বিভুরঞ্জন সরকার
হতাশাবাদী ও অপপ্রচারকারীরা সব সময় নেতিবাচক প্রচারণা চালালেও বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথ রুদ্ধ করা যাচ্ছে না। গত বছরের শেষদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা গেলেও আমাদের অর্থনীতি এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। অনেকে বলেছিল শ্রীলঙ্কা হবে, এই হবে, সেই হবে—তাদের মুখে ছাই পড়েছে। সেটা হয়নি, ইনশা আল্লাহ হবেও না।’ বিদায়ী বছরের বিভিন্ন সময় কত ধরনের গুজব ও আশঙ্কার কথাই তো ছড়ানো হয়েছে, কিন্তু বড় কোনো অঘটন বা ধাক্কা ছাড়াই আমরা বছরটি বিদায় করতে পারছি। নতুন বছর সামনে রেখে, বিশেষ করে বছরের শুরুতে হতে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তার ফলাফল, মার্কিন নিষেধাজ্ঞাসহ কত নেতিবাচক প্রচারণাই না চলছে। এসব কুডাকা পাখিদের মুখেও ছাই পড়বে, এটা বলা যায় অতীত অভিজ্ঞতার আলোকেই। তা ছাড়া বাংলায় কথা আছে, শকুনের অভিশাপে...।
দুই বছরের করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে (এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে গাজায় নৃশংসতা) পৃথিবীজুড়ে ভয়াবহ এক সংকট তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কার্যক্রমের (ইউএনডিপি) প্রধান আখিম স্টেইনার এক বছর আগেই বলেছিলেন, বিশ্বের ৫৪টি উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশ দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা জাতিসংঘের মহাসচিব নিজেও ব্যক্ত করেছেন। যুদ্ধের কারণে খাদ্যপণ্য সরবরাহে সমস্যা হওয়ায় দাম বাড়ছে। পৃথিবী যেহেতু এখনো পুরোপুরি ক্ষুধামুক্ত হয়নি, সেহেতু খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বিঘ্নিত হলে খাদ্যসংকটের কথাটি সামনে আসে। খাদ্য এমন একটি অতিজরুরি দ্রব্য, যা প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। খাদ্যের মতো এমন জরুরি জিনিস নিয়ে যে রাজনীতি হয় না, তা-ও নয়। বিশ্বব্যাপী যখন অর্থনৈতিক, জ্বালানি ও খাদ্যসংকটের আগাম আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তখন খাদ্য নিয়ে অপপ্রচার ও রাজনীতি থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক বক্তৃতায় খাদ্যসংকটের ইঙ্গিত দিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এ কথা কখনো বলেননি যে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে; বরং তিনি এটাই বলেছেন, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অবস্থা আমাদের আছে। তিনি বৈশ্বিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদের আওতায় আনতে বলেছেন।
এটা ঠিক যে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন কমে গেলে পরিস্থিতি খারাপ হবেই। আমরা খাদ্য উৎপাদনে এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। আমাদের খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। চাল-গমসহ যা যা আমদানি করতে হয়, বিশ্বে তার উৎপাদন কমে গেলে আমরা তো সংকটে পড়তেই পারি। তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছে। বিশ্বজুড়েই অর্থনীতির চরম অবস্থা যাচ্ছে। দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। মানুষ কর্মহীন হচ্ছে, গরিব হচ্ছে। আয়-ব্যয়ের বিরাট ব্যবধানে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে কোনো অবস্থায়ই স্বাভাবিক বলা যাবে না।
বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য। সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার ঋণ করেছে বাংলাদেশ। এই অর্থ অবশ্য একবারে পাওয়া যাবে না, তিন বছরে পাওয়া যাবে। এই ঋণচুক্তির সময় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট কনসালট্যান্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেছিলেন, আইএমএফের সঙ্গে এ ধরনের ঋণচুক্তি বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির। তিনি মনে করেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঋণ প্যাকেজ থাকলে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে মাথা খাটাবে না।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানও বলেছিলেন, আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের স্বস্তি নিয়ে আসবে। যদিও অর্থের অঙ্কে এই ঋণ তেমন বড় কিছু নয়। তবে এ ঋণ বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া আইএমএফের ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হওয়ার খবরে একধরনের বার্তা আছে। এটি বহুপক্ষীয় অন্য সংস্থাগুলোকে আশ্বস্ত করবে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের বাজেট সহায়তা দিতে উৎসাহিত হবে। বাজেট সহায়তাও কিন্তু রিজার্ভে যোগ হয়, সেদিক থেকে এর গুরুত্ব আছে।
আইএমএফের ঋণ পাওয়াকে অর্থনীতিবিদেরা ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও রাজনৈতিকভাবে যাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে, তাঁরা এতে হতাশ হয়েছেন হয়তো। কোনো ঘটনা সরকারের পক্ষে গেলে তাতে বিএনপির গা জ্বলে। কারণ বিএনপি তো সারাক্ষণ ক্ষমতাসীন দলের পতনধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পায় না। দেশের অর্থনীতি বেহাল হলে তাতে যে খুশি হওয়ার কিছু থাকে না, এটাও এখন বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা ভুলে বসে আছে। তবে সরকারের জন্য আত্মতুষ্টির কিছু নেই। সরকারের কিছু কিছু পদক্ষেপের কারণে যে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে, এটা মানতেই হবে। রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রীকে মাঝেমাঝেই কথা বলতে হচ্ছে। বিদেশে অর্থ পাচার, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লাফিয়ে লাফিয়ে ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়া সরকারের জন্য ভালো নয়। মানুষের কল্যাণের কথা বলে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীকে সুবিধা দেওয়ার নীতি থেকে সরকারকে সরে আসতেই হবে।
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় নিজেদের দাতা সংস্থা হিসেবে জাহির করত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাতা হওয়ার দাবি নাকচ করে দিয়ে প্রথমবারের মতো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বলে অভিহিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই অভিধা অত্যন্ত যৌক্তিক। কেননা, বাংলাদেশেরও বিশ্বব্যাংকে মালিকানা রয়েছে, প্রতিবছর চাঁদা দিয়ে সংস্থাটির তহবিল বৃদ্ধি করে থাকে। আর আইএমএফ বা অন্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণে অর্থ নিলেও আসলসহ বিপুল পরিমাণ সুদ পরিশোধ করতে হয়। তারা তো দান করে না। সাধারণত এদের কাছে ঋণ চাইতে গেলেই নানা শর্ত নিয়ে চলে আলোচনা। এগুলো সম্মানজনক নয়।
অনেকেই এটা মনে করেন যে লুটপাট বন্ধ হলে সামান্য ঋণের জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন হয়তো হতো না। আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংক টাকা দিলেই খুশিতে বগল না বাজিয়ে সরকারের উচিত হবে আর্থিক বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে দৃঢ়তা দেখানো। যদি বৈষম্য কমানোর পথে সরকার না হাঁটে, তাহলে দুর্ভিক্ষ এড়ানো গেলেও মানুষের জীবন থেকে সংকট কাটবে না।
স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশের অনেক সাফল্য আছে, অগ্রগতি আছে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে আর দুর্যোগ-দুর্বিপাকের দেশ হিসেবে পরিচিত নয়। বাংলাদেশ এখন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দেশে দেশে ছোটাছুটি করে না। সামাজিক ও মানব উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশ এখন অনেক সমৃদ্ধ দেশকেও টেক্কা দেওয়ার সক্ষমতা দেখাতে পারছে। নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ অনেকেই বাংলাদেশের অগ্রগতির, সাফল্যের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশ এখন আর দুর্বল অর্থনীতির দেশ নয়। মানুষের গড় আয় বেড়েছে। আয়ু বেড়েছে। শিক্ষিতের হার বেড়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে। এসব অর্জনকে যাঁরা দেখতে চান না, তাঁরা একদেশদর্শী। তাঁদের সঙ্গে বিতর্ক করা অর্থহীন।
তবে এটাও ঠিক যে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। আরও অনেক সমস্যারই স্থায়ী সমাধান করতে হবে। আমাদের দেশে এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষ আছে। এখনো অনেক মানুষ আছে, যারা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার সুযোগবঞ্চিত। উচ্চশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। শিক্ষার মান নিয়ে আছে প্রশ্ন ও সমালোচনা।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সুশাসনের ক্ষেত্রে। আমরা কেন যেন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, গোষ্ঠী ও দলপ্রীতির বাইরে যেতে পারি না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, যারা ক্ষমতার রাজনীতি করে, তারা ক্ষমতার বাইরে থাকতে যেসব কথা বলে ক্ষমতায় গিয়ে তার উল্টোটা চর্চা করে। এটা বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেলায় যেমন সত্য, তেমনি অতীতে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির বেলায়ও সত্য। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রশ্ন হলো, এই পরিবর্তনটা আনবে কে? যারা খারাপটা চর্চা করছে, তারা ভালোটা আনবে মনে করে বসে থাকলে হবে না। এখন আওয়ামী লীগের শাসন অনেকের ভালো লাগছে না। ঠিক আছে, আওয়ামী লীগকে ভোটে পরাজিত করে তার চেয়ে ভালো একটি দলকে ক্ষমতায় আনার সুযোগ কি আমাদের দেশে আছে? আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি হতে পারে না। বিএনপি কেমন দল, তারা কী করতে পারে, সে প্রমাণ অতীতে তারা দিয়েছে। আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় জনকল্যাণের ব্রত নিয়ে একটি রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় জরুরি, বলা যায় এটা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সমাজের কোনো দিক থেকেই তেমন কোনো আয়োজন বা উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
এবার নির্বাচনের পর রাজনীতি মেরামতের কোনো উদ্যোগ কি কোনো পক্ষ থেকে নেওয়া হবে? খতম আর পতন চাওয়ার ধারা থেকে রাজনীতি মুক্ত না হলে টেকসই উন্নয়নও নিশ্চিত হবে না। আমরা ‘বাহির পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয় পানে চাইনি’। এবার হৃদয় পানে চাওয়ার বিষয়টি কি রাজনীতিতে গুরুত্ব পাবে?
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
হতাশাবাদী ও অপপ্রচারকারীরা সব সময় নেতিবাচক প্রচারণা চালালেও বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথ রুদ্ধ করা যাচ্ছে না। গত বছরের শেষদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা গেলেও আমাদের অর্থনীতি এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। অনেকে বলেছিল শ্রীলঙ্কা হবে, এই হবে, সেই হবে—তাদের মুখে ছাই পড়েছে। সেটা হয়নি, ইনশা আল্লাহ হবেও না।’ বিদায়ী বছরের বিভিন্ন সময় কত ধরনের গুজব ও আশঙ্কার কথাই তো ছড়ানো হয়েছে, কিন্তু বড় কোনো অঘটন বা ধাক্কা ছাড়াই আমরা বছরটি বিদায় করতে পারছি। নতুন বছর সামনে রেখে, বিশেষ করে বছরের শুরুতে হতে যাওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তার ফলাফল, মার্কিন নিষেধাজ্ঞাসহ কত নেতিবাচক প্রচারণাই না চলছে। এসব কুডাকা পাখিদের মুখেও ছাই পড়বে, এটা বলা যায় অতীত অভিজ্ঞতার আলোকেই। তা ছাড়া বাংলায় কথা আছে, শকুনের অভিশাপে...।
দুই বছরের করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে (এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে গাজায় নৃশংসতা) পৃথিবীজুড়ে ভয়াবহ এক সংকট তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কার্যক্রমের (ইউএনডিপি) প্রধান আখিম স্টেইনার এক বছর আগেই বলেছিলেন, বিশ্বের ৫৪টি উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশ দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা জাতিসংঘের মহাসচিব নিজেও ব্যক্ত করেছেন। যুদ্ধের কারণে খাদ্যপণ্য সরবরাহে সমস্যা হওয়ায় দাম বাড়ছে। পৃথিবী যেহেতু এখনো পুরোপুরি ক্ষুধামুক্ত হয়নি, সেহেতু খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বিঘ্নিত হলে খাদ্যসংকটের কথাটি সামনে আসে। খাদ্য এমন একটি অতিজরুরি দ্রব্য, যা প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। খাদ্যের মতো এমন জরুরি জিনিস নিয়ে যে রাজনীতি হয় না, তা-ও নয়। বিশ্বব্যাপী যখন অর্থনৈতিক, জ্বালানি ও খাদ্যসংকটের আগাম আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তখন খাদ্য নিয়ে অপপ্রচার ও রাজনীতি থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক বক্তৃতায় খাদ্যসংকটের ইঙ্গিত দিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এ কথা কখনো বলেননি যে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে; বরং তিনি এটাই বলেছেন, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো অবস্থা আমাদের আছে। তিনি বৈশ্বিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদের আওতায় আনতে বলেছেন।
এটা ঠিক যে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন কমে গেলে পরিস্থিতি খারাপ হবেই। আমরা খাদ্য উৎপাদনে এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। আমাদের খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। চাল-গমসহ যা যা আমদানি করতে হয়, বিশ্বে তার উৎপাদন কমে গেলে আমরা তো সংকটে পড়তেই পারি। তার ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছে। বিশ্বজুড়েই অর্থনীতির চরম অবস্থা যাচ্ছে। দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। মানুষ কর্মহীন হচ্ছে, গরিব হচ্ছে। আয়-ব্যয়ের বিরাট ব্যবধানে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে কোনো অবস্থায়ই স্বাভাবিক বলা যাবে না।
বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য। সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার ঋণ করেছে বাংলাদেশ। এই অর্থ অবশ্য একবারে পাওয়া যাবে না, তিন বছরে পাওয়া যাবে। এই ঋণচুক্তির সময় বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট কনসালট্যান্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেছিলেন, আইএমএফের সঙ্গে এ ধরনের ঋণচুক্তি বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির। তিনি মনে করেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঋণ প্যাকেজ থাকলে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে মাথা খাটাবে না।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানও বলেছিলেন, আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের স্বস্তি নিয়ে আসবে। যদিও অর্থের অঙ্কে এই ঋণ তেমন বড় কিছু নয়। তবে এ ঋণ বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া আইএমএফের ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সম্মত হওয়ার খবরে একধরনের বার্তা আছে। এটি বহুপক্ষীয় অন্য সংস্থাগুলোকে আশ্বস্ত করবে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের বাজেট সহায়তা দিতে উৎসাহিত হবে। বাজেট সহায়তাও কিন্তু রিজার্ভে যোগ হয়, সেদিক থেকে এর গুরুত্ব আছে।
আইএমএফের ঋণ পাওয়াকে অর্থনীতিবিদেরা ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও রাজনৈতিকভাবে যাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে, তাঁরা এতে হতাশ হয়েছেন হয়তো। কোনো ঘটনা সরকারের পক্ষে গেলে তাতে বিএনপির গা জ্বলে। কারণ বিএনপি তো সারাক্ষণ ক্ষমতাসীন দলের পতনধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পায় না। দেশের অর্থনীতি বেহাল হলে তাতে যে খুশি হওয়ার কিছু থাকে না, এটাও এখন বিএনপিসহ সরকারবিরোধীরা ভুলে বসে আছে। তবে সরকারের জন্য আত্মতুষ্টির কিছু নেই। সরকারের কিছু কিছু পদক্ষেপের কারণে যে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে, এটা মানতেই হবে। রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রীকে মাঝেমাঝেই কথা বলতে হচ্ছে। বিদেশে অর্থ পাচার, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লাফিয়ে লাফিয়ে ঋণখেলাপির সংখ্যা বাড়া সরকারের জন্য ভালো নয়। মানুষের কল্যাণের কথা বলে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীকে সুবিধা দেওয়ার নীতি থেকে সরকারকে সরে আসতেই হবে।
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় নিজেদের দাতা সংস্থা হিসেবে জাহির করত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের দাতা হওয়ার দাবি নাকচ করে দিয়ে প্রথমবারের মতো উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বলে অভিহিত করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই অভিধা অত্যন্ত যৌক্তিক। কেননা, বাংলাদেশেরও বিশ্বব্যাংকে মালিকানা রয়েছে, প্রতিবছর চাঁদা দিয়ে সংস্থাটির তহবিল বৃদ্ধি করে থাকে। আর আইএমএফ বা অন্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণে অর্থ নিলেও আসলসহ বিপুল পরিমাণ সুদ পরিশোধ করতে হয়। তারা তো দান করে না। সাধারণত এদের কাছে ঋণ চাইতে গেলেই নানা শর্ত নিয়ে চলে আলোচনা। এগুলো সম্মানজনক নয়।
অনেকেই এটা মনে করেন যে লুটপাট বন্ধ হলে সামান্য ঋণের জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন হয়তো হতো না। আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংক টাকা দিলেই খুশিতে বগল না বাজিয়ে সরকারের উচিত হবে আর্থিক বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে দৃঢ়তা দেখানো। যদি বৈষম্য কমানোর পথে সরকার না হাঁটে, তাহলে দুর্ভিক্ষ এড়ানো গেলেও মানুষের জীবন থেকে সংকট কাটবে না।
স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশের অনেক সাফল্য আছে, অগ্রগতি আছে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীতে আর দুর্যোগ-দুর্বিপাকের দেশ হিসেবে পরিচিত নয়। বাংলাদেশ এখন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দেশে দেশে ছোটাছুটি করে না। সামাজিক ও মানব উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশ এখন অনেক সমৃদ্ধ দেশকেও টেক্কা দেওয়ার সক্ষমতা দেখাতে পারছে। নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনসহ অনেকেই বাংলাদেশের অগ্রগতির, সাফল্যের মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশ এখন আর দুর্বল অর্থনীতির দেশ নয়। মানুষের গড় আয় বেড়েছে। আয়ু বেড়েছে। শিক্ষিতের হার বেড়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে। এসব অর্জনকে যাঁরা দেখতে চান না, তাঁরা একদেশদর্শী। তাঁদের সঙ্গে বিতর্ক করা অর্থহীন।
তবে এটাও ঠিক যে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। আরও অনেক সমস্যারই স্থায়ী সমাধান করতে হবে। আমাদের দেশে এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষ আছে। এখনো অনেক মানুষ আছে, যারা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার সুযোগবঞ্চিত। উচ্চশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। শিক্ষার মান নিয়ে আছে প্রশ্ন ও সমালোচনা।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সুশাসনের ক্ষেত্রে। আমরা কেন যেন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, গোষ্ঠী ও দলপ্রীতির বাইরে যেতে পারি না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো, যারা ক্ষমতার রাজনীতি করে, তারা ক্ষমতার বাইরে থাকতে যেসব কথা বলে ক্ষমতায় গিয়ে তার উল্টোটা চর্চা করে। এটা বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেলায় যেমন সত্য, তেমনি অতীতে ক্ষমতায় থাকা বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির বেলায়ও সত্য। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রশ্ন হলো, এই পরিবর্তনটা আনবে কে? যারা খারাপটা চর্চা করছে, তারা ভালোটা আনবে মনে করে বসে থাকলে হবে না। এখন আওয়ামী লীগের শাসন অনেকের ভালো লাগছে না। ঠিক আছে, আওয়ামী লীগকে ভোটে পরাজিত করে তার চেয়ে ভালো একটি দলকে ক্ষমতায় আনার সুযোগ কি আমাদের দেশে আছে? আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি হতে পারে না। বিএনপি কেমন দল, তারা কী করতে পারে, সে প্রমাণ অতীতে তারা দিয়েছে। আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় জনকল্যাণের ব্রত নিয়ে একটি রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় জরুরি, বলা যায় এটা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সমাজের কোনো দিক থেকেই তেমন কোনো আয়োজন বা উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
এবার নির্বাচনের পর রাজনীতি মেরামতের কোনো উদ্যোগ কি কোনো পক্ষ থেকে নেওয়া হবে? খতম আর পতন চাওয়ার ধারা থেকে রাজনীতি মুক্ত না হলে টেকসই উন্নয়নও নিশ্চিত হবে না। আমরা ‘বাহির পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয় পানে চাইনি’। এবার হৃদয় পানে চাওয়ার বিষয়টি কি রাজনীতিতে গুরুত্ব পাবে?
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৬ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে