মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
আধুনিক সব রাষ্ট্রেই স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী নেতাকে জাতির পিতা হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। জাতির পিতার জন্ম ও মৃত্যুর দিন জাতি বিশেষভাবে পালনও করে থাকে।আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রে এর ব্যত্যয় প্রায়ই ঘটে। এখনো আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল ও ব্যক্তি ছাড়া অন্যরা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করেন, এমনটি দেখা যায় না, বরং ক্ষমতায় গেলে তারা বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে নানা তাচ্ছিল্য করেন। এমন দ্বিচারিতার নজির স্বাধীন কোনো রাষ্ট্রে দেখা যায় না। অথচ বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এ দেশ কখনো স্বাধীন হতো কি না, কাউকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো পাওয়া যেত কি না, সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর তাঁরা কেউ দিতে পারেন না। কিন্তু তাঁরা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার ইত্যাদি নিয়ে এখন কত কথাই না বলেন। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের আন্দোলন, সংগ্রাম ও নেতৃত্ব প্রদান ছাড়া স্বাধীন রাষ্ট্রলাভের কথা কল্পনাই করা যেত না। বঙ্গবন্ধুসহ নেতারা দেশকে স্বাধীন করার জন্য কেবলই নিজেদের উৎসর্গই করে গেছেন, কিছু পাওয়ার আশা তাঁরা করেননি। বঙ্গবন্ধু একবারের জন্যও তাঁর জন্মদিন পালনের আকাঙ্ক্ষা মনে মনে পোষণও করেননি।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রদানের পর বন্দী অবস্থায় তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় ১৯৬৭ সালে তিনি লেখেন, ‘এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কখনো নিজে পালন করি নাই—বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটাতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম, ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয় আমি জেলে বন্দী আছি বলেই। আমি একজন মানুষ আর আমার আবার জন্মদিন! দেখে হাসলাম। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম-আমার কাছে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে আমার ঘরে উপস্থিত। আমাকে বলল, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার একটা রক্তগোলাপ এবং বাবু সুধাংশু বিমল দত্তও একটি শাদা গোলাপ এবং ডিপিআর বন্দী এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন।’ বিকাল ৫টার সময় ঠিকই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত মানুষজন কেক ও ফুল হাতে জেলগেটে হাজির হলেন। তাঁরা হলেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ও সন্তানেরা, বিশেষত কনিষ্ঠ সন্তান রাসেল। বঙ্গবন্ধু লিখলেন, ‘দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেলগেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো।’
এরপরের জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ঢাকার সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামিরূপে। সেখানে জন্মদিন পালন কল্পনা করাও দুরাশার বিষয় ছিল। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের ফলে তিনি মুক্ত হলেন ২২ ফেব্রুয়ারি। বাঙালির বিজয়ী নেতা হিসেবে সে বছরের জন্মদিনে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। তারপরও পরিবারের সদস্য ও নেতা-কর্মীরা তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ভুল করেননি।
১৯৭০ সালে তাঁর জন্মের ৫০ বছর পূর্তি হলেও সেটিতেও তিনি ছিলেন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। পারিবারিক এবং দলীয়ভাবে তাঁকে কেক কেটে শুভেচ্ছা জানানোর বাইরে সময় দেওয়ার সুযোগ তাঁর কমই ছিল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপহারটি তিনি পেয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ তারিখে। সেই উপহারের কথা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। সেদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আবুল খায়ের এমএনএ ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণটি অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের অনুলিপি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হাজির হন। তিনি এর একটি কপি উপহার দিলে বঙ্গবন্ধু অভিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই এত বড় কাজ কীভাবে করলি?’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তখন তরুণ আরেক এমএনএ তোফায়েল আহমেদ ছিলেন। তিনি খায়ের সাহেবের উদ্দেশে বললেন, ‘খায়ের ভাই, এই রেকর্ড বিক্রি করলে অনেক টাকা পাবেন, এর রয়্যালটি তো আওয়ামী লীগও পেতে পারে।’ বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ ভাষায় মজা করে বললেন, ‘গলা আমার, ভাষণ আমার, রয়্যালটি পেলে তো আমাকেই দিতে হবে।’
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতা। সেদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেদিন ছুটি ভোগ করার বা জন্মদিন পালন করার সামান্যতম সুযোগ ছিল না। সে বছর ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জন্মদিন হিসেবে এটি পালিত হওয়ার কথা বেশ আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেটি হয়নি। সেদিন জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা পালিত হয়েছে অনাড়ম্বর আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এর কারণ ছিল, বঙ্গবন্ধু নিজে তা হতে দেননি। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সেদিনই উপস্থিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানকারী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ফলে দিনটি ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যেই কাটাতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। তবে সেদিন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ৫৫ কোটি ভারতবাসীর পক্ষ থেকে ফলমূল ও মিষ্টান্ন উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আয়োজনকে দিয়েছিলেন ভিন্ন মাত্রা। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনী সেদিনই দেশে প্রত্যাবর্তন করার আয়োজনটিতেও বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী উপস্থিত ছিলেন।
বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৩তম জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৫৫তম জন্মবার্ষিকী। সেটিই তাঁর দেখে যাওয়া শেষ জন্মদিন। এই দিন নেতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য তাঁর বাসভবন অভিমুখে ছিল জনতার স্রোত। বেলা ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু সমবেত সবার উদ্দেশে বলেন, ‘আমার জন্মদিনে আমি ছুটি ঘোষণা করিনি। তাই আজ আমি অফিসে যাব, অল্পক্ষণের জন্য হলেও অফিসের কাজ করব।’ উপস্থিত সবাইকে তিনি নিজ নিজ অফিসে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন। তাঁর জন্মদিন এবং ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছর পালন করার কোনো অনুকূল সুযোগ ছিল না। জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনকালে এই দিবসগুলো পালনে ছিল নানা ধরনের সরকারি বাধা। অথচ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর জন্মদিন পালনই শুধু নয়, তাঁর নাম উচ্চারণেও বাধানিষেধ জারি করে রাখা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং ১৫ আগস্ট পালন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, কাঙালিভোজের আয়োজনে হামলা, ভাঙচুর এবং লেলিয়ে দেওয়া হতো গুন্ডা বাহিনী।
পাঠ্যপুস্তক থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৩ জুন সরকার গঠিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ বেতার ও টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ এই প্রথম বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দৃশ্য ভিডিওতে অবলোকন করার সুযোগ পেল। এত দিন তাদের বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক মিথ্যা, বানোয়াট গল্প রাজনীতির মঞ্চ ও অপপ্রচারের মাঠে শোনানো হয়েছিল। অনেকে তা বিশ্বাসও করেছিল। একটি প্রজন্ম সেই মিথ্যাচারে বিশ্বাস করে বেড়ে উঠেছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে কত বড় নেতা ছিলেন, তিনি না থাকলে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হতো না, আমরাও নিজেদের স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে পারতাম না, আজকের বড় বড় অবস্থানে যাওয়ার সুযোগও পেতাম না—এই সত্য ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ’৯৬-পরবর্তী সময় থেকে ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় আমাদের জীবনে আবার ফিরে এলেন।
বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, অসংখ্য অডিও, ভিডিও ও দলিলপত্রও প্রকাশিত হয়েছে, আরও হওয়ার অপেক্ষায় আছে। শত বছরে মুজিব আমাদের জাতীয় জীবনে নতুনভাবে পুনর্জাগরণের স্পন্দন যেন এনে দিলেন। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ তাঁকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখবে সোনার বাংলা হয়ে ওঠার।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
আধুনিক সব রাষ্ট্রেই স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী নেতাকে জাতির পিতা হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। জাতির পিতার জন্ম ও মৃত্যুর দিন জাতি বিশেষভাবে পালনও করে থাকে।আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রে এর ব্যত্যয় প্রায়ই ঘটে। এখনো আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল ও ব্যক্তি ছাড়া অন্যরা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করেন, এমনটি দেখা যায় না, বরং ক্ষমতায় গেলে তারা বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে নানা তাচ্ছিল্য করেন। এমন দ্বিচারিতার নজির স্বাধীন কোনো রাষ্ট্রে দেখা যায় না। অথচ বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এ দেশ কখনো স্বাধীন হতো কি না, কাউকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো পাওয়া যেত কি না, সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর তাঁরা কেউ দিতে পারেন না। কিন্তু তাঁরা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার ইত্যাদি নিয়ে এখন কত কথাই না বলেন। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের আন্দোলন, সংগ্রাম ও নেতৃত্ব প্রদান ছাড়া স্বাধীন রাষ্ট্রলাভের কথা কল্পনাই করা যেত না। বঙ্গবন্ধুসহ নেতারা দেশকে স্বাধীন করার জন্য কেবলই নিজেদের উৎসর্গই করে গেছেন, কিছু পাওয়ার আশা তাঁরা করেননি। বঙ্গবন্ধু একবারের জন্যও তাঁর জন্মদিন পালনের আকাঙ্ক্ষা মনে মনে পোষণও করেননি।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রদানের পর বন্দী অবস্থায় তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে ‘কারাগারের রোজনামচা’য় ১৯৬৭ সালে তিনি লেখেন, ‘এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কখনো নিজে পালন করি নাই—বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটাতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম, ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয় আমি জেলে বন্দী আছি বলেই। আমি একজন মানুষ আর আমার আবার জন্মদিন! দেখে হাসলাম। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম-আমার কাছে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে আমার ঘরে উপস্থিত। আমাকে বলল, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার একটা রক্তগোলাপ এবং বাবু সুধাংশু বিমল দত্তও একটি শাদা গোলাপ এবং ডিপিআর বন্দী এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন।’ বিকাল ৫টার সময় ঠিকই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত মানুষজন কেক ও ফুল হাতে জেলগেটে হাজির হলেন। তাঁরা হলেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ও সন্তানেরা, বিশেষত কনিষ্ঠ সন্তান রাসেল। বঙ্গবন্ধু লিখলেন, ‘দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেলগেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো।’
এরপরের জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ঢাকার সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামিরূপে। সেখানে জন্মদিন পালন কল্পনা করাও দুরাশার বিষয় ছিল। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের ফলে তিনি মুক্ত হলেন ২২ ফেব্রুয়ারি। বাঙালির বিজয়ী নেতা হিসেবে সে বছরের জন্মদিনে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। তারপরও পরিবারের সদস্য ও নেতা-কর্মীরা তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ভুল করেননি।
১৯৭০ সালে তাঁর জন্মের ৫০ বছর পূর্তি হলেও সেটিতেও তিনি ছিলেন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। পারিবারিক এবং দলীয়ভাবে তাঁকে কেক কেটে শুভেচ্ছা জানানোর বাইরে সময় দেওয়ার সুযোগ তাঁর কমই ছিল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপহারটি তিনি পেয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ তারিখে। সেই উপহারের কথা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। সেদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আবুল খায়ের এমএনএ ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণটি অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের অনুলিপি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হাজির হন। তিনি এর একটি কপি উপহার দিলে বঙ্গবন্ধু অভিভূত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই এত বড় কাজ কীভাবে করলি?’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তখন তরুণ আরেক এমএনএ তোফায়েল আহমেদ ছিলেন। তিনি খায়ের সাহেবের উদ্দেশে বললেন, ‘খায়ের ভাই, এই রেকর্ড বিক্রি করলে অনেক টাকা পাবেন, এর রয়্যালটি তো আওয়ামী লীগও পেতে পারে।’ বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ ভাষায় মজা করে বললেন, ‘গলা আমার, ভাষণ আমার, রয়্যালটি পেলে তো আমাকেই দিতে হবে।’
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতা। সেদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেদিন ছুটি ভোগ করার বা জন্মদিন পালন করার সামান্যতম সুযোগ ছিল না। সে বছর ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জন্মদিন হিসেবে এটি পালিত হওয়ার কথা বেশ আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেটি হয়নি। সেদিন জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা পালিত হয়েছে অনাড়ম্বর আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এর কারণ ছিল, বঙ্গবন্ধু নিজে তা হতে দেননি। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সেদিনই উপস্থিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানকারী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ফলে দিনটি ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যেই কাটাতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। তবে সেদিন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ৫৫ কোটি ভারতবাসীর পক্ষ থেকে ফলমূল ও মিষ্টান্ন উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আয়োজনকে দিয়েছিলেন ভিন্ন মাত্রা। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনী সেদিনই দেশে প্রত্যাবর্তন করার আয়োজনটিতেও বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী উপস্থিত ছিলেন।
বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৩তম জন্মদিন উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৫৫তম জন্মবার্ষিকী। সেটিই তাঁর দেখে যাওয়া শেষ জন্মদিন। এই দিন নেতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য তাঁর বাসভবন অভিমুখে ছিল জনতার স্রোত। বেলা ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু সমবেত সবার উদ্দেশে বলেন, ‘আমার জন্মদিনে আমি ছুটি ঘোষণা করিনি। তাই আজ আমি অফিসে যাব, অল্পক্ষণের জন্য হলেও অফিসের কাজ করব।’ উপস্থিত সবাইকে তিনি নিজ নিজ অফিসে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন। তাঁর জন্মদিন এবং ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ২০ বছর পালন করার কোনো অনুকূল সুযোগ ছিল না। জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনকালে এই দিবসগুলো পালনে ছিল নানা ধরনের সরকারি বাধা। অথচ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর জন্মদিন পালনই শুধু নয়, তাঁর নাম উচ্চারণেও বাধানিষেধ জারি করে রাখা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং ১৫ আগস্ট পালন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, কাঙালিভোজের আয়োজনে হামলা, ভাঙচুর এবং লেলিয়ে দেওয়া হতো গুন্ডা বাহিনী।
পাঠ্যপুস্তক থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৩ জুন সরকার গঠিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ বেতার ও টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ এই প্রথম বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দৃশ্য ভিডিওতে অবলোকন করার সুযোগ পেল। এত দিন তাদের বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক মিথ্যা, বানোয়াট গল্প রাজনীতির মঞ্চ ও অপপ্রচারের মাঠে শোনানো হয়েছিল। অনেকে তা বিশ্বাসও করেছিল। একটি প্রজন্ম সেই মিথ্যাচারে বিশ্বাস করে বেড়ে উঠেছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে কত বড় নেতা ছিলেন, তিনি না থাকলে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হতো না, আমরাও নিজেদের স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে পারতাম না, আজকের বড় বড় অবস্থানে যাওয়ার সুযোগও পেতাম না—এই সত্য ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ’৯৬-পরবর্তী সময় থেকে ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় আমাদের জীবনে আবার ফিরে এলেন।
বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, অসংখ্য অডিও, ভিডিও ও দলিলপত্রও প্রকাশিত হয়েছে, আরও হওয়ার অপেক্ষায় আছে। শত বছরে মুজিব আমাদের জাতীয় জীবনে নতুনভাবে পুনর্জাগরণের স্পন্দন যেন এনে দিলেন। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ তাঁকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখবে সোনার বাংলা হয়ে ওঠার।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে