জাহীদ রেজা নূর
আমাদের বর্তমান সংকটটা হচ্ছে গণতন্ত্রের। সেই গণতন্ত্রকে পোক্ত করার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটা শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ আসবে কি আসবে না, সেটা নাকি নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র যে একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ, সে কথা বহুবার বহুভাবে আমাদের জানিয়েছে কমিউনিস্টরা। যে পুঁজিবাদের ওপর ভর করে সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র মোড়লিপনা করে, সেই পুঁজিবাদ বাইরের বিশ্বের গণতন্ত্রকে গলা টিপে মেরেছে এবং মারছে—এমন নজির অনেক আছে।
তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তর সমালোচনা করা যায়। কিন্তু ভোটের অধিকার পাওয়া এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বসবাস করতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এ দেশের জনগণেরই। আমরা যে ভোটবিষয়ক জটিলতায় পড়ে গেছি, সেটা মিথ্যে নয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র কী চাইছে-না চাইছে, সে আলোচনায় না গিয়ে আমরা বরং বলতে পারি, জনগণ যেন নিজের ভোটটা দিতে পারে, তা নিশ্চিত করার কথাই রাজনীতিকদের এখন ভাবা উচিত।
২. এই বাঙালিই একসময় পাকিস্তান এনেছিল। তাদের মনে তখন মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তবে তারও আগে, ১৯০৫ সালে হিন্দু-মুসলমান সংকট প্রকট হয়ে দেখা গিয়েছিল। ১৯০৫ সালে যে হিন্দুরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের জয়গান গেয়েছিল, সেই হিন্দু সম্প্রদায়ই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছেড়ে হয়ে উঠেছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। মাত্র বছর চল্লিশের ব্যবধানে একেবারে অ্যাবাউট-টার্ন! হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অখণ্ড বাংলার স্বপ্নে কেবল যোগ দিয়েছিলেন আবুল হাশিম, শরৎ বসু, কিরণশংকর রায়। এ ছাড়া আর কাউকে কি আন্তরিকভাবে অখণ্ড বাংলার পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে? নেহরু-প্যাটেলের বিরোধিতা বাংলা বিভাগকে ত্বরান্বিত করেছিল।
তবে পাকিস্তান হওয়ার পর বাঙালিকে অতি দ্রুত বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সমমর্যাদা দেবে না। পশ্চিমাদের মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, বাংলার মানুষ আশরাফ মুসলমান নয়, হিন্দু শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয় বলে তাদের খাঁটিত্ব নিয়েও প্রশ্ন ছিল তাদের মনে। আর ছিল তীব্র ঘৃণা। ঘৃণা না থাকলে ১৯৭১ সালে এসে এ রকম জেনোসাইড ঘটাতে পারে কেউ?
৩. ভাষার প্রশ্নে ধাক্কাটা ছিল প্রবল। জবাবটাও ছিল দাঁতভাঙা। ১৯৫২ সালে গুলি ছুড়ে নিজের পায়েই কুড়াল মারল পুলিশ। রবীন্দ্রনাথ ‘রথের রশি’তে লিখেছেন, ‘বাধা পেলে শক্তি নিজেকে নিজে চিনতে পারে, চিনতে পারলেই আর ঠেকানো যায় না।’ ওই বাধাই বাংলাকে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। যদিও ভাষা আন্দোলন ১৯৫৬ পর্যন্ত একই বেগে চলেনি, কিন্তু রাজনৈতিক নানা খেলার মধ্যে এই বছরটিতে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হয়। তত দিনে বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের সন্ধানে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বুঝতে শিখেছে, শুধু ধর্মীয় বন্ধন একটি জাতিকে মুক্তির ঠিকানা দিতে পারে না। বাঙালি, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান এত দিনে নিজের শিকড়ের দিকে তাকাল। আরব-ইরাক-তুর্কি-মোগলের বংশধর হিসেবে নিজের পরিচয় দেওয়া বন্ধ করে পায়ের নিচেই পেল ভিত্তিভূমি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হলো এ সময়।
৪. কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল একসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথকে ঠেকাতে অকথা-কুকথার বন্যা বইয়ে দিল ইসলাম-পসন্দ্ বুদ্ধিজীবীর দল। আর এই সময়েই ১৯৬১ সালে এল রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। সামরিক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হলো। এবং এরই মধ্যে বোঝা গেল, অলস বাঙালির রক্তে লেগেছে প্রলয়দোলা। নিজ পরিচয় নিয়ে যে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল বাঙালি। বাঙালির বিরুদ্ধে করা বঞ্চনাগুলো উঠে আসতে লাগল ওপরে। একটা ছোট হিসাব দেওয়া যাক।
উন্নয়ন পরিকল্পনায় শুরু থেকেই ছিল বৈষম্য। ১৯৪৮ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার প্রদেশ উন্নয়নের যে পরিকল্পনা করে, তা বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ১৬ কোটি রুপি আর পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ কোটি রুপির বেশি ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। সম্পূরক তথ্য: ১৯৫২ সালে জাতীয় উন্নয়নের জন্য যে ১৮ কোটি রুপি ব্যয় ধরা হয়েছিল, তার মধ্যে মাত্র ৫ কোটি ৫০ লাখ রুপি ব্যয় হয় পূর্ব পাকিস্তানে। বাকি ১২ কোটি ৫০ লাখ রুপি ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
পূর্ব পাকিস্তানের শক্তি ছিল তার কৃষি। ১৯৫১ সালের ২৯ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশন পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৫৭ লাখ ৬২ হাজার ৪১৭ টাকা কম বরাদ্দ দেয়। তাতে কৃষি উন্নয়নে ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। ১৯৬৬ সালের ১৪ জুন সংসদীয় বিতর্কে আতাউর রহমান খান যে তথ্য তুলে ধরেন, তার সারমর্ম হলো, ১৯৬৪-৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ২৩ মিলিয়ন একর চাষযোগ্য জমিতে ৮ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানে ৬৫.৫৪ মিলিয়ন একর আবাদি জমিতে উৎপন্ন হয় ৬ লাখ টন খাদ্যশস্য। পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদন খরচ ছিল বেশি।
শোষণ-বঞ্চনার এই সংবাদগুলো যখন সংবাদপত্রে আসত, তখন বামপন্থী আন্দোলন খুবই জোরালো হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মধ্যে কেন জাতীয়তাবাদী ধারাই ছড়িয়ে পড়ল, তার একটা জবাব পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের পটভূমিতেই খুঁজে পাওয়া যাবে।
দেশের জনগণ যখন দেখেছে, একই দেশের অন্য প্রান্ত তাদের শোষণ করছে, তখন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই রুখে দাঁড়িয়েছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষের সামনে এগিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকা মানুষের বুকের আর্তির অনুবাদ করতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত, দেশের জনগণের মূল সংকটটি চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন তিনি। আর তাই শক্তিশালী আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধারক-বাহকদের পেছনে ফেলে সে সময় এগিয়ে গিয়েছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।
৫. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কর্মী। অন্য অনেক বিষয়ে ভাবলেও নিয়মতান্ত্রিক পথটিই ছিল তাঁর মূল চলার পথ। ইয়াহিয়া-ভুট্টো যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তাতে পাকিস্তানের শাসনভার বাঙালির হাতে দেওয়া হবে না, সেটা নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে মূলত পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার সূচনা করল পাকিস্তানি শাসকেরাই।
যে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হলো, সেই বাংলাদেশে মূল জনগোষ্ঠী বাঙালি। এখন কোনো ইংরেজ কিংবা কোনো পাঞ্জাবি এসে বাংলাকে শোষণ করে না। কিন্তু দেখা গেল, যে আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্ন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিরোহিত হলো। বঙ্গবন্ধু তাঁর চারপাশে পেলেন ‘চোরের খনি’। জিয়াউর রহমান রাজনীতিবিদদের অসৎ হওয়ার লাইসেন্স দিয়ে দিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছাত্রদেরও কলুষিত করলেন। হাস্যকর মসজিদ-রাজনীতি করার সময় একবারও তার মনে হয়নি, এই ধর্ম ব্যবসার বিরুদ্ধেই একদা এ দেশে সংগ্রাম হয়েছিল।
বহু আকাঙ্ক্ষিত ছিল এরশাদ-পরবর্তী গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশ। কিন্তু সেই গণতন্ত্রকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তো বাইরের শোষক নেই। তাহলে শোষণ করছে কারা? কারা দেশ থেকে টাকা পাচার করছে? কাদের কারণে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক? কারা সিন্ডিকেট করে কয়েক দিনের জন্য পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে কামিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা? এ রকম বহু প্রশ্ন জেগেছে সাধারণ মানুষের মনে।
শুধু রজনীতিক নন, সব প্রতিষ্ঠানে পচন ধরার দায় নিতে হবে সমাজে তথাকথিত অগ্রসর যে মানবগোষ্ঠী রয়েছে, তাদেরও। নিজেদের সুবিধা ছাড়া তারা এক পা-ও কি নড়েছে? সেই সুশীল সমাজ মাঝে মাঝে সোচ্চার হয় নানা বিষয়ে, তাদের বিষয়ে খোঁজ নিলেও দেখা যাবে, তারা মূলত সুবিধাভোগী শ্রেণি। কোনো কোনো গোলটেবিল অনুষ্ঠান হয় বিদেশি ফান্ড পেলে। বিদেশিরা চাইলে এ দেশে আর্সেনিক নিয়ে, অ্যাসিড নিয়ে, নারী অধিকার নিয়ে, মাদক নিয়ে কথা চলতে পারে। তারা না চাইলেই সুশীল সমাজ একেবারে সুশীল হয়ে ঘরের কোণে বসে থাকে।
বিরোধী দল কি এমন কোনো আগ্রহোদ্দীপক স্বপ্ন দেখিয়েছে, যার কারণে তাদের পক্ষেই ভোট দেবে সাধারণ মানুষ? এখন তো অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ক্ষমতার পরিবর্তনের অর্থ হলো, কারা দেশের সম্পদ লুটেপুটে খাবে তার একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া। এভাবে কত দূর এগোতে পারে একটা জাতি?
এই অবস্থায় ‘দেশের মালিক’, অর্থাৎ নিরীহ ভোটদাতারা বুঝতে পারছেন, দেশের মালিকানা স্বত্ব আসলে তাদের নয়, ওই লুটপাটকারী ব্যবসায়ীদের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে রাজনীতি। তারাই পরোক্ষভাবে দেশের মালিক।
সাধারণ মানুষ শুধু ভাবে, এখন তো বাঙালিরাই দেশ চালায়, তাহলে এত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আখের গোছানোর খেলা চলছে কেন? এগুলো থেকে বের হয়ে আসার জন্যই না আমরা ইংরেজ তাড়িয়েছিলাম, পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়েছিলাম?
বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের সন্ধান করছে না আর। তাই যুক্তরাষ্ট্র এসে ছড়ি ঘোরাতে পারছে। নিজের হাতেই নির্ভরতার চাবি থাকলে বাংলাদেশই তার সমাধান করতে পারত। বাইরের শক্তিদের বলতে পারত, অযথা নাক গলাবেন না। আমরাই আমাদের দায়িত্ব নিতে পারি।
সেই স্বপ্নটাও কিন্তু ছিল স্বাধিকার আন্দোলনের সময়। স্বপ্নটা কি মরীচিকায় পরিণত হওয়ার আগে আরেকবার ফিরিয়ে আনা যায় না?
আমাদের বর্তমান সংকটটা হচ্ছে গণতন্ত্রের। সেই গণতন্ত্রকে পোক্ত করার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটা শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ আসবে কি আসবে না, সেটা নাকি নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র যে একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ, সে কথা বহুবার বহুভাবে আমাদের জানিয়েছে কমিউনিস্টরা। যে পুঁজিবাদের ওপর ভর করে সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র মোড়লিপনা করে, সেই পুঁজিবাদ বাইরের বিশ্বের গণতন্ত্রকে গলা টিপে মেরেছে এবং মারছে—এমন নজির অনেক আছে।
তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তর সমালোচনা করা যায়। কিন্তু ভোটের অধিকার পাওয়া এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বসবাস করতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এ দেশের জনগণেরই। আমরা যে ভোটবিষয়ক জটিলতায় পড়ে গেছি, সেটা মিথ্যে নয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র কী চাইছে-না চাইছে, সে আলোচনায় না গিয়ে আমরা বরং বলতে পারি, জনগণ যেন নিজের ভোটটা দিতে পারে, তা নিশ্চিত করার কথাই রাজনীতিকদের এখন ভাবা উচিত।
২. এই বাঙালিই একসময় পাকিস্তান এনেছিল। তাদের মনে তখন মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তবে তারও আগে, ১৯০৫ সালে হিন্দু-মুসলমান সংকট প্রকট হয়ে দেখা গিয়েছিল। ১৯০৫ সালে যে হিন্দুরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের জয়গান গেয়েছিল, সেই হিন্দু সম্প্রদায়ই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছেড়ে হয়ে উঠেছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। মাত্র বছর চল্লিশের ব্যবধানে একেবারে অ্যাবাউট-টার্ন! হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অখণ্ড বাংলার স্বপ্নে কেবল যোগ দিয়েছিলেন আবুল হাশিম, শরৎ বসু, কিরণশংকর রায়। এ ছাড়া আর কাউকে কি আন্তরিকভাবে অখণ্ড বাংলার পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে? নেহরু-প্যাটেলের বিরোধিতা বাংলা বিভাগকে ত্বরান্বিত করেছিল।
তবে পাকিস্তান হওয়ার পর বাঙালিকে অতি দ্রুত বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, এই রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সমমর্যাদা দেবে না। পশ্চিমাদের মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, বাংলার মানুষ আশরাফ মুসলমান নয়, হিন্দু শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয় বলে তাদের খাঁটিত্ব নিয়েও প্রশ্ন ছিল তাদের মনে। আর ছিল তীব্র ঘৃণা। ঘৃণা না থাকলে ১৯৭১ সালে এসে এ রকম জেনোসাইড ঘটাতে পারে কেউ?
৩. ভাষার প্রশ্নে ধাক্কাটা ছিল প্রবল। জবাবটাও ছিল দাঁতভাঙা। ১৯৫২ সালে গুলি ছুড়ে নিজের পায়েই কুড়াল মারল পুলিশ। রবীন্দ্রনাথ ‘রথের রশি’তে লিখেছেন, ‘বাধা পেলে শক্তি নিজেকে নিজে চিনতে পারে, চিনতে পারলেই আর ঠেকানো যায় না।’ ওই বাধাই বাংলাকে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। যদিও ভাষা আন্দোলন ১৯৫৬ পর্যন্ত একই বেগে চলেনি, কিন্তু রাজনৈতিক নানা খেলার মধ্যে এই বছরটিতে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হয়। তত দিনে বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের সন্ধানে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বুঝতে শিখেছে, শুধু ধর্মীয় বন্ধন একটি জাতিকে মুক্তির ঠিকানা দিতে পারে না। বাঙালি, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান এত দিনে নিজের শিকড়ের দিকে তাকাল। আরব-ইরাক-তুর্কি-মোগলের বংশধর হিসেবে নিজের পরিচয় দেওয়া বন্ধ করে পায়ের নিচেই পেল ভিত্তিভূমি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হলো এ সময়।
৪. কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল একসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথকে ঠেকাতে অকথা-কুকথার বন্যা বইয়ে দিল ইসলাম-পসন্দ্ বুদ্ধিজীবীর দল। আর এই সময়েই ১৯৬১ সালে এল রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। সামরিক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হলো। এবং এরই মধ্যে বোঝা গেল, অলস বাঙালির রক্তে লেগেছে প্রলয়দোলা। নিজ পরিচয় নিয়ে যে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল বাঙালি। বাঙালির বিরুদ্ধে করা বঞ্চনাগুলো উঠে আসতে লাগল ওপরে। একটা ছোট হিসাব দেওয়া যাক।
উন্নয়ন পরিকল্পনায় শুরু থেকেই ছিল বৈষম্য। ১৯৪৮ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার প্রদেশ উন্নয়নের যে পরিকল্পনা করে, তা বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে ১৬ কোটি রুপি আর পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ কোটি রুপির বেশি ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। সম্পূরক তথ্য: ১৯৫২ সালে জাতীয় উন্নয়নের জন্য যে ১৮ কোটি রুপি ব্যয় ধরা হয়েছিল, তার মধ্যে মাত্র ৫ কোটি ৫০ লাখ রুপি ব্যয় হয় পূর্ব পাকিস্তানে। বাকি ১২ কোটি ৫০ লাখ রুপি ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
পূর্ব পাকিস্তানের শক্তি ছিল তার কৃষি। ১৯৫১ সালের ২৯ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশন পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৫৭ লাখ ৬২ হাজার ৪১৭ টাকা কম বরাদ্দ দেয়। তাতে কৃষি উন্নয়নে ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। ১৯৬৬ সালের ১৪ জুন সংসদীয় বিতর্কে আতাউর রহমান খান যে তথ্য তুলে ধরেন, তার সারমর্ম হলো, ১৯৬৪-৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ২৩ মিলিয়ন একর চাষযোগ্য জমিতে ৮ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানে ৬৫.৫৪ মিলিয়ন একর আবাদি জমিতে উৎপন্ন হয় ৬ লাখ টন খাদ্যশস্য। পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদন খরচ ছিল বেশি।
শোষণ-বঞ্চনার এই সংবাদগুলো যখন সংবাদপত্রে আসত, তখন বামপন্থী আন্দোলন খুবই জোরালো হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মধ্যে কেন জাতীয়তাবাদী ধারাই ছড়িয়ে পড়ল, তার একটা জবাব পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের পটভূমিতেই খুঁজে পাওয়া যাবে।
দেশের জনগণ যখন দেখেছে, একই দেশের অন্য প্রান্ত তাদের শোষণ করছে, তখন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই রুখে দাঁড়িয়েছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষের সামনে এগিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। দেয়ালে পিঠ ঠেকা মানুষের বুকের আর্তির অনুবাদ করতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত, দেশের জনগণের মূল সংকটটি চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন তিনি। আর তাই শক্তিশালী আন্তর্জাতিক রাজনীতির ধারক-বাহকদের পেছনে ফেলে সে সময় এগিয়ে গিয়েছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।
৫. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কর্মী। অন্য অনেক বিষয়ে ভাবলেও নিয়মতান্ত্রিক পথটিই ছিল তাঁর মূল চলার পথ। ইয়াহিয়া-ভুট্টো যে ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তাতে পাকিস্তানের শাসনভার বাঙালির হাতে দেওয়া হবে না, সেটা নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে মূলত পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার সূচনা করল পাকিস্তানি শাসকেরাই।
যে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হলো, সেই বাংলাদেশে মূল জনগোষ্ঠী বাঙালি। এখন কোনো ইংরেজ কিংবা কোনো পাঞ্জাবি এসে বাংলাকে শোষণ করে না। কিন্তু দেখা গেল, যে আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্ন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিরোহিত হলো। বঙ্গবন্ধু তাঁর চারপাশে পেলেন ‘চোরের খনি’। জিয়াউর রহমান রাজনীতিবিদদের অসৎ হওয়ার লাইসেন্স দিয়ে দিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছাত্রদেরও কলুষিত করলেন। হাস্যকর মসজিদ-রাজনীতি করার সময় একবারও তার মনে হয়নি, এই ধর্ম ব্যবসার বিরুদ্ধেই একদা এ দেশে সংগ্রাম হয়েছিল।
বহু আকাঙ্ক্ষিত ছিল এরশাদ-পরবর্তী গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশ। কিন্তু সেই গণতন্ত্রকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তো বাইরের শোষক নেই। তাহলে শোষণ করছে কারা? কারা দেশ থেকে টাকা পাচার করছে? কাদের কারণে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক? কারা সিন্ডিকেট করে কয়েক দিনের জন্য পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে কামিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা? এ রকম বহু প্রশ্ন জেগেছে সাধারণ মানুষের মনে।
শুধু রজনীতিক নন, সব প্রতিষ্ঠানে পচন ধরার দায় নিতে হবে সমাজে তথাকথিত অগ্রসর যে মানবগোষ্ঠী রয়েছে, তাদেরও। নিজেদের সুবিধা ছাড়া তারা এক পা-ও কি নড়েছে? সেই সুশীল সমাজ মাঝে মাঝে সোচ্চার হয় নানা বিষয়ে, তাদের বিষয়ে খোঁজ নিলেও দেখা যাবে, তারা মূলত সুবিধাভোগী শ্রেণি। কোনো কোনো গোলটেবিল অনুষ্ঠান হয় বিদেশি ফান্ড পেলে। বিদেশিরা চাইলে এ দেশে আর্সেনিক নিয়ে, অ্যাসিড নিয়ে, নারী অধিকার নিয়ে, মাদক নিয়ে কথা চলতে পারে। তারা না চাইলেই সুশীল সমাজ একেবারে সুশীল হয়ে ঘরের কোণে বসে থাকে।
বিরোধী দল কি এমন কোনো আগ্রহোদ্দীপক স্বপ্ন দেখিয়েছে, যার কারণে তাদের পক্ষেই ভোট দেবে সাধারণ মানুষ? এখন তো অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ক্ষমতার পরিবর্তনের অর্থ হলো, কারা দেশের সম্পদ লুটেপুটে খাবে তার একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া। এভাবে কত দূর এগোতে পারে একটা জাতি?
এই অবস্থায় ‘দেশের মালিক’, অর্থাৎ নিরীহ ভোটদাতারা বুঝতে পারছেন, দেশের মালিকানা স্বত্ব আসলে তাদের নয়, ওই লুটপাটকারী ব্যবসায়ীদের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে রাজনীতি। তারাই পরোক্ষভাবে দেশের মালিক।
সাধারণ মানুষ শুধু ভাবে, এখন তো বাঙালিরাই দেশ চালায়, তাহলে এত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আখের গোছানোর খেলা চলছে কেন? এগুলো থেকে বের হয়ে আসার জন্যই না আমরা ইংরেজ তাড়িয়েছিলাম, পাকিস্তানকে বিদায় জানিয়েছিলাম?
বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের সন্ধান করছে না আর। তাই যুক্তরাষ্ট্র এসে ছড়ি ঘোরাতে পারছে। নিজের হাতেই নির্ভরতার চাবি থাকলে বাংলাদেশই তার সমাধান করতে পারত। বাইরের শক্তিদের বলতে পারত, অযথা নাক গলাবেন না। আমরাই আমাদের দায়িত্ব নিতে পারি।
সেই স্বপ্নটাও কিন্তু ছিল স্বাধিকার আন্দোলনের সময়। স্বপ্নটা কি মরীচিকায় পরিণত হওয়ার আগে আরেকবার ফিরিয়ে আনা যায় না?
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে