বিচারবহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতি নির্মূল হবে?

ড. মইনুল ইসলাম
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২২, ০৭: ৩৮
আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২২, ১০: ১৯

সম্প্রতি র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সাতজন সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করায় দেশের রাজনীতিতে প্রচণ্ড তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৯ সালের পর বাংলাদেশে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত খুন ও গুমের গুরুতর অভিযোগে মার্কিন সরকার এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করল। এর অব্যবহিত আগের দিনগুলোতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কর্তৃক আয়োজিত ৯-১০ ডিসেম্বরের গণতন্ত্র সম্মেলনে বিশ্বের ১১০টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোয় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ব্যাপারেও যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ রয়েছে, সে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও নেপাল ওই গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছিল। (পাকিস্তান অবশ্য দাওয়াত পেয়েও সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেনি)। ভোটের রাজনীতি চালু থাকা সত্ত্বেও বাদ পড়া দক্ষিণ এশীয় দেশ ছিল বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা। এর মানে, এই দুই দেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো যথেষ্ট জালিয়াতিমুক্ত হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি পায়নি। ভুটান রাজতন্ত্র হিসেবে দাওয়াত পায়নি, আর আফগানিস্তানের মৌলবাদী তালেবান সরকার এখনো মার্কিন স্বীকৃতি না পাওয়ায় ওই সরকারেরও দাওয়াত না পাওয়াই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচন যে বিশ্বব্যাপী প্রশ্নবিদ্ধ, এই সত্যটা গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ না পাওয়ায় আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ২০১৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনের পথ ধরে গত তিন বছর বাংলাদেশের পুরো নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াই যে লাইনচ্যুত হয়ে গেছে, সে সম্পর্কে বিবেকবান কারও সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। দেশের সর্বস্তরের নির্বাচনই যেভাবে সন্ত্রাস এবং জালিয়াতির দুষ্টচক্রে বন্দী হয়ে গেছে, তা থেকে যে সহজে জাতি পরিত্রাণ পাবে না, সেটা এখন দিবালোকের মতো পরিষ্কার। এরপর মানবাধিকার লঙ্ঘন ইস্যুতে র‍্যাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ বিশ্বকে জানান দিল যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের ঘাটতি অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

বাংলাদেশে র‍্যাব প্রতিষ্ঠা করেছিল ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। দেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার–সব বাহিনী থেকেই এই এলিট ফোর্সের অফিসার ও কর্মচারীদের ডেপুটেশনে র‍্যাবে নিয়োগ করা হয়। যদিও র‍্যাবের ফরমাল নিয়ন্ত্রণ পুলিশের আইজির অধীনে থাকে; তবু র‍্যাব পরিচালনায় অনেকটাই র‍্যাব কর্তৃপক্ষ নিজেরা ক্ষমতা প্রয়োগ করে। ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের জনৈক জামায়াতি স্বরাষ্ট্রসচিবের ডিজাইন মোতাবেক প্রথম থেকেই জনমনে র‍্যাব সম্পর্কে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে এই বাহিনীর কালো ড্রেসে জল্লাদের পোশাকের আবহ সৃষ্টি করা হয়, র‍্যাবের কর্মকাণ্ডেও পরিকল্পিত নিষ্ঠুরতার ছাপ থাকে আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। র‍্যাব সৃষ্টির পর প্রায় আড়াই বছর বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের র‍্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যার টার্গেটে পরিণত করেছিল ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’-এর মাধ্যমে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি-ছাত্রদল ও জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা গত ১৩ বছর র‍্যাবের অপারেশনের মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে।

জামায়াত-শিবির একটি রক্তলোলুপ ফ্যাসিবাদী সিভিল আর্মি হিসেবে দেশের তাবৎ ‘কিলিং স্কোয়াডগুলোর ‘মাদার অর্গানাইজেশন’ হিসেবে সারা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও কুখ্যাত সংগঠন। তারা ইসলাম ধর্মের অত্যন্ত বিকৃত একধরনের ব্যাখ্যাকে পুঁজি করে এ দেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলের উন্মত্ত ও প্রাণঘাতী অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় ১৯৭৬ সাল থেকে, এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার পাওয়ার পর থেকেই। প্রথমে ইসলামী ছাত্রশিবির ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের অঙ্গসংগঠন হিসেবে মাঠে নামলেও ১৯৭৮ সালে জামায়াতে ইসলামী স্বনামে মাঠে নামার পর আর নাম বদলাতে হয়নি তাদের। গত ৪৫ বছরে তাদের ক্যাডার বাহিনী ফুলেফেঁপে বিশাল এক সিভিল আর্মিতে পরিণত হয়েছে। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড, ইন্দোনেশিয়ার জামাহ ইসলামিয়া, পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী, আফগানিস্তানের তালেবান, সৌদি আরব ও আফগানিস্তান থেকে উত্থিত আল-কায়েদা, ইরাক ও সিরিয়ায় ‘ইসলামিক স্টেট’ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধরত এবং ভিডিও ক্যামেরার সামনে বেশ কয়েকজন পশ্চিমা নাগরিকের শিরশ্ছেদ করার মতো নারকীয় নিষ্ঠুরতার জন্মদাতা আইসিস বা আইএস বা ইসলামিক স্টেট, আফ্রিকার আল-শাবাব ও বোকো হারাম–এগুলোর যে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, সেটাই জামায়াত-শিবিরেরও অভিন্ন নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশে জেএমবি, হুজি, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসারুল ইসলাম বাংলাদেশ, হিযবুত তাহরীর, হিজবুত তাওহিদ–এ ধরনের হরেক কিসিমের নাম নিয়ে একেক সময় একেক জঙ্গিগোষ্ঠীর যে তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়েছে, ওগুলো জামায়াত-শিবিরের সূতিকাগারে জন্ম নেওয়া জঙ্গিগোষ্ঠী। কথায় বলে, ‘রসুনের কোয়া অনেকগুলো হলেও গোড়া একটাই’–কথাটা সব সময় মনে রাখতে হবে। প্রয়োজনমাফিক এসব ‘পকেট সংগঠনের’ জন্ম দিতেই থাকবে জামায়াত-শিবির।

২০০৯ সালে মহাজোট সরকারে আসীন হওয়ার পর দেশে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীদের খুনোখুনি মারাত্মক পর্যায়ে উপনীত হয়। বিশেষত, দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত জামায়াত ও বিএনপির কয়েকজন নেতাকে যখন ফাঁসি দেওয়া হয় তখন সারা দেশে জামায়াত-শিবির এবং তাদের এই জঙ্গিবাদী কিলিং স্কোয়াডগুলোর খুনোখুনি চরম আকার ধারণ করে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের হোলি আর্টিজানের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ পর্যন্ত দেশে সংঘটিত যাবতীয় খুন-জখম থেকে পুলিশ বাহিনীও রক্ষা পায়নি। এর ক্রোধান্বিত প্রতিক্রিয়া ও প্রতিশোধ গ্রহণ শুরু হয়েছিল পুলিশ ও র‍্যাবের গ্রেপ্তার অভিযানগুলোর মধ্যে সংঘটিত ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। যত ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক না কেন, এগুলো যে নির্জলা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। রাষ্ট্রের পুলিশ ও র‍্যাব যখন এ ধরনের ক্রসফায়ারে মেতে ওঠে, তখন এই খুনোখুনি বাড়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, এই বাহিনীগুলো সুযোগ পেলেই আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আইনের শাসনই নাগরিকদের রক্ষাকবচ। সন্দেহভাজন জঙ্গি বিচারের মাধ্যমে অপরাধী প্রমাণিত হওয়ার আগেই যদি পুলিশ বা র‍্যাবের কাস্টডিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা পড়তে শুরু করে, তাহলে রাষ্ট্রের শাসকদের এবং গুপ্তঘাতকদের হুকুমদাতাদের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য থাকে না।

ক্রোধের যৌক্তিক কারণ রয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আইনের শাসনকে সমুন্নত রেখেই জঙ্গিবাদী ঘাতক বাহিনীকে নির্মূল করার অভিযানকে শক্তিশালী করতে হবে। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, হার্ট অ্যাটাক–যে নামেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকে ডাকা হোক, এটা নির্জলা অসভ্যতা। বিচারব্যবস্থার অকার্যকারিতা ও অবিশ্বাস্য দীর্ঘসূত্রতা এ দেশে আমাদের সবার চরম হতাশার কারণ ঘটাচ্ছে। তারপরও বলব, পুলিশ বা র‍্যাবকে ঘাতকের ভূমিকায় নামিয়ে দেওয়ায় বিশ্বের কাছে একটা অসভ্য জাতি হিসেবে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। চারদিক থেকে অপপ্রচারের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে সরকার। ২০১৬ সালের পর দেশে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস অনেকখানি কমে গেলেও ক্রসফায়ারের মতো আইনের শাসন থেকে বিচ্যুতি রাষ্ট্রের শাসকদের শাসনের নৈতিক অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। আবশ্যক ছিল অতিদ্রুত বিচারের মাধ্যমে গ্রেপ্তারকৃত সন্দেহভাজন জঙ্গি খুনিদের আদালতের মাধ্যমে যথোপযুক্ত শাস্তির বিধান করার জন্য অবিলম্বে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত দুটো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি ট্রাইব্যুনাল বর্তমানে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার সানুনয় আবেদন, যথোপযুক্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কিলিং স্কোয়াডের আততায়ীদের ট্রাইব্যুনালের বিচারে সোপর্দ করার ব্যবস্থা করা হোক এবং বিচারের সর্বোচ্চ সীমা দুই মাসের মধ্যে সীমিত করা হোক। প্রয়োজনে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগও রহিত করা হোক। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছিল। তাই আল্লাহর ওয়াস্তে ক্রসফায়ার বন্ধ করুন। র‍্যাবের বিরুদ্ধে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যদি বাংলাদেশে গেড়ে বসা বিচারবহির্ভূত হত্যার অসভ্য কালচার থেকে জাতিকে কিছুটা পরিত্রাণ দেয়, তাহলে জাতি আখেরে উপকৃত হবে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলো, এক্সট্রা-জুডিশিয়াল কিলিং সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত ১৩ বছরেও কোনো ‘সুয়োমোটো’ নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি।

ড. মইনুল ইসলাম: অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত