শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
দেশের সাতটি কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ১০টিতে দাগি বন্দীদের দাপটে অসহায় সাধারণ বন্দীরা। এমনকি কারারক্ষীদের চেয়েও তাঁদের কর্তৃত্ব বেশি। টাকার বিনিময়ে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা, চিকিৎসার ব্যবস্থা—সবকিছুতেই থাকে তাঁদের হাত। সাধারণ বন্দীরা তাঁদের জুলুমের শিকার হচ্ছেন। কারা কর্মকর্তারা এসব জানলেও নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় থাকে। খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে রয়েছে এসব তথ্য।
বিভিন্ন কারাগারের ভেতরে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, মারধরসহ বিভিন্ন অভিযোগ শোনা যায় মাঝেমধ্যেই। কিছু কিছু ঘটনায় ভুক্তভোগী বন্দী ও স্বজনেরা কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। কারাগারফেরত কয়েকজন বলেছেন, কিছু দাগি অপরাধীর কর্মকাণ্ডে সংশোধনাগারে স্বস্তি পান না সাধারণ বন্দীরা। ‘রাখিব নিরাপদ দেখাব আলোর পথ’—এই স্লোগান অনেক বন্দীর কাছেই হয়ে ওঠে কথার কথা। কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সীমিত জনবল ও অপর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে এসব বন্ধ করা খুব কঠিন।
জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল সুজাউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রতিটি কারাগারে আমাদের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম চলছে। অনেক সময় আমরা নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের কেউ অভিযোগ করলে তাদের অভিযোগও আমলে নিয়ে তদন্ত করি।’
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে ৬৮টি কারাগারের মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের অধীন ১৭টি। ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বন্দী, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, চিকিৎসক না থাকা, বিশুদ্ধ পানির সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা কারাগারগুলোতে কমবেশি রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গত মার্চে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে কয়েকজন জেলা প্রশাসক কারাগারের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। তাঁদের উত্থাপিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২৯ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে পাঠানো হয়। অবশ্য এর আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কারাগার নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে ২০টি কারাগারের বিভিন্ন সমস্যার চিত্র উঠে এসেছে।
১০ কারাগারে দাগি আসামিদের দাপট
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, কেন্দ্রীয় সাতটি কারাগারসহ কয়েকটি কারাগারে বেশ কিছু দাগি বন্দী রয়েছেন। পুরোনো কয়েদি হওয়ায় তাঁরা কারাগারের অন্য বন্দীদের ওপর জুলুম করছেন। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। দাগি আসামিদের দাপট থাকা কারাগারগুলো হচ্ছে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ১-২, হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার, সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার, বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার, খুলনা জেলা কারাগার, ফরিদপুর জেলা কারাগার ও গাইবান্ধা জেলা কারাগার।
আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এসব কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়া আসামিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারাগারগুলোতে দাগি আসামিরা প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁদের অভিযোগ, আসামিদের এই চক্র পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন কারারক্ষীরা।
গত মাসে জামিনে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান রাজধানীর খিলগাঁও থানার একটি হত্যা মামলার আসামি সুজন। তিনি বলেন, ‘পুরো কারাগারে দাপট দাগি আসামিদের। নতুন বন্দীদের ঢোকানো আর বের করা ছাড়া কারারক্ষীদের সেভাবে কোনো কাজ থাকে না। ভেতরে যা চলে সব নগদ টাকায়। পান থেকে চুন খসলে সাধারণ বন্দীদের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। কারাগারে যে যত দুর্ধর্ষ আসামি, সে তত প্রভাবশালী।’
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাদেকুল ইসলামকে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় এপ্রিলে কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁর ছোট ভাই শাহিন অভিযোগ করেন, গাইবান্ধা জেলখানায় কারারক্ষীদের সেভাবে প্রভাব নেই। সব দাপট দাগি আসামিদের।
জানতে চাইলে গাইবান্ধা কারাগারের জেল সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, বন্দীসহ আত্মীয়দের কিছু অভিযোগ রয়েছে। জেলখানায় কোনো অনিয়ম হলে বা কেউ করলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কারাগার
ওই প্রতিবেদন এবং সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৩ সালে ১০ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয় ভোলা জেলা কারাগার। কারা অভ্যন্তরে জমির পরিমাণ ৩ দশমিক ৪০ একর ও বাইরে ৪ দশমিক ৫৭ একর। ওই সময় বন্দীদের জন্য একতলা-দোতলা দুটি ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এরপর আর কোনো স্থাপনা হয়নি, শুধু মেরামত করা হয়েছে।
ভৈরব নদের তীরে ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় খুলনা জেলা কারাগার। ২০০৪ সালে ভবনটিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে খুলনা সিটি করপোরেশন। এরপর ২৩ বছর ধরে সেই ভবনগুলোতে থাকছেন বন্দীরা, কারাগারের প্রশাসনিক কার্যক্রমও চলছে। রাজশাহী কারাগারের অবস্থা আরও করুণ।
এই কারাগারগুলোতে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করা কয়েকজন জানান, কারাগারে ধারণক্ষমতার বেশি বন্দী থাকায় ওয়ার্ডে শোয়ার পরিবেশ নেই। ওপর থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে। ভারী বৃষ্টি হলে পানি চুইয়ে পড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অবকাঠামোগত এই সমস্যা রয়েছে খাগড়াছড়ি, গাইবান্ধা, বরিশালসহ আরও অন্তত সাতটি কারাগারে। খুলনা কারাগারের জেলার মো. এনামুল কবির বলেন, আপাতত এভাবেই চলতে হচ্ছে। নতুন কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভোলা কারাগারের জেলার দেওয়ান মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার। উপর মহলকে জানানো হয়েছে।
৬৮ কারাগারে চিকিৎসক ৪ জন
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫২১ বন্দী থাকা জয়পুরহাট জেলা কারাগারের পরিবেশ, সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামোগত—সব দিক ভালো হলেও হাসপাতাল নেই। কর্তৃপক্ষ বলছে, জয়পুরহাট কারাগার জেলা আধুনিক হাসপাতাল লাগোয়া। হাসপাতালের একজন সহকারী সার্জন প্রয়োজনে বন্দীদের চিকিৎসা করেন। জয়পুরহাট কারাগারের জেলার মো. কামরুল ইসলাম বলেন, জয়পুরহাট কারাগার ছোট। পাশেই হাসপাতাল। তাই সেভাবে প্রয়োজন হয় না।
সূত্র বলছে, ৬৮ কারাগারের ২৫টিতেই কারা হাসপাতাল নেই। হাসপাতাল না থাকা কারাগারের ভিআইপি ও অবস্থাপন্ন বন্দীরা বাইরের কিছু হাসপাতালে সেবা নিতে পারলেও সাধারণ বন্দীদের বেশির ভাগের চিকিৎসা জোটে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ৬৮ কারাগারের মধ্যে ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা কারাগারে চারজন চিকিৎসক রয়েছেন। অথচ কারাগারগুলোর জন্য অনুমোদিত চিকিৎসক পদ রয়েছে ১৪১টি। কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল সুজাউর রহমান বলেন, কয়েকটি নিয়োগ আটকে আছে। নিয়োগগুলো চূড়ান্ত হলেই সমস্যার সমাধান হবে।
বিশুদ্ধ পানির সংকট চলছেই
চাঁদপুর জেলা কারাগারের কর্মকর্তা, কর্মচারী, বন্দীদের ব্যবহারের জন্য পানিতে অতিরিক্ত আয়রন। ফলে এক দশকেরও বেশি সময় বিশুদ্ধ পানির সংকট সেখানে। অভিযোগ আছে, বিশুদ্ধ পানি ছাড়া টাকার বিনিময়ে সবই মেলে ওই কারাগারে। জানতে চাইলে চাঁদপুর কারাগারের জেলার মুহম্মদ মুনীর হোসাইন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘টাকার বিষয়ে কারও অভিযোগ থাকলে আমাকে বললে আমি ব্যবস্থা নেব। আর বিশুদ্ধ পানির চেষ্টা চলছে।’
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) এ এস এম মোসা বলেন, ‘আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি পানির ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করছি। ৯০ ভাগ কাজ শেষ। শিগগির এটি চালু করা যাবে।’ বিশুদ্ধ পানির সমস্যা রয়েছে কক্সবাজার, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনাসহ বেশ কয়েকটি কারাগারে।
কয়েক গুণ বন্দী, খাবারে টান
মাগুরা জেলা কারাগারের কয়েকটি বড় সমস্যার অন্যতম হলো ১৭২ জন ধারণক্ষমতা থাকলেও বন্দী প্রায় পাঁচ গুণ। খুলনা কারাগারের ধারণক্ষমতা ৫৮০ জন, তবে বন্দী রয়েছেন ১ হাজার ২০০। কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এই সমস্যা সব কারাগারেই। দেশের সব কারাগার মিলিয়ে ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জন।তবে গত পাঁচ বছর ধরে কারাগারগুলোতে ৭০ থেকে ৮০ হাজার বন্দী থাকছে। বিভিন্ন সময়ে কারাগারে থাকা কয়েকজন বলেন, প্রতিদিন যে খাবার দেয়, তাতে একজনের অর্ধেক পেটও ভরে না। বন্দী বেশি বলে খাবারের পরিমাণ কম।
দেড় শ বন্দীর জন্য এক টয়লেট
কুড়িগ্রাম জেলা কারাগারে বন্দীদের আবাসনের পাশাপাশি টয়লেট-সংকট প্রকট। অথচ এই কারাগারের অভ্যন্তরীণ আয়তন (মূল কারাগার) ৩ দশমিক ৮৬ একর। নাগেশ্বরী পৌর এলাকার আশিকুর রহমান ১৬ দিন কারাগারে ছিলেন। একই কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন রাজিবপুরের মোজাম্মেল। আবাসন-সংকটের কথা জানিয়ে তাঁরা বলেন, কারাগারের প্রতিটি ওয়ার্ডে এক থেকে দেড় শ বন্দীর জন্য টয়লেট মাত্র একটি। ফলে দীর্ঘ লাইন লেগে থাকে।
কুড়িগ্রাম কারাগারের জেলার আবু ছায়েম বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেষ্টা চলছে। মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, কারাগার হলো অভিযুক্তকে সংশোধন করে মূল স্রোতোধারায় ফিরিয়ে আনার জায়গা। তাই বন্দীদের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, যা নিপীড়নমূলক হয়। একজন কয়েদিকেও কারাবিধিতে উল্লেখিত সেবা পূর্ণ মাত্রায় দিতে হবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আজকের পত্রিকার ভোলা, কুড়িগ্রাম, চাঁদপুর, গাইবান্ধা, মাগুরা, জয়পুরহাট ও খুলনা প্রতিনিধি]
দেশের সাতটি কেন্দ্রীয় কারাগারসহ ১০টিতে দাগি বন্দীদের দাপটে অসহায় সাধারণ বন্দীরা। এমনকি কারারক্ষীদের চেয়েও তাঁদের কর্তৃত্ব বেশি। টাকার বিনিময়ে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা, চিকিৎসার ব্যবস্থা—সবকিছুতেই থাকে তাঁদের হাত। সাধারণ বন্দীরা তাঁদের জুলুমের শিকার হচ্ছেন। কারা কর্মকর্তারা এসব জানলেও নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় থাকে। খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে রয়েছে এসব তথ্য।
বিভিন্ন কারাগারের ভেতরে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, মারধরসহ বিভিন্ন অভিযোগ শোনা যায় মাঝেমধ্যেই। কিছু কিছু ঘটনায় ভুক্তভোগী বন্দী ও স্বজনেরা কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। কারাগারফেরত কয়েকজন বলেছেন, কিছু দাগি অপরাধীর কর্মকাণ্ডে সংশোধনাগারে স্বস্তি পান না সাধারণ বন্দীরা। ‘রাখিব নিরাপদ দেখাব আলোর পথ’—এই স্লোগান অনেক বন্দীর কাছেই হয়ে ওঠে কথার কথা। কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সীমিত জনবল ও অপর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে এসব বন্ধ করা খুব কঠিন।
জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল সুজাউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রতিটি কারাগারে আমাদের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম চলছে। অনেক সময় আমরা নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের কেউ অভিযোগ করলে তাদের অভিযোগও আমলে নিয়ে তদন্ত করি।’
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে ৬৮টি কারাগারের মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের অধীন ১৭টি। ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বন্দী, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, চিকিৎসক না থাকা, বিশুদ্ধ পানির সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা কারাগারগুলোতে কমবেশি রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গত মার্চে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে কয়েকজন জেলা প্রশাসক কারাগারের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। তাঁদের উত্থাপিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২৯ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে পাঠানো হয়। অবশ্য এর আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কারাগার নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে ২০টি কারাগারের বিভিন্ন সমস্যার চিত্র উঠে এসেছে।
১০ কারাগারে দাগি আসামিদের দাপট
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, কেন্দ্রীয় সাতটি কারাগারসহ কয়েকটি কারাগারে বেশ কিছু দাগি বন্দী রয়েছেন। পুরোনো কয়েদি হওয়ায় তাঁরা কারাগারের অন্য বন্দীদের ওপর জুলুম করছেন। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। দাগি আসামিদের দাপট থাকা কারাগারগুলো হচ্ছে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ১-২, হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার, সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার, বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার, খুলনা জেলা কারাগার, ফরিদপুর জেলা কারাগার ও গাইবান্ধা জেলা কারাগার।
আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এসব কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়া আসামিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারাগারগুলোতে দাগি আসামিরা প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁদের অভিযোগ, আসামিদের এই চক্র পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন কারারক্ষীরা।
গত মাসে জামিনে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান রাজধানীর খিলগাঁও থানার একটি হত্যা মামলার আসামি সুজন। তিনি বলেন, ‘পুরো কারাগারে দাপট দাগি আসামিদের। নতুন বন্দীদের ঢোকানো আর বের করা ছাড়া কারারক্ষীদের সেভাবে কোনো কাজ থাকে না। ভেতরে যা চলে সব নগদ টাকায়। পান থেকে চুন খসলে সাধারণ বন্দীদের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। কারাগারে যে যত দুর্ধর্ষ আসামি, সে তত প্রভাবশালী।’
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাদেকুল ইসলামকে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় এপ্রিলে কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁর ছোট ভাই শাহিন অভিযোগ করেন, গাইবান্ধা জেলখানায় কারারক্ষীদের সেভাবে প্রভাব নেই। সব দাপট দাগি আসামিদের।
জানতে চাইলে গাইবান্ধা কারাগারের জেল সুপার নজরুল ইসলাম বলেন, বন্দীসহ আত্মীয়দের কিছু অভিযোগ রয়েছে। জেলখানায় কোনো অনিয়ম হলে বা কেউ করলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কারাগার
ওই প্রতিবেদন এবং সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৩ সালে ১০ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয় ভোলা জেলা কারাগার। কারা অভ্যন্তরে জমির পরিমাণ ৩ দশমিক ৪০ একর ও বাইরে ৪ দশমিক ৫৭ একর। ওই সময় বন্দীদের জন্য একতলা-দোতলা দুটি ভবনসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এরপর আর কোনো স্থাপনা হয়নি, শুধু মেরামত করা হয়েছে।
ভৈরব নদের তীরে ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় খুলনা জেলা কারাগার। ২০০৪ সালে ভবনটিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে খুলনা সিটি করপোরেশন। এরপর ২৩ বছর ধরে সেই ভবনগুলোতে থাকছেন বন্দীরা, কারাগারের প্রশাসনিক কার্যক্রমও চলছে। রাজশাহী কারাগারের অবস্থা আরও করুণ।
এই কারাগারগুলোতে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করা কয়েকজন জানান, কারাগারে ধারণক্ষমতার বেশি বন্দী থাকায় ওয়ার্ডে শোয়ার পরিবেশ নেই। ওপর থেকে পলেস্তারা খসে পড়ে। ভারী বৃষ্টি হলে পানি চুইয়ে পড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অবকাঠামোগত এই সমস্যা রয়েছে খাগড়াছড়ি, গাইবান্ধা, বরিশালসহ আরও অন্তত সাতটি কারাগারে। খুলনা কারাগারের জেলার মো. এনামুল কবির বলেন, আপাতত এভাবেই চলতে হচ্ছে। নতুন কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভোলা কারাগারের জেলার দেওয়ান মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার। উপর মহলকে জানানো হয়েছে।
৬৮ কারাগারে চিকিৎসক ৪ জন
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫২১ বন্দী থাকা জয়পুরহাট জেলা কারাগারের পরিবেশ, সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামোগত—সব দিক ভালো হলেও হাসপাতাল নেই। কর্তৃপক্ষ বলছে, জয়পুরহাট কারাগার জেলা আধুনিক হাসপাতাল লাগোয়া। হাসপাতালের একজন সহকারী সার্জন প্রয়োজনে বন্দীদের চিকিৎসা করেন। জয়পুরহাট কারাগারের জেলার মো. কামরুল ইসলাম বলেন, জয়পুরহাট কারাগার ছোট। পাশেই হাসপাতাল। তাই সেভাবে প্রয়োজন হয় না।
সূত্র বলছে, ৬৮ কারাগারের ২৫টিতেই কারা হাসপাতাল নেই। হাসপাতাল না থাকা কারাগারের ভিআইপি ও অবস্থাপন্ন বন্দীরা বাইরের কিছু হাসপাতালে সেবা নিতে পারলেও সাধারণ বন্দীদের বেশির ভাগের চিকিৎসা জোটে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ৬৮ কারাগারের মধ্যে ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা কারাগারে চারজন চিকিৎসক রয়েছেন। অথচ কারাগারগুলোর জন্য অনুমোদিত চিকিৎসক পদ রয়েছে ১৪১টি। কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল সুজাউর রহমান বলেন, কয়েকটি নিয়োগ আটকে আছে। নিয়োগগুলো চূড়ান্ত হলেই সমস্যার সমাধান হবে।
বিশুদ্ধ পানির সংকট চলছেই
চাঁদপুর জেলা কারাগারের কর্মকর্তা, কর্মচারী, বন্দীদের ব্যবহারের জন্য পানিতে অতিরিক্ত আয়রন। ফলে এক দশকেরও বেশি সময় বিশুদ্ধ পানির সংকট সেখানে। অভিযোগ আছে, বিশুদ্ধ পানি ছাড়া টাকার বিনিময়ে সবই মেলে ওই কারাগারে। জানতে চাইলে চাঁদপুর কারাগারের জেলার মুহম্মদ মুনীর হোসাইন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘টাকার বিষয়ে কারও অভিযোগ থাকলে আমাকে বললে আমি ব্যবস্থা নেব। আর বিশুদ্ধ পানির চেষ্টা চলছে।’
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) এ এস এম মোসা বলেন, ‘আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি পানির ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করছি। ৯০ ভাগ কাজ শেষ। শিগগির এটি চালু করা যাবে।’ বিশুদ্ধ পানির সমস্যা রয়েছে কক্সবাজার, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনাসহ বেশ কয়েকটি কারাগারে।
কয়েক গুণ বন্দী, খাবারে টান
মাগুরা জেলা কারাগারের কয়েকটি বড় সমস্যার অন্যতম হলো ১৭২ জন ধারণক্ষমতা থাকলেও বন্দী প্রায় পাঁচ গুণ। খুলনা কারাগারের ধারণক্ষমতা ৫৮০ জন, তবে বন্দী রয়েছেন ১ হাজার ২০০। কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এই সমস্যা সব কারাগারেই। দেশের সব কারাগার মিলিয়ে ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার ৬২৬ জন।তবে গত পাঁচ বছর ধরে কারাগারগুলোতে ৭০ থেকে ৮০ হাজার বন্দী থাকছে। বিভিন্ন সময়ে কারাগারে থাকা কয়েকজন বলেন, প্রতিদিন যে খাবার দেয়, তাতে একজনের অর্ধেক পেটও ভরে না। বন্দী বেশি বলে খাবারের পরিমাণ কম।
দেড় শ বন্দীর জন্য এক টয়লেট
কুড়িগ্রাম জেলা কারাগারে বন্দীদের আবাসনের পাশাপাশি টয়লেট-সংকট প্রকট। অথচ এই কারাগারের অভ্যন্তরীণ আয়তন (মূল কারাগার) ৩ দশমিক ৮৬ একর। নাগেশ্বরী পৌর এলাকার আশিকুর রহমান ১৬ দিন কারাগারে ছিলেন। একই কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন রাজিবপুরের মোজাম্মেল। আবাসন-সংকটের কথা জানিয়ে তাঁরা বলেন, কারাগারের প্রতিটি ওয়ার্ডে এক থেকে দেড় শ বন্দীর জন্য টয়লেট মাত্র একটি। ফলে দীর্ঘ লাইন লেগে থাকে।
কুড়িগ্রাম কারাগারের জেলার আবু ছায়েম বলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেষ্টা চলছে। মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, কারাগার হলো অভিযুক্তকে সংশোধন করে মূল স্রোতোধারায় ফিরিয়ে আনার জায়গা। তাই বন্দীদের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, যা নিপীড়নমূলক হয়। একজন কয়েদিকেও কারাবিধিতে উল্লেখিত সেবা পূর্ণ মাত্রায় দিতে হবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আজকের পত্রিকার ভোলা, কুড়িগ্রাম, চাঁদপুর, গাইবান্ধা, মাগুরা, জয়পুরহাট ও খুলনা প্রতিনিধি]
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৬ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে