ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
দ্বিজেন্দ্র লাল রায় ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। এর চেয়ে ঢের ছিলেন গীতিকবি। তাঁর শিশুতোষ ব্যঙ্গ কবিতা ‘নন্দলাল’ পড়তে পড়তে অদ্ভুত দেখা মেলে বর্তমান সময়ের অসংখ্য নন্দলালের। নন্দলালের ভীষণ পণ ‘স্বদেশের তরে যে করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।’
সবাই যখন জানতে চাইল তার এমন ভাব ও ভাবনার হেতু কী, তখন নন্দর জবাব: ‘বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল, আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’ তার ভাই কলেরায় মরে মরে, এমন সময় সবাই যখন ভাইকে সেবার কথা বলে, তখন নন্দর জবাব: ‘ভাইয়ের জন্য জীবনটা যদি দি/না হয় দিলাম, কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কী?’ নন্দ হঠাৎ একটা কাগজ বের করে, গালি দিয়ে গদ্যে পদ্যে বিদ্যা জাহির করে, দেশের জন্য নন্দ খাটতে যেয়ে ‘লেখে যত তার দ্বিগুণ ঘুমায়, খায় তার দশ গুণ।’ নন্দ একবার কাগজে এক সাহেবকে গালি দেয়।
এ জন্য সাহেব তার গলা টিপে ধরলে নন্দ জানায়, ‘কী হবে দেশের, গলা টিপুনিতে আমি যদি মরে যাই? তার চাইতে বলো ক বিঘত নাকে দিব খত, যা বল করিব তাহা।’ অনেক কারণে নন্দ বাড়ির বের হয় না, ‘কোথায় কী ঘটে কী জানি’, নন্দ চড়ে না গাড়ি ‘যদি উল্টিয়ে যায়’, ভীষণ তুফানের ভয়ে নৌকায় চড়ে না, রেলে চড়ে না কলিশনের ভয়ে, হাঁটতে গেলে সাপ, কুকুরের কামড়ের ভয়, রাস্তায় গাড়িচাপা পড়ার ভয়, তাই শুয়ে শুয়ে কষ্টে চিরকাল বেঁচে থাকার পথ ধরে নন্দলাল। পরাধীন ভারতবর্ষে শতাব্দীকাল আগে দ্বিজেন্দ্র লালের নন্দলালের অবস্থা-ব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমান সময়ে স্বাধীন সার্বভৌম দেশে নন্দলালদের মন-মানসিকতা ও আচার-আচরণের সমিল, সহমত অবস্থানের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষিত হতেই পারে। এর ভিত্তিতে শুধু এটুকু বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যমতে, ‘বাঙালীর নাম দরখাস্তের দ্বিতীয় পাতায়’ থাকার বা রাখার হতাশা এখনো এই ডিজিটাল ও স্মার্ট যুগেও বিদ্যমান।
নন্দলাল যতটা না দেশপ্রেমিক ছিল, তার চেয়ে তার আত্মস্বার্থজ্ঞান এবং ভৌত নিরাপত্তা সচেতনতা ছিল প্রচুর। পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের তাড়ানোর মতো আন্দোলন অহিংস থেকে সহিংসতায় রূপ লাভ করায় রাষ্ট্রদ্রোহ ওরফে নাশকতার এন্তার অভিযোগ তোলার প্রয়াস পেয়েছিল ঔপনিবেশিক সরকার। সেখানে ‘আত্মত্যাগে’র দ্বিধায় পড়েছিল ‘বাঙালি’ নন্দলাল। নানান উপায় উপলক্ষকে কেন্দ্র করে সুকৌশলে সেসব এড়িয়ে যেতে চাইত সে। বাকস্বাধীনতার ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা ছিল তখনো।
নিজে কাগজ বের করে ‘সেলফ সেন্সরে’ পড়েও নন্দলাল রাজাকে প্রতিপক্ষ করে ফেলে, রাজার সহচর এক ‘সাহেব’-এর সমালোচনা হয়ে যায় লেখায়। যথারীতি সাহেব তাকে পাকড়াও করেন। আবহমান সংস্কৃতির মতো নাকে খত দিয়ে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায় নন্দলালকে। তলে তলে সাহেবের সঙ্গে সন্ধি করেও ফেলে স্বদেশি আন্দেলনের কাপুরুষরূপী নন্দলাল। এভাবে নন্দলালদের আত্মসমর্পণের ন্যক্কারজনক নতজানু হওয়ার ঘটনায় ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রাম আরও প্রলম্বিত হয়, পিছিয়ে যায় হোম রুল অর্জনের আকিঞ্চন আকাঙ্ক্ষা। দেশ ও দশের স্বার্থবিক্রির মাধ্যমে নন্দলালদের নিরাপত্তা হয় নিরঙ্কুশ।
নন্দলালের এর বেশি কিছু করার কীই-বা বাকি ছিল? নিজের নিরাপত্তা ভাবনায় তার মাথায় ক্ষুদিরামের প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা, সূর্য সেন কিংবা মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা অবশিষ্ট ছিল না। থাকবেই বা কেন? নন্দলাল দিব্য চোখে দেখতে পেয়েছিল পক্ষ-বিপক্ষের ধুয়া না তুলে ভূত-ভবিষ্যৎ নষ্ট করার পথে হাঁটা তার জন্য সমীচীন হবে না। নন্দলাল এমনি এমনি অতিমাত্রায় আত্মযত্নবান হয়নি।
দেশ-সমাজ তাকে তেমনটি বানিয়েছিল। উপেক্ষার উদগ্র অভিসন্ধিতে নন্দলালদের জন্য তেমন কোনো পথ খোলা পাওয়া যায়নি। হয়েছিল তুমুল হট্টগোলের শিকার।যে সমাজে খোলাবাজারে নীতিহীন নেতা কেনাবেচা চলে, যে সমাজে আদর্শের ঝান্ডা ওড়ানোর নাম করে নিজেরা তলে তলে নতজানু থাকায় ‘আত্মতুষ্টি’র কারণ সৃষ্টি হয়, সেই সমাজে জনসাধারণ বা নন্দলালদের হতোদ্যম না হয়ে উপায় আছে?
একসময় যে পরাধীন পরিবেশে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘শিক্ষা আন্দোলন’ কিংবা মনগড়া ‘সংবিধানের’ বিরুদ্ধে হয়েছিল তুমুল আন্দোলন, সেই স্বাধীন দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় বশংবদ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং সংবিধান সংশোধনের অপপ্রয়াসের বিপক্ষে ‘আন্দোলন’ তো দূরের কথা, সামান্য উচ্চবাচ্য না করাই বরং অপশক্তির অপরাধের শামিল। নন্দলাল এসব দেখে ও ভেবে রণে ভঙ্গ দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হিসেবে মনে করে।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
দ্বিজেন্দ্র লাল রায় ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। এর চেয়ে ঢের ছিলেন গীতিকবি। তাঁর শিশুতোষ ব্যঙ্গ কবিতা ‘নন্দলাল’ পড়তে পড়তে অদ্ভুত দেখা মেলে বর্তমান সময়ের অসংখ্য নন্দলালের। নন্দলালের ভীষণ পণ ‘স্বদেশের তরে যে করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।’
সবাই যখন জানতে চাইল তার এমন ভাব ও ভাবনার হেতু কী, তখন নন্দর জবাব: ‘বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল, আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’ তার ভাই কলেরায় মরে মরে, এমন সময় সবাই যখন ভাইকে সেবার কথা বলে, তখন নন্দর জবাব: ‘ভাইয়ের জন্য জীবনটা যদি দি/না হয় দিলাম, কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কী?’ নন্দ হঠাৎ একটা কাগজ বের করে, গালি দিয়ে গদ্যে পদ্যে বিদ্যা জাহির করে, দেশের জন্য নন্দ খাটতে যেয়ে ‘লেখে যত তার দ্বিগুণ ঘুমায়, খায় তার দশ গুণ।’ নন্দ একবার কাগজে এক সাহেবকে গালি দেয়।
এ জন্য সাহেব তার গলা টিপে ধরলে নন্দ জানায়, ‘কী হবে দেশের, গলা টিপুনিতে আমি যদি মরে যাই? তার চাইতে বলো ক বিঘত নাকে দিব খত, যা বল করিব তাহা।’ অনেক কারণে নন্দ বাড়ির বের হয় না, ‘কোথায় কী ঘটে কী জানি’, নন্দ চড়ে না গাড়ি ‘যদি উল্টিয়ে যায়’, ভীষণ তুফানের ভয়ে নৌকায় চড়ে না, রেলে চড়ে না কলিশনের ভয়ে, হাঁটতে গেলে সাপ, কুকুরের কামড়ের ভয়, রাস্তায় গাড়িচাপা পড়ার ভয়, তাই শুয়ে শুয়ে কষ্টে চিরকাল বেঁচে থাকার পথ ধরে নন্দলাল। পরাধীন ভারতবর্ষে শতাব্দীকাল আগে দ্বিজেন্দ্র লালের নন্দলালের অবস্থা-ব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমান সময়ে স্বাধীন সার্বভৌম দেশে নন্দলালদের মন-মানসিকতা ও আচার-আচরণের সমিল, সহমত অবস্থানের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষিত হতেই পারে। এর ভিত্তিতে শুধু এটুকু বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যমতে, ‘বাঙালীর নাম দরখাস্তের দ্বিতীয় পাতায়’ থাকার বা রাখার হতাশা এখনো এই ডিজিটাল ও স্মার্ট যুগেও বিদ্যমান।
নন্দলাল যতটা না দেশপ্রেমিক ছিল, তার চেয়ে তার আত্মস্বার্থজ্ঞান এবং ভৌত নিরাপত্তা সচেতনতা ছিল প্রচুর। পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের তাড়ানোর মতো আন্দোলন অহিংস থেকে সহিংসতায় রূপ লাভ করায় রাষ্ট্রদ্রোহ ওরফে নাশকতার এন্তার অভিযোগ তোলার প্রয়াস পেয়েছিল ঔপনিবেশিক সরকার। সেখানে ‘আত্মত্যাগে’র দ্বিধায় পড়েছিল ‘বাঙালি’ নন্দলাল। নানান উপায় উপলক্ষকে কেন্দ্র করে সুকৌশলে সেসব এড়িয়ে যেতে চাইত সে। বাকস্বাধীনতার ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা ছিল তখনো।
নিজে কাগজ বের করে ‘সেলফ সেন্সরে’ পড়েও নন্দলাল রাজাকে প্রতিপক্ষ করে ফেলে, রাজার সহচর এক ‘সাহেব’-এর সমালোচনা হয়ে যায় লেখায়। যথারীতি সাহেব তাকে পাকড়াও করেন। আবহমান সংস্কৃতির মতো নাকে খত দিয়ে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করতে দেখা যায় নন্দলালকে। তলে তলে সাহেবের সঙ্গে সন্ধি করেও ফেলে স্বদেশি আন্দেলনের কাপুরুষরূপী নন্দলাল। এভাবে নন্দলালদের আত্মসমর্পণের ন্যক্কারজনক নতজানু হওয়ার ঘটনায় ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রাম আরও প্রলম্বিত হয়, পিছিয়ে যায় হোম রুল অর্জনের আকিঞ্চন আকাঙ্ক্ষা। দেশ ও দশের স্বার্থবিক্রির মাধ্যমে নন্দলালদের নিরাপত্তা হয় নিরঙ্কুশ।
নন্দলালের এর বেশি কিছু করার কীই-বা বাকি ছিল? নিজের নিরাপত্তা ভাবনায় তার মাথায় ক্ষুদিরামের প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা, সূর্য সেন কিংবা মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা অবশিষ্ট ছিল না। থাকবেই বা কেন? নন্দলাল দিব্য চোখে দেখতে পেয়েছিল পক্ষ-বিপক্ষের ধুয়া না তুলে ভূত-ভবিষ্যৎ নষ্ট করার পথে হাঁটা তার জন্য সমীচীন হবে না। নন্দলাল এমনি এমনি অতিমাত্রায় আত্মযত্নবান হয়নি।
দেশ-সমাজ তাকে তেমনটি বানিয়েছিল। উপেক্ষার উদগ্র অভিসন্ধিতে নন্দলালদের জন্য তেমন কোনো পথ খোলা পাওয়া যায়নি। হয়েছিল তুমুল হট্টগোলের শিকার।যে সমাজে খোলাবাজারে নীতিহীন নেতা কেনাবেচা চলে, যে সমাজে আদর্শের ঝান্ডা ওড়ানোর নাম করে নিজেরা তলে তলে নতজানু থাকায় ‘আত্মতুষ্টি’র কারণ সৃষ্টি হয়, সেই সমাজে জনসাধারণ বা নন্দলালদের হতোদ্যম না হয়ে উপায় আছে?
একসময় যে পরাধীন পরিবেশে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ‘শিক্ষা আন্দোলন’ কিংবা মনগড়া ‘সংবিধানের’ বিরুদ্ধে হয়েছিল তুমুল আন্দোলন, সেই স্বাধীন দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় বশংবদ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং সংবিধান সংশোধনের অপপ্রয়াসের বিপক্ষে ‘আন্দোলন’ তো দূরের কথা, সামান্য উচ্চবাচ্য না করাই বরং অপশক্তির অপরাধের শামিল। নন্দলাল এসব দেখে ও ভেবে রণে ভঙ্গ দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হিসেবে মনে করে।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে