ড. মইনুল ইসলাম
জিডিপি ও জিএনআই প্রবৃদ্ধিসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক সূচক গত তিন দশক ধরে সন্দেহাতীতভাবে জানান দিচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুন্নয়ন ও পরনির্ভরতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে। কিন্তু মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয় বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে। ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই আয়বৈষম্য ক্রমে বাড়তে থাকার প্রবণতাকে দেশের জন্য মহা বিপৎসংকেত বললে অত্যুক্তি হবে না। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আশির দশক থেকেই এ দেশে আয় ও সম্পদবৈষম্য ক্রমেই বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য নানা পরিমাপক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে লরেঞ্জ কার্ভ ও জিনি (বা গিনি) সহগ উল্লেখযোগ্য। কোনো অর্থনীতির জিনি সহগ যখন দ্রুত বাড়তে থাকে এবং শূন্য দশমিক ৫-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা তা অতিক্রম করে, তখন নীতিনির্ধারকদের বোঝার কথা যে আয়বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের খানা আয়-ব্যয় জরিপে জিনি সহগ নির্ধারিত হয়েছে শূন্য দশমিক ৪৮৩। ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে জিনি সহগ পৌঁছে গেছে শূন্য দশমিক ৪৯৯-এ।
এই ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর দখলে জিডিপির ক্রমবর্ধমান অংশ পুঞ্জীভূত হতে দেওয়ার বিপদ দেখা গিয়েছিল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর কৌশল কী ফল দিতে পারে, তা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার হেডলাইন সংবাদ ‘বিশ্বে ধনকুবেরের সংখ্যা প্রবৃদ্ধির হারের শীর্ষে বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে। ওই খবর থেকে জানা গিয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭—এই পাঁচ বছরে ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে ৩০ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ডলারের (৩৫০ কোটি টাকা) বেশি নিট সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদের ‘আলট্রা-হাই নেট-ওয়ার্থ’ (ইউএইচএনডব্লিউ) ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল।
সাধারণ জনগণের কাছে যেসব বিষয়ের বিপদগুলো হচ্ছে—১. দেশে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় ১১ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতাপিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২. দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩. দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরোপুরি বাজারীকরণ হয়েছে; ৪. ব্যাংকের ঋণ দেশের একটা ক্ষুদ্র অংশের কাছে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৫. দেশের জায়গা-জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট মানে রিয়েল এস্টেটের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে; ৬. বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মকভাবে বাড়ছে; ৭. ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিবাসী; ৮. দেশে বিলাসবহুল গাড়ির আমদানি দ্রুত বেড়েছে; ৯. বিদেশে বাড়ি-ঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০. ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশভ্রমণ বাড়ছে; ১১. উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২. উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩. প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক বেড়েছে; ১৫. দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও/এ লেভেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মচ্ছব চলছে; ১৬. প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে; এবং ১৭. দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সমস্যা মোকাবিলা করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন। কারণ আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টন খুবই কঠিন রাজনৈতিক নীতি-পরিবর্তন ছাড়া অর্জন করা যায় না। সমাজের শক্তিধর ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর কায়েমি স্বার্থে আয়-পুনর্বণ্টন নীতিমালাকে ভণ্ডুল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবেই। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, গণচীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইসরায়েল ও শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্র নানা রকম কার্যকর আয় পুনর্বণ্টন কার্যক্রম গ্রহণ ও সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জিনি সহগ বৃদ্ধিকে শ্লথ করতে বা থামিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বিশ্বে জিনি সহগ কমানোর ব্যাপারে কিউবা ছাড়া অন্য কোনো উন্নয়নশীল দেশকে তেমন একটা সাফল্য অর্জন করতে দেখা যাচ্ছে না। এই দেশগুলোর মধ্যে কিউবা, গণচীন ও ভিয়েতনাম এখনো নিজেদের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করে, বাকি দেশগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনুসারী হয়েও শক্তিশালী বৈষম্য নিরসন নীতিমালা গ্রহণ করে চলেছে। ওপরের বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে সফল ভূমি সংস্কার অথবা কৃষি সংস্কার নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়েছে। নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির মতো ইউরোপের কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় নীতি অনেক বেশি আয় পুনর্বণ্টনমূলক। ওসব দেশে যথার্থভাবে ব্যক্তির আয়কর ও সম্পত্তি করের মতো প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে জিডিপির ৩০-৩৫ শতাংশ সরকারি রাজস্ব হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত রাজস্ব থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা (প্রধানত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পেনশন, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন), পরিবেশ উন্নয়ন, নিম্নবিত্ত পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা, গণপরিবহন, বেকার ভাতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয়। এই রাষ্ট্রগুলোর প্রতিরক্ষা বাহিনী, সিভিল আমলাতন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জন্য সরকারি ব্যয় জিডিপির শতাংশ হিসেবে খুবই অনুল্লেখ্য। এই কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোতে এবং বৈষম্য-সচেতন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে বিষয়ে মিল দেখা যাচ্ছে সেগুলো হলো:
১) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা একই মানসম্পন্ন, সর্বজনীন, আধুনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার ব্যাপারে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
২) অত্যন্ত সফলভাবে জনগণের সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু রয়েছে।
৩) প্রবীণদের পেনশন-ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
৪) সর্বজনীন বেকার ভাতা চালু রয়েছে।
৫) এসব দেশে নিম্নবিত্ত জনগণের জন্য ভর্তুকি মূল্যে রেশন বা বিনা মূল্যে খাদ্য কর্মসূচি চালু রয়েছে।
৬) প্রবীণ জনগণের আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা উন্নত-উন্নয়নশীলনির্বিশেষে এসব দেশে চালু রয়েছে।
৭) এসব দেশে গণপরিবহনসুলভ ও ব্যয়সাশ্রয়ী এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
৮) এসব দেশে রাষ্ট্র ‘জিরো টলারেন্স অগ্রাধিকার’ দিয়ে দুর্নীতি দমনে কঠোর শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা চালু করেছে।
৯) এসব দেশ ‘মেগা-সিটি’ উন্নয়নকে সফলভাবে নিরুৎসাহিত করে চলেছে এবং গ্রাম-শহরের বৈষম্য নিরসন ও আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসনে খুবই মনোযোগী।
১০) দেশগুলোতে ‘ন্যূনতম মজুরির হার’ নির্ধারণ করে কঠোরভাবে প্রতিপালনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
১১) নিম্নবিত্তদের আবাসনকে এসব দেশে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
১২) এসব দেশে কৃষকেরা যাতে তাঁদের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্য দাম পান, তার জন্য কার্যকর সরকারি নীতি বাস্তবায়িত হয়।
১৩) ব্যক্তি খাতের বিক্রেতারা যেন জনগণকে মুনাফাবাজির শিকার করতে না পারে, সে জন্য এসব দেশে রাষ্ট্র কঠোর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে।
এ ক্ষেত্রে ভারতের কেরালা মডেল বাংলাদেশের জন্য অনুসরণীয় মডেল হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। সত্তরের দশক থেকেই কেরালা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে উন্নয়নের ‘কেরালা মডেলের’ জন্য। ২০১০ সালে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আবার রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখনো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে ডুবে রয়েছে সরকার। অনেকেই এখন বর্তমান সরকারকে প্রধানমন্ত্রী ও জনাকয়েক ধনকুবের ব্যবসায়ীর ‘অলিগার্কি’ বলে অভিহিত করছেন। একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য এই রাষ্ট্রচরিত্রই দায়ী। অথচ সমাজতন্ত্রকে ‘বাত কা বাত’ বানিয়ে না রেখে ওপরে উল্লিখিত নীতিমালা এবং বিশেষত কেরালাকে অনুসরণ করলে বাংলাদেশ ক্রমেই আয়বৈষম্য নিরসনের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
জিডিপি ও জিএনআই প্রবৃদ্ধিসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক সূচক গত তিন দশক ধরে সন্দেহাতীতভাবে জানান দিচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুন্নয়ন ও পরনির্ভরতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে। কিন্তু মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যদি দেশে আয় বণ্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে। ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই আয়বৈষম্য ক্রমে বাড়তে থাকার প্রবণতাকে দেশের জন্য মহা বিপৎসংকেত বললে অত্যুক্তি হবে না। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আশির দশক থেকেই এ দেশে আয় ও সম্পদবৈষম্য ক্রমেই বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য নানা পরিমাপক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে লরেঞ্জ কার্ভ ও জিনি (বা গিনি) সহগ উল্লেখযোগ্য। কোনো অর্থনীতির জিনি সহগ যখন দ্রুত বাড়তে থাকে এবং শূন্য দশমিক ৫-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা তা অতিক্রম করে, তখন নীতিনির্ধারকদের বোঝার কথা যে আয়বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের খানা আয়-ব্যয় জরিপে জিনি সহগ নির্ধারিত হয়েছে শূন্য দশমিক ৪৮৩। ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে জিনি সহগ পৌঁছে গেছে শূন্য দশমিক ৪৯৯-এ।
এই ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর দখলে জিডিপির ক্রমবর্ধমান অংশ পুঞ্জীভূত হতে দেওয়ার বিপদ দেখা গিয়েছিল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর কৌশল কী ফল দিতে পারে, তা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার হেডলাইন সংবাদ ‘বিশ্বে ধনকুবেরের সংখ্যা প্রবৃদ্ধির হারের শীর্ষে বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে। ওই খবর থেকে জানা গিয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭—এই পাঁচ বছরে ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে ৩০ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ডলারের (৩৫০ কোটি টাকা) বেশি নিট সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদের ‘আলট্রা-হাই নেট-ওয়ার্থ’ (ইউএইচএনডব্লিউ) ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল।
সাধারণ জনগণের কাছে যেসব বিষয়ের বিপদগুলো হচ্ছে—১. দেশে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় ১১ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতাপিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২. দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩. দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরোপুরি বাজারীকরণ হয়েছে; ৪. ব্যাংকের ঋণ দেশের একটা ক্ষুদ্র অংশের কাছে কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৫. দেশের জায়গা-জমি, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট মানে রিয়েল এস্টেটের দাম প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে; ৬. বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মকভাবে বাড়ছে; ৭. ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা ২ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিবাসী; ৮. দেশে বিলাসবহুল গাড়ির আমদানি দ্রুত বেড়েছে; ৯. বিদেশে বাড়ি-ঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০. ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশভ্রমণ বাড়ছে; ১১. উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২. উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘন ঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩. প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক বেড়েছে; ১৫. দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও/এ লেভেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মচ্ছব চলছে; ১৬. প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে; এবং ১৭. দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সমস্যা মোকাবিলা করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের সদিচ্ছা এ ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন। কারণ আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টন খুবই কঠিন রাজনৈতিক নীতি-পরিবর্তন ছাড়া অর্জন করা যায় না। সমাজের শক্তিধর ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর কায়েমি স্বার্থে আয়-পুনর্বণ্টন নীতিমালাকে ভণ্ডুল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবেই। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, গণচীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইসরায়েল ও শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্র নানা রকম কার্যকর আয় পুনর্বণ্টন কার্যক্রম গ্রহণ ও সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জিনি সহগ বৃদ্ধিকে শ্লথ করতে বা থামিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বিশ্বে জিনি সহগ কমানোর ব্যাপারে কিউবা ছাড়া অন্য কোনো উন্নয়নশীল দেশকে তেমন একটা সাফল্য অর্জন করতে দেখা যাচ্ছে না। এই দেশগুলোর মধ্যে কিউবা, গণচীন ও ভিয়েতনাম এখনো নিজেদের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করে, বাকি দেশগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনুসারী হয়েও শক্তিশালী বৈষম্য নিরসন নীতিমালা গ্রহণ করে চলেছে। ওপরের বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে সফল ভূমি সংস্কার অথবা কৃষি সংস্কার নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়েছে। নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির মতো ইউরোপের কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় নীতি অনেক বেশি আয় পুনর্বণ্টনমূলক। ওসব দেশে যথার্থভাবে ব্যক্তির আয়কর ও সম্পত্তি করের মতো প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে জিডিপির ৩০-৩৫ শতাংশ সরকারি রাজস্ব হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত রাজস্ব থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা (প্রধানত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পেনশন, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন), পরিবেশ উন্নয়ন, নিম্নবিত্ত পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা, গণপরিবহন, বেকার ভাতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয়। এই রাষ্ট্রগুলোর প্রতিরক্ষা বাহিনী, সিভিল আমলাতন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জন্য সরকারি ব্যয় জিডিপির শতাংশ হিসেবে খুবই অনুল্লেখ্য। এই কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোতে এবং বৈষম্য-সচেতন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে বিষয়ে মিল দেখা যাচ্ছে সেগুলো হলো:
১) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা একই মানসম্পন্ন, সর্বজনীন, আধুনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার ব্যাপারে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
২) অত্যন্ত সফলভাবে জনগণের সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু রয়েছে।
৩) প্রবীণদের পেনশন-ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
৪) সর্বজনীন বেকার ভাতা চালু রয়েছে।
৫) এসব দেশে নিম্নবিত্ত জনগণের জন্য ভর্তুকি মূল্যে রেশন বা বিনা মূল্যে খাদ্য কর্মসূচি চালু রয়েছে।
৬) প্রবীণ জনগণের আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা উন্নত-উন্নয়নশীলনির্বিশেষে এসব দেশে চালু রয়েছে।
৭) এসব দেশে গণপরিবহনসুলভ ও ব্যয়সাশ্রয়ী এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
৮) এসব দেশে রাষ্ট্র ‘জিরো টলারেন্স অগ্রাধিকার’ দিয়ে দুর্নীতি দমনে কঠোর শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা চালু করেছে।
৯) এসব দেশ ‘মেগা-সিটি’ উন্নয়নকে সফলভাবে নিরুৎসাহিত করে চলেছে এবং গ্রাম-শহরের বৈষম্য নিরসন ও আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসনে খুবই মনোযোগী।
১০) দেশগুলোতে ‘ন্যূনতম মজুরির হার’ নির্ধারণ করে কঠোরভাবে প্রতিপালনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
১১) নিম্নবিত্তদের আবাসনকে এসব দেশে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
১২) এসব দেশে কৃষকেরা যাতে তাঁদের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্য দাম পান, তার জন্য কার্যকর সরকারি নীতি বাস্তবায়িত হয়।
১৩) ব্যক্তি খাতের বিক্রেতারা যেন জনগণকে মুনাফাবাজির শিকার করতে না পারে, সে জন্য এসব দেশে রাষ্ট্র কঠোর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে।
এ ক্ষেত্রে ভারতের কেরালা মডেল বাংলাদেশের জন্য অনুসরণীয় মডেল হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। সত্তরের দশক থেকেই কেরালা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে উন্নয়নের ‘কেরালা মডেলের’ জন্য। ২০১০ সালে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র আবার রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখনো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ অহিফেনের মৌতাতে ডুবে রয়েছে সরকার। অনেকেই এখন বর্তমান সরকারকে প্রধানমন্ত্রী ও জনাকয়েক ধনকুবের ব্যবসায়ীর ‘অলিগার্কি’ বলে অভিহিত করছেন। একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য এই রাষ্ট্রচরিত্রই দায়ী। অথচ সমাজতন্ত্রকে ‘বাত কা বাত’ বানিয়ে না রেখে ওপরে উল্লিখিত নীতিমালা এবং বিশেষত কেরালাকে অনুসরণ করলে বাংলাদেশ ক্রমেই আয়বৈষম্য নিরসনের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে