জাহীদ রেজা নূর
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রথম সংগঠন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল কিছু মানুষের দায়িত্ববোধ থেকে। এরপর একসময় প্রবাসে বাংলাদেশ সরকার এ কেন্দ্রটিকে গড়েপিটে নেয়। সে সময় অবরুদ্ধ বাংলায়, মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীশিবিরে এই বেতার কেন্দ্র যে উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলত, তার তুলনা খুব কম।এই মাসে বিজয় এসেছিল। এই মাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ বেতারে।
এই বেতার কেন্দ্রটি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে কিছু, তারপরও নতুন প্রজন্মের জন্য সরলভাবে কিছু কথা বলে রাখা দরকার। আমাদের ওপর যুদ্ধটা হঠাৎ করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হঠাৎ করেই পালিয়ে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সে রাতেই শুরু হলো হত্যাযজ্ঞ—জেনোসাইড। ১৫ ডিসেম্বর থেকে কেন তিনি গোলটেবিল বৈঠকের নামে সময় পার করছিলেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও। কিন্তু বিদ্যমান সংকট রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে এভাবে নির্লজ্জভাবে বাঙালি নিধন করা হবে, এতটা বোধ হয় কল্পনা করেনি কেউ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উড়োজাহাজে করে সৈন্যরা আসছে, সে খবর ছিল। এরা যে বেপরোয়া হয়ে কিছু ক্ষতিসাধন করবে, সেটাও বুঝি রাজনীতিবিদদের জানা ছিল।
কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষ মাত্রই শত্রু, অতএব এদের নিধন করা যায়—কারও মধ্যে এ রকম ভাবনা যে থাকতে পারে, সেটা বোধ হয় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ভেতরে-ভেতরে এ ছিল জেনোসাইডের মহাপরিকল্পনা। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জানুয়ারির শেষ দিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর লারকানার বিশাল প্রাসাদে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন ইয়াহিয়া খান। সেখানে কী নিয়ে তাঁদের কথাবার্তা হয়েছিল, সেটা শুধু অনুমানই করা যায়। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য অনুমান হতে পারে, দুজনে মিলে পাখি শিকার করতে করতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাঞ্জাবি প্রশাসনিক ও সেনা আমলা গড়ে উঠেছিল, তারাই মূলত ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। সেই ক্ষমতার স্বাদ এতটাই মধুর ছিল, প্রথম গণপরিষদ নির্বাচনে জয়ী দলকেও ক্ষমতায় আসতে দিতে চায়নি।
২২ ফেব্রুয়ারি মিলিটারিদের এক পার্টিতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর ভাবনা আসে। একবারে বেশ কিছুসংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানিকে হত্যা করা হলে বাঙালিরা ভয় পেয়ে যাবে। আর কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। আর কখনোই বাঙালিদের ক্ষমতার ভাগ দিতে হবে না।
সেই অপারেশন সার্চলাইটই নেমে এল ২৫ মার্চ রাতে। শুরু হলো জেনোসাইড।ভূমিকাটুকু করে নিতে হলো এই কারণে যে ২৫ মার্চ রাতে কী ঘটেছে, কতটা ছড়িয়ে পড়েছিল আতঙ্ক, সেগুলোও শুধু অনুমানের ব্যাপার। তবে এ কথা ঠিক, সেদিন পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সড়ক, নৌ ও বিমানপথ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। দিশেহারা মানুষ বুঝতে পারছিল না তাদের করণীয় কী।
এই প্রেক্ষাপটে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’-এর গুরুত্ব অপরিসীম।
২.
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল ২৬ মার্চ। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠন। এখান থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান দেশের মানুষকে পথের দিশা দিয়েছিল। আঘাতের প্রত্যাঘাত করে গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে খবর সাইক্লোস্টাইল করা কাগজে কাগজে ছড়িয়ে পড়েছিল চট্টগ্রামেও। সেদিন দুপুরবেলায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। কিন্তু সেই স্টেশন খুঁজে পাওয়া ঘাতকদের জন্য খুব কঠিন কিছু ছিল না। এর হদিস পেলে বিমান হামলা করে স্টেশনটিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে বেশি সময় লাগত না। সে সময় বেলাল মোহাম্মদকে রেডিওর সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক সৈয়দ আবদুল কাহ্হার একটা পরামর্শ দেন। তিনি বলেছিলেন, আগ্রাবাদের বেতার ভবন থেকে বেতার কার্যক্রম চালানো ঠিক হবে না। তিনি বলেছিলেন, কালুরঘাটে একটা ছোট স্টুডিও আছে। দ্রুত সেটার হদিস পাবে না পাকিস্তানি সেনারা।
কথাটা বেলাল মোহাম্মদের মনে ধরেছিল। তিনি আবুল কাসেম সন্দীপ আর আব্দুল্লাহ আল ফারুককে নিয়ে শুরু করলেন নতুন এক বেতারের কাজ। ১০ কিলোওয়াটের মধ্যম তরঙ্গ বা মিডিয়াম ওয়েভে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে ভেসে এল আবুল কাসেম সন্দীপের কণ্ঠস্বর, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’
সেদিন এটা ছিল গুপ্ত বেতারকেন্দ্র। আধা ঘণ্টার সে অধিবেশনে এম এ হান্নানের পর আবুল কাসেম সন্দীপ, আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও সুলতানুল আলমও বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত ঘোষণাটি পাঠ করেন। তবে নিরাপত্তার কারণে কেউ নিজের নাম প্রকাশ করেননি।
এরপর ২৭ মার্চ। পটিয়ায় বেলাল মোহাম্মদরা গিয়েছিলেন বেতার কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার জন্য সেনা সাহায্যের আশায়। সেখানেই তিনি জিয়াউর রহমানকে পেয়ে যান। জিয়াউর রহমানকে কথাচ্ছলেই বেলাল মোহাম্মদ বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, মেজর সাহেব, এখানে আমরা তো সবাই মাইনর, একমাত্র মেজর হিসেবে আপনার নিজের কণ্ঠে কিছু প্রচার করলে কেমন হয়?’
জিয়াউর রহমান তাতে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে যে বক্তব্যটি দাঁড় করানো হয়েছিল, সেটা হলো, ‘আই, মেজর জিয়া, অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডু হেয়ারবাই ডিক্লেয়ার ইনডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ।’
হ্যাঁ, এটাই ছিল জিয়াউর রহমানের প্রথম ঘোষণা।
২৮ মার্চ জিয়াউর রহমান নতুন এক ঘোষণালিপি নিয়ে এসেছিলেন, সেখানে তিনি নিজেকে ‘প্রভিশনাল হেড অব বাংলাদেশ’ এবং স্বাধীন বাংলা ‘লিবারেশন আর্মি’ প্রধান বলে পরিচয় দেন। সেদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করেননি। একবারই তা প্রচারিত হয়। এ কে খান সে ঘোষণা শোনার পর বলেন, স্বাধীনতা ঘোষণা করা বা নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করা কোনো ছেলেখেলা নয়। এ কে খান তরুণ মেজরকে বুঝিয়ে দিলেন, সেই মুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার অধিকার আর কারও নেই। তাই যে কোনো ঘোষণাই করতে হতো শেখ মুজিবের পক্ষে। জিয়াউর রহমান সেটা মেনে নিলেন। তাঁর তৃতীয় ঘোষণাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম তিনি উল্লেখ করে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু বিপ্লবী পরিকল্পনা কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দিচ্ছেন।’
কথাগুলো উল্লেখ করতে হলো এই কারণে যে, অকারণেই আওয়ামী লীগ আর বিএনপি স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক করে থাকে। যদি এই পরস্পর হানাহানির রাজনীতির জায়গায় সুস্থ রাজনীতি ফিরে আসে, তাহলে কোনো গবেষক যখন এই বাক্যগুলো লিখবেন, তখন এ নিয়ে কেউ বিতর্ক করবেন না। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ শাসনের ম্যান্ডেট পেয়েছেন যে নেতা, তিনি ছাড়া আর কেউ কি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন?
৩.
৩০ মার্চেই বিমান হামলার পর গুঁড়িয়ে যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র। জিয়াউর রহমানের পরামর্শে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি তত দিনে বাদ দেওয়া হয়েছিল। কালুরঘাটের পতনের পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ শুরু হয় ৩ এপ্রিল, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাগফা থেকে।
শর্টওয়েভের হতো সেই অনুষ্ঠান। এরপর তা পরিবর্তন করে নিয়ে যাওয়া হয় আগরতলার কাছে শালবাগানে। এখানেও শর্টওয়েভ। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো বাংলাদেশের কিছু গান। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের খবর সরাসরি প্রচার করেছিল এই বেতার কেন্দ্র।
বাংলাদেশ থেকে আনা রেকর্ডের গানগুলোই বাজতে থাকে অনুষ্ঠানে। ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, দুর্গমগিরি কান্তার মরু’, ‘কেঁদো না গো মা,—এই ছিল গানের স্টক।
এ সময় মিডিয়াম ওয়েভে শক্তিশালী ট্রান্সমিটারের সাহায্যে অনুষ্ঠান করা যায় কি না, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলতে থাকে এবং তখন কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড ৫০ কিলোওয়াটের একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেটা ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মে। তবে বলা হতো, মুজিবনগর থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে।
৪.
এখানেই মূলত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তার রূপ পায়। তত দিনে বাংলাদেশ থেকে সাংবাদিক, শিল্পী ও কলা-কুশলীদের অনেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন এই কেন্দ্রে। অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান ছিলেন শামসুল হুদা চৌধুরী, বার্তা বিভাগের প্রধান ছিলেন কামাল লোহানী। শত প্রতিকূলতার মধ্যেই এখান থেকে উদ্দীপক গান, কথিকা, সংবাদ পরিবেশিত হতে থাকে। এম আর আখতার মুকুল রচিত ‘চরমপত্র’ পাঠ করতেন লেখক নিজেই। ‘জল্লাদের দরবার’ নামের একটি অনুষ্ঠানে অসাধারণ পারফর্ম করতেন রাজু আহমেদ। আরও অনেক ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো এই কেন্দ্র থেকে।
আর গানের কথা নতুন করে কী বলব। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে’সহ আরও কত গান সে সময় অনুপ্রেরণা দিয়েছে যুদ্ধরত জাতিকে। ইংরেজিতে আলমগীর কবির ও আলী যাকেরও নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন।
৫.
ইতিহাসকে সংরক্ষণ করা হলে তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রথম এ সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল কিছু মানুষের দায়িত্ববোধ থেকে। এরপর একসময় প্রবাসে বাংলাদেশ সরকার এ কেন্দ্রটিকে গড়েপিটে নেয়। সে সময় অবরুদ্ধ বাংলায়, মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীশিবিরে এই বেতার কেন্দ্র যে উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলত, তার তুলনা খুব কম। এ রকম উদ্যোগগুলোর কথা বারবার বলতে হবে।
পৃথিবীর বহু দেশই যুদ্ধের সময়কার স্মৃতিগুলোর মানবিক রূপটির সঙ্গে পরিচিত করায় নানাভাবে। এমনভাবে সেটা করতে হয়, যেন তা আরোপিত বলে মনে না হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও এ রকম আরও অনেক কিছু রয়েছে, যা ধরে রাখতে হলে পাঠ্যবই, অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যম ইত্যাদিতে সুচারুভাবে তা পরিবেশন করতে হবে।
৫২ বছর পেরিয়ে বিজয় এগিয়ে চলেছে। কিন্তু স্মারকগুলোকে ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছি কি? এ প্রশ্নটি তো আন্তরিকভাবে উঠতে হবে আগে। নইলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেজেগোবরে হয়ে গেলে তার দায় এড়াবে কে?
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রথম সংগঠন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল কিছু মানুষের দায়িত্ববোধ থেকে। এরপর একসময় প্রবাসে বাংলাদেশ সরকার এ কেন্দ্রটিকে গড়েপিটে নেয়। সে সময় অবরুদ্ধ বাংলায়, মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীশিবিরে এই বেতার কেন্দ্র যে উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলত, তার তুলনা খুব কম।এই মাসে বিজয় এসেছিল। এই মাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ বেতারে।
এই বেতার কেন্দ্রটি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে কিছু, তারপরও নতুন প্রজন্মের জন্য সরলভাবে কিছু কথা বলে রাখা দরকার। আমাদের ওপর যুদ্ধটা হঠাৎ করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হঠাৎ করেই পালিয়ে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সে রাতেই শুরু হলো হত্যাযজ্ঞ—জেনোসাইড। ১৫ ডিসেম্বর থেকে কেন তিনি গোলটেবিল বৈঠকের নামে সময় পার করছিলেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও। কিন্তু বিদ্যমান সংকট রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করে এভাবে নির্লজ্জভাবে বাঙালি নিধন করা হবে, এতটা বোধ হয় কল্পনা করেনি কেউ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উড়োজাহাজে করে সৈন্যরা আসছে, সে খবর ছিল। এরা যে বেপরোয়া হয়ে কিছু ক্ষতিসাধন করবে, সেটাও বুঝি রাজনীতিবিদদের জানা ছিল।
কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষ মাত্রই শত্রু, অতএব এদের নিধন করা যায়—কারও মধ্যে এ রকম ভাবনা যে থাকতে পারে, সেটা বোধ হয় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ভেতরে-ভেতরে এ ছিল জেনোসাইডের মহাপরিকল্পনা। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জানুয়ারির শেষ দিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর লারকানার বিশাল প্রাসাদে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন ইয়াহিয়া খান। সেখানে কী নিয়ে তাঁদের কথাবার্তা হয়েছিল, সেটা শুধু অনুমানই করা যায়। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য অনুমান হতে পারে, দুজনে মিলে পাখি শিকার করতে করতে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাঞ্জাবি প্রশাসনিক ও সেনা আমলা গড়ে উঠেছিল, তারাই মূলত ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। সেই ক্ষমতার স্বাদ এতটাই মধুর ছিল, প্রথম গণপরিষদ নির্বাচনে জয়ী দলকেও ক্ষমতায় আসতে দিতে চায়নি।
২২ ফেব্রুয়ারি মিলিটারিদের এক পার্টিতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর ভাবনা আসে। একবারে বেশ কিছুসংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানিকে হত্যা করা হলে বাঙালিরা ভয় পেয়ে যাবে। আর কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। আর কখনোই বাঙালিদের ক্ষমতার ভাগ দিতে হবে না।
সেই অপারেশন সার্চলাইটই নেমে এল ২৫ মার্চ রাতে। শুরু হলো জেনোসাইড।ভূমিকাটুকু করে নিতে হলো এই কারণে যে ২৫ মার্চ রাতে কী ঘটেছে, কতটা ছড়িয়ে পড়েছিল আতঙ্ক, সেগুলোও শুধু অনুমানের ব্যাপার। তবে এ কথা ঠিক, সেদিন পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সড়ক, নৌ ও বিমানপথ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। দিশেহারা মানুষ বুঝতে পারছিল না তাদের করণীয় কী।
এই প্রেক্ষাপটে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’-এর গুরুত্ব অপরিসীম।
২.
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল ২৬ মার্চ। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠন। এখান থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান দেশের মানুষকে পথের দিশা দিয়েছিল। আঘাতের প্রত্যাঘাত করে গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে খবর সাইক্লোস্টাইল করা কাগজে কাগজে ছড়িয়ে পড়েছিল চট্টগ্রামেও। সেদিন দুপুরবেলায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। কিন্তু সেই স্টেশন খুঁজে পাওয়া ঘাতকদের জন্য খুব কঠিন কিছু ছিল না। এর হদিস পেলে বিমান হামলা করে স্টেশনটিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে বেশি সময় লাগত না। সে সময় বেলাল মোহাম্মদকে রেডিওর সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক সৈয়দ আবদুল কাহ্হার একটা পরামর্শ দেন। তিনি বলেছিলেন, আগ্রাবাদের বেতার ভবন থেকে বেতার কার্যক্রম চালানো ঠিক হবে না। তিনি বলেছিলেন, কালুরঘাটে একটা ছোট স্টুডিও আছে। দ্রুত সেটার হদিস পাবে না পাকিস্তানি সেনারা।
কথাটা বেলাল মোহাম্মদের মনে ধরেছিল। তিনি আবুল কাসেম সন্দীপ আর আব্দুল্লাহ আল ফারুককে নিয়ে শুরু করলেন নতুন এক বেতারের কাজ। ১০ কিলোওয়াটের মধ্যম তরঙ্গ বা মিডিয়াম ওয়েভে সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে ভেসে এল আবুল কাসেম সন্দীপের কণ্ঠস্বর, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’
সেদিন এটা ছিল গুপ্ত বেতারকেন্দ্র। আধা ঘণ্টার সে অধিবেশনে এম এ হান্নানের পর আবুল কাসেম সন্দীপ, আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও সুলতানুল আলমও বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত ঘোষণাটি পাঠ করেন। তবে নিরাপত্তার কারণে কেউ নিজের নাম প্রকাশ করেননি।
এরপর ২৭ মার্চ। পটিয়ায় বেলাল মোহাম্মদরা গিয়েছিলেন বেতার কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার জন্য সেনা সাহায্যের আশায়। সেখানেই তিনি জিয়াউর রহমানকে পেয়ে যান। জিয়াউর রহমানকে কথাচ্ছলেই বেলাল মোহাম্মদ বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, মেজর সাহেব, এখানে আমরা তো সবাই মাইনর, একমাত্র মেজর হিসেবে আপনার নিজের কণ্ঠে কিছু প্রচার করলে কেমন হয়?’
জিয়াউর রহমান তাতে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে যে বক্তব্যটি দাঁড় করানো হয়েছিল, সেটা হলো, ‘আই, মেজর জিয়া, অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডু হেয়ারবাই ডিক্লেয়ার ইনডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ।’
হ্যাঁ, এটাই ছিল জিয়াউর রহমানের প্রথম ঘোষণা।
২৮ মার্চ জিয়াউর রহমান নতুন এক ঘোষণালিপি নিয়ে এসেছিলেন, সেখানে তিনি নিজেকে ‘প্রভিশনাল হেড অব বাংলাদেশ’ এবং স্বাধীন বাংলা ‘লিবারেশন আর্মি’ প্রধান বলে পরিচয় দেন। সেদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করেননি। একবারই তা প্রচারিত হয়। এ কে খান সে ঘোষণা শোনার পর বলেন, স্বাধীনতা ঘোষণা করা বা নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করা কোনো ছেলেখেলা নয়। এ কে খান তরুণ মেজরকে বুঝিয়ে দিলেন, সেই মুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার অধিকার আর কারও নেই। তাই যে কোনো ঘোষণাই করতে হতো শেখ মুজিবের পক্ষে। জিয়াউর রহমান সেটা মেনে নিলেন। তাঁর তৃতীয় ঘোষণাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম তিনি উল্লেখ করে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু বিপ্লবী পরিকল্পনা কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দিচ্ছেন।’
কথাগুলো উল্লেখ করতে হলো এই কারণে যে, অকারণেই আওয়ামী লীগ আর বিএনপি স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক করে থাকে। যদি এই পরস্পর হানাহানির রাজনীতির জায়গায় সুস্থ রাজনীতি ফিরে আসে, তাহলে কোনো গবেষক যখন এই বাক্যগুলো লিখবেন, তখন এ নিয়ে কেউ বিতর্ক করবেন না। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ শাসনের ম্যান্ডেট পেয়েছেন যে নেতা, তিনি ছাড়া আর কেউ কি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন?
৩.
৩০ মার্চেই বিমান হামলার পর গুঁড়িয়ে যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র। জিয়াউর রহমানের পরামর্শে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি তত দিনে বাদ দেওয়া হয়েছিল। কালুরঘাটের পতনের পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কাজ শুরু হয় ৩ এপ্রিল, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাগফা থেকে।
শর্টওয়েভের হতো সেই অনুষ্ঠান। এরপর তা পরিবর্তন করে নিয়ে যাওয়া হয় আগরতলার কাছে শালবাগানে। এখানেও শর্টওয়েভ। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো বাংলাদেশের কিছু গান। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের খবর সরাসরি প্রচার করেছিল এই বেতার কেন্দ্র।
বাংলাদেশ থেকে আনা রেকর্ডের গানগুলোই বাজতে থাকে অনুষ্ঠানে। ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, দুর্গমগিরি কান্তার মরু’, ‘কেঁদো না গো মা,—এই ছিল গানের স্টক।
এ সময় মিডিয়াম ওয়েভে শক্তিশালী ট্রান্সমিটারের সাহায্যে অনুষ্ঠান করা যায় কি না, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলতে থাকে এবং তখন কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড ৫০ কিলোওয়াটের একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। সেটা ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মে। তবে বলা হতো, মুজিবনগর থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে।
৪.
এখানেই মূলত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তার রূপ পায়। তত দিনে বাংলাদেশ থেকে সাংবাদিক, শিল্পী ও কলা-কুশলীদের অনেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন এই কেন্দ্রে। অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান ছিলেন শামসুল হুদা চৌধুরী, বার্তা বিভাগের প্রধান ছিলেন কামাল লোহানী। শত প্রতিকূলতার মধ্যেই এখান থেকে উদ্দীপক গান, কথিকা, সংবাদ পরিবেশিত হতে থাকে। এম আর আখতার মুকুল রচিত ‘চরমপত্র’ পাঠ করতেন লেখক নিজেই। ‘জল্লাদের দরবার’ নামের একটি অনুষ্ঠানে অসাধারণ পারফর্ম করতেন রাজু আহমেদ। আরও অনেক ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো এই কেন্দ্র থেকে।
আর গানের কথা নতুন করে কী বলব। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘একটি ফুলকে বাঁচাব বলে’, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে’সহ আরও কত গান সে সময় অনুপ্রেরণা দিয়েছে যুদ্ধরত জাতিকে। ইংরেজিতে আলমগীর কবির ও আলী যাকেরও নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন।
৫.
ইতিহাসকে সংরক্ষণ করা হলে তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রথম এ সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল কিছু মানুষের দায়িত্ববোধ থেকে। এরপর একসময় প্রবাসে বাংলাদেশ সরকার এ কেন্দ্রটিকে গড়েপিটে নেয়। সে সময় অবরুদ্ধ বাংলায়, মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীশিবিরে এই বেতার কেন্দ্র যে উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলত, তার তুলনা খুব কম। এ রকম উদ্যোগগুলোর কথা বারবার বলতে হবে।
পৃথিবীর বহু দেশই যুদ্ধের সময়কার স্মৃতিগুলোর মানবিক রূপটির সঙ্গে পরিচিত করায় নানাভাবে। এমনভাবে সেটা করতে হয়, যেন তা আরোপিত বলে মনে না হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও এ রকম আরও অনেক কিছু রয়েছে, যা ধরে রাখতে হলে পাঠ্যবই, অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যম ইত্যাদিতে সুচারুভাবে তা পরিবেশন করতে হবে।
৫২ বছর পেরিয়ে বিজয় এগিয়ে চলেছে। কিন্তু স্মারকগুলোকে ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছি কি? এ প্রশ্নটি তো আন্তরিকভাবে উঠতে হবে আগে। নইলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেজেগোবরে হয়ে গেলে তার দায় এড়াবে কে?
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৬ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে