর্ক চলছে। আবার যাঁদের নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে, তাঁরা তত নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।
বিশ্বজুড়ে প্রায় সব ‘বড় নেতা’কে নিয়ে হামেশা নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে। সেসব গবেষণায় ওই মানুষদের নিয়ে নতুন নতুন সত্য পাওয়া যাচ্ছে। সেসব ‘সত্য’ নিয়ে আবার পুনরায় ময়নাতদন্ত হচ্ছে। কেউ তাতে বাধা দেওয়ার নেই। তাতে ওই সব পাবলিক ফিগারকে নিয়ে পাঠ-পুনঃপাঠ ক্রমে বাড়ছেই। গান্ধী থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা পর্যন্ত বহুজনের বেলাতে এ রকমই ঘটছে। ঐতিহাসিক ঘটনাবলির বেলায়ও নিত্যনতুন সত্য খুঁজে আনছেন গবেষকেরা। প্রকাশ্যে সাবলীলভাবে সেসব প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে সেই সব ঘটনাবলি নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে।
কিন্তু গত ১৫ বছর বাংলাদেশে আমরা কী দেখলাম? স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে আমলাতন্ত্রের আইনকানুনে রীতিমতো আবদ্ধ দেখলাম। তাঁকে নিয়ে স্তুতিই কেবল অনুমোদিত ছিল। বিপুল খরচাপাতি হয়েছে তাঁকে নিয়ে তৈরি নানান কর্মসূচিতে। টনে টনে কাগজ মুদ্রিত হয়েছে তাঁর কথায়। শত শত কোটি টাকা নিয়েছেন নানা জন এসব কারবার থেকে। অথচ শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা ভালো একটা জীবনীও পেলাম না আমরা।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সিলেবাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাঁর নাম ব্যবহার করে বহু বিভাগ, ‘চেয়ার’, ‘কর্নার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাঠ্যবইগুলোয় তাঁকে নিয়ে অনেক প্রবন্ধ ও কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে এসব হয়েছে। এসবে যুক্ত থাকা, অংশ নেওয়া, উপস্থিত থাকা, সম্মতি জোগানো, অভিনন্দন জানানোকে আমলাতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতায় পরিণত করা হয়েছিল। তাতে ইন্ধন জোগানোর জন্য অনেক সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব ঘটেছিল। এসব নিয়ে যেকোনো ভিন্নমতকে প্রায় দেশদ্রোহীর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বহু বাঙালিকে তাদের নেতা মুজিবের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘জাতির জনক’ ইত্যাদি না লেখার জন্য হেনস্তা করা হয়েছে। বহু আমলা এসব কাজে উৎসাহ ও নেতৃত্ব দিয়ে ভাগ্য বদলে নিয়েছেন। যাঁদের সর্বোচ্চ যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব হওয়ার কথা ছিল, তাঁরা এসব করে সচিব, সিনিয়র সচিব হয়েছেন। রাষ্ট্রদূত হয়েছেন।
কিন্তু শেষমেশ তার ফল কী হলো? নতুন প্রজন্মের ভেতর মুজিবকে স্বমহিমায় কি প্রতিষ্ঠা করা গেল? উত্তর নিশ্চয়ই সবার জানা।
গত ১৫ বছরে যারা স্কুল-কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এল, তারা তো আমলাতান্ত্রিক মুজিব-বর্ষগুলো পেরিয়ে আসা প্রাণ। তাদের কাছে তো মুজিবের কোনো সমালোচনা ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। তারা তো মুজিব-সম্পর্কিত প্রচার-প্রচারণার ভেতরই বড় হওয়া মানুষ। কিন্তু তাদের এখনকার প্রতিক্রিয়া থেকে কী বার্তা পাই আমরা?
নিশ্চয়ই প্রশ্ন তোলা যায়, এ অবস্থার দায় কার এবং এ থেকে কোনো আত্মসমালোচনা করবে কি না তখনকার সংশ্লিষ্টরা? সেই সব আমলা এখন কোথায়? সচেতন বাড়াবাড়ির মাধ্যমে এই অবস্থা তৈরির মাধ্যমে তাঁরা আসলে কার স্বার্থ হাসিল করেছেন? জীবন্ত মুজিবকে নিজেদের ইচ্ছার ফসিলে পরিণত করেছিলেন তাঁরা কার পৃষ্ঠপোষকতায়?
বিগত বছরগুলোর শেষ দিকে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আয়োজিত প্রায় সব কাজে সাধারণ জনগণ তো দূরের কথা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল অতি ক্ষীণ। উচ্চপদস্থ একদল মানুষকে সামনে রেখে কিছু স্তুতিজীবী এসবে থাকতেন। প্রাণহীন এসব অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয় নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে নির্ধারিত ছকে কৃত্রিমভাবে শেষ হতো।
১৯৭৫ সালে শারীরিকভাবে মারা যাওয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে হত্যা করা হয়েছিল। মুজিবকে জনতার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। জাতীয় নেতা থেকে তাঁকে দলীয় নেতায় পরিণত করা হয়। কার্যত তাঁকে জনগণ ও বাস্তব মানবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।
স্বাধীনতাসংগ্রামী মুজিব প্রশাসকও ছিলেন কয়েক বছর। তাঁর প্রশাসনিক পদক্ষেপের অনেক সমালোচনা আছে। এটা অস্বাভাবিক নয়। তাঁর জীবনের সব দিক নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলে সেসব থেকে তরুণেরা শিখতে পারত অনেক কিছু। বিশ্বে সমালোচনা ও ভুলের ঊর্ধ্বে কোনো নেতা নেই। ছিলেন না।
কিন্তু একদল তোষামোদকারী মুজিবকে সব ভুলের ঊর্ধ্বে দেখাতে গিয়ে দেবতার চরিত্র দানের চেষ্টায় তাঁকে মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন। এই ছিনিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াটা ছিল নাগরিকদের জন্য খুবই অমর্যাদাকর। তারই প্রতিক্রিয়া দেখেছি আমরা ২০২৪-এর আগস্টে।
সম্প্রতি গণ-আন্দোলনের পর শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্থাপিত যেসব স্থাপনা আক্রান্ত হয়েছে, সেসব আসলে ১৯৭৫ সালে মারা যাওয়া স্বাধীনতাসংগ্রামী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আক্রোশবশত হয়েছে ভাবলে ভুল হওয়ার শঙ্কা আছে। সেসব হয়েছে তাঁকে নিয়ে গত ১৫ বছর যেসব আমলাতান্ত্রিক বাড়াবাড়ি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে। তাঁকে জননেতার বদলে দেবতায় পরিণত করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। তাঁকে বাংলার-মানব-সমাজ থেকে কেড়ে নেওয়ার আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে আড়াল করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। যাঁরা উল্লিখিত সাম্প্রতিক ভাঙচুরকে মুজিববিরোধী আক্রোশ আকারে দেখছেন, তাঁরা আসলে এখনকার সমাজ-মনস্তত্ত্ব পাঠ করতে অনেকাংশে ব্যর্থ বলতে চাই।
প্রকৃতপক্ষে এবারের আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানকে আমলাতন্ত্র ও একটা দলের হাত থেকে জনতার কাছে ফিরে আসার লক্ষণ দেখছি।
এই মুজিবকে নিয়ে মানুষ এখন ইচ্ছামতো কথা বলতে পারবে, লিখতে পারবে, প্রশংসা করতে পারবে, সমালোচনা করতে পারবে, নতুন করে অনুসন্ধান করতে পারবে, বিতর্ক করতে পারবে। কারণ তিনি তাঁদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ জন। তাঁকে স্বাধীনভাবে পর্যালোচনার কথা বলতে গিয়ে কাউকে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে হবে না।
মুজিবের জীবন অনুসন্ধানের বহু দিক এখনো বাকি। তরুণেরা এখন থেকে স্বাধীনভাবে সেসব খুঁজতে পারবে। বলা যায়, অবশেষে মুজিব মুক্তি পেলেন। এখন বরং দেখা দরকার এই মুজিব যেন বেহাত না হন।
একইভাবে মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, জিয়াউর রহমান, কর্নেল আবু তাহের, সিরাজ সিকদারসহ আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যেন সব সময় জনতার আলাপ-আলোচনা-সমালোচনা-প্রশংসার জন্য উন্মুক্ত থাকেন। তাঁদের স্মরণ করার দায় যেন জনগণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া না হয়। সেসব স্মরণ উদ্যোগ যেন সাইবার আইনের মতো সব কালো আইনের কারাগার থেকে মুক্ত থাকে।
আলতাফ পারভেজ, লেখক ও ইতিহাস গবেষক
২০২৪ সালের ‘আগস্টে’র প্রতিটি দিন যেন এক-একটা মাসের মতো দীর্ঘ। কত কিছু যে ঘটছে প্রতিদিন। উত্তেজনায় টগবগ করছে দেশ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের পর এমন সময় আর আসেনি এ দেশে।
বাংলাদেশে একই সঙ্গে বিপুল চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে এবারের আগস্ট। সেই সব সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে ইতিমধ্যে ভাবুকেরা লিখছেন, বলছেন। পুরো দেশ এখন তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে মেতে আছে।
এর মাঝেই এল ‘১৫ আগস্ট’। আগে থেকেই এটা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক স্পর্শকাতর দিন। আলোচিত দিন। এবারের আগস্টে এই দিনকে ঘিরে মনোযোগ, আলোচনা ও উত্তেজনা আগের চেয়ে বেড়েছে।
এসব আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গ—কীভাবে আমরা দেখব তাঁকে, কীভাবে তাঁর জীবন ও মৃত্যুকে স্মরণ করব আমরা, ভবিষ্যতে তাঁকে কোথায় রাখব? এসব নিয়ে নতুন করে সমাজে বিতর্ক উঠেছে। আলোচনা-অনুমান হচ্ছে। সামনে এ রকম আলোচনা আরও হবে বলে মনে করছি।
বিতর্ক মানেই খারাপ নয়। ‘পাবলিক ফিগার’ বা জননেতাদের নিয়ে ইতিহাসে বিতর্ক থাকে। বিশ্বজুড়ে ইতিহাসবিদেরা এসবকে স্বাস্থ্যকর হিসেবেই দেখেন। অন্তত একটা উদাহরণ দিই। লেনিনকে পুঁজিবাদী বিশ্ব পছন্দ করছে না। বহু আগে তিনি মারাও গেছেন। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াও নেই। কিন্তু গত কয়েক বছর লেনিনকে নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখেছি, খোদ আমেরিকায় তাঁকে নিয়ে শত শত একাডেমিক গবেষণা চলছে এখনো এবং সেসব গবেষণার মানও দুর্দান্ত। যতটুকু পড়েছি, প্রতিমুহূর্তে মনে হতো কত কম জানতাম ওনার সম্পর্কে।
একই কথা বলা যায়, এম কে গান্ধীর বেলায়। প্রতিবছর তাঁকে নিয়ে নতুন নতুন গবেষণাকাজ হচ্ছে। কেউ তথ্য-উপাত্ত হাজির করে দেখাচ্ছেন গান্ধী বর্ণবাদী ছিলেন, আবার অন্য কেউ দেখাচ্ছেন কীভাবে বিশ্বজুড়ে তাঁর আদর্শ ও রাজনৈতিক পদ্ধতি এখনো বিপুলভাবে প্রাসঙ্গিক। ভারতবর্ষের গান্ধীকে নিয়ে আফ্রিকাজুড়ে কী পরিমাণ যে লেখালেখি ও গবেষণা হচ্ছে, সেটা দক্ষিণ এশিয়ায় বসে আমরা অনুমানও করতে পারব না। এভাবে প্রতিদিন দুনিয়াজুড়ে ইতিহাসের গঠন ও পুনর্গঠন হয়। কোথাও কেউ সাইবার অ্যাক্ট করে সেই সব আটকানোর চেষ্টা করে না।
বাংলাদেশের পাকস্থলী এতটা শক্তিশালী নয়। এখানে বিতর্ক ও মতভেদকে নেতিবাচকভাবে দেখার রেওয়াজ। ইতিহাস নিয়ে, একাত্তর নিয়ে, মুজিবকে নিয়ে যেকোনো নতুন অনুসন্ধানের আগে ভাবতে হয় সমাজ কীভাবে নেবে সেটা, আওয়ামী লীগ কীভাবে নেবে, সাইবার অ্যাক্ট ঝামেলা করবে কি না, ডিজিটাল আইনে মামলা হবে কি না, মার খেতে হবে কি না।
অথচ বিশ্বের অন্যত্র রেওয়াজটা পুরোপুরি ভিন্ন। যে পাবলিক ফিগার বিশ্বের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতে যত প্রাসঙ্গিক, তাঁকে নিয়ে তত বিতর্ক চলছে। আবার যাঁদের নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে, তাঁরা তত নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।
বিশ্বজুড়ে প্রায় সব ‘বড় নেতা’কে নিয়ে হামেশা নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে। সেসব গবেষণায় ওই মানুষদের নিয়ে নতুন নতুন সত্য পাওয়া যাচ্ছে। সেসব ‘সত্য’ নিয়ে আবার পুনরায় ময়নাতদন্ত হচ্ছে। কেউ তাতে বাধা দেওয়ার নেই। তাতে ওই সব পাবলিক ফিগারকে নিয়ে পাঠ-পুনঃপাঠ ক্রমে বাড়ছেই। গান্ধী থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা পর্যন্ত বহুজনের বেলাতে এ রকমই ঘটছে। ঐতিহাসিক ঘটনাবলির বেলায়ও নিত্যনতুন সত্য খুঁজে আনছেন গবেষকেরা। প্রকাশ্যে সাবলীলভাবে সেসব প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে সেই সব ঘটনাবলি নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে।
কিন্তু গত ১৫ বছর বাংলাদেশে আমরা কী দেখলাম? স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে আমলাতন্ত্রের আইনকানুনে রীতিমতো আবদ্ধ দেখলাম। তাঁকে নিয়ে স্তুতিই কেবল অনুমোদিত ছিল। বিপুল খরচাপাতি হয়েছে তাঁকে নিয়ে তৈরি নানান কর্মসূচিতে। টনে টনে কাগজ মুদ্রিত হয়েছে তাঁর কথায়। শত শত কোটি টাকা নিয়েছেন নানা জন এসব কারবার থেকে। অথচ শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা ভালো একটা জীবনীও পেলাম না আমরা।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সিলেবাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তাঁর নাম ব্যবহার করে বহু বিভাগ, ‘চেয়ার’, ‘কর্নার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাঠ্যবইগুলোয় তাঁকে নিয়ে অনেক প্রবন্ধ ও কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে এসব হয়েছে। এসবে যুক্ত থাকা, অংশ নেওয়া, উপস্থিত থাকা, সম্মতি জোগানো, অভিনন্দন জানানোকে আমলাতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতায় পরিণত করা হয়েছিল। তাতে ইন্ধন জোগানোর জন্য অনেক সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব ঘটেছিল। এসব নিয়ে যেকোনো ভিন্নমতকে প্রায় দেশদ্রোহীর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বহু বাঙালিকে তাদের নেতা মুজিবের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘জাতির জনক’ ইত্যাদি না লেখার জন্য হেনস্তা করা হয়েছে। বহু আমলা এসব কাজে উৎসাহ ও নেতৃত্ব দিয়ে ভাগ্য বদলে নিয়েছেন। যাঁদের সর্বোচ্চ যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব হওয়ার কথা ছিল, তাঁরা এসব করে সচিব, সিনিয়র সচিব হয়েছেন। রাষ্ট্রদূত হয়েছেন।
কিন্তু শেষমেশ তার ফল কী হলো? নতুন প্রজন্মের ভেতর মুজিবকে স্বমহিমায় কি প্রতিষ্ঠা করা গেল? উত্তর নিশ্চয়ই সবার জানা।
গত ১৫ বছরে যারা স্কুল-কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এল, তারা তো আমলাতান্ত্রিক মুজিব-বর্ষগুলো পেরিয়ে আসা প্রাণ। তাদের কাছে তো মুজিবের কোনো সমালোচনা ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। তারা তো মুজিব-সম্পর্কিত প্রচার-প্রচারণার ভেতরই বড় হওয়া মানুষ। কিন্তু তাদের এখনকার প্রতিক্রিয়া থেকে কী বার্তা পাই আমরা?
নিশ্চয়ই প্রশ্ন তোলা যায়, এ অবস্থার দায় কার এবং এ থেকে কোনো আত্মসমালোচনা করবে কি না তখনকার সংশ্লিষ্টরা? সেই সব আমলা এখন কোথায়? সচেতন বাড়াবাড়ির মাধ্যমে এই অবস্থা তৈরির মাধ্যমে তাঁরা আসলে কার স্বার্থ হাসিল করেছেন? জীবন্ত মুজিবকে নিজেদের ইচ্ছার ফসিলে পরিণত করেছিলেন তাঁরা কার পৃষ্ঠপোষকতায়?
বিগত বছরগুলোর শেষ দিকে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আয়োজিত প্রায় সব কাজে সাধারণ জনগণ তো দূরের কথা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল অতি ক্ষীণ। উচ্চপদস্থ একদল মানুষকে সামনে রেখে কিছু স্তুতিজীবী এসবে থাকতেন। প্রাণহীন এসব অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয় নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে নির্ধারিত ছকে কৃত্রিমভাবে শেষ হতো।
১৯৭৫ সালে শারীরিকভাবে মারা যাওয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে হত্যা করা হয়েছিল। মুজিবকে জনতার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। জাতীয় নেতা থেকে তাঁকে দলীয় নেতায় পরিণত করা হয়। কার্যত তাঁকে জনগণ ও বাস্তব মানবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।
স্বাধীনতাসংগ্রামী মুজিব প্রশাসকও ছিলেন কয়েক বছর। তাঁর প্রশাসনিক পদক্ষেপের অনেক সমালোচনা আছে। এটা অস্বাভাবিক নয়। তাঁর জীবনের সব দিক নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলে সেসব থেকে তরুণেরা শিখতে পারত অনেক কিছু। বিশ্বে সমালোচনা ও ভুলের ঊর্ধ্বে কোনো নেতা নেই। ছিলেন না।
কিন্তু একদল তোষামোদকারী মুজিবকে সব ভুলের ঊর্ধ্বে দেখাতে গিয়ে দেবতার চরিত্র দানের চেষ্টায় তাঁকে মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন। এই ছিনিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াটা ছিল নাগরিকদের জন্য খুবই অমর্যাদাকর। তারই প্রতিক্রিয়া দেখেছি আমরা ২০২৪-এর আগস্টে।
সম্প্রতি গণ-আন্দোলনের পর শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্থাপিত যেসব স্থাপনা আক্রান্ত হয়েছে, সেসব আসলে ১৯৭৫ সালে মারা যাওয়া স্বাধীনতাসংগ্রামী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আক্রোশবশত হয়েছে ভাবলে ভুল হওয়ার শঙ্কা আছে। সেসব হয়েছে তাঁকে নিয়ে গত ১৫ বছর যেসব আমলাতান্ত্রিক বাড়াবাড়ি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে। তাঁকে জননেতার বদলে দেবতায় পরিণত করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। তাঁকে বাংলার-মানব-সমাজ থেকে কেড়ে নেওয়ার আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে আড়াল করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। যাঁরা উল্লিখিত সাম্প্রতিক ভাঙচুরকে মুজিববিরোধী আক্রোশ আকারে দেখছেন, তাঁরা আসলে এখনকার সমাজ-মনস্তত্ত্ব পাঠ করতে অনেকাংশে ব্যর্থ বলতে চাই।
প্রকৃতপক্ষে এবারের আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানকে আমলাতন্ত্র ও একটা দলের হাত থেকে জনতার কাছে ফিরে আসার লক্ষণ দেখছি।
এই মুজিবকে নিয়ে মানুষ এখন ইচ্ছামতো কথা বলতে পারবে, লিখতে পারবে, প্রশংসা করতে পারবে, সমালোচনা করতে পারবে, নতুন করে অনুসন্ধান করতে পারবে, বিতর্ক করতে পারবে। কারণ তিনি তাঁদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ জন। তাঁকে স্বাধীনভাবে পর্যালোচনার কথা বলতে গিয়ে কাউকে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে হবে না।
মুজিবের জীবন অনুসন্ধানের বহু দিক এখনো বাকি। তরুণেরা এখন থেকে স্বাধীনভাবে সেসব খুঁজতে পারবে। বলা যায়, অবশেষে মুজিব মুক্তি পেলেন। এখন বরং দেখা দরকার এই মুজিব যেন বেহাত না হন।
একইভাবে মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, জিয়াউর রহমান, কর্নেল আবু তাহের, সিরাজ সিকদারসহ আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যেন সব সময় জনতার আলাপ-আলোচনা-সমালোচনা-প্রশংসার জন্য উন্মুক্ত থাকেন। তাঁদের স্মরণ করার দায় যেন জনগণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া না হয়। সেসব স্মরণ উদ্যোগ যেন সাইবার আইনের মতো সব কালো আইনের কারাগার থেকে মুক্ত থাকে।
আলতাফ পারভেজ, লেখক ও ইতিহাস গবেষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে