মানবর্দ্ধন পাল
তখন কৈশোরকাল। সদ্য এসএসসি পাস করে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছি ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে। ১৯৭৩ সাল। এ বছরই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু জনসভা করতে ময়মনসিংহের সার্কিট হাউস ময়দানে এসেছিলেন। লক্ষাধিক মানুষ ঠাঁই নেওয়ার মতো বিরাট মাঠ। উত্তরে ব্রহ্মপুত্র, দক্ষিণে মুমিনুন্নেসা কলেজ, পশ্চিমে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা এবং পুবে প্রশস্ত রাস্তা। কলকাতার গড়ের মাঠ দেখিনি, তবে ময়মনসিংহবাসীর জন্য সার্কিট হাউস গড়ের মাঠতুল্যই। বঙ্গবন্ধু তখন হ্যামিলনের বংশীবাদকের চেয়েও মহান জাদুকর—লিলিপুটের দেশে গ্যালিভারের মতো হিমালয়সদৃশ পুরুষ! তখন তিনি শেখ মুজিব নন, মুজিব ভাই নন—বাঙালির নয়নমণি বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালির কাছে তাঁর প্রায় ঐশ্বরিক খ্যাতি ও দৈবিক জনপ্রিয়তা এমনই তুঙ্গে যে তাঁকে একনজর দেখে পুণ্যলাভ করতে মানুষ প্রাণপাতেও যেন প্রস্তুত।
ময়মনসিংহে তিনি আসবেন শুনে আমরা ঈদের গরু চালানের ট্রাকের মতো বোঝাই হয়ে ভাঙাচোরা পায়জামামার্কা রাস্তায় দুলতে দুলতে, ঝাঁকুনি খেতে খেতে ময়মনসিংহে যখন পৌঁছাই, তখন দুপুর গড়িয়েছে। ইতিমধ্যে মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে লোকারণ্য ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়, ব্রহ্মপুত্রের তীরে—অতিকায় বৃক্ষরাজি ও আশপাশের বিল্ডিংয়ে। গাছগুলোও কিশোর দর্শকে পরিপূর্ণ। মনে হচ্ছে, ডালগুলো যেন অপক্ব মনুষ্য-ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে। ছাদেও তিল ধারণের ঠাঁই নেই—নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, আবালবৃদ্ধবনিতা। তাই দুর্বল স্বাস্থ্যের আমি ট্রাক থেকে নামার সাহস আর পেলাম না! তাঁকে নামামাত্র আবছায়া দেখে বাকিটুকু ভালোবাসা দিয়ে কল্পনা করে নিলাম। বঙ্গবন্ধুর মুখের আদল, কালো ফ্রেমের চশমা, তাঁর দেবদূততুল্য সফেদ পাঞ্জাবি, কালো কোট এবং আপাদমস্তক চেহারা। এই ছিল বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে আমার প্রথম ও শেষ চাক্ষুষ বঙ্গবন্ধু-দর্শন।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের চরম শোকাবহ হত্যাযজ্ঞ আমার সদ্য তরুণ মনকে এমনই কাতর ও শোকাবিষ্ট করে রেখেছিল যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আমি তন্ময় হয়েছিলাম—এই বিভোরতা কাটেনি আজও। সেই প্রেম থেকে পুরোনো পত্রপত্রিকা বা ম্যাগাজিনে যেখানেই বঙ্গবন্ধুর ছবি পাই, তা সংগ্রহ করি এবং সযত্নে তা ক্যাপশনসহ বিজ্ঞানের ব্যবহারিক খাতায় লাগিয়ে রাখি। আগে আমার শখ ছিল বিদ্বজ্জন ও কৃতী ব্যক্তিত্বের অটোগ্রাফ এবং দেশি-বিদেশি ডাকটিকিট সংগ্রহ করা। সেই শখ একমুখী হয় বঙ্গবন্ধুর ছবি সংগ্রহে। যেখানে যা পাই বুভুক্ষুর মতো সংগ্রহ করি—কখনো বলে, কখনো না জানিয়ে।
প্রগতি প্রকাশন তখন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল মলাটের বই ও পত্রপত্রিকার খনি। বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি নামে একটি সংগঠনের শাখা তখন প্রায় সব জেলা ও অনেক থানা পর্যায়েও ছিল। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানায়ও এই সমিতি ছিল। আমার বাবা মদনমোহন পাল ছিলেন এর সভাপতি। সেই সূত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের সব পত্রিকাই ডাকযোগে আমাদের বাড়িতে আসত; বিশেষ করে ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’, ‘সোভিয়েত নারী’। সেসব পত্রিকা ছাপা হতো দামি গ্লোসি পেপারে। চকচকে উজ্জ্বল চাররঙা ছবি থাকত ফটোগ্রাফির চেয়েও দৃষ্টিনন্দন। বাড়িতে থাকা সেসব পত্রিকা ঘেঁটে পেয়ে যাই বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অনেক দুষ্প্রাপ্য ছবি। সেসব পত্রিকার পাতা কেটে আমি তাতে অসংখ্য দরজা-জানালা ও খিড়কি বানিয়ে ফেলি। পরম যত্নে গ্লোসি পেপারের সেই রঙিন ছবিগুলো দিয়ে তিন পর্বে বঙ্গবন্ধুর একটি কালানুক্রমিক অ্যালবাম বানাই। নিজে দেখি, সংগোপনে বিশ্বস্ত বন্ধুদের দেখাই এবং লুকিয়ে রাখি। মনে একধরনের প্রশান্তি বোধ করি। জনসমক্ষে তা বের করি না—যারে-তারে দেখাই না। কারণ, বঙ্গবন্ধু তখন এ দেশে একটি নিষিদ্ধ শব্দ, অনুচ্চার্য নাম—যেন রামায়ণে রামের নাম নেই! যাঁর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ হলো, যাঁর অনুপ্রেরণায় দেশ স্বাধীন হলো, তিনিই কবন্ধের রাজত্বে পরবাসী! স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে সামরিক সরকারের সর্ববিধ ষড়যন্ত্র তখন রাহুর মতো গ্রাস করতে উদ্যত।
ইতিমধ্যে জাতীয় জীবনে ঘটতে থাকে আরও দুর্ঘটনা—পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর। অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান—ক্ষমতা দখলের জন্য আরও কত গুপ্তসুপ্ত ষড়যন্ত্রের পাহাড়! তখন সারা দেশে শুরু হয় প্রগতিশীল নেতাদের ওপর নির্যাতন ও ধরপাকড়। আমাদের পরিবারেও ঘনিয়ে আসে সেই বিপর্যয়! প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক সরকার কেন্দ্র থেকে জেলা-থানার অনেক প্রগতিশীল নেতা-কর্মীকে নির্বিচারে জেলে পুরতে থাকে। আমার বাবা একদা মোজাফফর ন্যাপ করলেও তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির থানা শাখার সক্রিয় কর্মী। ময়মনসিংহের অধ্যাপক যতীন সরকার, জ্যোতিষ বোস, অজয় রায়, অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম, প্রদীপ চক্রবর্তী প্রমুখ ছিলেন বাবার ব্যক্তিগত বন্ধু ও সাংগঠনিকভাবে ঘনিষ্ঠ। সংগঠনের কাজে বহুবার তাঁরা এসেছেন হালুয়াঘাট। বাবা যেমন এলাকার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, তেমনি রাজনীতিতে পোড়খাওয়া জেলখাটা মানুষ। পাকিস্তান আমলেও রাজনৈতিক কারণে দুবার জেল খেটেছেন।
মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গেও তিনি ময়মনসিংহ জেলে ছিলেন। তাঁর ‘জেলে ত্রিশ বছর ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বইয়ে এর উল্লেখ আছে। পঁচাত্তরের পরে প্রতিক্রিয়াশীলতার কালো ছায়াঘেরা সেই দিনগুলোতে বাবার প্রতি পার্টির নির্দেশ ছিল, গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার। পার্টির সেই নির্দেশ মান্য করে তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আত্মগোপনের পর পুলিশ, বিডিআর ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন প্রকাশ্যে ও গোপনে বাবার খোঁজখবর নিতে তৎপর হয়ে ওঠে। হাবিব নামের এক বিডিআরের সিগন্যাল অফিসার আমাদের বাসায় প্রায়ই এসে খাতির জমাতে চাইতেন, ভয়ও দেখাতেন। কৌশলে বন্ধু সেজে বাবার খোঁজখবর নিতে চাইতেন। আমরা বুঝতে পারতাম, রাতের বেলা মাঝেমধ্যে আমাদের পাটাতন ঘরের নিচে টিকটিকি বসে থাকত। আঁচ করতে চাইত, আমাদের কথাবার্তায় বাবার অবস্থানের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় কি না। সে সময় কয়েকবার আমাদের বাসায় পুলিশ তল্লাশি করে। কাগজপত্র, বইপুস্তক তছনছ করে। কোনো কিছুই না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আমার সেই অ্যালবাম তিনটিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে অবৈধ জিনিস সংরক্ষণের অভিযোগে তা নিয়ে যায়। এভাবেই আমার শখের বস্তুটি হাতছাড়া হয় এবং আমার দীর্ঘদিনের শ্রমে তৈরি করা বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন ও লালিত স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে।
১৯৭৫ থেকে ২১ বছর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকারের পর আবার মুক্তিযুদ্ধের শক্তি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হন। এখন সরকারি উদ্যোগে এবং বিভিন্ন প্রকাশনী তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা দামের বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তাতে থাকছে বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে শোকাবহ ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ধারাবাহিক জীবনের পরিণতি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তো তাঁকে নিয়ে বই ও অ্যালবাম প্রকাশের জোয়ার! সুদৃশ্য এই অ্যালবামগুলো সুসময়ের ফসল এবং বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থেই প্রকাশিত।
কিন্তু আমি হৃদয়ের টানে ও তারুণ্যের আবেগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে অ্যালবাম তৈরি করেছিলাম, তার আর্থিক মূল্য না থাকলেও আত্মিক মূল্য নিশ্চয়ই কম নয়। আমার উদ্দেশ্য ছিল জনকের প্রতি কেবল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার। আমি এখন আর তা প্রমাণ করতে পারব না। তবে মনে শান্তি পাই এই ভেবে যে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত না থেকেও আদর্শিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম সেই অ্যালবামের মাধ্যমে। এই চিন্তা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতার প্রতি ভালোবাসার জোয়ারে তখন প্রথম আমার মাথায় এসেছিল। অন্তত আমি আত্মতৃপ্ত হই এই ভেবে যে সেই খোয়া যাওয়া অ্যালবামটি নিশ্চয়ই ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম অ্যালবাম—অবাণিজ্যিক, একক এবং মাস্টারপিস। যদি সেটি এখন আমার হাতে থাকত, তবে তা বিপরীত স্রোতে ‘রুদ্ধদ্বার মুক্ত প্রাণ’-এর কল্লোল হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে সমর্পণ করতাম।
এখন বঙ্গবন্ধুর এই জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে অনুকূল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক অ্যালবাম ও অগণিত বইয়ে বাজার সয়লাব। ২০২২ সালের একুশের বইমেলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সহস্রাধিক বই বেরিয়েছে—কবিতা, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, গল্প, উপন্যাস ও মূল্যায়নধর্মী। এই তালিকায় যোগ্য লেখকের চেয়ে অযোগ্য অলেখকের সংখ্যাই বেশি। সেসব অপাঠ্য-অখাদ্য হাতে-পাতে নেওয়ার অযোগ্য। ভুল বাক্য, বানান ও বিকৃত তথ্যে বিবমিষা জাগায় সেসব বই। সরল পাঠককে ঠকিয়ে বাণিজ্য করাই সেই সব প্রকাশক ও অলেখকের উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরে এ ধরনের ভুঁইফোড় লেখকদের অপাঠ্য লেখায় সয়লাব হয়েছিল বইবাজার! কবি বিষ্ণু দে এর নাম দিয়েছিলেন ‘রবীন্দ্র-ব্যবসা’। এখন যেন আদেশের প্রকাশনাশিল্পে চলছে তেমনই ‘বঙ্গবন্ধু-ব্যবসা’র যুগ।
শোকের মাসের শুরুর দিনে বঙ্গবন্ধুর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
তখন কৈশোরকাল। সদ্য এসএসসি পাস করে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছি ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে। ১৯৭৩ সাল। এ বছরই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু জনসভা করতে ময়মনসিংহের সার্কিট হাউস ময়দানে এসেছিলেন। লক্ষাধিক মানুষ ঠাঁই নেওয়ার মতো বিরাট মাঠ। উত্তরে ব্রহ্মপুত্র, দক্ষিণে মুমিনুন্নেসা কলেজ, পশ্চিমে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা এবং পুবে প্রশস্ত রাস্তা। কলকাতার গড়ের মাঠ দেখিনি, তবে ময়মনসিংহবাসীর জন্য সার্কিট হাউস গড়ের মাঠতুল্যই। বঙ্গবন্ধু তখন হ্যামিলনের বংশীবাদকের চেয়েও মহান জাদুকর—লিলিপুটের দেশে গ্যালিভারের মতো হিমালয়সদৃশ পুরুষ! তখন তিনি শেখ মুজিব নন, মুজিব ভাই নন—বাঙালির নয়নমণি বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালির কাছে তাঁর প্রায় ঐশ্বরিক খ্যাতি ও দৈবিক জনপ্রিয়তা এমনই তুঙ্গে যে তাঁকে একনজর দেখে পুণ্যলাভ করতে মানুষ প্রাণপাতেও যেন প্রস্তুত।
ময়মনসিংহে তিনি আসবেন শুনে আমরা ঈদের গরু চালানের ট্রাকের মতো বোঝাই হয়ে ভাঙাচোরা পায়জামামার্কা রাস্তায় দুলতে দুলতে, ঝাঁকুনি খেতে খেতে ময়মনসিংহে যখন পৌঁছাই, তখন দুপুর গড়িয়েছে। ইতিমধ্যে মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে লোকারণ্য ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়, ব্রহ্মপুত্রের তীরে—অতিকায় বৃক্ষরাজি ও আশপাশের বিল্ডিংয়ে। গাছগুলোও কিশোর দর্শকে পরিপূর্ণ। মনে হচ্ছে, ডালগুলো যেন অপক্ব মনুষ্য-ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে। ছাদেও তিল ধারণের ঠাঁই নেই—নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, আবালবৃদ্ধবনিতা। তাই দুর্বল স্বাস্থ্যের আমি ট্রাক থেকে নামার সাহস আর পেলাম না! তাঁকে নামামাত্র আবছায়া দেখে বাকিটুকু ভালোবাসা দিয়ে কল্পনা করে নিলাম। বঙ্গবন্ধুর মুখের আদল, কালো ফ্রেমের চশমা, তাঁর দেবদূততুল্য সফেদ পাঞ্জাবি, কালো কোট এবং আপাদমস্তক চেহারা। এই ছিল বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে আমার প্রথম ও শেষ চাক্ষুষ বঙ্গবন্ধু-দর্শন।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের চরম শোকাবহ হত্যাযজ্ঞ আমার সদ্য তরুণ মনকে এমনই কাতর ও শোকাবিষ্ট করে রেখেছিল যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আমি তন্ময় হয়েছিলাম—এই বিভোরতা কাটেনি আজও। সেই প্রেম থেকে পুরোনো পত্রপত্রিকা বা ম্যাগাজিনে যেখানেই বঙ্গবন্ধুর ছবি পাই, তা সংগ্রহ করি এবং সযত্নে তা ক্যাপশনসহ বিজ্ঞানের ব্যবহারিক খাতায় লাগিয়ে রাখি। আগে আমার শখ ছিল বিদ্বজ্জন ও কৃতী ব্যক্তিত্বের অটোগ্রাফ এবং দেশি-বিদেশি ডাকটিকিট সংগ্রহ করা। সেই শখ একমুখী হয় বঙ্গবন্ধুর ছবি সংগ্রহে। যেখানে যা পাই বুভুক্ষুর মতো সংগ্রহ করি—কখনো বলে, কখনো না জানিয়ে।
প্রগতি প্রকাশন তখন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল মলাটের বই ও পত্রপত্রিকার খনি। বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি নামে একটি সংগঠনের শাখা তখন প্রায় সব জেলা ও অনেক থানা পর্যায়েও ছিল। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানায়ও এই সমিতি ছিল। আমার বাবা মদনমোহন পাল ছিলেন এর সভাপতি। সেই সূত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের সব পত্রিকাই ডাকযোগে আমাদের বাড়িতে আসত; বিশেষ করে ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’, ‘সোভিয়েত নারী’। সেসব পত্রিকা ছাপা হতো দামি গ্লোসি পেপারে। চকচকে উজ্জ্বল চাররঙা ছবি থাকত ফটোগ্রাফির চেয়েও দৃষ্টিনন্দন। বাড়িতে থাকা সেসব পত্রিকা ঘেঁটে পেয়ে যাই বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অনেক দুষ্প্রাপ্য ছবি। সেসব পত্রিকার পাতা কেটে আমি তাতে অসংখ্য দরজা-জানালা ও খিড়কি বানিয়ে ফেলি। পরম যত্নে গ্লোসি পেপারের সেই রঙিন ছবিগুলো দিয়ে তিন পর্বে বঙ্গবন্ধুর একটি কালানুক্রমিক অ্যালবাম বানাই। নিজে দেখি, সংগোপনে বিশ্বস্ত বন্ধুদের দেখাই এবং লুকিয়ে রাখি। মনে একধরনের প্রশান্তি বোধ করি। জনসমক্ষে তা বের করি না—যারে-তারে দেখাই না। কারণ, বঙ্গবন্ধু তখন এ দেশে একটি নিষিদ্ধ শব্দ, অনুচ্চার্য নাম—যেন রামায়ণে রামের নাম নেই! যাঁর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ হলো, যাঁর অনুপ্রেরণায় দেশ স্বাধীন হলো, তিনিই কবন্ধের রাজত্বে পরবাসী! স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে সামরিক সরকারের সর্ববিধ ষড়যন্ত্র তখন রাহুর মতো গ্রাস করতে উদ্যত।
ইতিমধ্যে জাতীয় জীবনে ঘটতে থাকে আরও দুর্ঘটনা—পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর। অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান—ক্ষমতা দখলের জন্য আরও কত গুপ্তসুপ্ত ষড়যন্ত্রের পাহাড়! তখন সারা দেশে শুরু হয় প্রগতিশীল নেতাদের ওপর নির্যাতন ও ধরপাকড়। আমাদের পরিবারেও ঘনিয়ে আসে সেই বিপর্যয়! প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক সরকার কেন্দ্র থেকে জেলা-থানার অনেক প্রগতিশীল নেতা-কর্মীকে নির্বিচারে জেলে পুরতে থাকে। আমার বাবা একদা মোজাফফর ন্যাপ করলেও তখন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির থানা শাখার সক্রিয় কর্মী। ময়মনসিংহের অধ্যাপক যতীন সরকার, জ্যোতিষ বোস, অজয় রায়, অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম, প্রদীপ চক্রবর্তী প্রমুখ ছিলেন বাবার ব্যক্তিগত বন্ধু ও সাংগঠনিকভাবে ঘনিষ্ঠ। সংগঠনের কাজে বহুবার তাঁরা এসেছেন হালুয়াঘাট। বাবা যেমন এলাকার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, তেমনি রাজনীতিতে পোড়খাওয়া জেলখাটা মানুষ। পাকিস্তান আমলেও রাজনৈতিক কারণে দুবার জেল খেটেছেন।
মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গেও তিনি ময়মনসিংহ জেলে ছিলেন। তাঁর ‘জেলে ত্রিশ বছর ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বইয়ে এর উল্লেখ আছে। পঁচাত্তরের পরে প্রতিক্রিয়াশীলতার কালো ছায়াঘেরা সেই দিনগুলোতে বাবার প্রতি পার্টির নির্দেশ ছিল, গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলার। পার্টির সেই নির্দেশ মান্য করে তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আত্মগোপনের পর পুলিশ, বিডিআর ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন প্রকাশ্যে ও গোপনে বাবার খোঁজখবর নিতে তৎপর হয়ে ওঠে। হাবিব নামের এক বিডিআরের সিগন্যাল অফিসার আমাদের বাসায় প্রায়ই এসে খাতির জমাতে চাইতেন, ভয়ও দেখাতেন। কৌশলে বন্ধু সেজে বাবার খোঁজখবর নিতে চাইতেন। আমরা বুঝতে পারতাম, রাতের বেলা মাঝেমধ্যে আমাদের পাটাতন ঘরের নিচে টিকটিকি বসে থাকত। আঁচ করতে চাইত, আমাদের কথাবার্তায় বাবার অবস্থানের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় কি না। সে সময় কয়েকবার আমাদের বাসায় পুলিশ তল্লাশি করে। কাগজপত্র, বইপুস্তক তছনছ করে। কোনো কিছুই না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আমার সেই অ্যালবাম তিনটিতে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে অবৈধ জিনিস সংরক্ষণের অভিযোগে তা নিয়ে যায়। এভাবেই আমার শখের বস্তুটি হাতছাড়া হয় এবং আমার দীর্ঘদিনের শ্রমে তৈরি করা বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন ও লালিত স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে।
১৯৭৫ থেকে ২১ বছর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকারের পর আবার মুক্তিযুদ্ধের শক্তি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হন। এখন সরকারি উদ্যোগে এবং বিভিন্ন প্রকাশনী তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা দামের বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। তাতে থাকছে বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে শোকাবহ ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ধারাবাহিক জীবনের পরিণতি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তো তাঁকে নিয়ে বই ও অ্যালবাম প্রকাশের জোয়ার! সুদৃশ্য এই অ্যালবামগুলো সুসময়ের ফসল এবং বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থেই প্রকাশিত।
কিন্তু আমি হৃদয়ের টানে ও তারুণ্যের আবেগে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে অ্যালবাম তৈরি করেছিলাম, তার আর্থিক মূল্য না থাকলেও আত্মিক মূল্য নিশ্চয়ই কম নয়। আমার উদ্দেশ্য ছিল জনকের প্রতি কেবল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার। আমি এখন আর তা প্রমাণ করতে পারব না। তবে মনে শান্তি পাই এই ভেবে যে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত না থেকেও আদর্শিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম সেই অ্যালবামের মাধ্যমে। এই চিন্তা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতার প্রতি ভালোবাসার জোয়ারে তখন প্রথম আমার মাথায় এসেছিল। অন্তত আমি আত্মতৃপ্ত হই এই ভেবে যে সেই খোয়া যাওয়া অ্যালবামটি নিশ্চয়ই ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম অ্যালবাম—অবাণিজ্যিক, একক এবং মাস্টারপিস। যদি সেটি এখন আমার হাতে থাকত, তবে তা বিপরীত স্রোতে ‘রুদ্ধদ্বার মুক্ত প্রাণ’-এর কল্লোল হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে সমর্পণ করতাম।
এখন বঙ্গবন্ধুর এই জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে অনুকূল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক অ্যালবাম ও অগণিত বইয়ে বাজার সয়লাব। ২০২২ সালের একুশের বইমেলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সহস্রাধিক বই বেরিয়েছে—কবিতা, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, গল্প, উপন্যাস ও মূল্যায়নধর্মী। এই তালিকায় যোগ্য লেখকের চেয়ে অযোগ্য অলেখকের সংখ্যাই বেশি। সেসব অপাঠ্য-অখাদ্য হাতে-পাতে নেওয়ার অযোগ্য। ভুল বাক্য, বানান ও বিকৃত তথ্যে বিবমিষা জাগায় সেসব বই। সরল পাঠককে ঠকিয়ে বাণিজ্য করাই সেই সব প্রকাশক ও অলেখকের উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পরে এ ধরনের ভুঁইফোড় লেখকদের অপাঠ্য লেখায় সয়লাব হয়েছিল বইবাজার! কবি বিষ্ণু দে এর নাম দিয়েছিলেন ‘রবীন্দ্র-ব্যবসা’। এখন যেন আদেশের প্রকাশনাশিল্পে চলছে তেমনই ‘বঙ্গবন্ধু-ব্যবসা’র যুগ।
শোকের মাসের শুরুর দিনে বঙ্গবন্ধুর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে