বিভুরঞ্জন সরকার
২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৯৪৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেন থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই রাজনৈতিক দলটির। ১৯৪৯ থেকে ২০২৪। দীর্ঘ সময়। দীর্ঘ পথপরিক্রমা। জন্মলগ্নে নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ।
১৯৫৪ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামেই দলটির পরিচিতি এবং বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। এই দলের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, উদ্যোগী ছিলেন, তাঁরা সবাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার দুই বছর না যেতেই কেন একটি নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দিতে হলো, তা অবশ্যই ভাবার বিষয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার গর্ভজাত দল নয়।
ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরতেই এই দলের জন্ম। তাই এটা বলা যায় যে জনগণের প্রয়োজনে, জনগণের দল হিসেবেই আওয়ামী লীগের জন্ম ও বেড়ে ওঠা।বাংলাদেশের মানুষ সবাই হয়তো আওয়ামী লীগ করে না, অনেকেই আছে বরং চরম আওয়ামী লীগবিরোধী। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নাকচ করা বা বাতিল করার উপায় কারও নেই। বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগকে আলাদা করা যাবে না। আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ হারলে বাংলাদেশ হারে—এটা কোনো বুলিমাত্র নয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বদানকারী দল মুসলিম লীগ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই গণবিরোধী ভূমিকা এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতির পাকে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানের পূর্ব অংশে মুসলিম লীগ রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত মাওলানা আকরম খাঁ এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের হাতে। উপেক্ষিত হন মুসলিম লীগের মধ্যে উদার ও অগ্রসর চিন্তার ব্যক্তিরা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকে ছিলেন এই ধারায়। তাঁরাই মূলত আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন। প্রতিষ্ঠার ছয় বছরের মাথায় দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ রাখা হয়।
আওয়ামী লীগকে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত অবদান সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে যতই জনগণের সামনে শত্রু বা ভিলেন বানানোর চেষ্টা করেছে, তাঁকে বারবার কারাগারে নিয়েছে, বিনা বিচারে আটক রেখেছে, দেশের মানুষ ততই তাঁকে আপনজন ভেবেছে, নায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছে। যারা শেখ মুজিবকে গুরুত্বহীন করে তোলার চেষ্টা করেছে, মানুষের কাছে তারাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবের মুক্তি পাওয়া, বঙ্গবন্ধু হওয়া, সত্তরের নির্বাচনে অভূতপূর্ব জয় এবং তারপর একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান—সবই সম্ভব করে তুলেছে এ দেশের মানুষ। বঙ্গবন্ধু যেমন মানুষের অনিঃশেষ ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি তিনিও দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন, একটু বেশিই ভালোবেসেছেন। মানুষকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে তিনি রাজনীতির হিসাব-নিকাশ করেননি। রাজনীতি ছিল যাঁর জীবন। তিনি মানুষকে বিশ্বাস-ভালোবাসার বেলায় থাকলেন বেহিসাবি। ইতিহাসের কী মারাত্মক স্ববিরোধ!
শেখ মুজিবকে জীবন দিতে হয়েছে তিনি যে দেশের স্বাধীনতার ধারাবাহিক সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই স্বাধীন দেশেরই একদল বিশ্বাসঘাতকের হাতে। তাঁর কি কোনো বড় ভুল ছিল? তিনি কি বুঝতে পারেননি যে দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষছেন? তিনি বুঝতেন, জানতেনও। কারা তাঁর শত্রু, কারা গোপনে অস্ত্র শাণ দিচ্ছে, সেসব তিনি জানতেন। বিশ্বাস করতে চাইতেন না। ভাবতেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিছুই ঠিক হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলো। দেশের রাজনীতি চলে গেল একাত্তর-পূর্ব ধারায়।
মুজিববিহীন দেশে দিশেহারা অবস্থায় একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। যে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছিল পঁচাত্তরের খুনিচক্র, মুজিব হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি জিয়াউর রহমান, সেই আওয়ামী লীগ কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যারা দম্ভ করে বলত, আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, তাদের দম্ভ চূর্ণ হয়েছে। তাদেরই বরং ক্ষমতায় ফেরার আশা প্রায় দুরাশায় পরিণত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের উত্থান-পতনের সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িত। এই দল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় নিশ্চিত করেছে। আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশের নতুন সমৃদ্ধিযাত্রা। বাংলাদেশকে আজ আর বিশ্বসম্প্রদায় দুর্যোগ-দুর্বিপাক এবং ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেশ মনে করে না। বাংলাদেশ আজ আত্মশক্তিতে বলীয়ান মর্যাদাসম্পন্ন একটি দেশ। উন্নয়ন সহায়ক দেশ ও প্রতিষ্ঠানের অন্যায় চাপ, পরামর্শ উপেক্ষা করার সাহসও বাংলাদেশ অর্জন করেছে।
পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়েসহ যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, তা কার্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম বাংলাদেশেরই ছবি। একসময়ের সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন অন্য দেশের সাহায্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
তার মানে কি বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নেই? আওয়ামী লীগ যা করছে, সব ভালো? না, তা অবশ্যই নয়। আওয়ামী লীগের ভেতরেও নানা সংকট আছে। সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে আদর্শের সংকট। আওয়ামী লীগ যে গণতন্ত্র ও উদারতার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, অন্যদের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল করে তুলেছে, সেখানে এখন তৈরি হয়েছে ফাটল। আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতাই এখন প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।
এ কথা ঠিক, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দেশ ও দেশের মানুষের দুর্দশা-দুর্গতি বাড়ে। সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী রাজনীতি ফণা তোলে, আবার এটাও অসত্য নয় যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য যে নীতিহীন আপসকামী ভূমিকা নিচ্ছে, সেটা আসলে দেশের আত্মশক্তিও দুর্বল করছে। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতি-অনৈতিকতা শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করছে। মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস জনগণ। তাই যেকোনো মূল্যে জনগণের মধ্যে আস্থা ধরে রাখার কাজে আওয়ামী লীগকে সফল হতেই হবে। সময়ের দাবি বা প্রয়োজন পূরণে আওয়ামী লীগ কখনো ব্যর্থ হয়নি। দেশের যেকোনো সংকটকালে যখনই প্রশ্ন এসেছে, আওয়ামী লীগ সংকট মোকাবিলার সক্ষমতা দেখাতে পারবে তো?
আওয়ামী লীগ কিন্তু তা পেরেছে। আওয়ামী লীগ পেরেছে বলেই অন্যরা হেরেছে। অন্যরা হেরেছে বলে দেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। দেশের হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগ। হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিলে যেমন মানুষ বাঁচে না, তেমনি আওয়ামী লীগও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হেলাফেলা করলে বাংলাদেশেরও কার্যত নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীরা টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। কিন্তু দেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন নানা কারণে উঠছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের বিজ্ঞানমুখী এবং যুক্তিবাদী হওয়ার ডাক দিয়েছেন। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে কি মানুষকে ধর্মমুখী করে তোলার চেষ্টা করছে না? ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়। রাজনীতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখার যে নীতি বঙ্গবন্ধু অনুসরণ করতেন, আজকের আওয়ামী লীগ কি সেই ধারায় দৃঢ় আছে?
পরগাছাকে বঙ্গবন্ধু ভয় করতেন। পরগাছা রাজনীতিবিদদের প্রতি ছিল তাঁর ঘৃণা। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির নানা মেরুকরণে এখন আওয়ামী লীগেও ঢুকে পড়েছে আগাছা-পরগাছা, যাদের বলা হচ্ছে হাইব্রিড, কাউয়া। দলের মধ্যে যেসব প্রাণঘাতী ভাইরাস ঢুকেছে, তাদের পরাস্ত করার সংগ্রাম শুরু করতে হবে আওয়ামী লীগকে। করোনাভাইরাস অদৃশ্য শক্তি, আওয়ামী লীগের ভাইরাস দৃশ্যমান, সহজে শনাক্ত করা সম্ভব। অদৃশ্য শত্রুকে পরাভূত করার সংগ্রামে সফল হওয়া গেলে দৃশ্যমান শত্রু মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ সফল হবে না কেন?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৯৪৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেন থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই রাজনৈতিক দলটির। ১৯৪৯ থেকে ২০২৪। দীর্ঘ সময়। দীর্ঘ পথপরিক্রমা। জন্মলগ্নে নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ।
১৯৫৪ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামেই দলটির পরিচিতি এবং বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। এই দলের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, উদ্যোগী ছিলেন, তাঁরা সবাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার দুই বছর না যেতেই কেন একটি নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দিতে হলো, তা অবশ্যই ভাবার বিষয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার গর্ভজাত দল নয়।
ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরতেই এই দলের জন্ম। তাই এটা বলা যায় যে জনগণের প্রয়োজনে, জনগণের দল হিসেবেই আওয়ামী লীগের জন্ম ও বেড়ে ওঠা।বাংলাদেশের মানুষ সবাই হয়তো আওয়ামী লীগ করে না, অনেকেই আছে বরং চরম আওয়ামী লীগবিরোধী। কিন্তু আওয়ামী লীগকে নাকচ করা বা বাতিল করার উপায় কারও নেই। বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগকে আলাদা করা যাবে না। আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ হারলে বাংলাদেশ হারে—এটা কোনো বুলিমাত্র নয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্বদানকারী দল মুসলিম লীগ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই গণবিরোধী ভূমিকা এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতির পাকে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানের পূর্ব অংশে মুসলিম লীগ রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত মাওলানা আকরম খাঁ এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের হাতে। উপেক্ষিত হন মুসলিম লীগের মধ্যে উদার ও অগ্রসর চিন্তার ব্যক্তিরা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকে ছিলেন এই ধারায়। তাঁরাই মূলত আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন। প্রতিষ্ঠার ছয় বছরের মাথায় দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ রাখা হয়।
আওয়ামী লীগকে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত অবদান সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে যতই জনগণের সামনে শত্রু বা ভিলেন বানানোর চেষ্টা করেছে, তাঁকে বারবার কারাগারে নিয়েছে, বিনা বিচারে আটক রেখেছে, দেশের মানুষ ততই তাঁকে আপনজন ভেবেছে, নায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছে। যারা শেখ মুজিবকে গুরুত্বহীন করে তোলার চেষ্টা করেছে, মানুষের কাছে তারাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবের মুক্তি পাওয়া, বঙ্গবন্ধু হওয়া, সত্তরের নির্বাচনে অভূতপূর্ব জয় এবং তারপর একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান—সবই সম্ভব করে তুলেছে এ দেশের মানুষ। বঙ্গবন্ধু যেমন মানুষের অনিঃশেষ ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি তিনিও দেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন, একটু বেশিই ভালোবেসেছেন। মানুষকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে তিনি রাজনীতির হিসাব-নিকাশ করেননি। রাজনীতি ছিল যাঁর জীবন। তিনি মানুষকে বিশ্বাস-ভালোবাসার বেলায় থাকলেন বেহিসাবি। ইতিহাসের কী মারাত্মক স্ববিরোধ!
শেখ মুজিবকে জীবন দিতে হয়েছে তিনি যে দেশের স্বাধীনতার ধারাবাহিক সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই স্বাধীন দেশেরই একদল বিশ্বাসঘাতকের হাতে। তাঁর কি কোনো বড় ভুল ছিল? তিনি কি বুঝতে পারেননি যে দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষছেন? তিনি বুঝতেন, জানতেনও। কারা তাঁর শত্রু, কারা গোপনে অস্ত্র শাণ দিচ্ছে, সেসব তিনি জানতেন। বিশ্বাস করতে চাইতেন না। ভাবতেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিছুই ঠিক হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলো। দেশের রাজনীতি চলে গেল একাত্তর-পূর্ব ধারায়।
মুজিববিহীন দেশে দিশেহারা অবস্থায় একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। যে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছিল পঁচাত্তরের খুনিচক্র, মুজিব হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি জিয়াউর রহমান, সেই আওয়ামী লীগ কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যারা দম্ভ করে বলত, আওয়ামী লীগ আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না, তাদের দম্ভ চূর্ণ হয়েছে। তাদেরই বরং ক্ষমতায় ফেরার আশা প্রায় দুরাশায় পরিণত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের উত্থান-পতনের সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িত। এই দল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় নিশ্চিত করেছে। আবার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশের নতুন সমৃদ্ধিযাত্রা। বাংলাদেশকে আজ আর বিশ্বসম্প্রদায় দুর্যোগ-দুর্বিপাক এবং ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো দেশ মনে করে না। বাংলাদেশ আজ আত্মশক্তিতে বলীয়ান মর্যাদাসম্পন্ন একটি দেশ। উন্নয়ন সহায়ক দেশ ও প্রতিষ্ঠানের অন্যায় চাপ, পরামর্শ উপেক্ষা করার সাহসও বাংলাদেশ অর্জন করেছে।
পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়েসহ যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, তা কার্যত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম বাংলাদেশেরই ছবি। একসময়ের সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন অন্য দেশের সাহায্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
তার মানে কি বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নেই? আওয়ামী লীগ যা করছে, সব ভালো? না, তা অবশ্যই নয়। আওয়ামী লীগের ভেতরেও নানা সংকট আছে। সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে আদর্শের সংকট। আওয়ামী লীগ যে গণতন্ত্র ও উদারতার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, অন্যদের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল করে তুলেছে, সেখানে এখন তৈরি হয়েছে ফাটল। আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতাই এখন প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।
এ কথা ঠিক, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দেশ ও দেশের মানুষের দুর্দশা-দুর্গতি বাড়ে। সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী রাজনীতি ফণা তোলে, আবার এটাও অসত্য নয় যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য যে নীতিহীন আপসকামী ভূমিকা নিচ্ছে, সেটা আসলে দেশের আত্মশক্তিও দুর্বল করছে। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতি-অনৈতিকতা শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করছে। মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস জনগণ। তাই যেকোনো মূল্যে জনগণের মধ্যে আস্থা ধরে রাখার কাজে আওয়ামী লীগকে সফল হতেই হবে। সময়ের দাবি বা প্রয়োজন পূরণে আওয়ামী লীগ কখনো ব্যর্থ হয়নি। দেশের যেকোনো সংকটকালে যখনই প্রশ্ন এসেছে, আওয়ামী লীগ সংকট মোকাবিলার সক্ষমতা দেখাতে পারবে তো?
আওয়ামী লীগ কিন্তু তা পেরেছে। আওয়ামী লীগ পেরেছে বলেই অন্যরা হেরেছে। অন্যরা হেরেছে বলে দেশের কোনো ক্ষতি হয়নি। দেশের হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগ। হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিলে যেমন মানুষ বাঁচে না, তেমনি আওয়ামী লীগও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হেলাফেলা করলে বাংলাদেশেরও কার্যত নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীরা টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। কিন্তু দেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন নানা কারণে উঠছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের বিজ্ঞানমুখী এবং যুক্তিবাদী হওয়ার ডাক দিয়েছেন। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে কি মানুষকে ধর্মমুখী করে তোলার চেষ্টা করছে না? ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়। রাজনীতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখার যে নীতি বঙ্গবন্ধু অনুসরণ করতেন, আজকের আওয়ামী লীগ কি সেই ধারায় দৃঢ় আছে?
পরগাছাকে বঙ্গবন্ধু ভয় করতেন। পরগাছা রাজনীতিবিদদের প্রতি ছিল তাঁর ঘৃণা। কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতির নানা মেরুকরণে এখন আওয়ামী লীগেও ঢুকে পড়েছে আগাছা-পরগাছা, যাদের বলা হচ্ছে হাইব্রিড, কাউয়া। দলের মধ্যে যেসব প্রাণঘাতী ভাইরাস ঢুকেছে, তাদের পরাস্ত করার সংগ্রাম শুরু করতে হবে আওয়ামী লীগকে। করোনাভাইরাস অদৃশ্য শক্তি, আওয়ামী লীগের ভাইরাস দৃশ্যমান, সহজে শনাক্ত করা সম্ভব। অদৃশ্য শত্রুকে পরাভূত করার সংগ্রামে সফল হওয়া গেলে দৃশ্যমান শত্রু মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ সফল হবে না কেন?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে