মহসিন মিঠু
গতকালের পর নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা
অন্তর্বর্তী সরকার যদি শুধু দ্রুত নির্বাচন পরিচালনা করার দায়িত্বে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে দেশের রাজনৈতিক ধরন, আচরণ ও রীতিনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আশা করার কোনোই কারণ নেই। তড়িঘড়ি নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু ক্ষমতার পালাবদল হবে, দেয়ালে কার ছবি থাকবে সেটির বদল হবে, যারা আগে নির্যাতিত ছিল তারা নির্যাতনকারীতে পরিণত হবে, তাতে সাধারণ মানুষের ভাগ্য অপরিবর্তিতই থেকে যাবে। নিঃসন্দেহে সাধারণ জনতা এবং গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী কেউ সেটি চাইবে না। তাই রাজনৈতিক সরকারে পুরোনো বাজে অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে এবং জেন-জি’র নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য পূরণ করতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে কেবল ৯০ দিনের মধ্যে একটি নির্বাচন পরিচালনার চেয়ে আরও অনেক বেশি কিছু করতে হবে। কিন্তু ‘অনেক বেশি’ লক্ষ্যের মধ্যে কী কী থাকতে পারে? এসব লক্ষ্য অর্জনের আইনি বা সাংবিধানিক ভিত্তি কি এই সরকারের থাকবে? তারা কি আগের রাজনৈতিক সরকারের নিয়োগকৃত, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পাবে?
অতীত থেকে শিক্ষা
কথায় বলে, ‘ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়’। যদিও বাঙালি জাতির বেলতলায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা অনেক, তবে অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া অপরিহার্য। ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত অরাজনৈতিক সরকার দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক দুর্নীতি নির্মূলের লক্ষ্যে তারা উভয় রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করেছিল।
প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলে পারিবারিক রাজনৈতিক চর্চা ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দলের মধ্যে সংস্কারপন্থীদের সংগঠিত করেছিল এবং চাপ প্রয়োগ করেছিল। পরিতাপের বিষয়, দুর্নীতি নির্মূল অভিযানে সম্পৃক্ত অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে যায় এবং রাজনৈতিক দলের সংস্কারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি নির্বাচনের আয়োজন করে, যাতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে। আব্দুল জলিল, আমির হোসেন আমু ও মান্নান ভূঁইয়ার মতো সংস্কারপন্থী নেতারা পরবর্তীকালে তাঁদের নিজ নিজ দল কর্তৃক নিগৃহীত হন।
ছাত্র-জনতার এই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর দেশের মানুষ ব্যাপক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে, যা নতুন বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি হিসেবে
কাজ করতে পারে।
বাস্তবতা হলো, একটি দেশকে, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ট্রান্সফর্ম করা বেশ দুরূহ কাজ। আমরা দেখেছি, ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের অভিলাষী লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল, যার কারণ ছিল সাংবিধানিক ক্ষমতাবিহীন এবং অনির্বাচিত সরকার হয়েও স্বল্প সময়ে অনেক বেশি কিছু অর্জনের প্রচেষ্টা। বর্তমান পরিস্থিতি ২০০৭-২০০৯ সালের চেয়ে আরও অনেক বেশি জটিল। অতএব, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করার আগে নতুন সরকারকে স্পষ্ট নীতি নির্ধারণ করতে হবে এবং কর্মপদ্ধতিও ঠিক করে নিতে হবে এবং সেগুলো জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। উপরন্তু, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে কী কী কাজ করতে হবে, তা-ও ঠিক করে নিতে হবে। মোটা দাগে পাঁচটি বিষয়ে সংস্কার হলে জনগণের নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ হবে বলে আমি মনে করি।
সংস্কারের মূল ক্ষেত্র
১. রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের অবসান: জনগণ পারিবারিক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে, যা মূলত কোটাভিত্তিক পক্ষপাতিত্বের একটি রূপ। নেতৃত্ব নির্বাচন হতে হবে যোগ্যতার মাপকাঠিতে, পারিবারিক সম্পর্কের মাধ্যমে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নয়। পরিবারতন্ত্রনির্ভর নেতা নির্বাচনের প্রচলন দেশের সরকারের সর্বোচ্চ পদ থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রচলিত, যার ফলে ক্ষমতার বলয় শুধু কতিপয় পরিবারের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত। এই পরিবারভিত্তিক ‘কোটাব্যবস্থা’ দূর করা গেলে জনগণের হাতে ক্ষমতা যাবে এবং পরিবারতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। ক্ষমতা বণ্টনে এ ধরনের পরিবর্তন দুর্নীতি ও নিপীড়নকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে। মোটকথা, রাজনৈতিক দলগুলোকে অভ্যন্তরীণভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। দলীয় নেতৃত্ব বা জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন অভ্যন্তরীণ দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে করতে হবে। এই প্রক্রিয়া জবাবদিহি নিশ্চিত করবে, দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বে উন্নীত করবে এবং আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলবে।
২. ভোটের অধিকার এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নিশ্চয়তা: স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা দেখেছি, ক্ষমতার পালাবদলে প্রায় সব সময়েই প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রক্তপাতবিহীন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৮১, ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০৬ কিংবা সর্বশেষ ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তরে দেশ উত্তাল হয়েছে, সংখ্যাভেদে মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ এটি কখনোই প্রত্যাশা করেনি। গত ৫৩ বছরে আমরা রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন, পরবর্তী সময়ে বিলুপ্তি এবং অন্যান্য অনেক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছি। যদিও এই পরিবর্তনগুলোর প্রেক্ষাপট ও কারণ ভিন্ন ছিল, তবে প্রতিটি ঘটনারই মূল কারণ ছিল জনগণের রায় ছাড়া অন্য উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখার বা দখল করার ইচ্ছা। নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে নতুন সরকারকে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি টেকসই প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে, যা গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি।
৩. পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসন অরাজনৈতিকীকরণ ও দুর্নীতি নির্মূলকরণ: এটি কোনো গোপন বিষয় নয় যে দেশের সমস্ত সরকারি ক্ষেত্র অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত। বলা বাহুল্য, দেশের সবচেয়ে বড় ধরনের দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড সাধারণত রাজনীতিবিদদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটে, যা সরকারি কর্মচারীদের তাঁদের নিজস্ব দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার লাইসেন্স দেয়, যার শিকার হয় সাধারণ মানুষ। আমরা সবাই জানি, সরকারি কর্মচারীদের চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুধু কোটা দ্বারাই প্রভাবিত হয় না, বরং রাজনৈতিক সুপারিশ, প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং ঘুষের বাণিজ্যও সমানভাবে প্রভাবিত করে। সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হবে শুধু মেধার ভিত্তিতে, কোনো ঘুষ ছাড়া, প্রশ্নপত্র ফাঁস বাণিজ্যমুক্ত এবং রাজনৈতিক সুপারিশ ছাড়া। জনগণের এই প্রত্যাশা শুধু তাদের সাংবিধানিক অধিকারই নয়, এটি নিশ্চিত করা গেলে প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ বন্ধ করা যাবে, যা দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আবশ্যক। তাই সব ধরনের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার জন্য আমাদের কর্মসংস্থান প্রক্রিয়া সংস্কারের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
৪. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ: গত ১৫ বছর দেশটি অতিরিক্ত মাত্রায় সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে গেছে। অধিকাংশ টিভি বা সংবাদপত্র তাদের পছন্দমতো খবর প্রকাশ করতে পারেনি। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে ইন্টারনেট এবং যোগাযোগ ব্ল্যাকআউটের ঘটনাও ঘটেছে, যা জাতিকে বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সরকারের ইচ্ছায় বন্ধ হয়েছে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, আড়ি পাতা হয়েছে মানুষের ফোনে। একটি টেকসই গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই। তাই সংবাদমাধ্যমকে টেকসই উপায়ে স্বাধীন করতে হবে, যাতে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে হেডলাইনের ধরন না বদলায়।
৫. একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকরণ: সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগকে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে, আমরা অনেক প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত ও কার্যধারা প্রত্যক্ষ করেছি, যা বিচারব্যবস্থার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রকাশ করেছে। এই সমস্যা দেশের নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বিস্তৃত।
অকস্মাৎ গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে দেশের সামনে পুরোনো রাজনৈতিক রীতিনীতি সংস্কারের এক অপূর্ব সুযোগ এসেছে। যদিও এই মুহূর্তে জাতির সামনে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের প্রতি বিশ্বাস পুনঃস্থাপন, পুলিশকে পুনর্বাসনসহ অসংখ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রয়েছে নতুন বাংলাদেশ গঠনের এক সুবর্ণ সুযোগ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তাই গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা, সমান কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা এবং একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ অধ্যাপক ইউনূসকে অনেক সম্মান করেন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশকে আলোর পথ দেখাবে, পুরোনো নষ্ট রাজনৈতিক প্রচলন পেছনে ফেলে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গঠনের দিকে এগিয়ে যাবে, সেই প্রত্যাশা থাকল।
লেখক: অর্গানাইজেশনাল ট্রান্সফরমেশন এক্সপার্ট, উত্তর আমেরিকা
গতকালের পর নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা
অন্তর্বর্তী সরকার যদি শুধু দ্রুত নির্বাচন পরিচালনা করার দায়িত্বে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে দেশের রাজনৈতিক ধরন, আচরণ ও রীতিনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আশা করার কোনোই কারণ নেই। তড়িঘড়ি নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু ক্ষমতার পালাবদল হবে, দেয়ালে কার ছবি থাকবে সেটির বদল হবে, যারা আগে নির্যাতিত ছিল তারা নির্যাতনকারীতে পরিণত হবে, তাতে সাধারণ মানুষের ভাগ্য অপরিবর্তিতই থেকে যাবে। নিঃসন্দেহে সাধারণ জনতা এবং গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী কেউ সেটি চাইবে না। তাই রাজনৈতিক সরকারে পুরোনো বাজে অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে এবং জেন-জি’র নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য পূরণ করতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে কেবল ৯০ দিনের মধ্যে একটি নির্বাচন পরিচালনার চেয়ে আরও অনেক বেশি কিছু করতে হবে। কিন্তু ‘অনেক বেশি’ লক্ষ্যের মধ্যে কী কী থাকতে পারে? এসব লক্ষ্য অর্জনের আইনি বা সাংবিধানিক ভিত্তি কি এই সরকারের থাকবে? তারা কি আগের রাজনৈতিক সরকারের নিয়োগকৃত, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পাবে?
অতীত থেকে শিক্ষা
কথায় বলে, ‘ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়’। যদিও বাঙালি জাতির বেলতলায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা অনেক, তবে অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া অপরিহার্য। ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত অরাজনৈতিক সরকার দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক দুর্নীতি নির্মূলের লক্ষ্যে তারা উভয় রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করেছিল।
প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলে পারিবারিক রাজনৈতিক চর্চা ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দলের মধ্যে সংস্কারপন্থীদের সংগঠিত করেছিল এবং চাপ প্রয়োগ করেছিল। পরিতাপের বিষয়, দুর্নীতি নির্মূল অভিযানে সম্পৃক্ত অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে যায় এবং রাজনৈতিক দলের সংস্কারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি নির্বাচনের আয়োজন করে, যাতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে। আব্দুল জলিল, আমির হোসেন আমু ও মান্নান ভূঁইয়ার মতো সংস্কারপন্থী নেতারা পরবর্তীকালে তাঁদের নিজ নিজ দল কর্তৃক নিগৃহীত হন।
ছাত্র-জনতার এই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর দেশের মানুষ ব্যাপক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে, যা নতুন বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি হিসেবে
কাজ করতে পারে।
বাস্তবতা হলো, একটি দেশকে, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ট্রান্সফর্ম করা বেশ দুরূহ কাজ। আমরা দেখেছি, ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের অভিলাষী লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল, যার কারণ ছিল সাংবিধানিক ক্ষমতাবিহীন এবং অনির্বাচিত সরকার হয়েও স্বল্প সময়ে অনেক বেশি কিছু অর্জনের প্রচেষ্টা। বর্তমান পরিস্থিতি ২০০৭-২০০৯ সালের চেয়ে আরও অনেক বেশি জটিল। অতএব, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করার আগে নতুন সরকারকে স্পষ্ট নীতি নির্ধারণ করতে হবে এবং কর্মপদ্ধতিও ঠিক করে নিতে হবে এবং সেগুলো জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। উপরন্তু, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে কী কী কাজ করতে হবে, তা-ও ঠিক করে নিতে হবে। মোটা দাগে পাঁচটি বিষয়ে সংস্কার হলে জনগণের নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক লক্ষ্য পূরণ হবে বলে আমি মনে করি।
সংস্কারের মূল ক্ষেত্র
১. রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের অবসান: জনগণ পারিবারিক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে, যা মূলত কোটাভিত্তিক পক্ষপাতিত্বের একটি রূপ। নেতৃত্ব নির্বাচন হতে হবে যোগ্যতার মাপকাঠিতে, পারিবারিক সম্পর্কের মাধ্যমে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নয়। পরিবারতন্ত্রনির্ভর নেতা নির্বাচনের প্রচলন দেশের সরকারের সর্বোচ্চ পদ থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রচলিত, যার ফলে ক্ষমতার বলয় শুধু কতিপয় পরিবারের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত। এই পরিবারভিত্তিক ‘কোটাব্যবস্থা’ দূর করা গেলে জনগণের হাতে ক্ষমতা যাবে এবং পরিবারতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। ক্ষমতা বণ্টনে এ ধরনের পরিবর্তন দুর্নীতি ও নিপীড়নকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে। মোটকথা, রাজনৈতিক দলগুলোকে অভ্যন্তরীণভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। দলীয় নেতৃত্ব বা জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন অভ্যন্তরীণ দলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে করতে হবে। এই প্রক্রিয়া জবাবদিহি নিশ্চিত করবে, দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বে উন্নীত করবে এবং আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলবে।
২. ভোটের অধিকার এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের নিশ্চয়তা: স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা দেখেছি, ক্ষমতার পালাবদলে প্রায় সব সময়েই প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে রক্তপাতবিহীন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৮১, ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০৬ কিংবা সর্বশেষ ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তরে দেশ উত্তাল হয়েছে, সংখ্যাভেদে মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ এটি কখনোই প্রত্যাশা করেনি। গত ৫৩ বছরে আমরা রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তন, পরবর্তী সময়ে বিলুপ্তি এবং অন্যান্য অনেক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছি। যদিও এই পরিবর্তনগুলোর প্রেক্ষাপট ও কারণ ভিন্ন ছিল, তবে প্রতিটি ঘটনারই মূল কারণ ছিল জনগণের রায় ছাড়া অন্য উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখার বা দখল করার ইচ্ছা। নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে নতুন সরকারকে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি টেকসই প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে, যা গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি।
৩. পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসন অরাজনৈতিকীকরণ ও দুর্নীতি নির্মূলকরণ: এটি কোনো গোপন বিষয় নয় যে দেশের সমস্ত সরকারি ক্ষেত্র অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত। বলা বাহুল্য, দেশের সবচেয়ে বড় ধরনের দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড সাধারণত রাজনীতিবিদদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটে, যা সরকারি কর্মচারীদের তাঁদের নিজস্ব দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার লাইসেন্স দেয়, যার শিকার হয় সাধারণ মানুষ। আমরা সবাই জানি, সরকারি কর্মচারীদের চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুধু কোটা দ্বারাই প্রভাবিত হয় না, বরং রাজনৈতিক সুপারিশ, প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং ঘুষের বাণিজ্যও সমানভাবে প্রভাবিত করে। সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ হবে শুধু মেধার ভিত্তিতে, কোনো ঘুষ ছাড়া, প্রশ্নপত্র ফাঁস বাণিজ্যমুক্ত এবং রাজনৈতিক সুপারিশ ছাড়া। জনগণের এই প্রত্যাশা শুধু তাদের সাংবিধানিক অধিকারই নয়, এটি নিশ্চিত করা গেলে প্রশাসনের রাজনৈতিকীকরণ বন্ধ করা যাবে, যা দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আবশ্যক। তাই সব ধরনের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার জন্য আমাদের কর্মসংস্থান প্রক্রিয়া সংস্কারের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
৪. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ: গত ১৫ বছর দেশটি অতিরিক্ত মাত্রায় সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে গেছে। অধিকাংশ টিভি বা সংবাদপত্র তাদের পছন্দমতো খবর প্রকাশ করতে পারেনি। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে ইন্টারনেট এবং যোগাযোগ ব্ল্যাকআউটের ঘটনাও ঘটেছে, যা জাতিকে বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সরকারের ইচ্ছায় বন্ধ হয়েছে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, আড়ি পাতা হয়েছে মানুষের ফোনে। একটি টেকসই গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই। তাই সংবাদমাধ্যমকে টেকসই উপায়ে স্বাধীন করতে হবে, যাতে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে হেডলাইনের ধরন না বদলায়।
৫. একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকরণ: সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগকে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে, আমরা অনেক প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত ও কার্যধারা প্রত্যক্ষ করেছি, যা বিচারব্যবস্থার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রকাশ করেছে। এই সমস্যা দেশের নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বিস্তৃত।
অকস্মাৎ গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে দেশের সামনে পুরোনো রাজনৈতিক রীতিনীতি সংস্কারের এক অপূর্ব সুযোগ এসেছে। যদিও এই মুহূর্তে জাতির সামনে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, প্রশাসনের প্রতি বিশ্বাস পুনঃস্থাপন, পুলিশকে পুনর্বাসনসহ অসংখ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রয়েছে নতুন বাংলাদেশ গঠনের এক সুবর্ণ সুযোগ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তাই গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা, সমান কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা এবং একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ অধ্যাপক ইউনূসকে অনেক সম্মান করেন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশকে আলোর পথ দেখাবে, পুরোনো নষ্ট রাজনৈতিক প্রচলন পেছনে ফেলে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গঠনের দিকে এগিয়ে যাবে, সেই প্রত্যাশা থাকল।
লেখক: অর্গানাইজেশনাল ট্রান্সফরমেশন এক্সপার্ট, উত্তর আমেরিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে