চিররঞ্জন সরকার
একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। এই কান্নাই বর্তমানে আমাদের দেশে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিষাদে রূপ নিচ্ছে ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবের ছুটির আনন্দ। সড়কে রোজ ঝরছে প্রাণ। অন্যান্য সপ্তাহের তুলনায় ঈদের সপ্তাহে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
যেখানে হাসিমাখা মুখ প্রিয়জনের হৃদয় জুড়িয়ে দেওয়ার কথা, সেখানে বাড়ির উঠানে আসছে নিথর দেহ। পৃথিবীর প্রতিটি জনপদেই উৎসব উদ্যাপিত হয়। কিন্তু কোনো নাশকতা ছাড়া শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় এত মানুষ হতাহতের নজির বোধ হয় অন্য কোথাও নেই। এবারের ঈদযাত্রায়ও সড়ক দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে এসেছে প্রতিদিনই।
শুধু ঈদের দিনই সারা দেশে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিআরটিএ জানিয়েছে, ৪ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৭ দিনে সারা দেশে ২৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩২০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৪৬২ জন আহত হয়েছে; যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ১৯ শতাংশ বেশি।অন্যদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, ঈদযাত্রা শুরুর দিন (৪ এপ্রিল) থেকে ১৮ এপ্রিল কর্মস্থলে ফেরা পর্যন্ত ১৫ দিনে সড়কে ৩৯৯টি দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৯৮ জন আহত হয়েছে। এই সময়ে রেলপথে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছে। নৌপথে ২টি দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়েছে। সব মিলিয়ে সড়ক, রেল ও নৌপথে ৪১৯টি দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত ও ১ হাজার ৪২৪ জন আহত হয়েছে।
গত বছর ঈদুল ফিতরে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৮ জন নিহত ও ৫৬৫ জন আহত হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ, প্রাণহানি ২৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ও আহত ১৪৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। আর এসব দুর্ঘটনায় যথারীতি মোটরসাইকেলই শীর্ষে রয়েছে। এবারের ঈদে ১৯৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৫ জন নিহত ও ২৪০ জন আহত হয়েছে; যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, নিহতের ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং আহতের ৩০ দশমিক ৩৭ শতাংশ প্রায়।
যদিও সব দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে না। তাই প্রকৃত দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আট বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৬০ হাজার ৮৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ৩ হাজার ৮৬২ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪ হাজার ৪৭৫ জনের; অর্থাৎ কেবল ঈদের মৌসুমেই সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছে। আর বর্তমান সরকারের সময়ে যে পরিমাণ নতুন রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে মাত্র ৩ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের সড়ক দিয়ে শুরু করা বাংলাদেশে বর্তমানে ৩ লাখ ৭৫ হাজার কিলোমিটারের সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক মিলিয়ে ২২ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক আছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে এসেছে বিস্ময়কর পরিবর্তন।
এসব সড়ক নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন হাইওয়ে পুলিশের ৭৩টি ইউনিটের প্রায় ৩ হাজার সদস্য। ইতিমধ্যে দেশে অনেক মহাসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, ওভারপাস, আন্ডারপাস, ওভারব্রিজ নির্মিত হয়েছে। দুই লেনের মহাসড়ক চার লেনে পরিণত হয়েছে আর চার লেনগুলো আট লেনে পরিণত হবে। কিন্তু এত সব আয়োজন দুর্ঘটনা কমাতে ন্যূনতম ভূমিকা পালন করতে পারছে না। মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। কোথাও কোনো প্রতিকার মিলছে না।
শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ফলে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এত এত অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল মোতায়েন এবং পরিবহন আইন সংস্কার সত্ত্বেও সড়কে শৃঙ্খলার অভাব রয়ে গেছে, যা রোজার ঈদ আর কোরবানির ঈদে প্রকট আকার ধারণ করে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ভাঙাচোরা সড়ক, অদক্ষ চালক, দুর্নীতি, ট্রাফিক তদারকির অভাব, অপ্রশস্ত সড়ক, বেপরোয়া গতি, মহাসড়কে মোটরসাইকেল, তিন চাকার গাড়ি চলাচল ইত্যাদি। পরিবহনের তুলনায় যাত্রী কয়েক গুণ বৃদ্ধি এবং পরিবহন মালিকের অতিমুনাফার লোভে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও অদক্ষ চালক রাস্তায় নামানো হয়।
সড়ক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কর্তব্যে অবহেলা ও দুর্নীতি সড়ক শৃঙ্খলার অন্তরায়। এমনকি মহাসড়কে অনভ্যস্ত শহুরে সিটি বাসগুলো সড়কে চাপ তৈরি করে। আর অধিক ট্রিপ পাওয়ার আশায় বিরতিহীন ও বেপরোয়া গতিতে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
অসচেতন যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা না ভেবে বাস, ট্রেন ও লঞ্চের ছাদে ভ্রমণের বহু পুরোনো অভ্যাস তো আছেই। আর যথাযথ রাষ্ট্রীয় তদারকিরও ঘাটতি আছে। তবে এসব ছাপিয়ে সাম্প্রতিককালে অগণিত মোটরসাইকেল সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। জ্যাম এড়াতে মহাসড়কে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি যাওয়া, উঠতি তরুণদের বেপরোয়া গতি, নিরাপত্তাসরঞ্জাম পরিধান না করার কারণে মূলত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহত বাড়ছে। এবারের ঈদেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
সড়ক নিরাপত্তায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, শত শত সুপারিশ, টাস্কফোর্স—কিছুই কাজে আসছে না। প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার পর গাড়ি কিংবা সড়কের ত্রুটি সামনে আসছে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), হাইওয়ে পুলিশসহ সরকারের নানা সংস্থা অনিয়ম রোধে থাকলেও আগেভাগে ত্রুটি ধরা পড়ে না।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে সড়কের নিরাপত্তায় শাস্তি বহু গুণ বাড়িয়ে আইন করা হয়। দুর্ঘটনা রোধে ১১১ দফা সুপারিশ জমা দিয়েছে উচ্চক্ষমতার কমিটি। সুপারিশ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্স হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন ৬ দফা নির্দেশনা। কিন্তু সড়কে কিছুই ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দুর্ঘটনাও রোধ হচ্ছে না।
মহাসড়ক নিরাপদ করতে ধীরগতির যানবাহন চলাচলে হাজার হাজার কোটি টাকায় সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সেগুলো দখল হয়ে গেছে। খোদ পুলিশ রয়েছে দখলদারের তালিকায়। মহাসড়কে বসানো হয়েছে স্পিডমিটার, সিসিক্যামেরা। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ফিটনেসবিহীন যান আর অপরিণত চালক টোল প্লাজায় পিষে দিচ্ছে অন্যান্য যান ও যাত্রীকে। এ যেন অমোঘ নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ!
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশ সরকার প্রতিনিয়ত সড়কের উন্নয়ন করছে, কিন্তু তবুও সড়কের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, যার দরুন প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। নিরাপদ সড়কের জন্য ২০১৮ সালে যখন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল, তখন সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ নামে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই আইনের পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে এবং দুর্ঘটনার হার কমবে—এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও সেই আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়নের দেখা মিলছে না এবং প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছেই।
প্রশ্ন হলো, আর কতটি প্রাণের বিনিময়ে বন্ধ হবে এই মৃত্যুর মিছিল? আর কত মায়ের কোল খালি করতে হবে? কত সন্তান বাবাহারা হবে?
সড়কের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। তাই সরকারের উচিত, শুধু আইন তৈরিতেই সীমাবদ্ধ না থেকে যত দ্রুত সম্ভব তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া এবং সাধারণ জনগণেরও উচিত, তাদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে আরও বেশি সচেতন হওয়া।
সড়ক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। নিয়ম মানাতে বাধ্য করতে হবে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে এ খাতকে সুশৃঙ্খল রাখা সম্ভব। যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স নিয়ে কোনো ধরনের শৈথিল্য কাম্য নয়। যানবাহনের ত্রুটি কিংবা চালকের অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে অকালে কোনো মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে না।
পঙ্গুত্বের মতো দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ জীবন কাটাতে পারে না। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ বাহিনী গঠন করা যায়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ ধরনের বাহিনী গঠন করা হচ্ছে না কেন? জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন না মানাই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক-শ্রমিক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের কাছ থেকে সমন্বিত, আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা সবাই আশা করে।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। এই কান্নাই বর্তমানে আমাদের দেশে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিষাদে রূপ নিচ্ছে ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবের ছুটির আনন্দ। সড়কে রোজ ঝরছে প্রাণ। অন্যান্য সপ্তাহের তুলনায় ঈদের সপ্তাহে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
যেখানে হাসিমাখা মুখ প্রিয়জনের হৃদয় জুড়িয়ে দেওয়ার কথা, সেখানে বাড়ির উঠানে আসছে নিথর দেহ। পৃথিবীর প্রতিটি জনপদেই উৎসব উদ্যাপিত হয়। কিন্তু কোনো নাশকতা ছাড়া শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় এত মানুষ হতাহতের নজির বোধ হয় অন্য কোথাও নেই। এবারের ঈদযাত্রায়ও সড়ক দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে এসেছে প্রতিদিনই।
শুধু ঈদের দিনই সারা দেশে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিআরটিএ জানিয়েছে, ৪ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৭ দিনে সারা দেশে ২৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩২০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৪৬২ জন আহত হয়েছে; যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ১৯ শতাংশ বেশি।অন্যদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, ঈদযাত্রা শুরুর দিন (৪ এপ্রিল) থেকে ১৮ এপ্রিল কর্মস্থলে ফেরা পর্যন্ত ১৫ দিনে সড়কে ৩৯৯টি দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ও ১ হাজার ৩৯৮ জন আহত হয়েছে। এই সময়ে রেলপথে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছে। নৌপথে ২টি দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়েছে। সব মিলিয়ে সড়ক, রেল ও নৌপথে ৪১৯টি দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত ও ১ হাজার ৪২৪ জন আহত হয়েছে।
গত বছর ঈদুল ফিতরে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৮ জন নিহত ও ৫৬৫ জন আহত হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ, প্রাণহানি ২৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ও আহত ১৪৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। আর এসব দুর্ঘটনায় যথারীতি মোটরসাইকেলই শীর্ষে রয়েছে। এবারের ঈদে ১৯৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৫ জন নিহত ও ২৪০ জন আহত হয়েছে; যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, নিহতের ৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং আহতের ৩০ দশমিক ৩৭ শতাংশ প্রায়।
যদিও সব দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে না। তাই প্রকৃত দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আট বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৬০ হাজার ৮৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ৩ হাজার ৮৬২ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪ হাজার ৪৭৫ জনের; অর্থাৎ কেবল ঈদের মৌসুমেই সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছে। আর বর্তমান সরকারের সময়ে যে পরিমাণ নতুন রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে মাত্র ৩ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের সড়ক দিয়ে শুরু করা বাংলাদেশে বর্তমানে ৩ লাখ ৭৫ হাজার কিলোমিটারের সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক মিলিয়ে ২২ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক আছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে এসেছে বিস্ময়কর পরিবর্তন।
এসব সড়ক নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন হাইওয়ে পুলিশের ৭৩টি ইউনিটের প্রায় ৩ হাজার সদস্য। ইতিমধ্যে দেশে অনেক মহাসড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, ওভারপাস, আন্ডারপাস, ওভারব্রিজ নির্মিত হয়েছে। দুই লেনের মহাসড়ক চার লেনে পরিণত হয়েছে আর চার লেনগুলো আট লেনে পরিণত হবে। কিন্তু এত সব আয়োজন দুর্ঘটনা কমাতে ন্যূনতম ভূমিকা পালন করতে পারছে না। মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। কোথাও কোনো প্রতিকার মিলছে না।
শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ফলে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এত এত অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল মোতায়েন এবং পরিবহন আইন সংস্কার সত্ত্বেও সড়কে শৃঙ্খলার অভাব রয়ে গেছে, যা রোজার ঈদ আর কোরবানির ঈদে প্রকট আকার ধারণ করে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ভাঙাচোরা সড়ক, অদক্ষ চালক, দুর্নীতি, ট্রাফিক তদারকির অভাব, অপ্রশস্ত সড়ক, বেপরোয়া গতি, মহাসড়কে মোটরসাইকেল, তিন চাকার গাড়ি চলাচল ইত্যাদি। পরিবহনের তুলনায় যাত্রী কয়েক গুণ বৃদ্ধি এবং পরিবহন মালিকের অতিমুনাফার লোভে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও অদক্ষ চালক রাস্তায় নামানো হয়।
সড়ক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কর্তব্যে অবহেলা ও দুর্নীতি সড়ক শৃঙ্খলার অন্তরায়। এমনকি মহাসড়কে অনভ্যস্ত শহুরে সিটি বাসগুলো সড়কে চাপ তৈরি করে। আর অধিক ট্রিপ পাওয়ার আশায় বিরতিহীন ও বেপরোয়া গতিতে গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
অসচেতন যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা না ভেবে বাস, ট্রেন ও লঞ্চের ছাদে ভ্রমণের বহু পুরোনো অভ্যাস তো আছেই। আর যথাযথ রাষ্ট্রীয় তদারকিরও ঘাটতি আছে। তবে এসব ছাপিয়ে সাম্প্রতিককালে অগণিত মোটরসাইকেল সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। জ্যাম এড়াতে মহাসড়কে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি যাওয়া, উঠতি তরুণদের বেপরোয়া গতি, নিরাপত্তাসরঞ্জাম পরিধান না করার কারণে মূলত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহত বাড়ছে। এবারের ঈদেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
সড়ক নিরাপত্তায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, শত শত সুপারিশ, টাস্কফোর্স—কিছুই কাজে আসছে না। প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার পর গাড়ি কিংবা সড়কের ত্রুটি সামনে আসছে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), হাইওয়ে পুলিশসহ সরকারের নানা সংস্থা অনিয়ম রোধে থাকলেও আগেভাগে ত্রুটি ধরা পড়ে না।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে সড়কের নিরাপত্তায় শাস্তি বহু গুণ বাড়িয়ে আইন করা হয়। দুর্ঘটনা রোধে ১১১ দফা সুপারিশ জমা দিয়েছে উচ্চক্ষমতার কমিটি। সুপারিশ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্স হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন ৬ দফা নির্দেশনা। কিন্তু সড়কে কিছুই ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দুর্ঘটনাও রোধ হচ্ছে না।
মহাসড়ক নিরাপদ করতে ধীরগতির যানবাহন চলাচলে হাজার হাজার কোটি টাকায় সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সেগুলো দখল হয়ে গেছে। খোদ পুলিশ রয়েছে দখলদারের তালিকায়। মহাসড়কে বসানো হয়েছে স্পিডমিটার, সিসিক্যামেরা। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ফিটনেসবিহীন যান আর অপরিণত চালক টোল প্লাজায় পিষে দিচ্ছে অন্যান্য যান ও যাত্রীকে। এ যেন অমোঘ নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ!
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশ সরকার প্রতিনিয়ত সড়কের উন্নয়ন করছে, কিন্তু তবুও সড়কের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, যার দরুন প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। নিরাপদ সড়কের জন্য ২০১৮ সালে যখন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল, তখন সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ নামে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই আইনের পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে এবং দুর্ঘটনার হার কমবে—এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু ২০২৪ সালে এসেও সেই আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়নের দেখা মিলছে না এবং প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছেই।
প্রশ্ন হলো, আর কতটি প্রাণের বিনিময়ে বন্ধ হবে এই মৃত্যুর মিছিল? আর কত মায়ের কোল খালি করতে হবে? কত সন্তান বাবাহারা হবে?
সড়কের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। তাই সরকারের উচিত, শুধু আইন তৈরিতেই সীমাবদ্ধ না থেকে যত দ্রুত সম্ভব তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া এবং সাধারণ জনগণেরও উচিত, তাদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে আরও বেশি সচেতন হওয়া।
সড়ক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে। নিয়ম মানাতে বাধ্য করতে হবে। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে এ খাতকে সুশৃঙ্খল রাখা সম্ভব। যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স নিয়ে কোনো ধরনের শৈথিল্য কাম্য নয়। যানবাহনের ত্রুটি কিংবা চালকের অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে অকালে কোনো মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে না।
পঙ্গুত্বের মতো দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ জীবন কাটাতে পারে না। দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ বাহিনী গঠন করা যায়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ ধরনের বাহিনী গঠন করা হচ্ছে না কেন? জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইন না মানাই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক-শ্রমিক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের কাছ থেকে সমন্বিত, আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা সবাই আশা করে।
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে