অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার মধ্য দিয়েই শেষ হলো ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চতুর্থ ধাপের ভোট গ্রহণ। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নে ভোট গ্রহণ শেষে সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমন্তাজ ইউনিয়নে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন একজন। এ ছাড়া সারা দেশে সংঘর্ষে পুলিশ, নারীসহ আহত হয়েছে শতাধিক।

এই নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে সিল মারা, ব্যালট ছিনতাই, জাল ভোট এবং পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কয়েক জায়গায় সাময়িক ও স্থায়ীভাবে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা গেছে কোনো কোনো জায়গায়।

তবে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেন, ‘চতুর্থ ধাপে ৮৩৬ ইউনিয়ন পরিষদে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ হয়েছে। দিনভর ভোটকেন্দ্রে জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল।’ ইসি সচিবের দেওয়া তথ্যমতে, ভোট গ্রহণকালে সংঘর্ষে ২৯ জন আহত হয়েছেন। এতে প্রার্থীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে ৬৩ জনকে আটক করেছে পুলিশ।

নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ভোটের দাবি করলেও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে

আমাদের প্রতিনিধিরা জানান, সকাল থেকেই ভোটকেন্দ্রে নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটে। ব্যালট ছিনতাই, প্রকাশ্যে সিল মারার অভিযোগ এনে কয়েক জায়গায় প্রার্থীরা ভোট বর্জনও করেছেন।

নির্বাচন ঘিরে প্রায় সব ইউনিয়নে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে পুলিশ, নারীসহ আহত হয়েছেন শতাধিক। কয়েকটি কেন্দ্রে জালিয়াতির অভিযোগে ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখা হয়।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নে ভোট গ্রহণ শেষে সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন। ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, রাজাগাঁও ইউনিয়নের ভোট গ্রহণ শেষে ব্যালট পেপার ভর্তি বাক্স নিয়ে নির্বাচন কাজে সংশ্লিষ্টরা ইউএনও অফিসে আসার সময় লোকজন রাস্তা অবরোধ করে। উত্তপ্ত জনতাকে নিবৃত্ত করতে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে শটগানের গুলিতে একজন ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান।

এদিকে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমন্তাজ ইউনিয়নে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবদুল খালেক নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যার পর ওই ইউনিয়নের নয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে ওই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন। তবে কার গুলিতে তিনি নিহত হয়েছেন সে বিষয়ে দায়িত্বশীল কোন পক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

গতকাল দুপুরে ভোট চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৫ জন। এ ঘটনায় ২ জনকে আটক করেছে পুলিশ। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রূপবাটি ইউনিয়নে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ৩ জন আহত হয়েছেন। অপরদিকে, জালালপুর ইউনিয়নের একটি কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ছিনতাই হয়ে যায়। হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৭ জন আহত হয়েছেন।

গতকাল বিকেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের গোহালবাড়ি ইউনিয়নে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ১০ জন। দুই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পার্বতীনগর, মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, ভবানীগঞ্জ, চররমণী মোহন ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভোটকেন্দ্রে চেয়ারম্যান প্রার্থী ও ইউপি সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে পুলিশসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন।

মাদারীপুরের শিবচরে জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগে এক যুবককে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। আরেকটি কেন্দ্র থেকে একজনকে আটক করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মনিয়ন্দ ইউনিয়নে ভোট চলাকালে এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর এজেন্টের কাছে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের নাম লেখা টাকার খাম উদ্ধার করা হয়েছে। ওই কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার অলোক কুমার চক্রবর্তীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ওই এজেন্টকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলার বিজয়নগরে পত্তন ইউনিয়নের একটি কেন্দ্র থেকে ৩৪ হাজার টাকাসহ একজনকে আটক করে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বুড়াবুড়ী ও দুর্গাপুর ইউনিয়নে কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টাকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হওয়ায় ছয়টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত থাকলেও পরে আবারও শুরু হয়। চুয়াডাঙ্গায় আলুকদিয়া ইউনিয়নে ভোটকেন্দ্রের সামনে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর দুই কর্মীকে কুপিয়ে জখমের অভিযোগ উঠেছে নৌকার প্রার্থীর কর্মীদের বিরুদ্ধে।

গতকাল রাজশাহীর বাঘার বাউসা ইউনিয়নে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন। রাজশাহীর দুর্গাপুরে দেলুয়াবাড়ী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৫ জন আহত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অভিযোগে পুলিশ বিভিন্ন এলাকা থেকে ২১ জনকে আটক করেছে। নোয়াখালীর সদর ও কবিরহাটের ১৬টি ইউনিয়নে পৃথক সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন।