ফরিদ তামাল্লাহ
আবলা লাফি, ৫৯ বছর বয়স। অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লাহর উত্তরে তুরমুস আইয়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি যখন তাঁর জলপাইবাগানের কথা বলছিলেন, তখন তাঁর কণ্ঠে এক অনির্বচনীয় আবেগ ঝরে পড়ছিল। এই জলপাই চাষে গ্রামবাসীদের বাধা দিচ্ছে ইসরায়েলি সেনা ও অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা।
‘এটা আমাদের জমি’, বলতে বলতে চোখে আগুন ঠিকরে বেরোয় আবলা লাফির। ‘কী সাহস তাঁদের! আমাদের জমিতে ঢুকতে ও জলপাই পাড়তে বাধা দেয়, যেন আমরা চুরি করতে ঢুকেছি। আমরা নিজ হাতে এসব গাছ লাগিয়েছি। চোর তো দখলদারেরা, আমরা এই জমির মালিক!’
অক্টোবর ও নভেম্বর হলো ফিলিস্তিনি কৃষকদের জলপাই আবাদের প্রধান মৌসুম। ফিলিস্তিনের হাজার হাজার পরিবারের জীবন ও জীবিকা এই জলাপাইর ওপর নির্ভরশীল। অধিকৃত পশ্চিম তীরের প্রায় ৪৫ শতাংশ কৃষিজমিতে জলপাই চাষ হয়। সেখানে প্রায় ১ কোটি জলপাইগাছ রয়েছে, যা থেকে প্রতিবছর ৩২ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন তেল উৎপাদিত হয়।
গাজায় যুদ্ধের কারণে এ বছর ইসরায়েলি সেনা ও অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনি কৃষকদের তাঁদের জলপাইবাগানে যেতে বাধা দিচ্ছে। গত মাসে দখলদার রাষ্ট্রের চরম ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জলপাই আবাদ নিষিদ্ধ করার জন্য ইসরায়েলি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। স্মোট্রিচের মতে, ইসরায়েলের বসতি স্থাপনকারীদের জন্য নিশ্চিত নিরাপদ এলাকা তৈরি করতে হবে, যার আশপাশে ফিলিস্তিনিদের নামগন্ধ পর্যন্ত থাকবে না। সেখানে শুধুই দখলদারেরা থাকবে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের নিজেদের ভূমিতে যেতে বাধা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী এই নীতি বাস্তবায়ন করছে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনীর চলাচল এবং প্রবেশের ওপর কড়া বিধিনিষেধ ফিলিস্তিনিদের জলপাইবাগানে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে; বিশেষ করে বসতিগুলোর কাছাকাছি জমিতে। ‘এ বছরের নভেম্বরের শেষে, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা এবং প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার কারণে ৮ লাখ বর্গমিটার জমিতে জলপাইয়ের চাষ হয়নি।’
ফিলিস্তিনিদের জন্য জলপাই শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি তাদের ঐতিহ্য, অদম্য প্রতিরোধ এবং জমির সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কের প্রতীক। জলপাইগাছ তাদের আত্মা ও পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করে।
আবলা লাফি বলেন, ‘একসময় আমরা পুরো পরিবার, নারী-পুরুষ, বাচ্চা-বুড়ো সবাই মিলে জমিতে কাজ করতে যেতাম। আনন্দে কেটে যেত সময়। কারণ চাষাবাদ করা মানে ভূমির সঙ্গে একাত্ম হওয়া।’ তিনি বলেন, ‘জলপাই মৌসুম আমাদের জন্য ঈদের মতো; আমরা আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের সঙ্গে এ সময়টা উপভোগ করি, এমনকি এ সময় খাবারের স্বাদও আলাদা হয়।’
‘কিন্তু ফিলিস্তিনি জমিতে অবৈধ ইহুদি বসতি গড়ে ওঠার পর থেকে আমাদের জলপাই মৌসুম কাটে ভয়, উদ্বেগ আর আতঙ্কে। বসতি স্থাপনকারী ও সেনাবাহিনীর ভয়ে আমরা ভীত। গাজায় যুদ্ধের কারণে এ বছর সেই উদ্বেগ আর দুঃখ আরও বেড়ে গেছে।’
তুরমুস আইয়া গ্রামের কৃষি কমিটির প্রধান নিদাল রাবি নিশ্চিত করেছেন, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ও তাদের রক্ষীরা নিজেদের বসতির কাছের জলপাইবাগানগুলোতে ফিলিস্তিনিদের যেতে বাধা দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের জমি থেকে আমাদেরই তাড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা আমাদের জমিতে ঢোকার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা বন্দুকের মুখে আমাদের বের করে দিয়েছে।’
৬১ বছর বয়সী এই ফিলিস্তিনি কৃষক (যাঁর মার্কিন নাগরিকত্ব রয়েছে) আরও বলেন, ‘আমরা এখন ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে চলে এসেছি। জলপাই বাছাই করার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। জলপাই তোলার চেষ্টাকারী প্রত্যেক কৃষককে গুলি করা হয়েছে। যদি আমরা আরও অপেক্ষা করি, জলপাই নষ্ট হয়ে যাবে এবং এ থেকে যে তেল তৈরি হবে তা খাওয়া যাবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে ৩০টি জমির মালিক। কিন্তু এখনো একটি জমি থেকেও ফসল তুলতে পারিনি।’
কয়েক দিন আগে তুরমুস আইয়ায় হামলা চালিয়ে গ্রামবাসীদের ৫০টি গাড়ি বাজেয়াপ্ত করে সেনাবাহিনী। কারণ সেগুলো কৃষিকাজে ব্যবহৃত হতো। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার বর্গমিটার জমির ফসল কাটার অনুমতি দেওয়া হয়নি। রাবি বলেন, ‘এসব জমিতে উৎপাদিত জলপাই থেকে প্রায় ৭০ হাজার লিটার অলিভ অয়েল উৎপাদন করতে পারতাম।’
মিশাল আল-কুক (৪৩) নামে আরেক কৃষক বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন এবং জমির দেখাশোনা ও চাষাবাদ করতে দুই বছর আগে ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন। ‘এ বছর আমরা গ্রামের পূর্বের সমতল অঞ্চলে গম চাষে একটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। কারণ দখলদার বাহিনী সেখানে কাজ করতে নিষেধ করেছে। কিন্তু এখন বীজ রোপণের মৌসুম। আমাদের দ্রুত রোপণ করতে হবে।’ তিনি জানান, গম খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং গ্রামবাসীর জন্য এটি একটি প্রধান ফসল। তিনি গম ও বার্লির বীজ কিনেছিলেন। কিন্তু সেগুলো রোপণ করতে পারবেন কি না, তা জানেন না।
ইসরায়েলিদের হাতে জলপাই বাগান ধ্বংস হচ্ছে—এটা এমন একটি সত্যের মুখোশ উন্মোচন করে, যা পশ্চিমের অনেকেই জানে না। এটা প্রায়ই শোনা যায় যে ইসরায়েলিরা দ্বৈত মার্কিন নাগরিকত্ব ধারণ করে। কিন্তু আমরা ফিলিস্তিনি আমেরিকানদের সম্পর্কে তেমন কিছু শুনি না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, অধিকৃত পশ্চিম তীরে আনুমানিক ৪৫ থেকে ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি আমেরিকান বসবাস করেন।
যা-ই হোক, এই সংখ্যা ইসরায়েলকে থামাতে পারেনি। বর্ণবাদী রাষ্ট্রটি সাধারণ ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যেমন আচরণ করে, আমেরিকান ফিলিস্তিনিদের সঙ্গেও একই আচরণ করে। মার্কিন নাগরিক বলে বিশেষ কোনো সুবিধা তাঁরা পান না। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিস্তিনি আমেরিকানদের পশ্চিম তীর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে বাধা দেয় ইসরায়েল, এটি একটি সাম্প্রতিক চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন, যে চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের নাগরিকেরা ভিসা ছাড়াই অন্য দেশ ভ্রমণ করতে পারেন।
রাবির মতে, তুরমুস আইয়া গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দার ফিলিস্তিন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, কিন্তু মার্কিন সরকার তাদের কোনো সুরক্ষা দেয় না। মার্কিন নাগরিকত্ব রয়েছে এমন কিছু গ্রামবাসী মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন এবং নিজস্ব জমিতে কাজ করার জন্য সুরক্ষা চেয়েছিলেন। তবে দূতাবাস বলেছে, তারা কেবল তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ সুরক্ষিত করতে সহায়তা করতে পারে।
যদিও বাইডেন প্রশাসন সহিংস বসতি স্থাপনকারীদের ভিসা না দেওয়ার নীতি ঘোষণা করেছে। কিন্তু রাবির মতে, ‘এটা নিছক প্রচার। বাইডেনের প্রকৃত অবস্থান তখনই স্পষ্ট হয়,যখন তিনি বলেছিলেন যে যদি ইসরায়েল না থাকে, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে এটি তৈরি করতে হবে। এটি ইসরায়েলের সঙ্গে ওয়াশিংটনের যোগসাজশকেই বোঝায়।’
আবলা লাফি বিশ্বাস করেন যে ইসরায়েলি ‘হয়রানির’ লক্ষ্য হলো চুরি করা জমিতে প্রতিষ্ঠিত অবৈধ বসতিগুলোর কাছাকাছি ফিলিস্তিনি জমি দখল করা যেখানে শত শত বছর ধরে চাষ করা জলপাইগাছ রয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘তাঁদের এর ওপর কোনো অধিকার বা মালিকানা নেই।’
লাফি বলেন, ‘প্রথম ইহুদি বসতি স্থাপনের পর থেকে প্রতিবছর আমরা একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। আমার মনে আছে, ১৯৭৮ সালে যখন আমার বয়স ছিল ১৪ বছর। কারিউত ও তুরমুস আইয়ায় দখল করা জমিতে রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল, তারপরে তারা ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।’
রাবি জানান, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সর্বশেষ যুদ্ধের আগেও বসতি স্থাপনকারীরা ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জমি বাজেয়াপ্ত, তাঁর এবং অন্যান্য গ্রামে জলপাইগাছ কাটা, পুড়িয়ে ফেলাসহ নানা অত্যাচার ক্রমাগত চালিয়েছে। বসতি স্থাপনকারীরা সবচেয়ে ভয়ংকর আক্রমণটি করেছিল এ বছরের ২১ জুন। ওই দিন শত শত বসতি স্থাপনকারী ফিলিস্তিনি গ্রামে হামলা চালায়। তারা ওমর কুতাইন নামের একজনকে হত্যা করে, কয়েক ডজন বাড়ি এবং গাড়ি, শত শত জলপাইগাছ এবং গমের খেত পুড়িয়ে দেয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এসব ধ্বংসযজ্ঞ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল, কিন্তু কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।
রাবি বলেন, ‘এসব হামলা কৃষকদের জমিতে কাজ চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি, পারবেও না। যদি আমরা চাষ করা বন্ধ করি, তাহলে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জমিটি কোনো মানুষের জমি নয় বলে এটি বাজেয়াপ্ত করে বসতি স্থাপনকারীদের দিয়ে দেবে। তারা আগেও এটা করেছে।’
১৯৭৯ থেকে ইসরায়েল ১৮৫৮ সালের অটোমান ভূমি আইনের উদাহরণ টেনে তা কাজে লাগায়। ওই আইনে বলা হয়েছে, কোনো বেসরকারি মালিকাধীন জমি চাষ না করে তিন বছর ফেলে রাখা হলে তা সরকারি খাসজমিতে পরিণত হবে।
আবলা লাফি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ইসরায়েলি এই আক্রমণ ফিলিস্তিনি কৃষকদের তাঁদের জমি চাষ করা থেকে বিরত রাখতে পারবে না। এসব জমি কৃষকদের ঘামে এবং শহীদদের রক্তে সিক্ত। এটি রক্ষা করতে গিয়ে জোদা আওয়াদ ১৯৮৮ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন এবং ১৯৯৩ সালে খামিস আবু আওয়াদ লাঙল চালাতে গিয়ে একজন বসতি স্থাপনকারীর হাতে নিহত হন। ফিলিস্তিনের মন্ত্রী জিয়াদ আবু আইনও ভূমি রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। এই গ্রীষ্মে ওমর আল-কুতাইন শহীদ হয়েছেন। আমরা সেই জমি ছেড়ে দিতে পারি না, যা রক্ষা করতে অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। আমরা এসব জমি আমাদের সন্তানদের কাছে পৌঁছে দেব।’
ফরিদ তামাল্লাহ, ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও লেখক
(মিডলইস্ট মনিটরে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
আবলা লাফি, ৫৯ বছর বয়স। অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লাহর উত্তরে তুরমুস আইয়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি যখন তাঁর জলপাইবাগানের কথা বলছিলেন, তখন তাঁর কণ্ঠে এক অনির্বচনীয় আবেগ ঝরে পড়ছিল। এই জলপাই চাষে গ্রামবাসীদের বাধা দিচ্ছে ইসরায়েলি সেনা ও অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা।
‘এটা আমাদের জমি’, বলতে বলতে চোখে আগুন ঠিকরে বেরোয় আবলা লাফির। ‘কী সাহস তাঁদের! আমাদের জমিতে ঢুকতে ও জলপাই পাড়তে বাধা দেয়, যেন আমরা চুরি করতে ঢুকেছি। আমরা নিজ হাতে এসব গাছ লাগিয়েছি। চোর তো দখলদারেরা, আমরা এই জমির মালিক!’
অক্টোবর ও নভেম্বর হলো ফিলিস্তিনি কৃষকদের জলপাই আবাদের প্রধান মৌসুম। ফিলিস্তিনের হাজার হাজার পরিবারের জীবন ও জীবিকা এই জলাপাইর ওপর নির্ভরশীল। অধিকৃত পশ্চিম তীরের প্রায় ৪৫ শতাংশ কৃষিজমিতে জলপাই চাষ হয়। সেখানে প্রায় ১ কোটি জলপাইগাছ রয়েছে, যা থেকে প্রতিবছর ৩২ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন তেল উৎপাদিত হয়।
গাজায় যুদ্ধের কারণে এ বছর ইসরায়েলি সেনা ও অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনি কৃষকদের তাঁদের জলপাইবাগানে যেতে বাধা দিচ্ছে। গত মাসে দখলদার রাষ্ট্রের চরম ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জলপাই আবাদ নিষিদ্ধ করার জন্য ইসরায়েলি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। স্মোট্রিচের মতে, ইসরায়েলের বসতি স্থাপনকারীদের জন্য নিশ্চিত নিরাপদ এলাকা তৈরি করতে হবে, যার আশপাশে ফিলিস্তিনিদের নামগন্ধ পর্যন্ত থাকবে না। সেখানে শুধুই দখলদারেরা থাকবে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের নিজেদের ভূমিতে যেতে বাধা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী এই নীতি বাস্তবায়ন করছে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনীর চলাচল এবং প্রবেশের ওপর কড়া বিধিনিষেধ ফিলিস্তিনিদের জলপাইবাগানে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে; বিশেষ করে বসতিগুলোর কাছাকাছি জমিতে। ‘এ বছরের নভেম্বরের শেষে, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা এবং প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার কারণে ৮ লাখ বর্গমিটার জমিতে জলপাইয়ের চাষ হয়নি।’
ফিলিস্তিনিদের জন্য জলপাই শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি তাদের ঐতিহ্য, অদম্য প্রতিরোধ এবং জমির সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কের প্রতীক। জলপাইগাছ তাদের আত্মা ও পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করে।
আবলা লাফি বলেন, ‘একসময় আমরা পুরো পরিবার, নারী-পুরুষ, বাচ্চা-বুড়ো সবাই মিলে জমিতে কাজ করতে যেতাম। আনন্দে কেটে যেত সময়। কারণ চাষাবাদ করা মানে ভূমির সঙ্গে একাত্ম হওয়া।’ তিনি বলেন, ‘জলপাই মৌসুম আমাদের জন্য ঈদের মতো; আমরা আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের সঙ্গে এ সময়টা উপভোগ করি, এমনকি এ সময় খাবারের স্বাদও আলাদা হয়।’
‘কিন্তু ফিলিস্তিনি জমিতে অবৈধ ইহুদি বসতি গড়ে ওঠার পর থেকে আমাদের জলপাই মৌসুম কাটে ভয়, উদ্বেগ আর আতঙ্কে। বসতি স্থাপনকারী ও সেনাবাহিনীর ভয়ে আমরা ভীত। গাজায় যুদ্ধের কারণে এ বছর সেই উদ্বেগ আর দুঃখ আরও বেড়ে গেছে।’
তুরমুস আইয়া গ্রামের কৃষি কমিটির প্রধান নিদাল রাবি নিশ্চিত করেছেন, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ও তাদের রক্ষীরা নিজেদের বসতির কাছের জলপাইবাগানগুলোতে ফিলিস্তিনিদের যেতে বাধা দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের জমি থেকে আমাদেরই তাড়িয়ে দিচ্ছে। আমরা আমাদের জমিতে ঢোকার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা বন্দুকের মুখে আমাদের বের করে দিয়েছে।’
৬১ বছর বয়সী এই ফিলিস্তিনি কৃষক (যাঁর মার্কিন নাগরিকত্ব রয়েছে) আরও বলেন, ‘আমরা এখন ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে চলে এসেছি। জলপাই বাছাই করার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। জলপাই তোলার চেষ্টাকারী প্রত্যেক কৃষককে গুলি করা হয়েছে। যদি আমরা আরও অপেক্ষা করি, জলপাই নষ্ট হয়ে যাবে এবং এ থেকে যে তেল তৈরি হবে তা খাওয়া যাবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে ৩০টি জমির মালিক। কিন্তু এখনো একটি জমি থেকেও ফসল তুলতে পারিনি।’
কয়েক দিন আগে তুরমুস আইয়ায় হামলা চালিয়ে গ্রামবাসীদের ৫০টি গাড়ি বাজেয়াপ্ত করে সেনাবাহিনী। কারণ সেগুলো কৃষিকাজে ব্যবহৃত হতো। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার বর্গমিটার জমির ফসল কাটার অনুমতি দেওয়া হয়নি। রাবি বলেন, ‘এসব জমিতে উৎপাদিত জলপাই থেকে প্রায় ৭০ হাজার লিটার অলিভ অয়েল উৎপাদন করতে পারতাম।’
মিশাল আল-কুক (৪৩) নামে আরেক কৃষক বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন এবং জমির দেখাশোনা ও চাষাবাদ করতে দুই বছর আগে ফিলিস্তিনে ফিরে আসেন। ‘এ বছর আমরা গ্রামের পূর্বের সমতল অঞ্চলে গম চাষে একটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। কারণ দখলদার বাহিনী সেখানে কাজ করতে নিষেধ করেছে। কিন্তু এখন বীজ রোপণের মৌসুম। আমাদের দ্রুত রোপণ করতে হবে।’ তিনি জানান, গম খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং গ্রামবাসীর জন্য এটি একটি প্রধান ফসল। তিনি গম ও বার্লির বীজ কিনেছিলেন। কিন্তু সেগুলো রোপণ করতে পারবেন কি না, তা জানেন না।
ইসরায়েলিদের হাতে জলপাই বাগান ধ্বংস হচ্ছে—এটা এমন একটি সত্যের মুখোশ উন্মোচন করে, যা পশ্চিমের অনেকেই জানে না। এটা প্রায়ই শোনা যায় যে ইসরায়েলিরা দ্বৈত মার্কিন নাগরিকত্ব ধারণ করে। কিন্তু আমরা ফিলিস্তিনি আমেরিকানদের সম্পর্কে তেমন কিছু শুনি না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, অধিকৃত পশ্চিম তীরে আনুমানিক ৪৫ থেকে ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি আমেরিকান বসবাস করেন।
যা-ই হোক, এই সংখ্যা ইসরায়েলকে থামাতে পারেনি। বর্ণবাদী রাষ্ট্রটি সাধারণ ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যেমন আচরণ করে, আমেরিকান ফিলিস্তিনিদের সঙ্গেও একই আচরণ করে। মার্কিন নাগরিক বলে বিশেষ কোনো সুবিধা তাঁরা পান না। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিস্তিনি আমেরিকানদের পশ্চিম তীর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে বাধা দেয় ইসরায়েল, এটি একটি সাম্প্রতিক চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন, যে চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের নাগরিকেরা ভিসা ছাড়াই অন্য দেশ ভ্রমণ করতে পারেন।
রাবির মতে, তুরমুস আইয়া গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দার ফিলিস্তিন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, কিন্তু মার্কিন সরকার তাদের কোনো সুরক্ষা দেয় না। মার্কিন নাগরিকত্ব রয়েছে এমন কিছু গ্রামবাসী মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন এবং নিজস্ব জমিতে কাজ করার জন্য সুরক্ষা চেয়েছিলেন। তবে দূতাবাস বলেছে, তারা কেবল তাদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ সুরক্ষিত করতে সহায়তা করতে পারে।
যদিও বাইডেন প্রশাসন সহিংস বসতি স্থাপনকারীদের ভিসা না দেওয়ার নীতি ঘোষণা করেছে। কিন্তু রাবির মতে, ‘এটা নিছক প্রচার। বাইডেনের প্রকৃত অবস্থান তখনই স্পষ্ট হয়,যখন তিনি বলেছিলেন যে যদি ইসরায়েল না থাকে, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে এটি তৈরি করতে হবে। এটি ইসরায়েলের সঙ্গে ওয়াশিংটনের যোগসাজশকেই বোঝায়।’
আবলা লাফি বিশ্বাস করেন যে ইসরায়েলি ‘হয়রানির’ লক্ষ্য হলো চুরি করা জমিতে প্রতিষ্ঠিত অবৈধ বসতিগুলোর কাছাকাছি ফিলিস্তিনি জমি দখল করা যেখানে শত শত বছর ধরে চাষ করা জলপাইগাছ রয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘তাঁদের এর ওপর কোনো অধিকার বা মালিকানা নেই।’
লাফি বলেন, ‘প্রথম ইহুদি বসতি স্থাপনের পর থেকে প্রতিবছর আমরা একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। আমার মনে আছে, ১৯৭৮ সালে যখন আমার বয়স ছিল ১৪ বছর। কারিউত ও তুরমুস আইয়ায় দখল করা জমিতে রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল, তারপরে তারা ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।’
রাবি জানান, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সর্বশেষ যুদ্ধের আগেও বসতি স্থাপনকারীরা ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জমি বাজেয়াপ্ত, তাঁর এবং অন্যান্য গ্রামে জলপাইগাছ কাটা, পুড়িয়ে ফেলাসহ নানা অত্যাচার ক্রমাগত চালিয়েছে। বসতি স্থাপনকারীরা সবচেয়ে ভয়ংকর আক্রমণটি করেছিল এ বছরের ২১ জুন। ওই দিন শত শত বসতি স্থাপনকারী ফিলিস্তিনি গ্রামে হামলা চালায়। তারা ওমর কুতাইন নামের একজনকে হত্যা করে, কয়েক ডজন বাড়ি এবং গাড়ি, শত শত জলপাইগাছ এবং গমের খেত পুড়িয়ে দেয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এসব ধ্বংসযজ্ঞ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল, কিন্তু কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।
রাবি বলেন, ‘এসব হামলা কৃষকদের জমিতে কাজ চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি, পারবেও না। যদি আমরা চাষ করা বন্ধ করি, তাহলে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জমিটি কোনো মানুষের জমি নয় বলে এটি বাজেয়াপ্ত করে বসতি স্থাপনকারীদের দিয়ে দেবে। তারা আগেও এটা করেছে।’
১৯৭৯ থেকে ইসরায়েল ১৮৫৮ সালের অটোমান ভূমি আইনের উদাহরণ টেনে তা কাজে লাগায়। ওই আইনে বলা হয়েছে, কোনো বেসরকারি মালিকাধীন জমি চাষ না করে তিন বছর ফেলে রাখা হলে তা সরকারি খাসজমিতে পরিণত হবে।
আবলা লাফি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ইসরায়েলি এই আক্রমণ ফিলিস্তিনি কৃষকদের তাঁদের জমি চাষ করা থেকে বিরত রাখতে পারবে না। এসব জমি কৃষকদের ঘামে এবং শহীদদের রক্তে সিক্ত। এটি রক্ষা করতে গিয়ে জোদা আওয়াদ ১৯৮৮ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন এবং ১৯৯৩ সালে খামিস আবু আওয়াদ লাঙল চালাতে গিয়ে একজন বসতি স্থাপনকারীর হাতে নিহত হন। ফিলিস্তিনের মন্ত্রী জিয়াদ আবু আইনও ভূমি রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। এই গ্রীষ্মে ওমর আল-কুতাইন শহীদ হয়েছেন। আমরা সেই জমি ছেড়ে দিতে পারি না, যা রক্ষা করতে অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। আমরা এসব জমি আমাদের সন্তানদের কাছে পৌঁছে দেব।’
ফরিদ তামাল্লাহ, ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও লেখক
(মিডলইস্ট মনিটরে প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনূদিত)
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৬ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে