আসিফ
বছরখানেক আগে একটা সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে অনেকের সঙ্গে আরও দুই-তিনজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করেন। তাঁরা যখন তাঁদের গবেষণাকাজের কথা বলছিলেন, তখন মনে হলো তাঁরা যেন বিজ্ঞানের মর্মার্থ বোঝানোর চেয়ে পণ্য উৎপাদনের বিষয়ে বেশি বললেন। মানুষের কিসে সুবিধা হবে, কিসে লাভ হবে—তার হিসাব দেখানোয় বেশি মনোযোগ দিলেন। আমি হতবাক হলাম এই ভেবে, বিজ্ঞানের আলোচনা কেমন করে যে বাণিজ্যিক আলোচনায় রূপ নিচ্ছে। এটাই কি আমাদের কাম্য বা লক্ষ্য ছিল?
আমি প্রশ্ন না করে পারলাম না। গবেষণার উদ্দেশ্য কি শুধু সুবিধা দেওয়া, বিজ্ঞানকে আত্তীকরণ করা নয়?
এই প্রাযুক্তিক সুবিধা ২৫ বছরে যে পরিমাণ দেওয়া হয়েছে, তা বিগত ৩০০ বছরে মানুষ চিন্তায়ও আনতে পারেনি। গড়ে ছয় ইঞ্চি বাই আড়াই ইঞ্চি আকৃতির মোবাইল ফোন নামে ছোট্ট যন্ত্রটি সুবিধার এক মহাসাগরে রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে আমরা সবাই হাবুডুবু খাচ্ছি। আমাদের মধ্যকার সাংস্কৃতিক পার্থক্য বেড়েই চলেছে। পরিণামে আমরা একটি ‘কালচারাল ব্যাটল ফিল্ড’ বা সাংস্কৃতিক সংঘাতের মধ্যে প্রবেশ করেছি। যেটাকে বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদেরা সবচেয়ে বড় বিপদ বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি এটাকে সভ্যতার ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি বলা যেতে পারে।
এরই প্রতিফলন পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছিল এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ইউএসএ সিনেটে টেক জায়ান্টদের উপস্থিতির ঘটনাটিতে। সেখানে ৪ ঘণ্টা ধরে সিনেটররা টেক জায়ান্টদের জেরা করেছেন। প্রযুক্তির এই কর্তাদের সামনে থেকে জেরা করার সুযোগ পাওয়া যে-সে ব্যাপার নয়। পরিস্থিতি কতটুকু বিপন্ন অবস্থায় পড়লে এ রকম হয়? সেই আলোচনা সভায় বিশ্বের নামকরা প্রযুক্তি কোম্পানির কর্তাদের উপস্থিতিতে বলা হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে এই প্রজন্ম ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, স্বয়ং মেটার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ ক্ষমাও চেয়েছেন। ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের জাকারবার্গ সিনেটে উপস্থিত অভিভাবকদের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কারও যাওয়া উচিত না।
উল্লেখ্য, সেই আলোচনায় জাকারবার্গ এবং টিকটকের সিইও শাও জি চিউ স্বেচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে রাজি হলেও স্ন্যাপ, এক্স (আগের টুইটার) এবং ডিসকর্ডের প্রধানেরা প্রাথমিকভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরপর সরকারের সমন জারির মাধ্যমে তাঁদের সেখানে আসতে বাধ্য করা হয়। সিনেটে উপস্থিত হওয়া পাঁচ প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধানের পেছনে বসে থাকা অভিভাবকদের চাপেই তাঁরা এখানে এসেছেন। তাঁদের পরিবারে সন্তানেরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ উদ্যোগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কনটেন্টের কারণে তাঁদের সন্তানেরা যৌন হয়রানি, প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে আরম্ভ করে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। প্রযুক্তির কর্তারা যখন সিনেট কক্ষে প্রবেশ করেন, তখন ওই পরিবারগুলোকে তাঁদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল।
ওই শুনানিতে অনলাইনে নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষা করার বিষয়টিই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। তবে এটা দুঃখজনক, এর বাইরে সিনেটররা এমন সব প্রশ্ন করেন, তাতে মূল বিষয়টি অনেকখানি ফিকে হয়ে যায়। যেমন বাইটডান্স নামের একটি চীনা কোম্পানির মালিকানাধীন টিকটকের সিইও শাও জি চিউকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁর প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ব্যবহারকারীদের তথ্য চীন সরকারকে দেয় কি না। উত্তরে তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিক জানালেও ইউএস সিনেটর টম কটন চিউকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কখনো যুক্ত ছিলেন কি না। এটা থেকে বোঝা যায়, বৈশ্বিক নেতৃত্বদানকারী সমাজের প্রতিনিধিরা বুঝে উঠতে পারছেন না বা চাইছেন না বিপদটার মাত্রা; বুঝলে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করতেন না। তবে শাও জি চিউ বলেছেন, ‘তিনটি ছোট সন্তানের বাবা হিসেবে আমি বুঝতে পারছি যে আমরা আজ যে বিষয়টি নিয়ে এখানে আলোচনা করছি, তা ভয়ংকর এবং অনেক মা-বাবার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো।’
জোয়ান বোগার্ড নামের এক অভিভাবক বলেছেন, ‘অনেক মা-বাবা ভাবতে পারেন যে আজ আমরা যে ক্ষতির কথা বলছি, তা তাঁদের পরিবারে কখনো প্রভাব ফেলবে না। একসময় আমিও এমনটা ভেবেছিলাম। আমার ছেলেও টিকটকের একটি দম বন্ধ করে রাখার ট্রেন্ডে অংশগ্রহণ করেছিল। আমার ছেলে ম্যাসন মারা গিয়েছিল ২০১৯ সালের মে মাসে।’ আর্তুরো বেজার, একজন সাবেক সিনিয়র স্টাফ মেম্বার, যিনি ২০২৩ সালের নভেম্বরে কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তিনিও এই শুনানিতে ছিলেন। তাঁর কথা থেকে বোঝা যায়, কিশোর-কিশোরীদের নিরাপদ পরিবেশের দায়িত্ব তাদের মা-বাবার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে মেটা। অথচ তারা একটি বাটনও যুক্ত করেনি, যার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানাতে পারবে। যদিও এই শুনানির সময় মেটা কর্তৃপক্ষ বলেছে, কিশোর-কিশোরীদের অনলাইনে নিরাপদ পরিবেশ দেওয়ার জন্য তারা ৩০টির বেশি টুলস এনেছে।
বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ঘটনাটি তুলে ধরলেও এই গ্লোবাল নিউজটিকে এক কলাম ছয় ইঞ্চির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো এবং কোনো ফলোআপও ছিল না পরবর্তী দুই মাসে। এর মধ্যে বেশ কিছু গণমাধ্যম বিষয়টি প্রকাশই করেনি।
ওপরের অভিজ্ঞতা দিয়ে সমস্যা এবং ক্ষতির মাত্রা কতটা, তা বোঝানো যায়। তাতে বিপদ থেকে একদম পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। পৃথিবীব্যাপী সমাজ কাঠামোয় কমবেশি যে বিজ্ঞান সংস্কৃতি বিকাশ ঘটার প্রয়োজন ছিল, সেটা হয়নি। বিষয়টাকে এভাবে বলা যায়:
নিউটনের সময় পর্যন্ত কাঠামো ও এর উপাদান পদার্থজগৎ যে আলাদা সত্তা নিয়েছিল, আইনস্টাইন তাকে একীভূত করলেন সময়ের বন্ধনে। একটা ছাড়া আরেকটার অস্তিত্ব অর্থহীন। যা ঘোষণা করল, আমরা এমন একটা বিশ্বে থাকি, যেখানে প্রান্ত আর বিন্দু একীভূত, সেরা বা শ্রেষ্ঠত্ব বলে কোনো স্থান নেই। মানুষ কৌশলটা নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি গড়ে তুলল, কিন্তু সমাজজীবনে শ্রেষ্ঠত্বকে বাদ দিল না। আমাদের প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলল। বিজ্ঞানকে আত্তীকরণের জায়গা থেকে কৌশলের উপায় হিসেবে নেওয়ার সাংস্কৃতিক অভিঘাত যে কত মারাত্মক হতে পারে, তার প্রকাশ দেখি চার্লস ডারউইনের তত্ত্বকে অস্বীকার করার মাধ্যমে। বিবর্তনবাদ বহু আগে থেকে প্রচলিত। এটা ডারউইন-প্রদত্ত কোনো ধারণা নয়। তিনি শুধু এর সঠিক ব্যাখ্যা দেন কীভাবে এটা ঘটে; এর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো জীববৈচিত্র্য; অর্থাৎ এই পৃথিবীতে আবহমণ্ডল থেকে প্রাণিজগৎ হয়ে মানুষ পর্যন্ত পরস্পরের কত নিকটবর্তী। একটা আরেকটার ওপর কতটা নির্ভরশীল। কিন্তু একটিকে ক্ষতি করলে বা ভারসাম্যহীন করলে, অন্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানেও মানুষ চার্লস ডারউইন, জোহান গ্রেগরি মেন্ডেলের ধারণাকে কৌশল হিসেবে নিয়ে জিন প্রকৌশল বা জৈব প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাল। কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ গড়ে তুলতে পারল না; বরং পরস্পরের কাছে স্বার্থের দেয়াল তুলে বিভাজনের পরিধি বাড়ানো হলো। পরিবেশকে ধ্বংস করে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির দিকে নিজেদের দিকে ঠেলে দিলাম আমরা।
খুবই আশ্চর্য, আমেরিকায় ‘কিডস অনলাইন সেফটি অ্যাক্ট’ এখনো পাস করা হয়নি। আমাদের দেশে তো প্রশ্নই আসে না। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না ভোক্তা হওয়া ছাড়া। কিন্তু আমরা যদি জরিপ চালাই, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ তাদের চেয়ে বেশি বই কম নয়। ক্যানসার ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে প্রযুক্তির এই অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার দায়ী। এর উৎপাদনে প্রচুর খনিজদ্রব্য ব্যবহারে পরিবেশদূষণ এবং এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শারীরিক ও মানসিক দূষণ তৈরি করছে—এর কোনো হিসাব নেই। যদি বিজ্ঞানের মর্মার্থকে অনুধাবন করতে পারতাম, তাহলে পরিবেশ রক্ষায় আমরা অধিকতর সচেতন হতে পারতাম। একটি সাইকেল, ক্যামেরা চালাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, কিন্তু মোবাইল ফোন চালানোর আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। অথচ কী নেই এর ভেতর? বলতে গেলে আমাদের পুরো জীবনকেই নিয়ন্ত্রণ করছে এটি।
প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করার অভাব এই সব বোঝাপড়াকে এগোতে দিচ্ছে না। বিজ্ঞান সব সময় দেখিয়েছে, বিশ্বজগতের সবকিছু কী প্রবলভাবে সম্পর্কযুক্ত। আর আমরা মানুষেরা নিয়েছি কৌশলগত ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা; অর্থাৎ ‘বিজনেস অ্যান্ড প্রফিট’, যা আজকে পৃথিবীর এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বিজ্ঞান ও মানবিকতার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে না পারলে এক মর্মান্তিক পৃথিবীর দিকে আমরা এগিয়ে যাব।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত
বছরখানেক আগে একটা সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে অনেকের সঙ্গে আরও দুই-তিনজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করেন। তাঁরা যখন তাঁদের গবেষণাকাজের কথা বলছিলেন, তখন মনে হলো তাঁরা যেন বিজ্ঞানের মর্মার্থ বোঝানোর চেয়ে পণ্য উৎপাদনের বিষয়ে বেশি বললেন। মানুষের কিসে সুবিধা হবে, কিসে লাভ হবে—তার হিসাব দেখানোয় বেশি মনোযোগ দিলেন। আমি হতবাক হলাম এই ভেবে, বিজ্ঞানের আলোচনা কেমন করে যে বাণিজ্যিক আলোচনায় রূপ নিচ্ছে। এটাই কি আমাদের কাম্য বা লক্ষ্য ছিল?
আমি প্রশ্ন না করে পারলাম না। গবেষণার উদ্দেশ্য কি শুধু সুবিধা দেওয়া, বিজ্ঞানকে আত্তীকরণ করা নয়?
এই প্রাযুক্তিক সুবিধা ২৫ বছরে যে পরিমাণ দেওয়া হয়েছে, তা বিগত ৩০০ বছরে মানুষ চিন্তায়ও আনতে পারেনি। গড়ে ছয় ইঞ্চি বাই আড়াই ইঞ্চি আকৃতির মোবাইল ফোন নামে ছোট্ট যন্ত্রটি সুবিধার এক মহাসাগরে রূপ নিয়েছে। এর মধ্যে আমরা সবাই হাবুডুবু খাচ্ছি। আমাদের মধ্যকার সাংস্কৃতিক পার্থক্য বেড়েই চলেছে। পরিণামে আমরা একটি ‘কালচারাল ব্যাটল ফিল্ড’ বা সাংস্কৃতিক সংঘাতের মধ্যে প্রবেশ করেছি। যেটাকে বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদেরা সবচেয়ে বড় বিপদ বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি এটাকে সভ্যতার ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি বলা যেতে পারে।
এরই প্রতিফলন পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছিল এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ইউএসএ সিনেটে টেক জায়ান্টদের উপস্থিতির ঘটনাটিতে। সেখানে ৪ ঘণ্টা ধরে সিনেটররা টেক জায়ান্টদের জেরা করেছেন। প্রযুক্তির এই কর্তাদের সামনে থেকে জেরা করার সুযোগ পাওয়া যে-সে ব্যাপার নয়। পরিস্থিতি কতটুকু বিপন্ন অবস্থায় পড়লে এ রকম হয়? সেই আলোচনা সভায় বিশ্বের নামকরা প্রযুক্তি কোম্পানির কর্তাদের উপস্থিতিতে বলা হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে এই প্রজন্ম ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, স্বয়ং মেটার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ ক্ষমাও চেয়েছেন। ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকের জাকারবার্গ সিনেটে উপস্থিত অভিভাবকদের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কারও যাওয়া উচিত না।
উল্লেখ্য, সেই আলোচনায় জাকারবার্গ এবং টিকটকের সিইও শাও জি চিউ স্বেচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে রাজি হলেও স্ন্যাপ, এক্স (আগের টুইটার) এবং ডিসকর্ডের প্রধানেরা প্রাথমিকভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এরপর সরকারের সমন জারির মাধ্যমে তাঁদের সেখানে আসতে বাধ্য করা হয়। সিনেটে উপস্থিত হওয়া পাঁচ প্রযুক্তি কোম্পানির প্রধানের পেছনে বসে থাকা অভিভাবকদের চাপেই তাঁরা এখানে এসেছেন। তাঁদের পরিবারে সন্তানেরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এ উদ্যোগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কনটেন্টের কারণে তাঁদের সন্তানেরা যৌন হয়রানি, প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে আরম্ভ করে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। প্রযুক্তির কর্তারা যখন সিনেট কক্ষে প্রবেশ করেন, তখন ওই পরিবারগুলোকে তাঁদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল।
ওই শুনানিতে অনলাইনে নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষা করার বিষয়টিই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। তবে এটা দুঃখজনক, এর বাইরে সিনেটররা এমন সব প্রশ্ন করেন, তাতে মূল বিষয়টি অনেকখানি ফিকে হয়ে যায়। যেমন বাইটডান্স নামের একটি চীনা কোম্পানির মালিকানাধীন টিকটকের সিইও শাও জি চিউকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁর প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ব্যবহারকারীদের তথ্য চীন সরকারকে দেয় কি না। উত্তরে তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিক জানালেও ইউএস সিনেটর টম কটন চিউকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কখনো যুক্ত ছিলেন কি না। এটা থেকে বোঝা যায়, বৈশ্বিক নেতৃত্বদানকারী সমাজের প্রতিনিধিরা বুঝে উঠতে পারছেন না বা চাইছেন না বিপদটার মাত্রা; বুঝলে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করতেন না। তবে শাও জি চিউ বলেছেন, ‘তিনটি ছোট সন্তানের বাবা হিসেবে আমি বুঝতে পারছি যে আমরা আজ যে বিষয়টি নিয়ে এখানে আলোচনা করছি, তা ভয়ংকর এবং অনেক মা-বাবার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো।’
জোয়ান বোগার্ড নামের এক অভিভাবক বলেছেন, ‘অনেক মা-বাবা ভাবতে পারেন যে আজ আমরা যে ক্ষতির কথা বলছি, তা তাঁদের পরিবারে কখনো প্রভাব ফেলবে না। একসময় আমিও এমনটা ভেবেছিলাম। আমার ছেলেও টিকটকের একটি দম বন্ধ করে রাখার ট্রেন্ডে অংশগ্রহণ করেছিল। আমার ছেলে ম্যাসন মারা গিয়েছিল ২০১৯ সালের মে মাসে।’ আর্তুরো বেজার, একজন সাবেক সিনিয়র স্টাফ মেম্বার, যিনি ২০২৩ সালের নভেম্বরে কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তিনিও এই শুনানিতে ছিলেন। তাঁর কথা থেকে বোঝা যায়, কিশোর-কিশোরীদের নিরাপদ পরিবেশের দায়িত্ব তাদের মা-বাবার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে মেটা। অথচ তারা একটি বাটনও যুক্ত করেনি, যার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানাতে পারবে। যদিও এই শুনানির সময় মেটা কর্তৃপক্ষ বলেছে, কিশোর-কিশোরীদের অনলাইনে নিরাপদ পরিবেশ দেওয়ার জন্য তারা ৩০টির বেশি টুলস এনেছে।
বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ঘটনাটি তুলে ধরলেও এই গ্লোবাল নিউজটিকে এক কলাম ছয় ইঞ্চির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো এবং কোনো ফলোআপও ছিল না পরবর্তী দুই মাসে। এর মধ্যে বেশ কিছু গণমাধ্যম বিষয়টি প্রকাশই করেনি।
ওপরের অভিজ্ঞতা দিয়ে সমস্যা এবং ক্ষতির মাত্রা কতটা, তা বোঝানো যায়। তাতে বিপদ থেকে একদম পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। পৃথিবীব্যাপী সমাজ কাঠামোয় কমবেশি যে বিজ্ঞান সংস্কৃতি বিকাশ ঘটার প্রয়োজন ছিল, সেটা হয়নি। বিষয়টাকে এভাবে বলা যায়:
নিউটনের সময় পর্যন্ত কাঠামো ও এর উপাদান পদার্থজগৎ যে আলাদা সত্তা নিয়েছিল, আইনস্টাইন তাকে একীভূত করলেন সময়ের বন্ধনে। একটা ছাড়া আরেকটার অস্তিত্ব অর্থহীন। যা ঘোষণা করল, আমরা এমন একটা বিশ্বে থাকি, যেখানে প্রান্ত আর বিন্দু একীভূত, সেরা বা শ্রেষ্ঠত্ব বলে কোনো স্থান নেই। মানুষ কৌশলটা নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি গড়ে তুলল, কিন্তু সমাজজীবনে শ্রেষ্ঠত্বকে বাদ দিল না। আমাদের প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলল। বিজ্ঞানকে আত্তীকরণের জায়গা থেকে কৌশলের উপায় হিসেবে নেওয়ার সাংস্কৃতিক অভিঘাত যে কত মারাত্মক হতে পারে, তার প্রকাশ দেখি চার্লস ডারউইনের তত্ত্বকে অস্বীকার করার মাধ্যমে। বিবর্তনবাদ বহু আগে থেকে প্রচলিত। এটা ডারউইন-প্রদত্ত কোনো ধারণা নয়। তিনি শুধু এর সঠিক ব্যাখ্যা দেন কীভাবে এটা ঘটে; এর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো জীববৈচিত্র্য; অর্থাৎ এই পৃথিবীতে আবহমণ্ডল থেকে প্রাণিজগৎ হয়ে মানুষ পর্যন্ত পরস্পরের কত নিকটবর্তী। একটা আরেকটার ওপর কতটা নির্ভরশীল। কিন্তু একটিকে ক্ষতি করলে বা ভারসাম্যহীন করলে, অন্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানেও মানুষ চার্লস ডারউইন, জোহান গ্রেগরি মেন্ডেলের ধারণাকে কৌশল হিসেবে নিয়ে জিন প্রকৌশল বা জৈব প্রযুক্তির বিকাশ ঘটাল। কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ গড়ে তুলতে পারল না; বরং পরস্পরের কাছে স্বার্থের দেয়াল তুলে বিভাজনের পরিধি বাড়ানো হলো। পরিবেশকে ধ্বংস করে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির দিকে নিজেদের দিকে ঠেলে দিলাম আমরা।
খুবই আশ্চর্য, আমেরিকায় ‘কিডস অনলাইন সেফটি অ্যাক্ট’ এখনো পাস করা হয়নি। আমাদের দেশে তো প্রশ্নই আসে না। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না ভোক্তা হওয়া ছাড়া। কিন্তু আমরা যদি জরিপ চালাই, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ তাদের চেয়ে বেশি বই কম নয়। ক্যানসার ছড়িয়ে যাওয়ার পেছনে প্রযুক্তির এই অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার দায়ী। এর উৎপাদনে প্রচুর খনিজদ্রব্য ব্যবহারে পরিবেশদূষণ এবং এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শারীরিক ও মানসিক দূষণ তৈরি করছে—এর কোনো হিসাব নেই। যদি বিজ্ঞানের মর্মার্থকে অনুধাবন করতে পারতাম, তাহলে পরিবেশ রক্ষায় আমরা অধিকতর সচেতন হতে পারতাম। একটি সাইকেল, ক্যামেরা চালাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, কিন্তু মোবাইল ফোন চালানোর আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। অথচ কী নেই এর ভেতর? বলতে গেলে আমাদের পুরো জীবনকেই নিয়ন্ত্রণ করছে এটি।
প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার বিজ্ঞানকে আত্মস্থ করার অভাব এই সব বোঝাপড়াকে এগোতে দিচ্ছে না। বিজ্ঞান সব সময় দেখিয়েছে, বিশ্বজগতের সবকিছু কী প্রবলভাবে সম্পর্কযুক্ত। আর আমরা মানুষেরা নিয়েছি কৌশলগত ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা; অর্থাৎ ‘বিজনেস অ্যান্ড প্রফিট’, যা আজকে পৃথিবীর এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বিজ্ঞান ও মানবিকতার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে না পারলে এক মর্মান্তিক পৃথিবীর দিকে আমরা এগিয়ে যাব।
লেখক: বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে