এ কে এম শামসুদ্দিন
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির সরকারের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শাসনক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেয় মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। বর্তমানে সশস্ত্র বিদ্রোহী দলগুলোর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পড়ে তারা নাস্তানাবুদ হচ্ছে। জান্তা বাহিনী সীমান্ত শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে গিয়ে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে টিকে থাকতে পারছে না। বিদ্রোহী দলগুলো একের পর এক শহর দখল করে নিচ্ছে। তাদের এই অভিযানে সে দেশের তরুণেরাও অংশগ্রহণ করছে।
কাচিন, কারেন, চিন ও রাখাইনদের পাশাপাশি সু চির সমর্থক বামারদের একাংশ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হয়েছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহী সশস্ত্র দলগুলো হলো—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি বা টিএনএলএ, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি বা এমএনডিএএ এবং আরাকান আর্মি বা এএ। এই তিন সংগঠনই পৃথক জাতিসত্তার আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন। এই সংগঠনগুলো মিলেই ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ গড়ে তুলেছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের মধ্যে প্রথম দুটি মিয়ানমার-চীন সীমান্তে সক্রিয়। এদের অবস্থান তাং ও ককং জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে। এএ বা আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন আরাকানের রাখাইন অঞ্চলে সরকারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতা জারি রেখেছে।
এই মুহূর্তে মিয়ানমারের বেশ কিছু অঞ্চলে সম্মিলিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে জান্তা বাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ চলছে। গত বছরের ২৭ অক্টোবর বৃহত্তর সশস্ত্র এই তিন দল সমন্বিতভাবে জান্তা সামরিক বাহিনীর ওপর সম্মিলিত আক্রমণের সূচনা করে। তার পর থেকেই তারা একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে চলেছে।
সর্বশেষ খবর হলো, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাত থেকে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এবং ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর পালতোয়া দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর একটি আরাকান আর্মি। পালতোয়া চিন রাজ্যে অবস্থিত। সমগ্র পালেতোয়া এলাকায় অবস্থিত সামরিক বাহিনীর সব ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে বলে আরাকান আর্মি দাবি করেছে। গত অক্টোবরে সম্মিলিত আক্রমণ সূচনার পর কয়েক ডজনেরও বেশি শহর দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহী জোট। এর মধ্যে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর কয়েক শ সামরিক কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ আউটপোস্ট অন্তর্ভুক্ত আছে।
এ বছরের জানুয়ারির শুরুর দিকে চীন সীমান্তের কাছে গুরুত্বপূর্ণ শহর লুয়াক্কাই দখল করে নেয় সশস্ত্র ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের যোদ্ধারা। সেই যুদ্ধে জান্তা বাহিনীর ২ হাজারেরও বেশি সেনাসদস্য আত্মসমর্পণ করেছেন বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উইলসন সেন্টার’-এর এক বিশ্লেষক খবরটি নিশ্চিত করে জানান, আত্মসমর্পণ করার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদের ছয়জন কর্মকর্তাকে সামরিক আদালতে সাজা দেওয়া হয়েছে। শাস্তি হিসেবে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড, নাকি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে জান্তা বাহিনী এমন খবর নাকচ করে দিয়েছে। গত বছরের ২৭ অক্টোবরের অভিযানের পর এযাবৎ ৪ হাজারেরও বেশি সেনাসদস্য পালিয়ে গেছেন অথবা আত্মসমর্পণ করার তথ্য জানা গেছে।
২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মোট ১৪ হাজার সেনাসদস্য বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে এত অধিকসংখ্যক সেনাসদস্যসহ অপারেশনাল কমান্ডারদের আত্মসমর্পণ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের একের পর এক পরাজয়ের ঘটনা সাধারণ সৈনিকদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সামরিক বাহিনীর সব স্তরের সদস্যদের মনোবল চাঙা রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সৈনিকদের মনোবল যদি একবার ভেঙে যায়, তাহলে সেই সব সেনাসদস্য নিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যেকোনো কমান্ডারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
সশস্ত্র বিদ্রোহী দলগুলোর এই সমন্বিত আক্রমণের পেছনে চীনের ভূমিকা নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠেছে। অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, চীনের সবুজ সংকেত পেয়েই ২৭ অক্টোবর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে চীন যেমন নিরন্তর সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে, তেমনি আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলোর সঙ্গে তারা সদ্ভাব বজায় রেখেছে। এসব দলের অস্ত্রশস্ত্রের প্রধান উৎস হলো চীন। তবে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত কারেন ও চিন রাজ্যের সশস্ত্র দলগুলোর বিষয় ব্যতিক্রম ছিল। এসব অঞ্চলে পশ্চিমা বেসরকারি সহযোগিতার হার বেশি। ২০২১ সালে ক্ষমতা হারানোর পর অং সান সু চির দল পিডিএফ ২০২২ সাল থেকে যখন সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর অনেক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চার্চ সমাজের যোগাযোগ আছে। এ ছাড়া পশ্চিমা সুশীল সমাজের নানা সংগঠন মিয়ানমারের এসব অঞ্চলের দরিদ্র মানুষকে মানবিক সহায়তা করে থাকে। বিগত কয়েক বছরে মিয়ানমারের রাজনীতিমনস্ক তরুণসমাজের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্ক আরও বেশি গভীর হয়েছে। ওই একই তরুণসমাজের মধ্যে চীনের বিষয়ে সন্দেহ ও অনাস্থা বেড়েছে কয়েক গুণ। পশ্চিমাদের এরূপ সম্পৃক্ততা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা দেখে চীনকে নতুন করে পরিকল্পনা আঁটতে হয়। পশ্চিমাদের প্রভাব থেকে সরিয়ে আনতে চীন সশস্ত্র বিদ্রোহী দলগুলোর দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। চীনের এমন সহযোগিতার মনোভাব পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গত ২৭ অক্টোবর মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে সমন্বিত সামরিক অভিযান শুরু করে।
সশস্ত্র বিদ্রোহীরাও পশ্চিমাদের সহযোগিতার জন্য বসে নেই। এ জন্য পশ্চিমাদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপকে দায়ী করা হয়। মিয়ানমার সামরিক জান্তার অভ্যুত্থানের পরে প্রতিরোধযুদ্ধে যখন ধীরে ধীরে গতি বাড়ছিল, তখন বিদ্রোহীদের প্রচুর অস্ত্রের দরকার ছিল। তারা আশা করেছিল, থাইল্যান্ডের মাধ্যমে ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর ন্যায় বিদ্রোহী দলগুলোকে অস্ত্র পাঠাবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। জান্তাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণনৃশংসতার স্পষ্ট ও চাক্ষুষ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসহ পশ্চিমা দেশগুলো জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মা অ্যাক্ট’ আক্ষরিক অর্থে কোনো কাজেই আসেনি। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পরিসরে জান্তাবিরোধী মিয়ানমার জাতীয় ঐক্য সরকার বা এনইউজির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, তা করতেও ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিদ্রোহীরা পশ্চিমাদের সাহায্যের আশা ছেড়ে দিয়েছে। চীন এই সুযোগই কাজে লাগিয়েছে। তারা আগের মতো এখনো মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর প্রবলভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করে চলেছে। চীন তাদের এই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। এ মুহূর্তে উভয় পক্ষের সঙ্গে ভারসাম্য সম্পর্ক বজায় রাখার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যুদ্ধের এই পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রতি চীন উভয় পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির ব্যবস্থা করে। যদিও এই চুক্তি বেশি দিন টেকেনি। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও জান্তা বাহিনী আকাশ ও স্থল হামলা অব্যাহত রাখলে চুক্তি ভেঙে যায়। তবে পরিস্থিতি যেদিকেই মোড় নিক, নিজস্ব স্বার্থ সুরক্ষার জন্য চীন যেকোনো মূল্যে মিয়ানমারকে নিজ বলয়ের মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহী দলের কাছে সামরিক জান্তার উপর্যুপরি মার খাওয়ার ফলে সে দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে এক অভূতপূর্ব ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছে। যখন কোনো জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তখন সেই অপশক্তির পরাজয় অনিবার্য। এ কথার প্রতিধ্বনি যেন শোনা যায় মিয়ানমারের চলমান সংকট নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে অনলাইনে যুক্ত হয়ে দেওয়া মিয়ানমার জাতীয় এনইউজির প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ও মুখপাত্র কিউ জর মুখে। তিনি বলেছেন, ‘সামরিক জান্তাকে হটাতে মিয়ানমারের ইতিহাসে এই প্রথম জনগণ এত প্রবলভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তিন বছর আগেও মনে করা হয়েছিল, শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা যাবে না। এখন প্রমাণিত হয়েছে, মিয়ানমারের জনগণ বর্বর এই সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিতে সামর্থ্য রাখে। জনগণ যখন একবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখন সেনাশাসকদের না হটিয়ে ঘরে ফিরে যাবে না।’ কিউ জর বক্তব্যে যে শক্তির আভাস পাওয়া যায়, তাতে জান্তা সরকার এখনই সরে যাবে তা নয়। তবে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ কথা বলা যায়, জান্তা সরকার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তবে এ সময় বিদ্রোহী দলগুলোর সঙ্গে চীনের যদি বিশেষ কোনো বোঝাপড়া হয়, তাহলে মিয়ানমারের চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টেও যেতে পারে। তবে এমন কিছু হয় কি না, তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সু চির সরকারের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শাসনক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেয় মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। বর্তমানে সশস্ত্র বিদ্রোহী দলগুলোর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পড়ে তারা নাস্তানাবুদ হচ্ছে। জান্তা বাহিনী সীমান্ত শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে গিয়ে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে টিকে থাকতে পারছে না। বিদ্রোহী দলগুলো একের পর এক শহর দখল করে নিচ্ছে। তাদের এই অভিযানে সে দেশের তরুণেরাও অংশগ্রহণ করছে।
কাচিন, কারেন, চিন ও রাখাইনদের পাশাপাশি সু চির সমর্থক বামারদের একাংশ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হয়েছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহী সশস্ত্র দলগুলো হলো—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি বা টিএনএলএ, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি বা এমএনডিএএ এবং আরাকান আর্মি বা এএ। এই তিন সংগঠনই পৃথক জাতিসত্তার আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন। এই সংগঠনগুলো মিলেই ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ গড়ে তুলেছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের মধ্যে প্রথম দুটি মিয়ানমার-চীন সীমান্তে সক্রিয়। এদের অবস্থান তাং ও ককং জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে। এএ বা আরাকান আর্মি বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন আরাকানের রাখাইন অঞ্চলে সরকারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতা জারি রেখেছে।
এই মুহূর্তে মিয়ানমারের বেশ কিছু অঞ্চলে সম্মিলিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে জান্তা বাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ চলছে। গত বছরের ২৭ অক্টোবর বৃহত্তর সশস্ত্র এই তিন দল সমন্বিতভাবে জান্তা সামরিক বাহিনীর ওপর সম্মিলিত আক্রমণের সূচনা করে। তার পর থেকেই তারা একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে চলেছে।
সর্বশেষ খবর হলো, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাত থেকে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এবং ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর পালতোয়া দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর একটি আরাকান আর্মি। পালতোয়া চিন রাজ্যে অবস্থিত। সমগ্র পালেতোয়া এলাকায় অবস্থিত সামরিক বাহিনীর সব ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে বলে আরাকান আর্মি দাবি করেছে। গত অক্টোবরে সম্মিলিত আক্রমণ সূচনার পর কয়েক ডজনেরও বেশি শহর দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহী জোট। এর মধ্যে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর কয়েক শ সামরিক কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ আউটপোস্ট অন্তর্ভুক্ত আছে।
এ বছরের জানুয়ারির শুরুর দিকে চীন সীমান্তের কাছে গুরুত্বপূর্ণ শহর লুয়াক্কাই দখল করে নেয় সশস্ত্র ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের যোদ্ধারা। সেই যুদ্ধে জান্তা বাহিনীর ২ হাজারেরও বেশি সেনাসদস্য আত্মসমর্পণ করেছেন বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উইলসন সেন্টার’-এর এক বিশ্লেষক খবরটি নিশ্চিত করে জানান, আত্মসমর্পণ করার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদের ছয়জন কর্মকর্তাকে সামরিক আদালতে সাজা দেওয়া হয়েছে। শাস্তি হিসেবে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড, নাকি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে জান্তা বাহিনী এমন খবর নাকচ করে দিয়েছে। গত বছরের ২৭ অক্টোবরের অভিযানের পর এযাবৎ ৪ হাজারেরও বেশি সেনাসদস্য পালিয়ে গেছেন অথবা আত্মসমর্পণ করার তথ্য জানা গেছে।
২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মোট ১৪ হাজার সেনাসদস্য বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে এত অধিকসংখ্যক সেনাসদস্যসহ অপারেশনাল কমান্ডারদের আত্মসমর্পণ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের একের পর এক পরাজয়ের ঘটনা সাধারণ সৈনিকদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সামরিক বাহিনীর সব স্তরের সদস্যদের মনোবল চাঙা রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সৈনিকদের মনোবল যদি একবার ভেঙে যায়, তাহলে সেই সব সেনাসদস্য নিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যেকোনো কমান্ডারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।
সশস্ত্র বিদ্রোহী দলগুলোর এই সমন্বিত আক্রমণের পেছনে চীনের ভূমিকা নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠেছে। অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, চীনের সবুজ সংকেত পেয়েই ২৭ অক্টোবর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে চীন যেমন নিরন্তর সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে, তেমনি আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলোর সঙ্গে তারা সদ্ভাব বজায় রেখেছে। এসব দলের অস্ত্রশস্ত্রের প্রধান উৎস হলো চীন। তবে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত কারেন ও চিন রাজ্যের সশস্ত্র দলগুলোর বিষয় ব্যতিক্রম ছিল। এসব অঞ্চলে পশ্চিমা বেসরকারি সহযোগিতার হার বেশি। ২০২১ সালে ক্ষমতা হারানোর পর অং সান সু চির দল পিডিএফ ২০২২ সাল থেকে যখন সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তখন তারা পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর অনেক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চার্চ সমাজের যোগাযোগ আছে। এ ছাড়া পশ্চিমা সুশীল সমাজের নানা সংগঠন মিয়ানমারের এসব অঞ্চলের দরিদ্র মানুষকে মানবিক সহায়তা করে থাকে। বিগত কয়েক বছরে মিয়ানমারের রাজনীতিমনস্ক তরুণসমাজের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্ক আরও বেশি গভীর হয়েছে। ওই একই তরুণসমাজের মধ্যে চীনের বিষয়ে সন্দেহ ও অনাস্থা বেড়েছে কয়েক গুণ। পশ্চিমাদের এরূপ সম্পৃক্ততা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা দেখে চীনকে নতুন করে পরিকল্পনা আঁটতে হয়। পশ্চিমাদের প্রভাব থেকে সরিয়ে আনতে চীন সশস্ত্র বিদ্রোহী দলগুলোর দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। চীনের এমন সহযোগিতার মনোভাব পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গত ২৭ অক্টোবর মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে সমন্বিত সামরিক অভিযান শুরু করে।
সশস্ত্র বিদ্রোহীরাও পশ্চিমাদের সহযোগিতার জন্য বসে নেই। এ জন্য পশ্চিমাদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপকে দায়ী করা হয়। মিয়ানমার সামরিক জান্তার অভ্যুত্থানের পরে প্রতিরোধযুদ্ধে যখন ধীরে ধীরে গতি বাড়ছিল, তখন বিদ্রোহীদের প্রচুর অস্ত্রের দরকার ছিল। তারা আশা করেছিল, থাইল্যান্ডের মাধ্যমে ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর ন্যায় বিদ্রোহী দলগুলোকে অস্ত্র পাঠাবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। জান্তাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণনৃশংসতার স্পষ্ট ও চাক্ষুষ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসহ পশ্চিমা দেশগুলো জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মা অ্যাক্ট’ আক্ষরিক অর্থে কোনো কাজেই আসেনি। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পরিসরে জান্তাবিরোধী মিয়ানমার জাতীয় ঐক্য সরকার বা এনইউজির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, তা করতেও ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিদ্রোহীরা পশ্চিমাদের সাহায্যের আশা ছেড়ে দিয়েছে। চীন এই সুযোগই কাজে লাগিয়েছে। তারা আগের মতো এখনো মিয়ানমারের পরিস্থিতির ওপর প্রবলভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করে চলেছে। চীন তাদের এই নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। এ মুহূর্তে উভয় পক্ষের সঙ্গে ভারসাম্য সম্পর্ক বজায় রাখার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যুদ্ধের এই পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রতি চীন উভয় পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির ব্যবস্থা করে। যদিও এই চুক্তি বেশি দিন টেকেনি। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও জান্তা বাহিনী আকাশ ও স্থল হামলা অব্যাহত রাখলে চুক্তি ভেঙে যায়। তবে পরিস্থিতি যেদিকেই মোড় নিক, নিজস্ব স্বার্থ সুরক্ষার জন্য চীন যেকোনো মূল্যে মিয়ানমারকে নিজ বলয়ের মধ্যে ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহী দলের কাছে সামরিক জান্তার উপর্যুপরি মার খাওয়ার ফলে সে দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে এক অভূতপূর্ব ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছে। যখন কোনো জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তখন সেই অপশক্তির পরাজয় অনিবার্য। এ কথার প্রতিধ্বনি যেন শোনা যায় মিয়ানমারের চলমান সংকট নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে অনলাইনে যুক্ত হয়ে দেওয়া মিয়ানমার জাতীয় এনইউজির প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ও মুখপাত্র কিউ জর মুখে। তিনি বলেছেন, ‘সামরিক জান্তাকে হটাতে মিয়ানমারের ইতিহাসে এই প্রথম জনগণ এত প্রবলভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তিন বছর আগেও মনে করা হয়েছিল, শক্তিশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা যাবে না। এখন প্রমাণিত হয়েছে, মিয়ানমারের জনগণ বর্বর এই সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিতে সামর্থ্য রাখে। জনগণ যখন একবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখন সেনাশাসকদের না হটিয়ে ঘরে ফিরে যাবে না।’ কিউ জর বক্তব্যে যে শক্তির আভাস পাওয়া যায়, তাতে জান্তা সরকার এখনই সরে যাবে তা নয়। তবে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ কথা বলা যায়, জান্তা সরকার আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তবে এ সময় বিদ্রোহী দলগুলোর সঙ্গে চীনের যদি বিশেষ কোনো বোঝাপড়া হয়, তাহলে মিয়ানমারের চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টেও যেতে পারে। তবে এমন কিছু হয় কি না, তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে