শশী থারুরের বক্তব্য এবং ভাষা আন্দোলন

মামুনুর রশীদ
প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭: ৪৫
আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৫: ৪২

সম্প্রতি ভারতের বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী শশী থারুর ইংল্যান্ডে দেওয়া একটি পুরোনো বক্তব্য ডিজিটাল মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে কিছু চমকপ্রদ তথ্য তিনি প্রকাশ করেছেন। ব্রিটিশরা আমাদের একটি শব্দকে তাদের করে নিয়েছে। শব্দটি হচ্ছে—‘লুট’। ‘লুট’ একটি উর্দু শব্দ। উৎস ফারসি কি না, তা আমার জানা নেই। এখন ‘লুট’ একটি ইংরেজি শব্দও, আছে আমাদের বাংলা অভিধানেও।

যা-ই হোক, ক্লাইভ থেকে শুরু করে মাউন্টব্যাটেন পর্যন্ত ভারতবর্ষ থেকে যে পরিমাণ সম্পদ লুট করে নিয়েছেন, তার একটা হিসাবও শশী থারুর দিয়েছেন। ইংরেজরা আমাদের মসলিন শুধু নয়, যেভাবে কাপড়ের শিল্পকে ধ্বংস করেছে, তা-ও বলেছেন। এখান থেকে কাঁচামাল লুট করে কীভাবে তাদের কারখানায় নিয়ে কাপড় বানিয়ে আবার ভারতে এনে উচ্চ শুল্ক নিয়ে বিক্রি করেছে, তার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। ভারতবর্ষে তারা কতগুলো দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা-ও সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন শশী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের যাবতীয় খরচ ভারতবর্ষই দিয়েছে এই শুল্কের মাধ্যমে।

পরিশেষে শশী দাবি করেছেন ‘রেপারেশন’। ইংরেজি ‘রেপারেশন’-এর অর্থ ক্ষতিপূরণ। ব্রিটিশ কলোনি ভারতবর্ষে এসে যে পরিমাণ ক্ষতি এই অঞ্চলের করেছে, এর জন্য তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদিও শুধু অর্থের মাধ্যমে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব নয়। তবু বছরে এক পাউন্ড করে দিলেও তো কয়েক শ বছর লেগে যাবে এই ক্ষতি পূরণ করতে। তবু শুরু হোক।

ব্রিটিশ শাসনামলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমরা; বিশেষ করে পূর্ব বাংলা। এই বাংলা সুজলা, সুফলা এবং বস্ত্রশিল্পে পৃথিবীতে অগ্রণী। মসলিন শিল্প ও উন্নতমানের বস্ত্রশিল্পের জন্যই ছিল এই অঞ্চলের খ্যাতি। সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই বাংলা থেকে এক কোটি টাকা রাজস্ব পেতেন। শোনা যায়, এই টাকা দিয়েই তিনি ভ্রাতাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের শাসন সুসংহত করেন। মোগলরা এ দেশের সম্পদ লুট না করে এখানেই কাজে লাগাতেন। যদিও যুদ্ধ কোনো সম্পদ রক্ষার কাজ নয়। তবে রাস্তাঘাট নির্মাণে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য তাদের উদ্বেগেরও অভাব ছিল না। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ধ্বংস করার জন্য ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি আবার নানাভাবে কাজ করেছে। এর জন্য তারা আগে এক ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার সূচনা করে, এরপর ভারতবর্ষকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। আর এর মধ্যে নির্বিঘ্নে নিজের পুঁজি গুছিয়ে নিয়ে সম্মানজনক এক প্রশংসা নিশ্চিত করে চম্পট দেয়। সেই সঙ্গে দুই দেশে এক তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ দিয়ে যায়।

ভারতে এ বিষয়ে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ গেয়ে ওঠে—‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।’ আর অন্যদিকে পূর্ব বাংলা থেকে উচ্চারিত হয়—‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই’। তখন পাকিস্তান এক দেশ—এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ড ১ হাজার ২০০ মাইল দূরে, এক অদ্ভুত রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করে ফেললেন, ‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ অথচ পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষী জনসংখ্যা ওখানকার বিশাল পাকিস্তানি ভূখণ্ডের চেয়েও বড়। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাই গর্জে উঠল বাংলার মানুষ। সেই থেকে শুরু—প্রবল অবিশ্বাস, শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা থেকে আন্দোলন। সামরিক শাসনে অভ্যস্ত এক অগণতান্ত্রিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জনমানুষের আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। মাত্র ২৪ বছরেই ব্রিটিশদের নীতি কাজে লেগে গেল। কী তাদের দূরদর্শিতা!

কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার জন্য এদিকে যেন আবার দ্বিতীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেল। মানুষ বলতে শুরু করল—‘ব্রিটিশ আমলেই তো আমরা ভালো ছিলাম!’ আর ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে অন্য কথা—‘পাকিস্তানই তো ভালো ছিল।’ কি শোষণ, কি দুর্নীতি—তখন জনগণ এসব বুঝল। কিন্তু ব্রিটিশদের যে কূট ষড়যন্ত্র, তা কি বুঝল আমাদের জনগণ? ব্রিটিশরা আসে তখন মধ্যস্থতা করতে। আমাদের বিচারালয় বোঝাই ব্যারিস্টার এবং বিচারপতিতে তাঁদের সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ওই ব্রিটিশ আইনে। ১৮৬০ সালের সেই পেনাল কোড সব ফৌজদারি আইনের নিয়ামক। কোনো বড় ধরনের আইনি সংস্কার আমরা করতে পারিনি। তাই যখন আমাদের সম্পদ লুট করে ব্রিটিশ, পাকিস্তান– তখন আমরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি না। তবে পাকিস্তানিরা যখন ভাষার ওপর আঘাত হানে, তখন আমরা বসে থাকিনি। প্রশ্ন হচ্ছে, আজ যখন মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ায়, ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা দিতে উৎসাহিত করে, এমনকি অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন গড়ে তোলে, যেখানে ইংরেজি ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তখন আমরা কিন্তু প্রতিরোধ করি না। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরাও অবলীলায় এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। এর কারণ হয়তো ইতিহাসচর্চার প্রতি অনীহা অথবা একান্তই ব্যক্তিগত আত্মসচেতনতা।

অমর একুশে বইমেলায় হাজার হাজার মানুষ আসে। কিন্তু কতজন একুশের চেতনার কথা ভাবে? এই দেশটা একসময় সাংস্কৃতিক রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা কোথায় চলে এলাম? শশী থারুর কতগুলো প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা কি আরও কিছু জরুরি প্রশ্ন তুলতে পারি না?

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত