চিররঞ্জন সরকার
জ্ঞানীরা বলে এসেছেন, সব দুঃখ ও অশান্তির মূলে আকাঙ্ক্ষা; শান্তি পেতে হলে আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করো। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, বিষয়াসক্তি ত্যাগ করে শুধু আমাকে পেতে চাও। রামকৃষ্ণ বলছেন, কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করো, ও দুটো বিষবৎ, জীবন নরক করে দেয়।
বুদ্ধ বলছেন, আকাঙ্ক্ষাই সব দুঃখের কারণ। বুদ্ধ তো শুধু ওটুকু বলেই থামেননি। তিনি বলছেন, জন্মও হয় জন্মানোর তৃষ্ণা থেকে। ওই তৃষ্ণাটাও ত্যাগ করো, যাতে জন্মে দুঃখ না পেতে হয়। এ সব মহাজ্ঞানীদের কথা এবং অবশ্যই শিরোধার্য, কারণ অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা এ আমাদের কী বিষম দুঃখ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেটা আমরা সবাই কমবেশি জানি। আর এ জন্যই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জ্ঞানীদের এত সাবধানবাণী।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি পাওয়া কি সম্ভব? বুদ্ধ জন্মানোর আকাঙ্ক্ষাকেই জয় করতে বলছেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, চাওয়ার বাসনা থেকে মায়ের কোলে খেলতে থাকা শিশুও মুক্ত নয়। ওর বন্ধ মুঠো খুলে একটা কিছু ধরিয়ে ওটা ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করুন, সে সহজে মুঠো খোলে না। যখন একটু বড় হয় এবং আঙুলগুলো ফুলের পাপড়ির মতো প্রস্ফুটিত হয়, তখন ওর হাতের একমাত্র কাজ আঙুল দেখিয়ে দেখিয়ে বস্তু চাওয়া। এটা দাও, ওটা দাও। এভাবে কত-কী চাইতে চাইতে সে বড় হয়, প্রাণধারণ করে, নানা কর্মযজ্ঞে সারা জীবন নিজেকে ব্যস্ত রাখে, বৃদ্ধ হয় এবং মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়। তখনো চাওয়া থেকে তার মুক্তি নেই।
সে তখন চায়, চিকিৎসাটা যেন তার ভালো হয়। মরতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু কষ্টটা যেন কম হয়। ছোট ছেলেটা এখনো কিছু করতে পারল না, ওর যেন একটা রোজগারের বন্দোবস্ত হয়। নাতনিটার যেন ভালো বিয়ে হয়। বড় ছেলে ঢাকায় থাকে। মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সে যেন বাড়ি আসে। কবরে যেন একটু মাটি দিতে পারে। বাজারের পাশের জমিটা বেদখল হয়ে যাবে মনে হয়। কিন্তু জমিটা উদ্ধারের ব্যাপারে কিংবা বিক্রি করে দেওয়ার ব্যাপারে একটা কিছু করা আর হয়ে উঠল না!
এই সবের কি কোনো অন্ত আছে? মানুষের চাওয়ার কি কোনো শেষ আছে? শৈশব থেকে যে তৃষ্ণার শুরু, সেটা চলতে থাকে সারা জীবন। শেষ হয় হয়তো কবরে কিংবা চিতার আগুনে। হিন্দুধর্মশাস্ত্র বলে তখনো শেষ হয় না। অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সবাই মারা যায়। এর ফলেই আবার জন্মগ্রহণ করে, অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাকে আবার পূর্ণ করার অভিলাষে। যা মজার, বিভিন্ন বয়সে মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রকৃতিও বিভিন্ন রকম। এটা পশুজগতে নেই। একটা সিংহ শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত মোটামুটি একই রকম আকাঙ্ক্ষায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে।
সেটা হলো—আহার, নিদ্রা, মৈথুন। আফ্রিকার আদিগন্ত প্রসারিত চারণভূমিতে হঠাৎ আকাশে ঘন কালো মেঘ ঘনিয়ে এলে সে সামনে চরতে থাকা হরিণদের কথা ভুলে কখনোই ভাববে না এইমুহূর্তে একটা রামধনু ফুটে উঠুক গোটা আকাশজুড়ে। সে শুধু ওটাই একটু দেখবে বলে ব্যাকুল। হরিণ চাই না, যুবতী সিংহী চাই না, কিছু চাই না, আকাশজুড়ে শুধু একটা রামধনুর অলৌকিক বর্ণচ্ছটা দেখতে চাই—একটা সিংহ কখনো এ রকম আকাঙ্ক্ষায় পীড়িত হবে না।
কিন্তু একটা মানুষ পীড়িত হতেই পারে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা অসংখ্য, বিচিত্র। তার জীবনে শৈশবে এক রকম আকাঙ্ক্ষা, কৈশোরে আরেক রকম, যৌবনে অন্য রকম, আর বার্ধক্যে আবার আরও অন্য রকম। অজস্র, বিচিত্র, সীমাহীন, বিস্ময়কর সব আকাঙ্ক্ষার উদ্দাম ঢেউয়ে সারা জীবন আছাড় খাওয়া থেকে তার মুক্তি নেই। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টাই সে কিছু পেতে চায়। কারণ, যখন ঘুমাতে যায়, তখনো লোকে বলে, ভালো ঘুমাও। ঘুমে যেন সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখো; অর্থাৎ সুখের স্বপ্ন দেখো। আনন্দের স্বপ্ন দেখো। পূর্ণতার স্বপ্ন দেখো।
বাস্তবে যা পাওনি, স্বপ্নে যেন সেটা পাও। বাস্তবের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা যেন স্বপ্নে অন্তত মেটে। স্বপ্নে যেন দুষ্প্রাপ্য মেয়েটির হাত ধরে দূরপাল্লার কোনো ট্রেনের জানালার ধারে বসতে পারো। স্বপ্নে যেন আইডিবি ভবনের ১২তলার অফিসটায় উঠে সাধের চাকরিটায় জয়েন করতে পারো। স্বপ্নে যেন শ্রীলঙ্কা কিংবা মালদ্বীপের নির্জন সৈকতে বেড়াতে পারো। লটারিতে প্রথম পুরস্কারটা যেন জিতে নিতে পারো। অনেক দিন ধরেই যে আই ফোনটা কিনি কিনি বলেও কিনতে পারোনি, সেটা যেন কিনে নিতে পারো।
আমরা যাদের সাধারণ মানুষ বলি, তারা কি এমন চায় নিজেদের জীবনে? একজন সাধারণ পিতা? বা করুণাময়ী মাতা? একজন সাধারণ সন্তান? কিন্তু সেটাও শেষ পর্যন্ত কজনের জীবনে মেটে? কজন প্রেমিক বা প্রেমিকা শেষ পর্যন্ত প্রেমে সফল হয়ে হাসতে হাসতে কক্সবাজারে হানিমুনে যায়? কজন কবি সারা রাত ধরে ভাবতে ভাবতে একটা মনের মতো বাক্প্রতিমা নির্মাণ করে এবং ভোরে সেটাকে না কেটে প্রফুল্লচিত্তে ঘুমোতে যায়? দরজার চৌকাঠে দুরু দুরু বুকে দাঁড়িয়ে থাকা কজন মাকে তার ছেলে বা মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলে, ক্লাসে সে ফার্স্ট হয়েছে? তার মানে এই নয় যে স্বপ্নপূরণ ঘটেছে ধনী বা আপাতদৃষ্টিতে সফল যারা তাদের ক্ষেত্রে।
তাদেরও হতাশা, ব্যর্থতার নিজস্ব জ্বালা আছে। চাওয়া ও পাওয়ার হিসাব তাদের ক্ষেত্রেও মেলে না। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তাদেরও থাকে এবং এই বেদনা একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যতটা অনুভূত হয়, একজন ধনী, প্রতাপশালী ব্যক্তির ক্ষেত্রেও ততটাই। তফাতটা হলো লক্ষ্যবস্তুর ভিন্নতা নিয়ে, অনুভূতির তীব্রতা নিয়ে নয়। একজন ছোট ব্যবসায়ী বছরে আরও ১০ হাজার টাকা আয় না করতে পারলে হয়তো আশাহত ও বিমর্ষ হয়। একজন ধনী ব্যবসায়ী ততটাই আশাহত ও বিমর্ষ হয় মাসে আরও ১ কোটি টাকা আয় না করতে পারলে। স্বপ্নভঙ্গের যে চাপ ও জ্বালা, সেটা দুজনের শরীর-মনেই প্রায় সমান। দুজনেই কষ্ট পায়। দুঃখ মাপার যদি কোনো যন্ত্র থাকত, তবে দেখতাম ওই যন্ত্র দুজনের দুঃখ প্রায় একই মাত্রায় দেখাচ্ছে।
মানুষ আসলে এক আশ্চর্য প্রাণী! বাসে উঠে ধাক্কা দেওয়ার জন্য যে লোকটার সঙ্গে ঝগড়া করলাম, বাস থেকে নামার পর তার কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যায়। ভাবি, ঝগড়াটা না করলেই হতো। সে তো ইচ্ছে করে ধাক্কাটা দেয়নি। আর তাতে আমার বড় কোনো ক্ষতিও হয়নি।
তাহলে কেন লোকটার সঙ্গে আমি খারাপ আচরণ করলাম? সেকি যানজটে বসে থেকে মেজাজ খিঁচড়ে ছিল বলে? ওই লোকটিরও তো একই কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে মন-মেজাজ খারাপ থাকতে পারে। তাই হয়তো একটু জোর খাটিয়ে নামতে চেয়েছিল! তাই বলে আমি তার সঙ্গে ঝগড়া করে বসলাম? বাস থেকে নামার পর লোকটার জন্য মন খারাপ করতে লাগল। নিজের জন্যও। আর ভাবতে লাগলাম কী ছোট ছোট কামনার দাস আমরা সবাই! কামনার কাছে আমরা কেমন অসহায়! ছোট-বড় কত কামনা মনের ভেতর কাজ করে দিন-রাত! সারা জীবন!
নতুন কেনা জুতায় কাদার ছিটে লাগলে কষ্ট পাই। বিভিন্ন দোকানের শো-কেসে সাজানো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ঘড়ির দিকে মাঝে মাঝে তাকাই, যা এত দামি যে কখনোই কিনতে পারব না। গ্র্যান্ড হোটেলে ডিনার করতে কেমন লাগে, সেটা জীবনে অন্তত এক দিনের জন্যও কখনো জানা হবে না। বসন্তের দুরন্ত হাওয়ায় কোকিলের ডাক শুনতে শুনতে বঙ্গভবনে দিবানিদ্রা করতে কেমন লাগে, সেটাও যদি জীবনে অন্তত এক দিনের জন্যও জানার সুযোগ ঘটত! অটোগ্রাফ দিতে কেমন লাগে যদি জানতে পারতাম। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার গোটা সেটটা রাখার মতো যদি একটা বড় বুক সেলফ থাকত বাড়িতে।
পেঙ্গুইন প্রকাশনা থেকে যদি আমার একটা বই ছাপা হতো। আমার একসময়ের সুপারভাইজার লোকটা যে শুধু শুধু আমাকে পীড়া দিত, তার গালে যদি কখনো প্রকাশ্যে একটা চড় কষে আসতে পারতাম। অনন্ত রূপময়ী শেরন স্টোন, যে বেচারি এখন প্রায় বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছে, অথচ যে ছিল আমার স্বপ্নের নায়িকা, তার সঙ্গে যদি সেন্ট মার্টিন বিচে একটু নিভৃতে গল্প করতে পারতাম। ধানমন্ডি লেকের ধারে আমার যদি একটা বাড়ি থাকত! পিকাসোর আঁকা একটি অরিজিনাল ছবি যদি আমিও আমার বাড়ির দেয়ালে ঝোলাতে পারতাম।
আমি জানি, আমার এই সব সাধের কোনোটাই কখনো পূর্ণ হবে না। আমাদের সবারই অধিকাংশ সাধ ম্যাচের কাঠির মতো দপ করে জ্বলে আবার নিভে যায়। চারপাশে হাঁটতে থাকা, ছুটতে থাকা, গাড়িতে বসে থাকা মানুষদের যদি জিজ্ঞেস করি, জীবনের কোন কোন সাধ পূর্ণ হলো, আমি নিশ্চিত বেশির ভাগই আমার দিকে ছলছল হাসিতে চোখ ভরে শুধু তাকিয়ে থাকবে একটানা।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
জ্ঞানীরা বলে এসেছেন, সব দুঃখ ও অশান্তির মূলে আকাঙ্ক্ষা; শান্তি পেতে হলে আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করো। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, বিষয়াসক্তি ত্যাগ করে শুধু আমাকে পেতে চাও। রামকৃষ্ণ বলছেন, কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করো, ও দুটো বিষবৎ, জীবন নরক করে দেয়।
বুদ্ধ বলছেন, আকাঙ্ক্ষাই সব দুঃখের কারণ। বুদ্ধ তো শুধু ওটুকু বলেই থামেননি। তিনি বলছেন, জন্মও হয় জন্মানোর তৃষ্ণা থেকে। ওই তৃষ্ণাটাও ত্যাগ করো, যাতে জন্মে দুঃখ না পেতে হয়। এ সব মহাজ্ঞানীদের কথা এবং অবশ্যই শিরোধার্য, কারণ অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা এ আমাদের কী বিষম দুঃখ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেটা আমরা সবাই কমবেশি জানি। আর এ জন্যই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জ্ঞানীদের এত সাবধানবাণী।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি পাওয়া কি সম্ভব? বুদ্ধ জন্মানোর আকাঙ্ক্ষাকেই জয় করতে বলছেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, চাওয়ার বাসনা থেকে মায়ের কোলে খেলতে থাকা শিশুও মুক্ত নয়। ওর বন্ধ মুঠো খুলে একটা কিছু ধরিয়ে ওটা ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করুন, সে সহজে মুঠো খোলে না। যখন একটু বড় হয় এবং আঙুলগুলো ফুলের পাপড়ির মতো প্রস্ফুটিত হয়, তখন ওর হাতের একমাত্র কাজ আঙুল দেখিয়ে দেখিয়ে বস্তু চাওয়া। এটা দাও, ওটা দাও। এভাবে কত-কী চাইতে চাইতে সে বড় হয়, প্রাণধারণ করে, নানা কর্মযজ্ঞে সারা জীবন নিজেকে ব্যস্ত রাখে, বৃদ্ধ হয় এবং মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়। তখনো চাওয়া থেকে তার মুক্তি নেই।
সে তখন চায়, চিকিৎসাটা যেন তার ভালো হয়। মরতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু কষ্টটা যেন কম হয়। ছোট ছেলেটা এখনো কিছু করতে পারল না, ওর যেন একটা রোজগারের বন্দোবস্ত হয়। নাতনিটার যেন ভালো বিয়ে হয়। বড় ছেলে ঢাকায় থাকে। মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সে যেন বাড়ি আসে। কবরে যেন একটু মাটি দিতে পারে। বাজারের পাশের জমিটা বেদখল হয়ে যাবে মনে হয়। কিন্তু জমিটা উদ্ধারের ব্যাপারে কিংবা বিক্রি করে দেওয়ার ব্যাপারে একটা কিছু করা আর হয়ে উঠল না!
এই সবের কি কোনো অন্ত আছে? মানুষের চাওয়ার কি কোনো শেষ আছে? শৈশব থেকে যে তৃষ্ণার শুরু, সেটা চলতে থাকে সারা জীবন। শেষ হয় হয়তো কবরে কিংবা চিতার আগুনে। হিন্দুধর্মশাস্ত্র বলে তখনো শেষ হয় না। অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়েই সবাই মারা যায়। এর ফলেই আবার জন্মগ্রহণ করে, অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাকে আবার পূর্ণ করার অভিলাষে। যা মজার, বিভিন্ন বয়সে মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রকৃতিও বিভিন্ন রকম। এটা পশুজগতে নেই। একটা সিংহ শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত মোটামুটি একই রকম আকাঙ্ক্ষায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে।
সেটা হলো—আহার, নিদ্রা, মৈথুন। আফ্রিকার আদিগন্ত প্রসারিত চারণভূমিতে হঠাৎ আকাশে ঘন কালো মেঘ ঘনিয়ে এলে সে সামনে চরতে থাকা হরিণদের কথা ভুলে কখনোই ভাববে না এইমুহূর্তে একটা রামধনু ফুটে উঠুক গোটা আকাশজুড়ে। সে শুধু ওটাই একটু দেখবে বলে ব্যাকুল। হরিণ চাই না, যুবতী সিংহী চাই না, কিছু চাই না, আকাশজুড়ে শুধু একটা রামধনুর অলৌকিক বর্ণচ্ছটা দেখতে চাই—একটা সিংহ কখনো এ রকম আকাঙ্ক্ষায় পীড়িত হবে না।
কিন্তু একটা মানুষ পীড়িত হতেই পারে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা অসংখ্য, বিচিত্র। তার জীবনে শৈশবে এক রকম আকাঙ্ক্ষা, কৈশোরে আরেক রকম, যৌবনে অন্য রকম, আর বার্ধক্যে আবার আরও অন্য রকম। অজস্র, বিচিত্র, সীমাহীন, বিস্ময়কর সব আকাঙ্ক্ষার উদ্দাম ঢেউয়ে সারা জীবন আছাড় খাওয়া থেকে তার মুক্তি নেই। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টাই সে কিছু পেতে চায়। কারণ, যখন ঘুমাতে যায়, তখনো লোকে বলে, ভালো ঘুমাও। ঘুমে যেন সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখো; অর্থাৎ সুখের স্বপ্ন দেখো। আনন্দের স্বপ্ন দেখো। পূর্ণতার স্বপ্ন দেখো।
বাস্তবে যা পাওনি, স্বপ্নে যেন সেটা পাও। বাস্তবের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা যেন স্বপ্নে অন্তত মেটে। স্বপ্নে যেন দুষ্প্রাপ্য মেয়েটির হাত ধরে দূরপাল্লার কোনো ট্রেনের জানালার ধারে বসতে পারো। স্বপ্নে যেন আইডিবি ভবনের ১২তলার অফিসটায় উঠে সাধের চাকরিটায় জয়েন করতে পারো। স্বপ্নে যেন শ্রীলঙ্কা কিংবা মালদ্বীপের নির্জন সৈকতে বেড়াতে পারো। লটারিতে প্রথম পুরস্কারটা যেন জিতে নিতে পারো। অনেক দিন ধরেই যে আই ফোনটা কিনি কিনি বলেও কিনতে পারোনি, সেটা যেন কিনে নিতে পারো।
আমরা যাদের সাধারণ মানুষ বলি, তারা কি এমন চায় নিজেদের জীবনে? একজন সাধারণ পিতা? বা করুণাময়ী মাতা? একজন সাধারণ সন্তান? কিন্তু সেটাও শেষ পর্যন্ত কজনের জীবনে মেটে? কজন প্রেমিক বা প্রেমিকা শেষ পর্যন্ত প্রেমে সফল হয়ে হাসতে হাসতে কক্সবাজারে হানিমুনে যায়? কজন কবি সারা রাত ধরে ভাবতে ভাবতে একটা মনের মতো বাক্প্রতিমা নির্মাণ করে এবং ভোরে সেটাকে না কেটে প্রফুল্লচিত্তে ঘুমোতে যায়? দরজার চৌকাঠে দুরু দুরু বুকে দাঁড়িয়ে থাকা কজন মাকে তার ছেলে বা মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলে, ক্লাসে সে ফার্স্ট হয়েছে? তার মানে এই নয় যে স্বপ্নপূরণ ঘটেছে ধনী বা আপাতদৃষ্টিতে সফল যারা তাদের ক্ষেত্রে।
তাদেরও হতাশা, ব্যর্থতার নিজস্ব জ্বালা আছে। চাওয়া ও পাওয়ার হিসাব তাদের ক্ষেত্রেও মেলে না। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তাদেরও থাকে এবং এই বেদনা একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যতটা অনুভূত হয়, একজন ধনী, প্রতাপশালী ব্যক্তির ক্ষেত্রেও ততটাই। তফাতটা হলো লক্ষ্যবস্তুর ভিন্নতা নিয়ে, অনুভূতির তীব্রতা নিয়ে নয়। একজন ছোট ব্যবসায়ী বছরে আরও ১০ হাজার টাকা আয় না করতে পারলে হয়তো আশাহত ও বিমর্ষ হয়। একজন ধনী ব্যবসায়ী ততটাই আশাহত ও বিমর্ষ হয় মাসে আরও ১ কোটি টাকা আয় না করতে পারলে। স্বপ্নভঙ্গের যে চাপ ও জ্বালা, সেটা দুজনের শরীর-মনেই প্রায় সমান। দুজনেই কষ্ট পায়। দুঃখ মাপার যদি কোনো যন্ত্র থাকত, তবে দেখতাম ওই যন্ত্র দুজনের দুঃখ প্রায় একই মাত্রায় দেখাচ্ছে।
মানুষ আসলে এক আশ্চর্য প্রাণী! বাসে উঠে ধাক্কা দেওয়ার জন্য যে লোকটার সঙ্গে ঝগড়া করলাম, বাস থেকে নামার পর তার কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে যায়। ভাবি, ঝগড়াটা না করলেই হতো। সে তো ইচ্ছে করে ধাক্কাটা দেয়নি। আর তাতে আমার বড় কোনো ক্ষতিও হয়নি।
তাহলে কেন লোকটার সঙ্গে আমি খারাপ আচরণ করলাম? সেকি যানজটে বসে থেকে মেজাজ খিঁচড়ে ছিল বলে? ওই লোকটিরও তো একই কারণে কিংবা অন্য কোনো কারণে মন-মেজাজ খারাপ থাকতে পারে। তাই হয়তো একটু জোর খাটিয়ে নামতে চেয়েছিল! তাই বলে আমি তার সঙ্গে ঝগড়া করে বসলাম? বাস থেকে নামার পর লোকটার জন্য মন খারাপ করতে লাগল। নিজের জন্যও। আর ভাবতে লাগলাম কী ছোট ছোট কামনার দাস আমরা সবাই! কামনার কাছে আমরা কেমন অসহায়! ছোট-বড় কত কামনা মনের ভেতর কাজ করে দিন-রাত! সারা জীবন!
নতুন কেনা জুতায় কাদার ছিটে লাগলে কষ্ট পাই। বিভিন্ন দোকানের শো-কেসে সাজানো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ঘড়ির দিকে মাঝে মাঝে তাকাই, যা এত দামি যে কখনোই কিনতে পারব না। গ্র্যান্ড হোটেলে ডিনার করতে কেমন লাগে, সেটা জীবনে অন্তত এক দিনের জন্যও কখনো জানা হবে না। বসন্তের দুরন্ত হাওয়ায় কোকিলের ডাক শুনতে শুনতে বঙ্গভবনে দিবানিদ্রা করতে কেমন লাগে, সেটাও যদি জীবনে অন্তত এক দিনের জন্যও জানার সুযোগ ঘটত! অটোগ্রাফ দিতে কেমন লাগে যদি জানতে পারতাম। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার গোটা সেটটা রাখার মতো যদি একটা বড় বুক সেলফ থাকত বাড়িতে।
পেঙ্গুইন প্রকাশনা থেকে যদি আমার একটা বই ছাপা হতো। আমার একসময়ের সুপারভাইজার লোকটা যে শুধু শুধু আমাকে পীড়া দিত, তার গালে যদি কখনো প্রকাশ্যে একটা চড় কষে আসতে পারতাম। অনন্ত রূপময়ী শেরন স্টোন, যে বেচারি এখন প্রায় বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছে, অথচ যে ছিল আমার স্বপ্নের নায়িকা, তার সঙ্গে যদি সেন্ট মার্টিন বিচে একটু নিভৃতে গল্প করতে পারতাম। ধানমন্ডি লেকের ধারে আমার যদি একটা বাড়ি থাকত! পিকাসোর আঁকা একটি অরিজিনাল ছবি যদি আমিও আমার বাড়ির দেয়ালে ঝোলাতে পারতাম।
আমি জানি, আমার এই সব সাধের কোনোটাই কখনো পূর্ণ হবে না। আমাদের সবারই অধিকাংশ সাধ ম্যাচের কাঠির মতো দপ করে জ্বলে আবার নিভে যায়। চারপাশে হাঁটতে থাকা, ছুটতে থাকা, গাড়িতে বসে থাকা মানুষদের যদি জিজ্ঞেস করি, জীবনের কোন কোন সাধ পূর্ণ হলো, আমি নিশ্চিত বেশির ভাগই আমার দিকে ছলছল হাসিতে চোখ ভরে শুধু তাকিয়ে থাকবে একটানা।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে