ড. আর এম দেবনাথ
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ হবে আগামী ৬ জুন। এই মুহূর্তে ব্যবসায়ীদের অভাব-অভিযোগ ও দাবির কোনো শেষ নেই। আবার ‘মিডিয়া রিপোর্ট’ অনুযায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের কোনো শেষ নেই। এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা যে সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরছেন, তার মধ্যে আছে ডলারের দাম, ডলারের অভাব, আমদানি সংকোচন নীতি, ঋণের অভাব, বৃহত্তম ঋণের ঊর্ধ্বসীমা, উৎসে কর ধার্য, সুদ ভর্তুকি প্রত্যাহার, ভর্তুকি হ্রাসের ঝুঁকি, করপোরেট কর হ্রাস, ঋণের ওপর উচ্চ সুদ ইত্যাদি। এর বাইরেও অনেক দায়-দাবি আছে।
ওদিকে যাচ্ছি না। তবে ঠিক এই মুহূর্তে বেশি শোরগোল হচ্ছে ঋণের ওপর উচ্চহারের সুদ নিয়ে। তাঁরা বলছেন, ঋণের ওপর সুদের হার মারাত্মক পর্যায়ে উঠেছে। এটা সহ্যসীমার বাইরে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। বাজারে টেকা যাচ্ছে না। উচ্চ উৎপাদন খরচে বিক্রয়মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এই মূল্যে ক্রেতা নেই—দেশে অথবা বিদেশে। সুদব্যয় (ইন্টারেস্ট এক্সপেন্ডিচার) এত বেড়েছে যে ব্যাংকে ঋণের বোঝা বেড়ে গেছে। ঋণের কিস্তি অনেক বেড়েছে, যা পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মালের আমদানি খরচ বেড়েছে, এর ওপর শুল্ক-কর বৃদ্ধি পেয়েছে, ভ্যাট বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই ১০০ টাকা ঋণে যে কাজ হতো, এখন তাতে লাগছে ১৫০ টাকা। অথচ ঋণের পরিমাণ বাড়াতে ব্যাংক রাজি নয়। বড় বড় ঋণগ্রহীতাকে বলা হয়েছে আর কোনো নতুন ঋণ দেওয়া হবে না। যতটুকু পরিশোধ হবে, ততটুকুই আবার পাওয়া যাবে, এর বেশি নয়। এতে বড় বড় গ্রাহক আছেন বিপদে।
এসব সমস্যা নিয়ে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ছুটছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে, ছুটছেন মন্ত্রীর কাছে। বসছেন নিজেরা—পথ কী তাহলে? গ্যাসসংকট, বিদ্যুৎসংকট ও মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের অভাব, ঋণের অভাব, সুদের হার বৃদ্ধি—তাহলে কি ব্যবসা বন্ধ করতে হবে? বড় কঠিন প্রশ্নই বটে। সমাধান কী, তা কেউ জানে না—সবাই প্রত্যাশা করে আছে একটা ‘মুস্তফা কামাল মার্কা’ বাজেট নয়, একটা বাস্তববাদী বাজেটের জন্য। এটা কি হবে? ঐতিহাসিক ৭ জুন সামনে রেখে এই প্রশ্ন। আসি তাহলে ঋণের ওপর সুদের হারের ইস্যুতে।
আমাদের সবারই হয়তো মনে আছে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমানত ও ঋণের ওপর সুদের হার নির্ধারণ করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই হার ব্যাংকভেদে। এতে প্রতিযোগিতা বিঘ্নিত হতো। বাজার অর্থনীতির নীতি লঙ্ঘিত হতো—এ কথা বলে ১৯৯০-৯৫-এর দিকে সুদের হার নির্ধারণের কাজ ছেড়ে দেওয়া হয় নিজ নিজ ব্যাংকের বোর্ডের কাছে। ঋণ শ্রেণিবদ্ধকরণ (ক্ল্যাসিফিকেশন) ইত্যাদি ইস্যুও ছেড়ে দেওয়া হয় ব্যাংকের কাছে। ফল যে খুব বেশি ভালো হয়, তা বলা যাবে না। তবু মোটামুটি চলছিল। হঠাৎ এলেন এক অ্যাকাউন্ট্যান্ট অর্থমন্ত্রী, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। তিনি অনেক কথা বলে এক হোটেলে বসে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঠিক করে দিলেন সুদের হার। আমানতের ওপর ৬ শতাংশ সুদ হবে সর্বোচ্চ। ঋণের ওপর হবে ৯ শতাংশ; যা পরিচিতি পেল ‘নয়-ছয়’ সুদনীতি হিসেবে। ‘নয়-ছয়’ কী, তা সবারই জানা। বলা হলো, ব্যবসায় খরচ কমবে, প্রতিযোগিতা ভালো হবে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে। পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরে আসবে। সরকারের রাজস্ব বাড়বে। কিন্তু এতে যে বাজার অর্থনীতি বিসর্জিত হলো, তা মুস্তফা কামালের বিবেচনায় ছিল না। শুধু তা-ই নয়, তিনি ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ জাতীয় সব নীতিতে ঘন ঘন পরিবর্তন এনে ঋণশৃঙ্খলায় আনেন এক বিপর্যয়। আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত। সঞ্চয়পত্র বন্ধ হয় হয়। দেশে সঞ্চয় হয় নিরুৎসাহিত। নীতি হয়ে যায় যেন ‘ঋণ করেই খাও সবাই’। হঠাৎ চলে এল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)—আমাদের উদ্ধারকর্তা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীন থেকে আসা করোনা বালাইয়ের কঠিন প্রেক্ষাপটে আমরা পড়ে যাই এক বড় সংকটে। সংকট থেকে উত্তরণে ‘আইএমএফের’ পথ সোজা। রোগনির্বিশেষে, দেশনির্বিশেষে, অর্থনীতির স্তরনির্বিশেষে, সামাজিক কাঠামোনির্বিশেষে তাদের ওষুধ কয়েকটা—সবকিছু ঠিক করবে বাজার। মার্কেটই হবে নিয়ন্তা। কোনো ভর্তুকি চলবে না। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার কোনো কিছুতেই থাকতে পারবে না ভর্তুকি। ডলারের দাম কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক করবে না। এর দাম নির্ধারিত হবে খোলাবাজারে। সুদের হার ঠিক হবে বাজারে, চাহিদা-সরবরাহের ভিত্তিতে। কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না। কথা একটাই, ‘বাজার অর্থনীতি’ খোলাবাজার। কে মরল, কে বাঁচল, তা কথা নয়। বাজার থাকবে। ক্যাশলেস সোসাইটি হবে। লোকের ক্রয়ক্ষমতা নেই। তাদের ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হবে। ঋণ করো, ঘি খাও। জমি কেনো, ফ্ল্যাট কেনো, আসবাব কেনো, খাওয়া-দাওয়া করো—এই হচ্ছে ক্রেডিট কার্ড। ভোগী জাতি হও, আমেরিকার মতো। ধনী হও তাদের মতো। যথা পরামর্শ তথা কাজ। শত হোক ডলার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে নেমে এসেছে ২০ বিলিয়ন ডলারে। বাইরের ঋণ ও সাহায্য সেভাবে নেই। এরই মধ্যে মাত্র ৪ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দেবে আইএমএফ। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি আমাদের। কত বড় বড় পারফরম্যান্স আমাদের। না, তাতে কিছু হবে না। ভর্তুকি তোলো। সুদনীতি বাজারভিত্তিক করো। ডলারের দাম বাজারের কাছে ছাড়ো। তালুকদার সাহেবের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ নীতির অধীনে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল।
ডলারের দাম কিছুটা নির্ধারণ করে বাকিটা বাজারের কাছে ছেড়ে দেয়। এতে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। বাড়ে ভালোভাবেই। সুদের হারেরও তা-ই। তিনি আবিষ্কার করেন ‘স্মার্ট সুদনীতি’—যেন ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশের একটি প্রতিফলন। ‘স্মার্ট’ সুদনীতি কী? সিক্স মান্থস মুভিজ অ্যাভারেজ রেট অব ইন্টারেস্ট অন ট্রেজারি বিল’; অর্থাৎ সরকার ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে যে ঋণ করে, তার ওপর যে সুদ দেয়, তার ছয় মাসের গড়ে হিসাব হবে সুদের হার। এতে লোনের ওপর, ঋণের ওপর সুদের হার বাড়তে থাকে। উদ্ধারকর্তা এবং আমাদের একশ্রেণির অর্থনীতিবিদের ‘দাদাঠাকুর’ আইএমএফ তাতে সন্তুষ্ট নয়। ছয় মাস যেতে না-যেতেই তালুকদার সাহেবের ‘স্মার্টনীতি’ ‘আনস্মার্ট’ হয়ে পড়ে।
বাতিল হয় স্মার্ট সুদনীতি। এখন চলছে বেশ খোশ মেজাজি ঋণের ওপর সুদনীতি। আবার বারবার বাড়ানো হচ্ছে ‘ব্যাংক রেট’, যাকে আজকাল পোশাকি নামে ডাকা হয় ‘রেপো রেট’ হিসেবে; অর্থাৎ এটা এই রেটে, যে রেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয় প্রয়োজনে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি কমছে না; বরং গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ। কী মারাত্মক অবস্থা। অথচ এসবই হচ্ছে বাজার অর্থনীতি করার জন্য। এখন বাজার হয়ে যাচ্ছে বেসামাল। বাজার অর্থনীতি আছে—বাজার নেই, ক্রেতা নেই, বিক্রেতা আছে, আর আছে ধনী, অতি ধনী ক্রেতা।
বাজার অর্থনীতিতে এখন, অন্য কথা বাদ, ডলারের দাম এবং ঋণের ওপর সুদের হার গাছের ওপরে। বাংলাদেশ ব্যাংক লজ্জায় বলে ডলারের দাম হবে ১১৭ টাকা (দুই বছর আগেও যা ছিল ৮৫-৮৬ টাকা)। কিন্তু খোলাবাজারে বস্তুটি নেই। জোগাড় হলে এর দাম নাকি হাঁকা হয় ১২০-১২৫। সত্যি মিথ্যা বলতে পারবে সরকারি সংস্থাগুলো এবং ভুক্তভোগীরা। এর ফল কী? এ কথা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। মূল্যস্ফীতি, আমদানিনির্ভর দেশ। সর্বশেষ খবর চলছে চিনি নিয়ে। চিনির ৯৮-৯৯ শতাংশ আমদানি হয়। আমদানি কম, ডলার নেই।
অতএব ‘গাল খাওয়া’ ভারত থেকে সমানে চিনি আসছে ‘দেশপ্রেমিক’ চোরাচালানিরা। ‘দেশপ্রেমিক’ চোরাচালানিদেরকে বন্ধু ‘দেশপ্রেমিক’ হুন্ডিওয়ালারা সাহায্য করছে ডলার দিয়ে। ডলার কোত্থেকে দেয় তারা? দেশের ডলার না থাকতে পারে। কিন্তু প্রভাবশালী হুন্ডিওয়ালারা বেশি দাম দিয়ে বিদেশেই বাংলাদেশি প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার নিয়ে নেয়। তা দিয়ে নানা কায়দায় তারা ভারতীয় চোরাচালানিদের চিনির টাকা পরিশোধ করে। এটাই হচ্ছে আদি ও অকৃত্রিম পন্থা এবং ব্যবসা। স্বাধীনতার আগে এবং পর থেকে এটাই দেশে চলে আসছে।
হুন্ডি ছিল, আছে, থাকবে—যত ‘পণ্ডিতি’ই করা হোক না কেন। এটা একটা অত্যন্ত সংগঠিত, মজবুত ব্যবসা, যা প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে কাজ করে।
ড. আর এম দেবনাথ, সাবেক শিক্ষক, ঢাবি; অর্থনীতি বিশ্লেষক
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ হবে আগামী ৬ জুন। এই মুহূর্তে ব্যবসায়ীদের অভাব-অভিযোগ ও দাবির কোনো শেষ নেই। আবার ‘মিডিয়া রিপোর্ট’ অনুযায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের কোনো শেষ নেই। এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা যে সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরছেন, তার মধ্যে আছে ডলারের দাম, ডলারের অভাব, আমদানি সংকোচন নীতি, ঋণের অভাব, বৃহত্তম ঋণের ঊর্ধ্বসীমা, উৎসে কর ধার্য, সুদ ভর্তুকি প্রত্যাহার, ভর্তুকি হ্রাসের ঝুঁকি, করপোরেট কর হ্রাস, ঋণের ওপর উচ্চ সুদ ইত্যাদি। এর বাইরেও অনেক দায়-দাবি আছে।
ওদিকে যাচ্ছি না। তবে ঠিক এই মুহূর্তে বেশি শোরগোল হচ্ছে ঋণের ওপর উচ্চহারের সুদ নিয়ে। তাঁরা বলছেন, ঋণের ওপর সুদের হার মারাত্মক পর্যায়ে উঠেছে। এটা সহ্যসীমার বাইরে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। বাজারে টেকা যাচ্ছে না। উচ্চ উৎপাদন খরচে বিক্রয়মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এই মূল্যে ক্রেতা নেই—দেশে অথবা বিদেশে। সুদব্যয় (ইন্টারেস্ট এক্সপেন্ডিচার) এত বেড়েছে যে ব্যাংকে ঋণের বোঝা বেড়ে গেছে। ঋণের কিস্তি অনেক বেড়েছে, যা পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মালের আমদানি খরচ বেড়েছে, এর ওপর শুল্ক-কর বৃদ্ধি পেয়েছে, ভ্যাট বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই ১০০ টাকা ঋণে যে কাজ হতো, এখন তাতে লাগছে ১৫০ টাকা। অথচ ঋণের পরিমাণ বাড়াতে ব্যাংক রাজি নয়। বড় বড় ঋণগ্রহীতাকে বলা হয়েছে আর কোনো নতুন ঋণ দেওয়া হবে না। যতটুকু পরিশোধ হবে, ততটুকুই আবার পাওয়া যাবে, এর বেশি নয়। এতে বড় বড় গ্রাহক আছেন বিপদে।
এসব সমস্যা নিয়ে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ছুটছেন বাংলাদেশ ব্যাংকে, ছুটছেন মন্ত্রীর কাছে। বসছেন নিজেরা—পথ কী তাহলে? গ্যাসসংকট, বিদ্যুৎসংকট ও মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের অভাব, ঋণের অভাব, সুদের হার বৃদ্ধি—তাহলে কি ব্যবসা বন্ধ করতে হবে? বড় কঠিন প্রশ্নই বটে। সমাধান কী, তা কেউ জানে না—সবাই প্রত্যাশা করে আছে একটা ‘মুস্তফা কামাল মার্কা’ বাজেট নয়, একটা বাস্তববাদী বাজেটের জন্য। এটা কি হবে? ঐতিহাসিক ৭ জুন সামনে রেখে এই প্রশ্ন। আসি তাহলে ঋণের ওপর সুদের হারের ইস্যুতে।
আমাদের সবারই হয়তো মনে আছে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে আমানত ও ঋণের ওপর সুদের হার নির্ধারণ করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই হার ব্যাংকভেদে। এতে প্রতিযোগিতা বিঘ্নিত হতো। বাজার অর্থনীতির নীতি লঙ্ঘিত হতো—এ কথা বলে ১৯৯০-৯৫-এর দিকে সুদের হার নির্ধারণের কাজ ছেড়ে দেওয়া হয় নিজ নিজ ব্যাংকের বোর্ডের কাছে। ঋণ শ্রেণিবদ্ধকরণ (ক্ল্যাসিফিকেশন) ইত্যাদি ইস্যুও ছেড়ে দেওয়া হয় ব্যাংকের কাছে। ফল যে খুব বেশি ভালো হয়, তা বলা যাবে না। তবু মোটামুটি চলছিল। হঠাৎ এলেন এক অ্যাকাউন্ট্যান্ট অর্থমন্ত্রী, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। তিনি অনেক কথা বলে এক হোটেলে বসে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঠিক করে দিলেন সুদের হার। আমানতের ওপর ৬ শতাংশ সুদ হবে সর্বোচ্চ। ঋণের ওপর হবে ৯ শতাংশ; যা পরিচিতি পেল ‘নয়-ছয়’ সুদনীতি হিসেবে। ‘নয়-ছয়’ কী, তা সবারই জানা। বলা হলো, ব্যবসায় খরচ কমবে, প্রতিযোগিতা ভালো হবে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে। পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরে আসবে। সরকারের রাজস্ব বাড়বে। কিন্তু এতে যে বাজার অর্থনীতি বিসর্জিত হলো, তা মুস্তফা কামালের বিবেচনায় ছিল না। শুধু তা-ই নয়, তিনি ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ জাতীয় সব নীতিতে ঘন ঘন পরিবর্তন এনে ঋণশৃঙ্খলায় আনেন এক বিপর্যয়। আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত। সঞ্চয়পত্র বন্ধ হয় হয়। দেশে সঞ্চয় হয় নিরুৎসাহিত। নীতি হয়ে যায় যেন ‘ঋণ করেই খাও সবাই’। হঠাৎ চলে এল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)—আমাদের উদ্ধারকর্তা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীন থেকে আসা করোনা বালাইয়ের কঠিন প্রেক্ষাপটে আমরা পড়ে যাই এক বড় সংকটে। সংকট থেকে উত্তরণে ‘আইএমএফের’ পথ সোজা। রোগনির্বিশেষে, দেশনির্বিশেষে, অর্থনীতির স্তরনির্বিশেষে, সামাজিক কাঠামোনির্বিশেষে তাদের ওষুধ কয়েকটা—সবকিছু ঠিক করবে বাজার। মার্কেটই হবে নিয়ন্তা। কোনো ভর্তুকি চলবে না। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার কোনো কিছুতেই থাকতে পারবে না ভর্তুকি। ডলারের দাম কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক করবে না। এর দাম নির্ধারিত হবে খোলাবাজারে। সুদের হার ঠিক হবে বাজারে, চাহিদা-সরবরাহের ভিত্তিতে। কোনো হস্তক্ষেপ চলবে না। কথা একটাই, ‘বাজার অর্থনীতি’ খোলাবাজার। কে মরল, কে বাঁচল, তা কথা নয়। বাজার থাকবে। ক্যাশলেস সোসাইটি হবে। লোকের ক্রয়ক্ষমতা নেই। তাদের ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হবে। ঋণ করো, ঘি খাও। জমি কেনো, ফ্ল্যাট কেনো, আসবাব কেনো, খাওয়া-দাওয়া করো—এই হচ্ছে ক্রেডিট কার্ড। ভোগী জাতি হও, আমেরিকার মতো। ধনী হও তাদের মতো। যথা পরামর্শ তথা কাজ। শত হোক ডলার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে নেমে এসেছে ২০ বিলিয়ন ডলারে। বাইরের ঋণ ও সাহায্য সেভাবে নেই। এরই মধ্যে মাত্র ৪ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দেবে আইএমএফ। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি আমাদের। কত বড় বড় পারফরম্যান্স আমাদের। না, তাতে কিছু হবে না। ভর্তুকি তোলো। সুদনীতি বাজারভিত্তিক করো। ডলারের দাম বাজারের কাছে ছাড়ো। তালুকদার সাহেবের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ নীতির অধীনে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল।
ডলারের দাম কিছুটা নির্ধারণ করে বাকিটা বাজারের কাছে ছেড়ে দেয়। এতে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। বাড়ে ভালোভাবেই। সুদের হারেরও তা-ই। তিনি আবিষ্কার করেন ‘স্মার্ট সুদনীতি’—যেন ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশের একটি প্রতিফলন। ‘স্মার্ট’ সুদনীতি কী? সিক্স মান্থস মুভিজ অ্যাভারেজ রেট অব ইন্টারেস্ট অন ট্রেজারি বিল’; অর্থাৎ সরকার ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে যে ঋণ করে, তার ওপর যে সুদ দেয়, তার ছয় মাসের গড়ে হিসাব হবে সুদের হার। এতে লোনের ওপর, ঋণের ওপর সুদের হার বাড়তে থাকে। উদ্ধারকর্তা এবং আমাদের একশ্রেণির অর্থনীতিবিদের ‘দাদাঠাকুর’ আইএমএফ তাতে সন্তুষ্ট নয়। ছয় মাস যেতে না-যেতেই তালুকদার সাহেবের ‘স্মার্টনীতি’ ‘আনস্মার্ট’ হয়ে পড়ে।
বাতিল হয় স্মার্ট সুদনীতি। এখন চলছে বেশ খোশ মেজাজি ঋণের ওপর সুদনীতি। আবার বারবার বাড়ানো হচ্ছে ‘ব্যাংক রেট’, যাকে আজকাল পোশাকি নামে ডাকা হয় ‘রেপো রেট’ হিসেবে; অর্থাৎ এটা এই রেটে, যে রেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেয় প্রয়োজনে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি কমছে না; বরং গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ। কী মারাত্মক অবস্থা। অথচ এসবই হচ্ছে বাজার অর্থনীতি করার জন্য। এখন বাজার হয়ে যাচ্ছে বেসামাল। বাজার অর্থনীতি আছে—বাজার নেই, ক্রেতা নেই, বিক্রেতা আছে, আর আছে ধনী, অতি ধনী ক্রেতা।
বাজার অর্থনীতিতে এখন, অন্য কথা বাদ, ডলারের দাম এবং ঋণের ওপর সুদের হার গাছের ওপরে। বাংলাদেশ ব্যাংক লজ্জায় বলে ডলারের দাম হবে ১১৭ টাকা (দুই বছর আগেও যা ছিল ৮৫-৮৬ টাকা)। কিন্তু খোলাবাজারে বস্তুটি নেই। জোগাড় হলে এর দাম নাকি হাঁকা হয় ১২০-১২৫। সত্যি মিথ্যা বলতে পারবে সরকারি সংস্থাগুলো এবং ভুক্তভোগীরা। এর ফল কী? এ কথা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। মূল্যস্ফীতি, আমদানিনির্ভর দেশ। সর্বশেষ খবর চলছে চিনি নিয়ে। চিনির ৯৮-৯৯ শতাংশ আমদানি হয়। আমদানি কম, ডলার নেই।
অতএব ‘গাল খাওয়া’ ভারত থেকে সমানে চিনি আসছে ‘দেশপ্রেমিক’ চোরাচালানিরা। ‘দেশপ্রেমিক’ চোরাচালানিদেরকে বন্ধু ‘দেশপ্রেমিক’ হুন্ডিওয়ালারা সাহায্য করছে ডলার দিয়ে। ডলার কোত্থেকে দেয় তারা? দেশের ডলার না থাকতে পারে। কিন্তু প্রভাবশালী হুন্ডিওয়ালারা বেশি দাম দিয়ে বিদেশেই বাংলাদেশি প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার নিয়ে নেয়। তা দিয়ে নানা কায়দায় তারা ভারতীয় চোরাচালানিদের চিনির টাকা পরিশোধ করে। এটাই হচ্ছে আদি ও অকৃত্রিম পন্থা এবং ব্যবসা। স্বাধীনতার আগে এবং পর থেকে এটাই দেশে চলে আসছে।
হুন্ডি ছিল, আছে, থাকবে—যত ‘পণ্ডিতি’ই করা হোক না কেন। এটা একটা অত্যন্ত সংগঠিত, মজবুত ব্যবসা, যা প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে কাজ করে।
ড. আর এম দেবনাথ, সাবেক শিক্ষক, ঢাবি; অর্থনীতি বিশ্লেষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে