মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
৮ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গণতন্ত্র মঞ্চ নামে একটি জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এই জোটের সদস্য দলগুলো হচ্ছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। বেশ কয়েক মাস ধরেই বিএনপিসহ নতুন জোটের নেতারা বর্তমান সরকারকে উৎখাতে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ নামের একটি জোট গঠনের কথা বারবার গণমাধ্যমে উচ্চারণ করে আসছিলেন। তখন থেকেই সবাই অপেক্ষায়—কবে গণতন্ত্রের মঞ্চে আসীন হবেন আমাদের পরিচিত কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, যাঁদের কেউ কেউ নানা দলে নানা জোটে থেকে রাজনীতি করেছেন, কেউ কেউ আবার সংসদে গেছেন, সরকার অনুগত বিরোধীদলীয় নেতাও হয়েছেন। তবে গণতন্ত্র মঞ্চটি হালের নতুন কোনো সংস্থা নয়।
২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক কাউন্সিল আয়োজিত ‘ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও আজকের বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সদস্য মওদুদ আহমদ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুসংহত করতে রাজধানীসহ দেশের জেলা ও উপজেলায় গণতন্ত্র মঞ্চ তৈরি করা হবে।’ পরদিন গণজাগরণ মঞ্চ থেকে মওদুদ আহমদের ওই সমালোচনার তীব্র প্রতিবাদ করে বলা হয়, ‘তাদের ওটা গণতন্ত্র মঞ্চ নয়, বরং রাজাকার মঞ্চ হবে।’ সে সময় দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে একদিকে তরুণ প্রজন্মের সিংহভাগ অংশ গণজাগরণ মঞ্চ নামে একটি আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠন এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী ওই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবির পক্ষে আন্দোলন সোচ্চার হতে থাকে। এমনকি সরকারও গণজাগরণ মঞ্চের দাবি পূরণ করতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইনের অসম্পূর্ণতা সংশোধন করে।
সে সময় এই বিচার এবং আন্দোলনের বিপক্ষে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াসহ শীর্ষ নেতৃত্ব বক্তব্য দেন। বিএনপির কোনো কোনো অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের অনেকেই গণজাগরণ মঞ্চেও যুক্ত হয়ে তাঁদের সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু দলের কঠোর অবস্থানের কারণে তাঁরা সরে যান। জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য বিএনপির এই অবস্থান স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জামায়াত-বিএনপি গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে ধর্মবিরোধীদের আন্দোলন নামে ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করে। সরকারে না থাকার কারণে বিএনপি ও জামায়াত ‘গণতন্ত্র মঞ্চের’ কোনো জায়গা অধিকারে নিতে পারেনি। তবে রমনা পার্ক থেকে উচ্চ মঞ্চের ব্যানারে গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সেটিকে গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীরাই প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর হেফাজতে ইসলামকে
নিয়ে বিএনপি-জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদেরবিচার বন্ধ করার অপচেষ্টা চালায়। সে ইতিহাস সবারই জানা।
গণতন্ত্র মঞ্চটি বোঝাই যাচ্ছে বিএনপির অত্যন্ত মনঃপূত একটি ‘শিশু’ সংস্থার নাম, যার আয়ুষ্কাল বেশি নয়। অনেকেই সেই সংগঠনটির নাম ভুলে গেলেও জামায়াত ও বিএনপি ভুলে যাবে, সেটি ভাবার কারণ নেই। যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দলগত অবস্থান নিতে পারে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করতে গণতন্ত্র মঞ্চের জন্ম দিতে পারে, তাদের রাজনীতিতে অপকৌশল প্রয়োগের ক্ষমতা সম্পর্কে কম জানেন বা বোঝেন তাঁরা হয়তো ভুলে গেছেন।
আমি বিস্মিত হয়েছি বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের মুখ থেকে যখন একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলতে শুনি, ২০১৩ সালে এমন সংগঠন যে সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি তাঁর জানা নেই। বিপ্লবীদের স্মৃতিশক্তি প্রখর, তাঁদের অনেক লেখাপড়াও আছে। রাজনীতিতে তাঁদের সৎ চরিত্রের একটা সুনাম আছে। দেশের জন্য বিপ্লবীদের ত্যাগের শেষ নেই। ২০ শতকের শুরু থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু জীবনযুদ্ধে পরাজিত অনেক বিপ্লবী আন্দোলনে টিকে থাকতে পারেননি। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা তত্ত্বীয় বিভ্রান্তিতে পড়ে এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরও অনেকে বিরোধিতা করেছিলেন। কেউ কেউ পাকিস্তানিদের পক্ষও নিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ নানা তত্ত্বে জড়িয়ে বিভক্ত হয়ে একে অপরের রক্তে হাত রঞ্জিত করেছেন।
দুঃখজনক হলো, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই বিপ্লব ও বিপ্লবী তত্ত্বের আবেগে আপ্লুত হয়ে অনেকেই রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির নানা জটিলতাকে বুঝতে একেবারেই অক্ষম হয়েছিলেন। আসলে বিপ্লবীদের মধ্যে রোমান্টিকতার যেমন বিস্তার ঘটে, একইভাবে ভুলভ্রান্তিতে দেশপ্রেম ও মেধাকে তেমন কেউই খুব একটা কাজে লাগাতে পারেননি। অথচ লাখো তরুণ-তরুণী স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিপ্লবীদের বাঁশির সুরেই বিমোহিত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেটি হ্যামিলনের বংশীবাদকের গল্পের মতোই আমাদেরও কয়েকজন মেধাবী, দেশপ্রেমিক, উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়ী প্রজন্মকে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও শিক্ষা থেকে হারাতে হয়েছে। এর প্রধান কারণ, বিপ্লবী রাজনীতি যে ধরনের সামগ্রিক জ্ঞানচর্চার দাবি রাখে, সেটি অনেক ক্ষেত্রেই বেশির ভাগ নেতা-কর্মী অর্জন করতে পারেন না। ফলে তাঁরাও পা দেন সে পথে, যে পথ তাঁদের নিয়ে যায় অন্যত্র। এভাবেই বাংলাদেশেও বিপ্লবী বাম রাজনীতি কেবলই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হচ্ছে। এর জন্য আমাদের মনঃকষ্ট আছে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি সম্ভবত আমরা বর্তমান কিংবা নিকট-ভবিষ্যতে দেখতে পাব না। গত ৫০ বছরের বিপ্লবীতত্ত্ব চর্চাকারীরাই নানা দলে বিভক্ত। কিন্তু কোন জোট তাদের খোসার মতো ব্যবহার করে ছুড়ে রাস্তায় ফেলে দেবে, সেই দূরদর্শিতা না থাকার কারণে তাঁরা বারবার ব্যবহৃত হয়েছেন।
এবার গণতন্ত্র মঞ্চের রূপরেখার কথা শোনা যাক। ‘আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা এবং অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হবে এবং একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।…রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ও সরকারের জবাবদিহির কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার। একই সঙ্গে ফেডারেল পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা বিষয়ে আলোচনার জন্য জাতীয় কমিশন গঠন।’
এসব নতুন কথা নয়। কিন্তু এসব করার ক্ষমতা এই জোটের নেই। যাঁরা তাঁদের এই মঞ্চটি ভাড়া দিয়েছেন, তাঁদের চিন্তার ধারেকাছে কখনো ছিল না, ক্ষমতায় গেলেও হবে না। যাঁরা এখন এই জোটের হয়ে কথা বলেন, তাঁরা জ্ঞানবুদ্ধিতে এঁদের চেয়ে মোটেও কম পাকা নন। কিন্তু তাঁরা এমন একটি দল করেন, যে দলের প্রতিষ্ঠাতা তাঁদেরই কারও কারও দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার রক্ত নিয়েছেন, নেতা-কর্মীদের জেলে পুরিয়েছেন, দল ভেঙে তছনছ করেছেন, নানাজনকে নানা স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এরপর যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। তিনি তো ঘোষণাই দিয়েছিলেন, ‘আমি রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে দেব।’ এ ক্ষেত্রে তিনি আসলেই সফল, সেটি বিশ্বাস করতেই হবে। নিজেই দল প্রতিষ্ঠিত করার আগেই স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, অতি ডান, অতি বাম ও সুবিধাবাদীদের জড়ো করেছেন। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ প্রতিষ্ঠা করে জামায়াত পুনঃপ্রতিষ্ঠার মহড়া দিয়েছেন। কারণ, তাঁর দল গঠনের জন্য দরকার ছিল অভিজ্ঞ আরেকটি রাজনৈতিক দলের সমর্থন, যার সঙ্গে আদর্শগত বিরোধ ততটা থাকবে না। কিন্তু চেহারায় নিজের দলটি থাকবে পাশ্চাত্য পোশাক, বেশভূষা এবং ক্লিন শেভড, অন্যদিকে মগজে থাকবে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের বাংলাদেশের ভাবনা, যার সঙ্গে জামায়াতের খুব বেশি দূরত্ব থাকবে না।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও জামায়াত-বিএনপি একজোটই ছিল, মাঝেমধ্যে একটু-আধটু ভিন্নতা দেখিয়েছে মাত্র। একানব্বইয়ের নির্বাচনের প্রাক্কালে খালেদা জিয়া গোলাম আযমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ২০৬ আসনে জামায়াতের ভোট প্রাপ্তি নিশ্চিত করলেন। এর বিনিময়ে জামায়াতকে ৯৪টি আসনে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এভাবেই আসন ভাগাভাগি হয়। বিজয় লাভের পর সংসদে দুটি নারী আসন জামায়াতকে দেওয়া হয়। এসব গোপন তৎপরতার অনেক কিছুই অনেকের জানা ছিল না। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জামায়াত তিনটি আসন পায়। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে ঐক্য হয়নি। এরপর আবার জামায়াত এবং বিএনপি আদর্শগত ঐক্যে ফিরে যায়। ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর খালেদা জিয়া, গোলাম আযম, এইচ এম এরশাদ এবং মাওলানা আজিজুল হক স্বাক্ষর করলেন চারদলীয় জোটের রূপরেখায়। এরশাদ জোটছুট হলেও বাকিরা চারদলীয় জোটেই থেকে গেলেন। ২০০১-এর নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি-জামায়াতের সরকার কেমন ছিল, তা নিশ্চয়ই দেশবাসীর মনে আছে।
জামায়াত এখন দৃশ্যপটে নেই। এটিও তাদের ঐকমত্যেই হচ্ছে। এটা বুঝতে আমাদের বাকি নেই। সামনে শুধু গণতন্ত্র মঞ্চের শোভাবর্ধন করা হচ্ছে। যদি ‘সুফল’ কিছু পাওয়া যায়! দেখা যাক কী হয়।
৮ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গণতন্ত্র মঞ্চ নামে একটি জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এই জোটের সদস্য দলগুলো হচ্ছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। বেশ কয়েক মাস ধরেই বিএনপিসহ নতুন জোটের নেতারা বর্তমান সরকারকে উৎখাতে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ নামের একটি জোট গঠনের কথা বারবার গণমাধ্যমে উচ্চারণ করে আসছিলেন। তখন থেকেই সবাই অপেক্ষায়—কবে গণতন্ত্রের মঞ্চে আসীন হবেন আমাদের পরিচিত কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, যাঁদের কেউ কেউ নানা দলে নানা জোটে থেকে রাজনীতি করেছেন, কেউ কেউ আবার সংসদে গেছেন, সরকার অনুগত বিরোধীদলীয় নেতাও হয়েছেন। তবে গণতন্ত্র মঞ্চটি হালের নতুন কোনো সংস্থা নয়।
২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক কাউন্সিল আয়োজিত ‘ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও আজকের বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির তৎকালীন সদস্য মওদুদ আহমদ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে পরিচালিত আন্দোলনের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুসংহত করতে রাজধানীসহ দেশের জেলা ও উপজেলায় গণতন্ত্র মঞ্চ তৈরি করা হবে।’ পরদিন গণজাগরণ মঞ্চ থেকে মওদুদ আহমদের ওই সমালোচনার তীব্র প্রতিবাদ করে বলা হয়, ‘তাদের ওটা গণতন্ত্র মঞ্চ নয়, বরং রাজাকার মঞ্চ হবে।’ সে সময় দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে একদিকে তরুণ প্রজন্মের সিংহভাগ অংশ গণজাগরণ মঞ্চ নামে একটি আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠন এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী ওই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবির পক্ষে আন্দোলন সোচ্চার হতে থাকে। এমনকি সরকারও গণজাগরণ মঞ্চের দাবি পূরণ করতে গিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইনের অসম্পূর্ণতা সংশোধন করে।
সে সময় এই বিচার এবং আন্দোলনের বিপক্ষে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াসহ শীর্ষ নেতৃত্ব বক্তব্য দেন। বিএনপির কোনো কোনো অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের অনেকেই গণজাগরণ মঞ্চেও যুক্ত হয়ে তাঁদের সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু দলের কঠোর অবস্থানের কারণে তাঁরা সরে যান। জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য বিএনপির এই অবস্থান স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জামায়াত-বিএনপি গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে ধর্মবিরোধীদের আন্দোলন নামে ব্যাপক অপপ্রচার শুরু করে। সরকারে না থাকার কারণে বিএনপি ও জামায়াত ‘গণতন্ত্র মঞ্চের’ কোনো জায়গা অধিকারে নিতে পারেনি। তবে রমনা পার্ক থেকে উচ্চ মঞ্চের ব্যানারে গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সেটিকে গণজাগরণ মঞ্চের নেতা-কর্মীরাই প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর হেফাজতে ইসলামকে
নিয়ে বিএনপি-জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদেরবিচার বন্ধ করার অপচেষ্টা চালায়। সে ইতিহাস সবারই জানা।
গণতন্ত্র মঞ্চটি বোঝাই যাচ্ছে বিএনপির অত্যন্ত মনঃপূত একটি ‘শিশু’ সংস্থার নাম, যার আয়ুষ্কাল বেশি নয়। অনেকেই সেই সংগঠনটির নাম ভুলে গেলেও জামায়াত ও বিএনপি ভুলে যাবে, সেটি ভাবার কারণ নেই। যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দলগত অবস্থান নিতে পারে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করতে গণতন্ত্র মঞ্চের জন্ম দিতে পারে, তাদের রাজনীতিতে অপকৌশল প্রয়োগের ক্ষমতা সম্পর্কে কম জানেন বা বোঝেন তাঁরা হয়তো ভুলে গেছেন।
আমি বিস্মিত হয়েছি বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকের মুখ থেকে যখন একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলতে শুনি, ২০১৩ সালে এমন সংগঠন যে সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি তাঁর জানা নেই। বিপ্লবীদের স্মৃতিশক্তি প্রখর, তাঁদের অনেক লেখাপড়াও আছে। রাজনীতিতে তাঁদের সৎ চরিত্রের একটা সুনাম আছে। দেশের জন্য বিপ্লবীদের ত্যাগের শেষ নেই। ২০ শতকের শুরু থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু জীবনযুদ্ধে পরাজিত অনেক বিপ্লবী আন্দোলনে টিকে থাকতে পারেননি। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা তত্ত্বীয় বিভ্রান্তিতে পড়ে এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরও অনেকে বিরোধিতা করেছিলেন। কেউ কেউ পাকিস্তানিদের পক্ষও নিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ নানা তত্ত্বে জড়িয়ে বিভক্ত হয়ে একে অপরের রক্তে হাত রঞ্জিত করেছেন।
দুঃখজনক হলো, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই বিপ্লব ও বিপ্লবী তত্ত্বের আবেগে আপ্লুত হয়ে অনেকেই রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির নানা জটিলতাকে বুঝতে একেবারেই অক্ষম হয়েছিলেন। আসলে বিপ্লবীদের মধ্যে রোমান্টিকতার যেমন বিস্তার ঘটে, একইভাবে ভুলভ্রান্তিতে দেশপ্রেম ও মেধাকে তেমন কেউই খুব একটা কাজে লাগাতে পারেননি। অথচ লাখো তরুণ-তরুণী স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিপ্লবীদের বাঁশির সুরেই বিমোহিত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেটি হ্যামিলনের বংশীবাদকের গল্পের মতোই আমাদেরও কয়েকজন মেধাবী, দেশপ্রেমিক, উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়ী প্রজন্মকে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও শিক্ষা থেকে হারাতে হয়েছে। এর প্রধান কারণ, বিপ্লবী রাজনীতি যে ধরনের সামগ্রিক জ্ঞানচর্চার দাবি রাখে, সেটি অনেক ক্ষেত্রেই বেশির ভাগ নেতা-কর্মী অর্জন করতে পারেন না। ফলে তাঁরাও পা দেন সে পথে, যে পথ তাঁদের নিয়ে যায় অন্যত্র। এভাবেই বাংলাদেশেও বিপ্লবী বাম রাজনীতি কেবলই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হচ্ছে। এর জন্য আমাদের মনঃকষ্ট আছে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি সম্ভবত আমরা বর্তমান কিংবা নিকট-ভবিষ্যতে দেখতে পাব না। গত ৫০ বছরের বিপ্লবীতত্ত্ব চর্চাকারীরাই নানা দলে বিভক্ত। কিন্তু কোন জোট তাদের খোসার মতো ব্যবহার করে ছুড়ে রাস্তায় ফেলে দেবে, সেই দূরদর্শিতা না থাকার কারণে তাঁরা বারবার ব্যবহৃত হয়েছেন।
এবার গণতন্ত্র মঞ্চের রূপরেখার কথা শোনা যাক। ‘আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা এবং অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হবে এবং একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।…রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ও সরকারের জবাবদিহির কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার। একই সঙ্গে ফেডারেল পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা বিষয়ে আলোচনার জন্য জাতীয় কমিশন গঠন।’
এসব নতুন কথা নয়। কিন্তু এসব করার ক্ষমতা এই জোটের নেই। যাঁরা তাঁদের এই মঞ্চটি ভাড়া দিয়েছেন, তাঁদের চিন্তার ধারেকাছে কখনো ছিল না, ক্ষমতায় গেলেও হবে না। যাঁরা এখন এই জোটের হয়ে কথা বলেন, তাঁরা জ্ঞানবুদ্ধিতে এঁদের চেয়ে মোটেও কম পাকা নন। কিন্তু তাঁরা এমন একটি দল করেন, যে দলের প্রতিষ্ঠাতা তাঁদেরই কারও কারও দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার রক্ত নিয়েছেন, নেতা-কর্মীদের জেলে পুরিয়েছেন, দল ভেঙে তছনছ করেছেন, নানাজনকে নানা স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এরপর যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। তিনি তো ঘোষণাই দিয়েছিলেন, ‘আমি রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে দেব।’ এ ক্ষেত্রে তিনি আসলেই সফল, সেটি বিশ্বাস করতেই হবে। নিজেই দল প্রতিষ্ঠিত করার আগেই স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, অতি ডান, অতি বাম ও সুবিধাবাদীদের জড়ো করেছেন। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ প্রতিষ্ঠা করে জামায়াত পুনঃপ্রতিষ্ঠার মহড়া দিয়েছেন। কারণ, তাঁর দল গঠনের জন্য দরকার ছিল অভিজ্ঞ আরেকটি রাজনৈতিক দলের সমর্থন, যার সঙ্গে আদর্শগত বিরোধ ততটা থাকবে না। কিন্তু চেহারায় নিজের দলটি থাকবে পাশ্চাত্য পোশাক, বেশভূষা এবং ক্লিন শেভড, অন্যদিকে মগজে থাকবে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের বাংলাদেশের ভাবনা, যার সঙ্গে জামায়াতের খুব বেশি দূরত্ব থাকবে না।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও জামায়াত-বিএনপি একজোটই ছিল, মাঝেমধ্যে একটু-আধটু ভিন্নতা দেখিয়েছে মাত্র। একানব্বইয়ের নির্বাচনের প্রাক্কালে খালেদা জিয়া গোলাম আযমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ২০৬ আসনে জামায়াতের ভোট প্রাপ্তি নিশ্চিত করলেন। এর বিনিময়ে জামায়াতকে ৯৪টি আসনে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এভাবেই আসন ভাগাভাগি হয়। বিজয় লাভের পর সংসদে দুটি নারী আসন জামায়াতকে দেওয়া হয়। এসব গোপন তৎপরতার অনেক কিছুই অনেকের জানা ছিল না। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জামায়াত তিনটি আসন পায়। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে ঐক্য হয়নি। এরপর আবার জামায়াত এবং বিএনপি আদর্শগত ঐক্যে ফিরে যায়। ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর খালেদা জিয়া, গোলাম আযম, এইচ এম এরশাদ এবং মাওলানা আজিজুল হক স্বাক্ষর করলেন চারদলীয় জোটের রূপরেখায়। এরশাদ জোটছুট হলেও বাকিরা চারদলীয় জোটেই থেকে গেলেন। ২০০১-এর নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি-জামায়াতের সরকার কেমন ছিল, তা নিশ্চয়ই দেশবাসীর মনে আছে।
জামায়াত এখন দৃশ্যপটে নেই। এটিও তাদের ঐকমত্যেই হচ্ছে। এটা বুঝতে আমাদের বাকি নেই। সামনে শুধু গণতন্ত্র মঞ্চের শোভাবর্ধন করা হচ্ছে। যদি ‘সুফল’ কিছু পাওয়া যায়! দেখা যাক কী হয়।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে