মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা কয়েক যুগ ধরে চলে আসছে। রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক আদর্শের বিকাশ, সংগঠন, নেতা-কর্মীর চেয়েও ভুঁইফোড়, সুবিধাবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান, বিকাশ, ক্ষমতায় ক্রমবর্ধমানভাবে প্রতিষ্ঠালাভের ফলেই এই সমস্যা জটিলতর হয়ে উঠেছে। একসময় বলাই হয়েছিল—রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য জটিল করে দেওয়া হবে। যাঁরা এমন দম্ভোক্তি করেছিলেন, তাঁরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যা করেছেন, তাতে গণতান্ত্রিক আদর্শবাদী রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করাই শুধু কঠিন হয়ে ওঠেনি, নির্বাচনেও তাঁদের অবস্থান দুর্বলতম স্থানে। গোটা সমাজ, রাষ্ট্র ও জনমানসে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুনরাবির্ভাব ঘটানো হয়েছিল। সেই জিগির তুলেই নির্বাচনে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকে পরাজিত করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছিল। এমনকি ১৯৯১-এর নির্বাচনেও ধর্ম ও ভারতবিরোধিতার জিগির কীভাবে কাজে লাগানো হয়েছিল, তা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এর পরও রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনকে অগণতান্ত্রিক শক্তির হাতে ধরে রাখার কূটকৌশল চালিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। নির্বাচনব্যবস্থায় একটি অ্যাডহক পদ্ধতি চালু করা হলেও সেটির ভেতরেও লুকিয়ে থাকা নানা অপশক্তি নির্বাচনকে প্রভাবিত করার গোপন ব্যবস্থা কার্যকর করেছিল।
ফলে ২০০৬ সালে দেশ নির্বাচন নিয়ে একটি গভীর সংকটে পড়ে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ক্ষমতাসীন সরকার ও তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের প্রচেষ্টায় ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে খুশি হতে পারেনি পরাজিতরা। দেশের সর্বোচ্চ আদালত অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে দেশ চলে যাওয়ার ব্যবস্থাকে সংবিধান পরিপন্থী বলে রায় দেন। ফলে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিক ধারা দেশে অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো প্রভাবমুক্তভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু বিরোধী জোট নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে পরিচালিত করে। সরকারপ্রধান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিলেও বিরোধী দল তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিরোধী দলের বর্জন, প্রত্যাখ্যান ও প্রতিহতের মুখে পড়ে। বলা চলে, বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা এই সময়ে এসে বর্জন, প্রত্যাখ্যান ও প্রতিহত করার মুখোমুখি এক ভয়াবহ সাংঘর্ষিক রূপ নেয়।
২০১৮-এর নির্বাচনবিরোধীদের অসংগঠিত, প্রস্তুতিহীনতা ও পরনির্ভরশীলতার কারণে তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়। সেই পরাজয়কে তারা মোটেও মেনে নিতে পারেনি। ২০২২ সাল থেকে বিরোধীরা সরকারবিরোধী আন্দোলন যেভাবে গড়ে তুলেছিল, তা যদি গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কৌশল হিসেবে কার্যকর হতো, তাহলে নির্বাচনে একটি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফিরে আসত। গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ধারায়ও দেশ এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনকারীরা সেই পথে হাঁটেনি; তারা সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অনড় থেকে দেশে ‘গণ-অভ্যুত্থান’ ঘটানোর যে আশা করেছিল, তা কতটা দুর্বল ছিল দেশে ও বিদেশে সবাই প্রত্যক্ষ করেছি। তাদের ধারণা ছিল বিদেশিরা পাশে থাকবে এবং সরকারের একতরফা নির্বাচন মেনে নেবে না। কিন্তু ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সরকারি দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ রাখেনি। বিরোধীরা সেই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ডাক দিয়েছিল, কিন্তু এর কিছুই তারা করতে পারেনি। বিদেশিরা নির্বাচন ও সরকারকে মেনে নিয়েছে। বিরোধীরা সেই থেকে সব ধরনের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে।
ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচন শুরু হয়েছে। এই নির্বাচনে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের তফসিল অনুযায়ী বিএনপির বেশ কিছু নেতা অংশগ্রহণ করেছেন। বিএনপি তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে। এর ফলে দলের স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রিয় নেতা-কর্মীরা নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে হয় বাধ্য হচ্ছেন, নতুবা দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হচ্ছে। বিএনপিসহ বিরোধীদের উদ্দেশ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন’, ‘একপক্ষীয়ভাবে’ অনুষ্ঠিত করার দোষে সরকারকে ‘দুষ্ট’ করা। এ ধরনের লক্ষ্য ও কৌশল গণতন্ত্রের জন্য মোটেও সুখকর নয়। বিএনপি ও বিরোধীরা এই ধারা কত দিন অব্যাহত রাখতে পারবে, রাখতে গেলে দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা কত দিন সেটি মেনে নেবেন, তা একটি মৌলিক প্রশ্ন, দেখারও বিষয়। ধরা যাক, তাদের এই কৌশল কোনো একদিন সফল হলো। কিন্তু তখন যে বেসামাল অবস্থা সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও জনমানসে তৈরি হবে, তা কি দেশে গণতন্ত্রের পথকে সুগম করবে, নাকি আরও জটিলতর করবে? বিএনপি এবং এর সঙ্গে থাকা বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই সাম্প্রদায়িক, উগ্র এবং হঠকারীও। ফলে গণতন্ত্র এমন বহু মিশালি রাজনৈতিক দল ও শক্তির দ্বারা বাংলাদেশে সুখের স্বপ্ন দেখাবে—এমনটি মোটেও আশা করা যায় না। অন্তত রাজনীতির বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতা তেমন কোনো আশার আলো দেখায় না। তেমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ বর্তমান বিরোধীদের দেখানো পথেই যদি নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করতেই মাঠে নামে, তাহলে দৃশ্যটা কেমন হবে, তা একবার কল্পনা করা দরকার।
বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে চেয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের চেয়েও জনগণের কাছে বাঁচা-মরার বিষয়টি বড় হয়ে উঠেছিল। দুই মাস মানুষ অনেকটাই ঘরবন্দী ছিল। অগ্নিসংযোগ, রাজধানীর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করার এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। মানুষের রুটিরুজি বন্ধ হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে ১৫৩ জনকে বিজয়ী ঘোষণা এবং বাকি আসনগুলোতে সাধারণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করায় সরকার গঠনে বাধা রইল না। দেশের মানুষও নির্বাচনের চেয়েও জ্বালাও-পোড়াও এবং মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ছিল। বিরোধীরা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঘরে বসে যায়। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধীদের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন এবং নির্বাচন রুখে দেওয়ার সব প্রস্তুতি সফলভাবে কাজে লাগিয়েছিল। বিরোধীরা অনেক বেশি চাতক পাখির মতো পিটার ডে হাস ও মার্কিন সরকারের দিকে তাকিয়ে ছিল। সরকারি দল নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকভাবে অনুষ্ঠিত করার জন্য নিজ দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অবাধ সুযোগ করে দেয়। জাতীয় পার্টিসহ অন্য বেশ কিছু দল নির্বাচনে অংশ নেয়। বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এসব দলের বিজয়ী হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। তাই সরকারকে কয়েকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাড় দিতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগকে এমন কৌশল নির্বাচনে অবলম্বন করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ বেশ সমস্যায়ও পড়তে হয়েছে। সেটির জের এখনো কাটেনি। কিন্তু বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের ফলে যে জটিল শাসনতান্ত্রিক সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তা থেকে দেশকে রক্ষা করার বিষয়টি অনেকেই টের পাননি।
এখন বিরোধীদের বর্জনের মুখেও আওয়ামী লীগকে উপজেলা নির্বাচনে কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত দিতে হয়েছে, যা অনেক উপজেলাতেই নেতা-কর্মীরা মানছেন না, স্বজনদের উপজেলায় প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্ব ১৩৯ আসনে ৮ মে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ধাপে মোট ১ হাজার ৬৩৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৫৭০, ভাইস চেয়ারম্যান ৬২৫ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৪০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রথম ধাপে মোট ২৮ জন প্রার্থী এরই মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। এই নির্বাচনে সবচেয়ে দলীয় শত্রুতার মুখে পড়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তা উপেক্ষা করে যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আটজন সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বিজয়ী হয়েছেন। বাকি আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতারাই উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনে বেশ কিছু অনিয়ম করার অভিযোগে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্ট, জাল ভোটদাতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কয়েকজনকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে নানা ব্যাখ্যা ও তথ্য রয়েছে, তবে সঠিক তথ্য এখনো জানা যায়নি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা, সমর্থক ও ভোটারদের মধ্যে সব জায়গায় সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি। এর কারণ হচ্ছে, দলীয় এমপি, মন্ত্রী ও প্রভাবশালী স্বজন নিজেদের বলয়ের প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান করায় অন্যরা দৃশ্যত নিষ্ক্রিয় ছিলেন। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নির্বাচনটি অবাধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও দলীয় যোগ্যদের নির্বাচিত হয়ে আসার যে সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলেন, তা প্রভাবশালীদের প্রভাব ও হীন স্বার্থের কারণে সফল হতে পারেনি। বিরোধীরা কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে নির্বাচনটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে দিতে চায়নি। আবার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নির্বাচনে নানা অপকৌশল অবলম্বন করায় অনেক জায়গায় প্রার্থী কম থাকায় ভোটার টানার সুযোগ ছিল না। আওয়ামী লীগের মধ্যে যেকোনো মূল্যে নিজের জয় বা প্রভাব ধরে রাখার প্রবণতা দলীয় সভাপতির সদিচ্ছাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। নির্বাচন এভাবে বিরোধী ও সরকারি দলের নানা মহলের সংকীর্ণ স্বার্থের লীলাখেলায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ছে। আগামী ২১ ও ২৯ মে এবং ৫ জুন পরবর্তী তিন ধাপের নির্বাচন শেষে ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচন ২০২৪ নিয়ে শেষ মূল্যায়নটি করা যাবে। কিন্তু এর আগেই আওয়ামী লীগ বাকি তিন পর্বের নির্বাচন নিয়ে নিজেদের করণীয় কীভাবে ঠিক করবে, সেটি তাদের দলীয় বিষয়।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা কয়েক যুগ ধরে চলে আসছে। রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক আদর্শের বিকাশ, সংগঠন, নেতা-কর্মীর চেয়েও ভুঁইফোড়, সুবিধাবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান, বিকাশ, ক্ষমতায় ক্রমবর্ধমানভাবে প্রতিষ্ঠালাভের ফলেই এই সমস্যা জটিলতর হয়ে উঠেছে। একসময় বলাই হয়েছিল—রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য জটিল করে দেওয়া হবে। যাঁরা এমন দম্ভোক্তি করেছিলেন, তাঁরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যা করেছেন, তাতে গণতান্ত্রিক আদর্শবাদী রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করাই শুধু কঠিন হয়ে ওঠেনি, নির্বাচনেও তাঁদের অবস্থান দুর্বলতম স্থানে। গোটা সমাজ, রাষ্ট্র ও জনমানসে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুনরাবির্ভাব ঘটানো হয়েছিল। সেই জিগির তুলেই নির্বাচনে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকে পরাজিত করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছিল। এমনকি ১৯৯১-এর নির্বাচনেও ধর্ম ও ভারতবিরোধিতার জিগির কীভাবে কাজে লাগানো হয়েছিল, তা ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এর পরও রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনকে অগণতান্ত্রিক শক্তির হাতে ধরে রাখার কূটকৌশল চালিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। নির্বাচনব্যবস্থায় একটি অ্যাডহক পদ্ধতি চালু করা হলেও সেটির ভেতরেও লুকিয়ে থাকা নানা অপশক্তি নির্বাচনকে প্রভাবিত করার গোপন ব্যবস্থা কার্যকর করেছিল।
ফলে ২০০৬ সালে দেশ নির্বাচন নিয়ে একটি গভীর সংকটে পড়ে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ক্ষমতাসীন সরকার ও তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের প্রচেষ্টায় ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল। কিন্তু সেই নির্বাচনে খুশি হতে পারেনি পরাজিতরা। দেশের সর্বোচ্চ আদালত অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে দেশ চলে যাওয়ার ব্যবস্থাকে সংবিধান পরিপন্থী বলে রায় দেন। ফলে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিক ধারা দেশে অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো প্রভাবমুক্তভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু বিরোধী জোট নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে পরিচালিত করে। সরকারপ্রধান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিলেও বিরোধী দল তা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিরোধী দলের বর্জন, প্রত্যাখ্যান ও প্রতিহতের মুখে পড়ে। বলা চলে, বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা এই সময়ে এসে বর্জন, প্রত্যাখ্যান ও প্রতিহত করার মুখোমুখি এক ভয়াবহ সাংঘর্ষিক রূপ নেয়।
২০১৮-এর নির্বাচনবিরোধীদের অসংগঠিত, প্রস্তুতিহীনতা ও পরনির্ভরশীলতার কারণে তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়। সেই পরাজয়কে তারা মোটেও মেনে নিতে পারেনি। ২০২২ সাল থেকে বিরোধীরা সরকারবিরোধী আন্দোলন যেভাবে গড়ে তুলেছিল, তা যদি গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কৌশল হিসেবে কার্যকর হতো, তাহলে নির্বাচনে একটি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফিরে আসত। গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ধারায়ও দেশ এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনকারীরা সেই পথে হাঁটেনি; তারা সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অনড় থেকে দেশে ‘গণ-অভ্যুত্থান’ ঘটানোর যে আশা করেছিল, তা কতটা দুর্বল ছিল দেশে ও বিদেশে সবাই প্রত্যক্ষ করেছি। তাদের ধারণা ছিল বিদেশিরা পাশে থাকবে এবং সরকারের একতরফা নির্বাচন মেনে নেবে না। কিন্তু ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সরকারি দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ রাখেনি। বিরোধীরা সেই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ডাক দিয়েছিল, কিন্তু এর কিছুই তারা করতে পারেনি। বিদেশিরা নির্বাচন ও সরকারকে মেনে নিয়েছে। বিরোধীরা সেই থেকে সব ধরনের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে।
ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচন শুরু হয়েছে। এই নির্বাচনে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের তফসিল অনুযায়ী বিএনপির বেশ কিছু নেতা অংশগ্রহণ করেছেন। বিএনপি তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে। এর ফলে দলের স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রিয় নেতা-কর্মীরা নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে হয় বাধ্য হচ্ছেন, নতুবা দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হচ্ছে। বিএনপিসহ বিরোধীদের উদ্দেশ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন’, ‘একপক্ষীয়ভাবে’ অনুষ্ঠিত করার দোষে সরকারকে ‘দুষ্ট’ করা। এ ধরনের লক্ষ্য ও কৌশল গণতন্ত্রের জন্য মোটেও সুখকর নয়। বিএনপি ও বিরোধীরা এই ধারা কত দিন অব্যাহত রাখতে পারবে, রাখতে গেলে দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা কত দিন সেটি মেনে নেবেন, তা একটি মৌলিক প্রশ্ন, দেখারও বিষয়। ধরা যাক, তাদের এই কৌশল কোনো একদিন সফল হলো। কিন্তু তখন যে বেসামাল অবস্থা সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও জনমানসে তৈরি হবে, তা কি দেশে গণতন্ত্রের পথকে সুগম করবে, নাকি আরও জটিলতর করবে? বিএনপি এবং এর সঙ্গে থাকা বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই সাম্প্রদায়িক, উগ্র এবং হঠকারীও। ফলে গণতন্ত্র এমন বহু মিশালি রাজনৈতিক দল ও শক্তির দ্বারা বাংলাদেশে সুখের স্বপ্ন দেখাবে—এমনটি মোটেও আশা করা যায় না। অন্তত রাজনীতির বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতা তেমন কোনো আশার আলো দেখায় না। তেমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ বর্তমান বিরোধীদের দেখানো পথেই যদি নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করতেই মাঠে নামে, তাহলে দৃশ্যটা কেমন হবে, তা একবার কল্পনা করা দরকার।
বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে চেয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের চেয়েও জনগণের কাছে বাঁচা-মরার বিষয়টি বড় হয়ে উঠেছিল। দুই মাস মানুষ অনেকটাই ঘরবন্দী ছিল। অগ্নিসংযোগ, রাজধানীর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করার এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। মানুষের রুটিরুজি বন্ধ হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে ১৫৩ জনকে বিজয়ী ঘোষণা এবং বাকি আসনগুলোতে সাধারণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করায় সরকার গঠনে বাধা রইল না। দেশের মানুষও নির্বাচনের চেয়েও জ্বালাও-পোড়াও এবং মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ছিল। বিরোধীরা পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঘরে বসে যায়। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধীদের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন এবং নির্বাচন রুখে দেওয়ার সব প্রস্তুতি সফলভাবে কাজে লাগিয়েছিল। বিরোধীরা অনেক বেশি চাতক পাখির মতো পিটার ডে হাস ও মার্কিন সরকারের দিকে তাকিয়ে ছিল। সরকারি দল নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলকভাবে অনুষ্ঠিত করার জন্য নিজ দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অবাধ সুযোগ করে দেয়। জাতীয় পার্টিসহ অন্য বেশ কিছু দল নির্বাচনে অংশ নেয়। বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এসব দলের বিজয়ী হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। তাই সরকারকে কয়েকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাড় দিতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগকে এমন কৌশল নির্বাচনে অবলম্বন করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ বেশ সমস্যায়ও পড়তে হয়েছে। সেটির জের এখনো কাটেনি। কিন্তু বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের ফলে যে জটিল শাসনতান্ত্রিক সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তা থেকে দেশকে রক্ষা করার বিষয়টি অনেকেই টের পাননি।
এখন বিরোধীদের বর্জনের মুখেও আওয়ামী লীগকে উপজেলা নির্বাচনে কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত দিতে হয়েছে, যা অনেক উপজেলাতেই নেতা-কর্মীরা মানছেন না, স্বজনদের উপজেলায় প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্ব ১৩৯ আসনে ৮ মে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ধাপে মোট ১ হাজার ৬৩৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৫৭০, ভাইস চেয়ারম্যান ৬২৫ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৪০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রথম ধাপে মোট ২৮ জন প্রার্থী এরই মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। এই নির্বাচনে সবচেয়ে দলীয় শত্রুতার মুখে পড়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তা উপেক্ষা করে যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আটজন সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বিজয়ী হয়েছেন। বাকি আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতারাই উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনে বেশ কিছু অনিয়ম করার অভিযোগে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্ট, জাল ভোটদাতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কয়েকজনকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে নানা ব্যাখ্যা ও তথ্য রয়েছে, তবে সঠিক তথ্য এখনো জানা যায়নি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা, সমর্থক ও ভোটারদের মধ্যে সব জায়গায় সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি। এর কারণ হচ্ছে, দলীয় এমপি, মন্ত্রী ও প্রভাবশালী স্বজন নিজেদের বলয়ের প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান করায় অন্যরা দৃশ্যত নিষ্ক্রিয় ছিলেন। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নির্বাচনটি অবাধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও দলীয় যোগ্যদের নির্বাচিত হয়ে আসার যে সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলেন, তা প্রভাবশালীদের প্রভাব ও হীন স্বার্থের কারণে সফল হতে পারেনি। বিরোধীরা কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে নির্বাচনটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হতে দিতে চায়নি। আবার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নির্বাচনে নানা অপকৌশল অবলম্বন করায় অনেক জায়গায় প্রার্থী কম থাকায় ভোটার টানার সুযোগ ছিল না। আওয়ামী লীগের মধ্যে যেকোনো মূল্যে নিজের জয় বা প্রভাব ধরে রাখার প্রবণতা দলীয় সভাপতির সদিচ্ছাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। নির্বাচন এভাবে বিরোধী ও সরকারি দলের নানা মহলের সংকীর্ণ স্বার্থের লীলাখেলায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ছে। আগামী ২১ ও ২৯ মে এবং ৫ জুন পরবর্তী তিন ধাপের নির্বাচন শেষে ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচন ২০২৪ নিয়ে শেষ মূল্যায়নটি করা যাবে। কিন্তু এর আগেই আওয়ামী লীগ বাকি তিন পর্বের নির্বাচন নিয়ে নিজেদের করণীয় কীভাবে ঠিক করবে, সেটি তাদের দলীয় বিষয়।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে